এটা কোন পরিণয়ের গল্প নয়;খুব সাদামাটা একটা গল্প যার জীবনে ঘটেছে এমন সে বিশ্বাস করবে যার জীবনে ঘটেনি সে বিশ্বাস করবে না। শুরুতেই বলে রাখি গল্পটা পূর্ণতা পায়নি।একসাথে হাঁটা হয়নি মাটির গন্ধ ভরা সেই পথে, যেখানে ঝোপের পাশে ফোটে বুনো ফুল;যে পথ ধরে হেঁটে যায় হাঁসের ছানা।তবে এক সকালে অরণ্য হেঁটেছিল সেই রাস্তায় যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল শুভ্রার সাথে; সেদিন এই পৃথিবীর সমগ্র রাস্তা ভরপুর হয়ে উঠেছিল প্রকৃতির সুগন্ধিভরা সৌন্দর্যে।শুভ্রা এসেছিল খুব ব্যস্ত পা'য়ে।
এসেই বলল "মাফ করবেন!আমি রাস্তা ভুলে গেছি।বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক কী ভাবে রায় বাড়ি যাব! সকালে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম।শুনেছিলাম এদিকটায় নাকি অনেক বড় একটা পুকুর আছে।সেই পুকুর নাকি গোলাপী রঙয়ের শাপলায় ভরে ওঠে বছরের এই সময়টায়।আচ্ছা আপনি কি পুকুরটা চেনেন?আপনি চিনলে আমি এখন আর রায় বাড়ি যাব না, সেই পুকুরটায় দেখতে যাব।"
মেয়েটা এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে অরণ্যের মুখের দিকে তাকাল।সকালের সোনালি আলোর সবটুকু ছোঁয়া মেয়েটির মুখের উপর এসে পড়েছে।সে তাকিয়ে আছে অরণ্যের কথা বলার অপেক্ষায় অথচ অরণ্য বাকরুদ্ধ ; প্রতিটা শব্দ হারিয়ে ফেলেছে।ভুলে গেছে যেন বাক্য গঠনের নিয়ম।গরম নেই অথচ অরণ্যের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে ।অরণ্য ভাবছে এই মেয়েটাকে সে আগেও দেখেছে।কোথায় দেখেছে,কিভাবে দেখেছে কিছুতেই মনে পড়ছে না।তবুও তাকে জানে অরণ্য।অনেক বেশি চেনা চেনা লাগছে। অরণ্য ভেবেই চলেছে ঠিক কোথায় দেখেছে।
বাতাসে চুল উড়ছে মেয়েটির, মুখের দিকে আরো একবার তাকাতেই অরণ্যের চোখে পড়ল মেয়েটার কপালে রয়েছে কাঁটা দাগ। ওটা দেখেই মনে পড়ে যায় অরণ্যের। কোথায় দেখেছে মেয়েটিকে।এভাবেই বুঝি মানুষের স্বপ্ন সত্যি হয়!স্বপ্নের মানুষ বুঝি বাস্তবে আসে! একটা স্বপ্ন প্রায় দেখত অরণ্য। একটি মেয়ে যার খোঁপায় জড়ানো বেলী ফুল, যার কপালের কাছে একটু কাঁটা,যার চোখে ভালোবাসার হাসি।সেই মেয়েটা হাসতে হাসতে অরণ্যের সামনে এসে মাথা থেকে বেলী ফুল খুলে অরণ্যের হাতে যখনি দিত অরণ্য হাত বাড়াত ফুলটি নেয়ার জন্য ঠিক তখনি স্বপ্নটা ভেঙে যেত।হ্যাঁ এই মেয়ে তো। এই মেয়ের তো কপালের দিকটায় কাঁটা আছে।মায়াবী চোখ -যার চোখে চোখ রেখে সমগ্র পৃথিবী এক নিমিষে দেখে ফেলা যায়।
-শুনুন পুকুরটা আমি চিনি না, কিন্তু আপনাকে কিন্তু আমি চিনি।মেয়েটা কপাল কুঁচকে একটা হাসি দিয়ে বলল, মজা করছেন বুঝি আমার সাথে!
