ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ। জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিশুদের ভালো করতে হলে তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুর ধারণক্ষমতা অনুসারে শিক্ষা দিলে সে একদিন কালজয়ী বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। আনন্দের মধ্যেই শিশুর শিক্ষা জীবনের অবস্থান। পারিবারিক কঠোর শাসন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিকূল পরিবেশ, শিশুর শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। শিশুর মনের আনন্দই তার দেহ-মনের শক্তির মূল উৎস। আনন্দ ও শিশুবান্ধব পরিবেশ ছাড়া তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব। হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ এ শিক্ষা আমাদের দিন দিন স্বার্থপর ও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের এ শিক্ষা থেকে বের করে আনতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবারের বিশেষ ভূমিকা থাকা জরুরি। এমন একটা শিক্ষা আমাদের এই সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে আছে, যা আমাদের শিশুমনকে গ্রাস করে খাচ্ছে। পরিবারগুলোয়ও শেখানো হয় আগে নিজে বাঁচো। পরিবারকে বাঁচাও।
বড় হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করে ভালো চাকরি-বাকরি করে নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করো। এভাবে স্বার্থপরতা শিশুমনকে ক্রমাগত গ্রাস করে দিচ্ছে। প্রায়ই খেয়াল করেছি, পরিবারে যে ছেলেটি একটু পরোপকারী, তার সম্পর্কে আজকালকার মা-বাবাদের বলতে শোনা যায়, আমার এই ছেলেটা একটু বোকা! নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াচ্ছে! আবার অনেক সময় দেখা যায়, শিশু-কিশোররা সহপাঠীদের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে, তখন বলে, এ ছেলেটা টাকা রাখতে জানে না, বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। আর যে ছেলেটা নিজের স্বার্থের ষোলো আনা বোঝে, তার স্বীকৃতি মেলে বুদ্ধিমান হিসেবে। তাকে নিয়ে বাবা-মায়েরা গর্ব করেন। কিন্তু মা-বাবারা এটা বোঝার চেষ্টা করেন না, ওই বুদ্ধিমান ছেলেটা যখন বড় হয়, সংসার হয়, তখনো নিজেরটাই দেখতে থাকে। অনেক সময় বুদ্ধিমান খেতাব দেওয়া সেই বাবা-মায়ের দায়িত্বও নিতে অস্বীকার করে। প্রমাণ আজকালকার বৃদ্ধাশ্রমগুলোয় পড়ে আছে। সামর্থ্যবান পরিবারগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, পরিবারে স্নেহ-মমতার বন্ধন হারিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা প্রত্যেকেই যে যার মতো। সন্তানের দিকে নজর দেওয়ার সময়টুকু নেই। এই সন্তানরা একগুঁয়ে হয়ে ওঠে। আর, একগুঁয়েমির কারণে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ। কোনো সিদ্ধান্তই সঠিকভাবে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেক পরিবার আছে, সন্তানদের এমনভাবে ভোগে-সুখে বড় করে তুলছেন, যা চাইছে তা তো দিচ্ছেনই, যা চাইছে না তাও দিচ্ছেন। চরিত্র কী? এটা না শিখিয়ে, শিখিয়েছেনÑখাও-দাও ফুর্তি করো। যার ফলে বড় হয়ে সেই শিশুরা বড় ধরনের অন্যায় করতেও ভয় পায় না। কারণ তার পেছনে সমর্থন দেওয়ার মতো পরিবার আছে।
প্রতিনিয়ত দেশে নারী নির্যাতন, খুন, ঘুম, হত্যা চলছে। এই খবরগুলো এখন সব সময়ই আমরা পাচ্ছি। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কি আমরা এই অপরাধগুলো সমাজ থেকে দূর করতে পারছি? সরকার পারছে? শুধু শাস্তি দিয়েই একে মোকাবিলা করা যাবে না। যে সমাজব্যবস্থা, যে সামাজিক পরিবেশ এই
চরিত্রের জন্ম দেয়, তাকে ধ্বংস করতে হবে। মূল জিনিসটাকে না পাল্টালে, আইন করে শুধু কিছু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যাবে, কিন্তু অপরাধ রোধ করা যাবে না। প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষা। শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ করে তুললে সে কখনো অন্যায় অপরাধ করবে না। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ থেকেই মানুষের চরিত্র গড়ে ওঠে। আজ যে শিশুটা বিদ্যালয়ে পড়ছে, তার বিকাশের উপযোগী পরিবেশ কি তার চারপাশে আছে? আমরা কি লেখাপড়াকে তার কাছে আনন্দ সহকারে উপস্থাপনের কোনো আয়োজন করেছি? আমরা তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছি ভারী ব্যাগের বোঝা। দশজনকে পেছনে ফেলে কীভাবে সামনে এগোতে হবে, তা-ই শেখাচ্ছি তাকে। রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাপাখি’র সেই গল্পের মতো। তোতাপাখিকে শিক্ষিত করতে চায় রাজা। সারাক্ষণ বইপত্র ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ানো হচ্ছে পাখিটাকে। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, শিক্ষা কেমন হচ্ছে? বলল, খুব শিক্ষিত হচ্ছে। দিন-রাত বিদ্যে ভরে দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে। একদিন তোতাপাখিটি মারা গেল।’ শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হলে তাদের সামনে একটা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারেও সেই দায়িত্ব নিতে হবে। আনন্দ ও শিশুবান্ধব পরিবেশ ছাড়া তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব।
আনন্দমূলক শিক্ষা তথা ঔড়ুভঁষ খবধৎহরহম নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের ঊফঁপধঃরড়হ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকতে হবে। ইংরেজি ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো শিক্ষা। ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ থেকে। লাতিন ভাষায় ৩টি মৌলিক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। এর একটি হলো ঊফঁপধৎব. এই ঊফঁপধৎব শব্দের অর্থ হলো লালন করা, পরিচর্যা করা, প্রতিপালন করা। অর্থাৎ শিশুকে আদর যতেœর মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য সক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার নামই হলো শিক্ষা। আগে শিক্ষা বলতে বোঝানো হতো শিশুকে নিয়ন্ত্রণ করা বা শাসন করা। শিশুকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে বিদ্যা দান করার যে পদ্ধতি, তা আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল, তাকেই শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদরা এ ধরনের শিক্ষাকে সংকীর্ণ শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিশুর ওপর জোর করে বিদ্যা চাপিয়ে দেওয়ার নাম শিক্ষা নয়। শিশুর গ্রহণ উপযোগী আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা দানই হলো প্রকৃত শিক্ষা। আমি আগেই বলেছি, আমাদের শিশুদের ব্যাগের বোঝা বাড়ছেই। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবারগুলো এক ধরনের জোর করে বিদ্যা চাপিয়ে দিচ্ছে শিশুদের। এ কারণে শিশুরা একটু খেলাধুলার জন্যও সময় পায় না। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছেন, ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব পযরষফং ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ভৎড়স রিঃয রহÑঅর্থাৎ ‘শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ’।
আমরা অনেক বিদ্যা অর্জন করেছি, অনেক ডিগ্রি অর্জন করছি। কিন্তু মানবিকতা মনুষ্যত্ববোধ সৃজনশীল মানুষ তৈরি করতে পারছি না। এর জন্য দায়ী যেমন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকার। একইভাবে দায়ী আমাদের পরিবারগুলোও। মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধ নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর, যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। আর মানবিক নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রাখে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৩