লেখকের কাজ হলো এমন কিছু লেখা, যা অন্যে লেখতে অসমর্থ। এটি আমার কথা নয়। আবার কেউ বলেন, এমন কিছু লেখো - যা কখনও কেউ ভুলে যাবে না। মাঝে মাঝে ভাবি, কেন লেখবো, যদি পাঠক তাতে নতুন কিছু না পান, যদি সেখানে মনে রাখার মতো কিছু না থাকে? অহেতুক জায়গা নষ্ট করার কোন মানে আছে? তার চেয়ে পড়তে থাকি, সেটাই ভালো। তাছাড়া এমন কিছুই আমার মাথায় আসে না, যা কখনও বলা হয় নি। অন্য কারও চেয়ে লেখকের কাছেই লেখার কাজটি সবচেয়ে কঠিন। লেখকের মনের এই দ্বন্দ্বটি নিয়েই আজকের লেখা।
আগে লেখার সুবিধা
লেখা নিয়ে চলমান অনুসন্ধানে এমন কিছু বিষয় যোগাড় হয়েছে, যা আলোচনা না করলে লেখকের (পোস্টদাতা) আর খেয়াল থাকবে না! পরে লেখক নিজেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার উপরে থাকবে। বলতে চাচ্ছি যে, অনুভূতি এক হলে প্রকাশও অনেক সময় মিলে যায়। সেক্ষেত্রে প্লেজিয়ারিজম বলা যায় কিনা, পাঠক বিচার করবেন। লেখা নিয়ে আজ আমি যা ভাবছি, তা যে কাল অন্য একজন ভাববেন না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? তাই 'এ কথাগুলোও' আগেই লিখে ফেলছি, যাতে পরে যিনি লিখবেন, তাকে প্লেজিয়ারজমের ব্যাপারে সাবধান হতে হয়।
ইতিহাস লেখক নাকি ইতিহাসের সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়ে থাকেন। এজন্যেই হয়তো ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন, ইতিহাস হলো বিজয়ীদের লেখা। তাই আগে লেখার অনেক সুবিধা। কেউ কেউ বলে থাকেন, আমি যা লেখব বলে ভাবি, সেগুলো দেখা যায় রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দরা আগেই লিখে ফেলেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেছিলেন, ইতিহাস আমার প্রতি সদয় হবে, যদি আমি নিজেই তা লেখতে মনস্থ করি।
লেখকেরা প্রতিনিয়ত অনুভূতির ইতিহাস লিখে চলেছেন, তাই প্রত্যেক লেখকই কোন-না-কোনভাবে একেকজন ঐতিহাসিক। লেখক তার লেখায় তার সমসাময়িকতার ইতিহাস তুলে ধরেন শৈল্পিকভাবে। তাই, আগে লেখার সুবিধাটি ওড়িয়ে দেয়া যায় না।
অনুভূতি-প্রবণতা আর জীবনবোধ: লেখার প্রধান সূত্র
একজন অনুভূতি-প্রবণ ব্যক্তি সহজেই লেখক হতে পারেন। লেখকরা সাধারণত অনুভূতিপ্রবণই হয়ে থাকেন। “লেখকের চোখে অশ্রু না এলে, পাঠকের চোখেও অশ্রু ঝরবে না - লেখক বিস্মিত না হলে পাঠকও বিস্মিত হবে না”। আমার প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টের কথা।
“লেখায় যদি নিঃশ্বাস ছাড়তে না পারেন, লেখার মাধ্যমে যদি কেঁদে ওঠতে না পারেন, গান গাইতে না পারেন - তবে বাদ দিন আপনার লেখা।” ফরাসী-কিউবান লেখক আনাই নিন-এর কথা। ভাষাগত দক্ষতার চেয়েও প্রয়োজন একটি বিদগ্ধ হৃদয়ের, 'লেখা নিয়ে লেখা’র পূর্বের একটি পর্বে একথাটিই বলেছিলাম।
