আকাশ ইকবাল »
‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এটি ঊনিশ শতকে ঢাকা শহরের বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার অগ্রভাবে লিখা থাকতো। কথাটির তাৎপর্য অনেক। বলা যায়, বর্তমান যুগে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক
বুদ্ধির মুক্তির জন্য প্রশ্ন উত্থাপন এবং যৌক্তিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘An unquestioned life is not worth living.’ মানব সভ্যতার অগ্রগতির মূলে কাজ করেছে প্রশ্ন। প্রশ্নই সত্যের কাছে পৌছায়। প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তরের ইতিহাসও দীর্ঘ। এদিক থেকে আমাদের সমাজে আপাত উত্তরণের কিছুটা সম্ভাবনা দৃশ্যমান। কেন এটি পুরোপুরি সম্ভব হয়নি, এর কারণ জানা যাবে আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনদর্শনে।
বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনের নির্মাতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরও আবির্ভাব এই শ্রেণি থেকে। তাদের সৃষ্টিকর্মে নিম্নবিত্তের চিন্তা চেতনার প্রতিফলন না থাকাই স্বাভাবিক। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতি, বিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণের অনস্বীকার্য ভূমিকা থাকার পরও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। নাগরিক সংস্কৃতির আদলে বিকাশ ঘটল আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির।
এই প্রেক্ষাপটে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করতে হবে। তিনি একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তিনি স্বশিক্ষিত। মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণি থেকে বহুদূরে তার আজীবন অধিষ্ঠান। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন। প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি সব কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশে দর্শনের ছাত্র বা শিক্ষকের অভাব নেই। দর্শনশাস্ত্রের অনুবাদকও রয়েছেন। তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই মৌলিক চিন্তা করেন। যারা চিন্তা করেন তাদের মধ্যে ৯৫ ভাগই মানসিকভাবে মৌলিক চিন্তা করেন না। অথচ তাদের দার্শনিক হিসেবে নির্বিচারে ভূষিত করা হয়েছে। আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন যথার্থই দার্শনিক। তিনি সেই নগণ্যসংখ্যক দার্শনিকের অন্যতম, যিনি মৌলিক চিন্তা করেছেন। শুধু মৌলিক চিন্তা করেছেন বলে মাতুব্বর অবিস্মরণীয় নন। তার অসাধারণত্ব এখানে যে, তিনি উঠে এসেছেন তৃণমূলের গভীর স্তর থেকে।
বলা যায় তিনি কৃষক থেকেই দার্শনিকে রূপান্তরিত হয়েছে মৌলিক চিন্তার মাধ্যমে। তিনি ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। অর্থকষ্ট ছিল তার নিত্যসঙ্গী। আরজ আলী নিজ গ্রামে মক্তবে ‘আদর্শলিপি’ আর আরবি শিক্ষা পড়তেন। দারিদ্র্যের কারণে তিনি খুব বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি কৃষিকাজ করেন। জীবনের এক পর্যায়ে আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
তবে ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। মক্তবে আরবি শিক্ষা আর ‘আদর্শলিপি’ পড়েই একটা সময় দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি ও বিজ্ঞানে কি গভীর জ্ঞান ছিল তার! ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। মুক্তচিন্তার আলোর মশাল তিনি, যার বেড়ে ওঠা এই দেশেরই মাটি এবং মানুষের মধ্য থেকে। সমাজ দর্শনের পথিকৃত হিসেবে আরজ আলী মাতুব্বর আজ সমাদৃত ।
বাল্যকালেই তিনি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্ছার হোন। যদিও সেটি হয় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিষয়ে একটি বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মা ছিলেন অতিশয় নামাজী-কালামী একজন ধার্মিকা রমণী। তার নামাজ-রোজা বাদ পড়া তো দূরের কথা, কাজা হতেও দেখিনি কোনোদিন আমার জীবনে। মাঘ মাসের দারুণ শীতের রাতেও তার তাহাজ্জত নামাজ কখনো বাদ পড়েনি এবং তারই ছোঁয়া লেগেছিল আমার গায়েও কিছুটা। কিন্তু আমার জীবনের গতিপথ বেঁকে যায় মায়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি দুঃখজনক ঘটনায়। সে ঘটনাটি আমাকে করেছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহী।’
আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম বরিশালের লামচরি গ্রামে ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। জন্মের চার বছরের মাথায় পিতা এন্তাজ আলী মাতুব্বর মারা যায়। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাইবোন। আরজ আলীর প্রকৃত নামি ছিল ‘আরজ আলী’। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে তিনি নামের শেষে ‘মাতুব্বর’ নাম ধারণ করেন।
গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে ‘আদর্শলিপি’ পড়তেন। এছাড়া তিনি মক্তবে কোরআন এবং ইসলামিক ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে এক ব্যক্তির সহায়তায় প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন।
তিনি নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বই সংগ্রহ করে পড়তে থাকেন। নিজের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি বরিশাল লাইব্রেরির সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগি ছাত্রের মতো পড়ে শেষ করেছিলেন। দর্শন ছিল তার প্রিয় বিষয়। পাঠাগারে পড়ার মতো পর্যাপ্ত বই ছিল না বলে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক কাজী গোলাম কাদির তার জ্ঞানগর্ভ বিচার দেখে মোহিত হয়ে সেই বিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দিতেন। বই পড়া শেষ করে আবার ফেরত দিতেন।
তাঁর লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টির রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’, ‘অনুমান’, ‘সৃষ্টির রহস্য’ ও ‘স্মরণিকা’। আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে। বইটি তাঁকে এলাকায় ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল। এছাড়া তার আরেকটি বই ‘সৃষ্টির রহস্য’ প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে স্বশিক্ষিত দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বই দুটিতে বিজ্ঞানীর মনোভাব সম্পর্কে তিনি যে যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে শাণিত অস্ত্র হিসেবে এখনও কাজ করছে।
পাকিস্তান সরকার আমলে তার লেখালেখির জন্য তিনি সমালোচিত ও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সেসময় তার লেখা-লেখি নিষিদ্ধ ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে আরজ আলী বিবাহিত ছিলেন। তিনি ১৩২৯ সালে লালমন্নেছাকে বিয়ে করেন। তাদের তিন মেয়ে এক ছেলে। পরে তিনি আরেকটি বিয়ে করেন সেই স্ত্রীর নাম সুফিয়া। সেই সংসারেও চার মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান ছিল।
আরজ আলীর একটি উক্তি ‘বিদ্যা শিক্ষার ডিগ্রি আছে, জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই: জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন।’ এই জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন পাঠাগার থেকে। পরবর্তীতে তিনি জ্ঞান বিতরণের জন্য তিনি তার অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি।’
আরজ আলী মাতুব্বরের পাঠাগার তৈরি নিয়ে আনু মুহাম্মদ তাঁর প্রবন্ধ ‘প্রশ্নের শক্তি : আরজ আলী মাতুব্বরদ’- এ লিখেছেন :
‘জ্ঞানের কি ডিগ্রি হয়? নিজের নামে পাননি বলে অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়েছেন। এক পর্যায়ে এসে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য। আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন, ‘দিনমজুরী করেছি মাঠে মাঠে আমিনগিরি রূপে। টাকা আমার নেই। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য আমার টাকার প্রয়োজনও নেই।’ নির্মাণ খরচ কমানোর জন্য লাইব্রেরি তৈরির সময় নিজে শ্রম দিয়েছেন। তিনি খুব পরিষ্কার ছিলেন এই বিষয়ে যে, ‘বস্তুত বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই। জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরি।’
আরজ আলী মাতুব্বর ১৯৮৫ সালের ১৫ই মার্চ বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে পরলোক গমন করেন। সেসময় মরণোত্তর চক্ষুদান করেন এবং পরবর্তীতে মেডিকেলের শিক্ষার উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করেন।
তার কর্ম ও সাহিত্য চর্চার জন্য বেশ কয়েকটি সম্মাননা পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম- বাংলা একাডেমী কর্তৃক আজীবন সদস্যপদ প্রদান এবং বাংলা ১৩৯২ সালের ১ লা বৈশাখ নববর্ষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন, বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ প্রতি বছর তার সম্মরে আরজ আলী মাতুব্বর বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে। এছাড়া হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার এবং বাংলাদেশ উদীচী কর্তৃক বরণীয় মনীষী সম্মাননা।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:১৯