শেখ কামাল সেদিন আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েক বন্ধুকে নিয়ে। রাত তখন আনুমানিক ৯টা কী সাড়ে ৯টা। আজকের বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সালমান এফ রহমান, যিনি কিনা শেখ কামালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন; ফোন করলেন হঠাৎ করেই। অর্থাৎ সেই রাতে। জানালেন নতুন একটি ভঙ্ ওয়াগন কোম্পানির মাইক্রোবাস কিনেছেন। টেলিফোনের এ প্রান্তে শেখ কামাল খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলেন এবং সালমান রহমানকে অনুরোধ করলেন গাড়িটি একটু পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য নতুন গাড়িতে চড়ে ঢাকা শহরটি একটু চক্কর দেওয়া। অনুরোধমতে গাড়িটি এলো রাত আনুমানিক ১০টার দিকে। উপস্থিত বন্ধুরা শেখ কামালকে প্রস্তাব করলেন পুরান ঢাকার চিনুর বিরিয়ানির দোকানে গিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য। যেই কথা সেই কাজ, শেখ কামাল আরও দু-তিন বন্ধুকে ফোন করলেন এবং ফোন করলেন বিএনপির মন্ত্রী টুকুও। তিনি প্রথমে অস্বীকার করলেন। কিন্তু নতুন ভঙ্ ওয়াগন গাড়িতে চড়া এবং চিনুর বিরিয়ানির লোভ সামলাতে পারলেন না। বললেন যাওয়ার সময় অ্যালিফ্যান্ট রোডে তার বাসার সামনে থেকে তাকে তুলে নেওয়ার জন্য। রাত সাড়ে ১০টায় অ্যালিফ্যান্ট রোড থেকে তাকে তুলে শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা কাকরাইল, জোনাকী সিনেমার সামনের রোড দিয়ে ফকিরের পুল হয়ে গুলিস্তান এবং গুলিস্তান হয়ে বংশাল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অর্থাৎ রাতের নিরিবিলি ঢাকায় নতুন গাড়িতে চড়ার আনন্দ উপভোগ। এভাবেই তারা কাকরাইল মোড় পর্যন্ত এগোলেন। বিপত্তি বাঁধল মোড় পার হওয়ার পরই। এই বিপত্তি নিয়ে কিছু বলার আগে তৎকালীন রাজনীতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু না বললেই নয়।
বঙ্গবন্ধু সরকারকে সমূলে বিনাশ করার জন্য যেসব দেশি-বিদেশি প্রবল প্রতিপক্ষ কাজ করছিল, তাদের মধ্যে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি বা নকশালেরা অন্যতম। এরা মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডে থেকে অপতৎপরতা চালাত। তখনকার নকশালীদের গুম, হত্যা, ডাকাতির বীভৎস রূপ এবং অস্ত্রের ঝনঝনানি সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্যদিকে, জাসদ নামক রাজনৈতিক দলটির গণবাহিনীর তৎপরতা ছিল আরও ভয়াবহ। তারা রাজনীতি করত জাসদের নামে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত 'গণবাহিনী'র নামে এবং অপপ্রচার চালাত 'গণকণ্ঠ' নামে তাদের মালিকানায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে। আজকের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, মহাজোটের এমপি মঈনউদ্দিন খান বাদল প্রমুখ ছিলেন জাসদ গণবাহিনীর লিডার, যাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সমূলে বিনাশ করা। জাসদ গণবাহিনীর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা সন্ধ্যার পর ঢাকার অলিগলিতে বের হয়ে পড়ত এবং খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, অপহরণের মাধ্যমে সরকারকে অচল করার অপপ্রয়াস চালাত। সরকারও সর্বশক্তি দিয়ে এদের দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের বিশেষ টিম সারা রাত গণবাহিনীর গুণ্ডাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাত। বীর মুক্তিযোদ্ধা এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ তখন পুলিশের কয়েকটি টিম পরিচালনা করতেন। গণবাহিনী এবং নকশালদের দমন করার জন্য এসপি মাহবুবের টিমগুলোর আবার পরিচিতি হতো টিম লিডারের নামানুসারে, একটি টিমের নাম ছিল 'কিবরিয়া বাহিনী'। আমরা যে রাতের কথা বলছি সেই রাতে কাকরাইল পল্টন এলাকায় টহলের দায়িত্বে ছিল এই কিবরিয়া বাহিনী। তারা সাদা পোশাকে সশস্ত্র অবস্থায় প্রাইভেট গাড়িতে ঘুরত মূলত গণবাহিনী বা নকশালীদের ধরার জন্য। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই চ্যালেঞ্জ করত এবং ক্ষেত্রবিশেষে গুলি চালাত।
শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা যখন কাকরাইল মোড় পার হলেন, তখন সামনে একটি প্রাইভেটকারে কয়েকজন সশস্ত্র লোককে দেখতে পেলেন। তারা মনে করলেন প্রাইভেটকারটি হয়তো গণবাহিনীর গুণ্ডাদের বা নকশালীদের। মাইক্রোবাসটি প্রাইভেটকারের চেয়ে উঁচু এবং উজ্জ্বল হেড লাইটের কারণে শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা গাড়ির আরোহীদের দেখতে পাচ্ছিলেন। অন্যদিকে, গাড়ির আরোহী সাদা পোশাকধারী পুলিশের কথিত কিবরিয়া বাহিনীর সদস্যরা মাইক্রোবাসের উচ্চতার কারণে ভেতরের আরোহীদের দেখতে পাচ্ছিলেন না। কাকরাইল মোড় পার হয়ে শেখ কামালদের গাড়ি যখন নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁ অতিক্রম করছিল, তখন তাদের তারুণ্যময় অ্যাডভেঞ্চারে পেয়ে বসল। তারা মনে করলেন, সামনের গাড়িটি গণবাহিনী বা নকশালীদের। ভুলে গেলেন চিনুর বিরিয়ানির কথা। ভাবলেন, কোনোমতে যদি ওই সন্ত্রাসীদের ধরা যায়, তাহলে সারা দেশে হয়তো একটি ধন্য ধন্য রব পড়ে যাবে। তারা গাড়িটি ধাওয়া করলেন। রাত তখন ১১টা। অন্যদিকে, প্রাইভেটকারে বসা কিবরিয়া বাহিনীর সদস্যরা মাইক্রোবাসের আরোহীদের মনে করলেন গণবাহিনীর সন্ত্রাসী।
পুলিশের গাড়ি হঠাৎ মতিঝিল থানার মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাদের অনুসরণ করে শেখ কামাল ও তার বন্ধুরাও মতিঝিল থানা কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়লেন। এরপর পুলিশ সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগলেন মাইক্রোবাসে বসা শেখ কামাল ও তার বন্ধুদের ওপর। সবাই মারাত্মক জখম হলেন কেবল বিএনপির ওই নেতাটি ছাড়া। এরই মধ্যে পুলিশ বাহিনী যখন বুঝতে পারল আসল ঘটনা, তখন আহতদের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু পরিবার তখন জানে না ঘটনা সম্পর্কে। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বিএনপি নেতাটি ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে ঢুকে শেখ জামালকে খবরটি দিয়ে পুনরায় ঢাকা মেডিকেলে চলে এলেন।
পরদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন বিএনপির মন্ত্রী টুকুকেও। তিনি যখন পৌঁছলেন, তখন বঙ্গবন্ধু খাচ্ছিলেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে জাতির পিতাকে খাওয়াচ্ছিলেন। ছেলের বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন-ভদ্রলোকের ছেলেরা কি রাত ১১টার সময় বাইরে বের হয়? ব্যস! আর যায় কোথায়! শেখ কামালের বন্ধুটি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করলেন তার ছেলের বন্ধুর মানসিক অবস্থা। আর কিছু বললেন না। শুধু হুকুম করলেন- এই বস, হাসু ওকে ভাত দে। ওই দিনের খাবারের মেনু ছিল শাক, ডাল আর কৈ মাছ। নেতাটি ভীতসন্ত্রস্ত এবং বিহ্বল হয়ে খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু গিলতে পারছিলেন না। শেখ হাসিনা জানতেন যে, তার ভাইয়ের এই বন্ধুটি মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারেন না। তাই তিনি উত্তর করলেন, "ঠিক আছে, আমি ওর মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছি।"
শেখ কামালকে 'ব্যাংক ডাকাত' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ১৯৭৪ সাল থেকে এই প্রচারণার শুরু। আমিও এই প্রচারে বিভ্রান্ত ছিলাম দীর্ঘদিন। আমি নিশ্চিত, এই লেখার পাঠকদের অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন দলবল নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল গুলিবিদ্ধ হন। সুযোগ পেলেই বিএনপি নেতারা, এমনকি বেগম খালেদা জিয়া নিজেও শেখ কামালকে ‘ব্যাংক ডাকাত’ বলে থাকেন। জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক কার্যবিবরণীতেও তাদের এমন বক্তব্য পাওয়া যায়। এ নিয়ে মেজর জেনারেল মইন তার “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক” বইতে স্বাধীনতাত্তোর অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা তথ্য দেন। তিনি লিখেন, ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসের আগের রাতে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সিরাজ শিকদার তার দলবল নিয়ে এসে শহরের বিভিন্নস্থানে হামলা চালাতে পারেন। এ অবস্থায় সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিতে থাকে। সর্বহারা পার্টির লোকজনের খোঁজে শেখ কামালও তার