-আমি বললাম এর আগেও আপনাকে আমি দেখেছি এবং প্রায়ই।মানুষের স্বপ্ন সত্যি হয় এটা জানা ছিল না।
অরণ্যের কথায় মেয়েটির মুখ আগের মতই ভাবলেশহীন রইল।দু'জনেই হাঁটছে।পথের বাঁকে চলতে চলতে অরণ্য আর শুভ্রা ঠিক চিনে নিয়েছে সেই পুকুর।বিশাল বড় পুকুর। পুকুর জুড়ে গোলাপী রঙয়ের শাপলা।একজন মাঝির নৌকা ভর্তি সেই শাপলা ফুল।অরণ্য শাপলা ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।কী সুন্দর মায়া ভরা রঙ! ইচ্ছে করছে শাপলা ফুলগুলো ছুঁয়ে দিতে।পুকুর পাড়ের গাছগুলোয় পাখির দারুণ কিচিরমিচির।জীবন কেন এত সুন্দর এসব ভাবতে ভাবতে কাঁধ ঘুরিয়ে দেখে শুভ্রা তার পাশে নেই।শুভ্রা যেন কেমন করে ওই নৌকায় উঠে বসেছে।কানে গুঁজেছে ফুল।অনেকগুলো ফুলের মাঝে শুভ্রাকে মনে হচ্ছে শিশিরের মুক্তো।শুভ্রা হাসছে,জল থেকে শাপলা তুলছে।অরণ্য পা বিছিয়ে পুকুর পাড়টায় বসে আছে।তারপর কিছু একটা ভেবে অরণ্য সেখান থেকে চলে যায়। চলে যাচ্ছি-এই কথাটি একটিবার শুভ্রাকে বলার প্রয়োজন বোধ করল না।
ঠিক দু'দিন পরের ঘটনা।পথ চলতে চলতে আবার শুভ্রার সাথে অরণ্যের দেখা।অরণ্য ফিরছিল চাকরির একটা ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে।
-সেদিন ওভাবে না বলে চলে গেলেন যে।
-আপনি ব্যস্ত ছিলেন তাই জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।
শুভ্রা একটা হাসি দিল।যেন এমনটি হওয়ার কথা ছিল।শুভ্রা আর কোন প্রশ্ন করল না।হেঁটেই চলেছে। আর তার সাথে সাথে অরণ্য।
পথের ধারে চারিদিকে অনেক গাছ।শুভ্রা একবার আকাশ দেখছে,একবার গাছ দেখছে আর একটু পর পর হাত দিয়ে গাছের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে।অরণ্য খেয়াল করল শুভ্রার বাম হাতের কনিষ্ঠা আংগুল নেই।শুভ্রা অরণ্যের মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল ও কিছু না,এরপর বলে উঠল জানেন, গাছের শেকড় কিন্তু মাটির নিচেই থাকে; ওপরে না।মাটির নিচের এই শেকড় কেটে দিয়ে দেখুন তো গাছ বাঁচে কি'না!যতই পানি ঢালুন গাছ কিন্তু বাঁচবে না।তেমনি মনে ব্যথা দিয়ে যতই আপনি জল ঢালুন না কেন, কাজ কিন্তু হবে না।
-আচ্ছা মেয়ে বটে! আমি কখন ওর মনে ব্যথা দিলাম!
-জানি না কেন বলছেন কথাগুলো তবুও মনে হল একটা সূক্ষ্ম ব্যথা বয়ে নিয়ে চলেছেন?শুভ্রা স্মিত হাসল। আমার আপনাকে আপনি করে বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি আপনাকে তুমি বলি।আচ্ছা, কী নাম আপনার?
-অরণ্য নাম আমার। শুনুন,আপনাকে আপনি করেই আপাতত কথা বলতে হবে।এই মুহুর্তে আমার মন তুমি শুনতে মোটেও প্রস্তুত নয়।
এই কথাটি শোনার পর শুভ্রার মুখ চোখ শক্ত হয়ে যায় কিন্তু এছাড়া অরণ্যের আর কোন উপায় ছিল না। সত্যটা অভিনয় করে লুকিয়ে রাখার কোন মানেই হয় না।তার ভালোলাগার কাছে নিজের খারাপ লাগাকে বিসর্জন তো দিতে পারে না,মনে মনে বিড়বিড় করে অরণ্য।
তারপর ঋতু বদলের মত করে শুভ্রা আর অরণ্যের জীবন অনেক খানিই বদলে যায়।দু'জনে হয়ে উঠে বন্ধুর মত তবে ঠিক বন্ধু না।
বছরের শেষ ছুটির দিনে শুভ্রা আর অরণ্যের দেখা হবার কথা এই ক্যাফেতে। শুভ্রা হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইল ফোনটা ব্যাগের ভেতর ঢোকায়।ওয়েটারকে বলে একটা বোতল দিতে। অরণ্য আর শুভ্রা বসে আছে এই শহরের ছোট এক ক্যাফেতে।পুরো ক্যাফেটা নীল রাঙা পর্দায় ঢাকায়।ঢুকতেই দেওয়ালে টানানো একটা ছবি।সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে খাঁচা ছেড়ে একটা পাখি উড়াল দিচ্ছে।সেখানে লেখা আছে,"কেবল বন্দিনী জানে মুক্তির কী স্বাদ! "
ক্যাফেটাতে আগেও এসেছে অরণ্য আর শুভ্রা।যখনই আসে তখনি যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায় সেখানে বসা চায় শুভ্রার।শুভ্রার কথা দূর থেকে মানুষ দেখার মাঝে অন্য রকম আনন্দ।কাছে গেলে মানুষের রঙ নাকি বদলে যায়!
