কবিতাকে ছুটি না দিয়ে আর উপায় দেখছি না। মাফ চাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্লগের অনেক কবিই আমাকে ভুল বুঝে থাকতে পারেন। কবিতা ছাত্রজীবনেও পড়েছি, কবিতাকে ভালোও বেসেছি, কিন্তু প্রকাশ করতে পারি নি কোন কালেই। যেমন পারি নি বাংলা সাহিত্যে সত্তরের ওপরে নম্বর ওঠাতে। হামাগুড়ি দিতে দিতে ব্লগে এসে যা পেলাম তা হলো, কবিতার সাথে ঘনিষ্টতা আর ‘লাইভ কবিতা’! সহব্লগারদের কবিতার গাঁথুনি আর ভাব প্রকাশের মুনশিয়ানা দেখে, কাউকে কাউকে ইতোমধ্যেই হিংসা করতে শুরু করেছি। ব্লগে অনেকের কবিতা আমার ভালো লাগে – আমোদিত হই, আলোড়িত হই, সঞ্জীবিত হই, কতকিছুই হই – কিন্তুক, পরকাশ করতে পারি না! অনেকের কবিতায় এতো মুগ্ধ হই যে, আরেকটি কবিতা লেখে ফেলার ‘খায়েশ’ জাগে – কিন্তুক, পেটে আসে আঙ্গুলে আসে না! কবিতা পাঠের অনুভূতি প্রকাশ করা আমার কাছে ‘কবিতা লেখার’ মতই কঠিন মনে হয়। ফলে যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাতে, আমার ধারণা, কবি ও কবিতার সাথে একটি সুপ্ত-গুপ্ত শত্রুতা সৃষ্টি হচ্ছে দিনকে দিন। হতেই পারে। কবিতা পড়ে মন্তব্য দিতে না পারলে, তা তো কবির প্রতি অবিচারই বলতে হয়।
“ভালো – খুব ভালো – খুবই ভালো”
স্কুল জীবনের বাংলা শিক্ষক পরীক্ষার খাতায় আমাদের লেখাকে মাত্র তিনটি গ্রেইডে মূল্যায়ন করতেন: ভালো, খুব ভালো, খুবই ভালো। কিন্তু ব্লগালয়ে এর কতটুকু ওজন আছে! ‘ভালো লাগলো’, ‘হুম’, ‘সুন্দর’ ‘ভালো লিখেছেন’ ইত্যাদি ছকে-বাঁধা মন্তব্য দেবার সময় নিজেই বিব্রত হই। একটি বিশ্লেষণী বা সমালোচনা-ভিত্তিক মন্তব্য একটি সুন্দর কবিতার অতি নায্য দাবি। একে কবিতার অধিকার বলা উচিত! পাঠকের বিচারে কবিতা ভালো না হলেও কবির অধিকার আছে সহব্লগারের অঙ্গুলি থেকে দু’একটা মতামত পাবার। কিন্তু, ওই যে কইলাম….!
“আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।”
“তোমার চোখ এতো লাল কেন?” কবিতার সরল-কঠিন আবেদনে যত ভাবের সৃষ্টি হয়, তা তো আমি প্রকাশ করতে পারি না। অনুভব অনুভবেই আটকে থাকুক – এরকম মনোভাব নিয়েই দিনাতিপাত করছি। কবি নির্মলেন্দু গুণ অবশ্যই আমাকে অপরাধ দেবেন না।
“তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।”
রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ’র ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ পড়ে যত ঘৃণা আর ক্ষোভের উদ্রেক তা কি প্রকাশ করতে পারবো ভাষায় কখনও?
“কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;… …
তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?”
‘চিল্কায় সকাল’ কবিতায় কবি বুদ্ধদেব বসু যেন আমার মতো নাদানেরই কথা বললেন, যাদের অনুভবে বুক ফুটে তবু কলম ফুটে না! তাই কবিতা থাকুক কবিতার স্থানে। আমার মন্তব্যে যেন কবিতার অধোগতি না হয়।
বাংলা সাহিত্য যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ সুকান্তদের বিভিন্ন প্রজন্ম দ্বারা। তারা বিভিন্ন রূপে ফিরে এসে বাংলা মায়ের কবিতার ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। সেখানে পাঠক হয়ে থাকাটাও কম কিসের?
অতএব… …
অতএব, সকল সহ-ব্লগার কবিদেরকে শ্রদ্ধা জানাই বিগত এবং আগামি কবিতার জন্য! ক্ষমা চাই তাদের প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত কবিতায় আমার অযোগ্য মন্তব্যের জন্য। কবিতা’র যেন সম্ভ্রমহানি না হয়, সেদিকে খেয়াল করতে গিয়ে অনেক ভুল হয়তো করেছি।
কবিতা লিখতে গিয়ে অনেক দেখেছি, চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তেষ্টা মেটে নি। চেষ্টার কোন ত্রুটিও করি নি, বরং মনে হয়েছে এর চেয়ে ভালো কবিতা আর হয় না। কিন্তু প্রকাশ হবার পর নিজ গর্ভের বিকলাঙ্গ সন্তানটির মতো মনে হয়েছে: যাকে ভালোবাসি কিন্তু অন্যদের মাঝে দেখে শুধুই করুণা হয়। তবে কেন আর চেষ্টা? একান্তই চাপে পড়লে দু’একটি ‘অকবিতা’ লেখবো, তা নিজেরই জন্য। তাছাড়া, কবিতা পাঠেই নিমগ্ন থাকতে চাই। অতএব কবিতা তোমায় দিলাম পুরাই ছুটি!
লেখা নিয়ে আমার ‘লেখাগুলো’:
১)) ভালো লেখার ৩টি গোপন সূত্র
২)) কী লিখবো, কেন লিখবো!
ছবি সূত্র:
_______________________________________________
ক) প্রথম ছবির শিরোনাম: “The Dream of the Poet/The Kiss of the Muse” 1859-60 (oil on canvas) by Paul Cezanne (1839-1906). actuarylit.com
খ) দ্বিতীয় ছবি: মারিয়া কিরিয়াকভ, ডিসেম্বর ২০১১: maraiakiriakov.blogspot.com
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৩