বন্ধুদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডি এলাকায় বের হন। সিরাজ শিকদারের খোঁজে টহলরত পুলিশ মাইক্রোবাসটি দেখতে পায় এবং আতংকিত হয়ে কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই গুলি চালায়। শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ হন। গুলি শেখ কামালের কাঁধে লাগে। তাকে তখনকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জেনারেল মইন তখন ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক। বিজয় দিবসে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সম্মিলিত সামরিক প্যারেড পরিচালনা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সালাম নেন। জেনারেল মইন লিখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অত্যন্ত গম্ভীর ও মলিন মুখে বসে ছিলেন। কারও সঙ্গেই তেমন কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে জেনারেল মইন বইতে লিখেন, ওইদিন শেখ মুজিব তার সঙ্গেও কথা বলেননি। ‘৭২ সাল থেকে অনেকবারই তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু এতটা মর্মাহত কখনও তাকে আগে দেখেননি। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল ওসমানীর এডিসি শেখ কামালও জেনারেল মইনের ঘনিষ্ট ছিলেন। প্যারেড শেষে মইন পিজিতে যান শেখ কামালকে দেখতে। হাসপাতালে বেগম মুজিব শেখ কামালের পাশে বসেছিলেন। মইন লিখেন, প্রধানমন্ত্রী তার ছেলের ওই রাতের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শেখ কামালকে হাসপাতালে দেখতে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে যান।
জেনারেল মইনকে এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শেষে তিনি লিখেন, এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা এই ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। ‘ব্যাংক ডাকাতি’ করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশ-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।
ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের ছেলেমেয়েরা সবসময়ই রাজনীতিতে নানা সমস্যা তৈরি করে থাকে। শেখ কামালকে আমি কখনও দেখিনি। তবে কেন যেন অল্প বয়স থেকেই তার সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা আমার হয়ে আছে। সত্য জানার পরও সে ধারণা পুরোপুরী দূর হয়নি। তবে এটা বুঝতে পারছি, শেখ কামাল সম্পর্কে বিরূপ প্রচারও প্রচুর হয়েছে। ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানে এসবের অনেকই মিথ্যাচার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার হিসেবে প্রমাণ হচ্ছে এবং হয়তো আরও হবে। আমার এই কথার স্বপক্ষে আমি চারজন সাক্ষী রাখলাম। কারও যদি আমার কথায় সন্দেহ হয়, দয়া করে এই চারজনকে জিজ্ঞাসা করলে আমার কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। চারজন হলেন-
১) তৎকালীন পুলিশ সুপার মাহাবুব আলম (বীরবিক্রম)। যাকে এক নামে সবাই এসপি মাহবুব নামে চেনে। যার নেতৃত্বে সেদিন পুলিশ দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে এসেছিল।
২) সেই সময়কার ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’ এর সম্পাদক প্রবীন সাংবাদিক এ.বি.এম মুসা (বর্তমানে মৃত)। যিনি ঘটনার পরদিন পত্রিকায় সত্য ঘটনাটি তুলে ধরেছিলেন।
৩) বর্তমানে বিএনপির নেতা ইকবাল হাছান টুকু। যে জিপটিতে কামালরা দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে গিয়েছিলেন, সেটা ছিল টুকুর এবং সেদিন জিপটি টুকুই ড্রাইভ করেছিলেন। তৃতীয় সাক্ষী নিয়ে একটা কথা: খালেদা জিয়া ঢাকার এক জনসভায় ভাষনে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘’ব্যাংক ডাকাতি তো তাদের রক্তে মিশে আছে।“ ম্যাডাম আর কত মিথ্যা বলবেন? একটু নিজের দলে বিএনপির নেতা ইকবাল হাছান টুকুর কাছে খোঁজ নেন, সত্যটা আপনার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত।
৪) জাপা'র প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ। যিনি কামালদের সিনিয়র হলেও, কামালদের সাথে প্রায় বন্ধুর মতো চলাফেরা করতেন এবং সেদিন তিনিও ঐ জিপে ছিলেন।
সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১২