একটু একটু করে ছাই রাঙা আকাশ থেকে মেঘ সরে সরে যায়।আলো আলো লাগে।এদিকটায় আলো, ওদিকটায় আলো।শুভ্রা বারান্দায় বসে থাকে।আকাশে রাখে চোখ,একটু সময়ের জন্য সে চোখ অন্য কোথাও রাখে না।কী যেন একটা পাখি ডেকে উঠেছে। কান পাতে খুব খেয়ালে কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না।সকালবেলায় কত পাখির ডাক শোনা যায়।এই তো আর একটু পর ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটলে তখন ডাকবে চড়ুইয়ের ঝাঁক।ছোট্ট পাখি অথচ গলায় কত শব্দ! বেশ শীত শীত আমেজ চলে এসেছে।বারান্দায় এলে ঋতুর সে স্পর্শ উপলব্ধি করা যায়।বারান্দায় বসে বসে শুভ্রা ভাবছে অরণ্যকে কী বলবে সে? অরণ্য জানতে চায় ভালোবাসে কি'না। ভালো না বাসলে ভালোবাসার কথা বলা যায় কী ? ভালোবাসা সে'তো হৃদয়ের কথা, হৃদয়ের সে দরজা খুলে দিলে গুনগুন করে পাখির মত গান শোনা যায়,মিষ্টি বাতাস আর সুগন্ধিতে ভালোবাসার সমস্ত ঘর ছেয়ে যায় নিবিড় পবিত্রতায়।
বিকালে পার্কে দেখা করার কথা।আজ শুভ্রা আসেনি দেখা করতে।অরণ্য শুভ্রাকে ঠিক বুঝতে পারে না। যে মেয়েটাকে ক'দিন পর বিয়ে করবে বলে মনস্থির করেছে সে মেয়েটা এমন অদ্ভুত আচরণ করে কেমন করে।অরণ্য চোখের সামনে দেখতে পায় শুভ্রা একটা হালকা বেগুনি রঙয়ের শাড়ি পরেছে। হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি।শুভ্রা যেদিকে যাচ্ছে সেই টুংটাং শব্দ কানে আসছে। শুভ্রাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।মেয়েটা চোখে কাজল দিয়েছে।কাজল দিলে মানুষের চোখে এত মায়া কেন লাগে?
শুভ্রাকে নিয়ে ভাবতে না ভাবতেই অরণ্যের মোবাইলে মেসেজ টোন ভেসে আসে। স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্রার মেসেজ।
- বিয়েটা কখনো তোমাকে করা হবে না।আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো না। স্বপ্ন দেখো পৃথিবীর উপর হেঁটে চলা মানুষকে নিয়ে।আমাকে নিয়ে নই; জানতে চেয়ো না তবে আমি কী!মনে রেখ পৃথিবীতে অনেক কিছুরই ব্যাখা থাকে না, তবুও আমরা ব্যাখা দাঁড় করায় নিজের মনের মত করে। যে যেমন তার ব্যাখাও ঠিক তেমনি।
যুক্তি দিয়ে মানুষ তর্কেই জিততে পারে ;অন্য কিছু না।আমি চলে যাচ্ছি ঠিক যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই।জানতে চেয়ো না কোথায় যাচ্ছি।তবে মনে রেখো তোমার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না।আমি ছিলাম ক্ষণিকের অতিথি।মনে রেখ মন চাইলেই স্বপ্নের মানুষের সাথে ঘর বাঁধা যায় না!খুঁজতে যেও না - তোমার হাসির যত্ন নিও।যত্ন নিও তোমার চোখের। আমি চললাম যেখানে আমার ঠিকানা।
ঘটনার আকস্মিকতায় অরণ্য অবাক হয়।কী এমন হল যে শুভ্রাকে হারিয়ে যেতে হচ্ছে।অরণ্য ফোন করে শুভ্রার ফোনে।বন্ধ।অরণ্য মনে মনে ভাবে স্বপ্নের মানুষ হঠাৎ করে আসে বুঝি হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার জন্য! নিজেকে অসহায় লাগে।বাহিরে তাকিয়ে দেখে আলোজ্বলা শহর।আকাশের কোথাও অন্ধকার নেই।আলোভরা শহুরে আকাশে তারাগুলো দেখা যায় না।তবুও তাকিয়ে থাকে।শহুরে আকাশ অনেক কথা বলে। অরণ্য কান পাতে।শুনতে পায় আকাশ বলছে "সে আছে, সে আছে।"অরণ্য জানে সে আছে, সে আছে , হয়ত খুব কাছে হয়ত এই পৃথিবীর গলিতে গলিতে স্বপ্নলোকের ধারায় ভালোবাসায় মিশে।
©রুবাইদা গুলশান