অনেকে বলে থাকেন, পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ থেকে জন্ম হয় লেখকের। চোখ-কান-নাক খোলা রাখুন, নিজের বিশ্লেষণী শক্তি প্রয়োগ করুন আর তা সাদা কাগজে ঢেলে দিন - ফলাফল হলো আপনি একজন লেখক! নিজেই নিজের আইডল। “যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে মানুষ সম্পর্কে আমি এতকিছু কীভাবে জানি, আমার সোজাসাপ্টা উত্তর: মানুষ সম্পর্কে আমি যা-কিছু জেনেছি, তা আমার নিজের থেকে শেখা।” বলেছেন রাশিয়ান চিকিৎসক-নাট্যকার আনটন চেখভ। একই কথা টি এস ইলিয়ট বলেছেন, নিজে বুদ্ধিমান হওয়া ছাড়া লেখক হবার অন্য কোন পদ্ধতি নেই। আনাতোল ফ্রাঁসে’র সোজা কথা: “কোন কিছু জানাটাই আসল কথা নয়, কল্পনাশক্তিই সবকিছু।” অর্থাৎ একটি পর্যবেক্ষণশীল মন আর সূক্ষ্ম কল্পনাশক্তি - এই দু’য়ে মিলে সৃষ্টি হয় লেখকের সত্ত্বা।
পাঠকের মধ্যে লেখক সত্ত্বা
পাঠকের মধ্যে লুকিয়ে আছে লেখকের বীজ। সাম্প্রতিক সময়ে এবিষয়টি নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছিল। পড়তে পড়তে লেখার ভুল-শুদ্ধ সফলতা-ব্যর্থতা আবিষ্কার করা যায়। পূর্বের লেখকের পদচিহ্নগুলো সঠিক গন্তব্যে গিয়েছিলো কিনা, তা পড়ে পাঠক তার লেখার গতিপথ নির্ণয় করতে পারেন। তাই পড়ার কোন বিকল্প নেই, লেখক হবার জন্য। সমসাময়িক হরর ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক স্টিফেন কিং-এর মতে, কেবল দু’টি পদ্ধতি আছে ভালো লেখক হবার জন্য: এর একটি হলো প্রচুর পড়া, অন্যটি প্রচুর লেখা।
লেখার পূর্বেই যত দ্বিধা এবং ভয় সংশয়। লেখা শুরু করে দিলে একটা কিছু দাঁড়াবেই। অনুভূতি বা ধারণাকে ধরে রাখা অনেকটা মাছ ধরার মতো একটি বিষয়। প্রথমে দু’একটিকে ধরে রাখা শিখে ফেললে আরও কিছু এসে যোগাড় হয়।
লেখকের কাজ হলো শুধু একটি সত্য বাক্য লেখা। একটি নতুন সত্য। এটি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা। “অনুপ্রেরণা লাভ করার জন্য আপনাকে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। হাতে লাঠি নিয়ে অনুপ্রেরণার পিছু নিন।” বলেছেন মার্কিন লেখক সাংবাদিক ও সমাজকর্মী জ্যাক লনডন। “একটি গল্প লেখলে তা খারাপ হতে পারে, কিন্তু একশ’ গল্প লেখলে দেখা যাবে, বিজোড়গুলো আপনার স্বপক্ষে গিয়েছে।” (এডগার রাইস বারোজ, টারজানের লেখক)
...এজন্যই ব্লগিং করি
এবার কিছু ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার ক্ষেত্রে যা হয়, তা হলো আজকের চিন্তাকে আগামিকালের জন্য ফেলে রাখা। বাঁচা গেলো যে, আমি কোন লেখক নই। ধরুন একটি বিষয় অনুভূতিতে প্রবল আঘাত হানলো। ভাবলাম এনিয়ে অবশ্যই লিখতে হবে আমাকে, কিন্তু সময় করে পরে একবার বসবো! পরে আর বসা হয় না - বসলেও সেই অনুভূতি আর ফিরে আসে না।
এমন কিছুই আমি লিখতে পারি না, যা অন্যের লেখায় আসে নি বা অন্যের পক্ষে লেখা অসম্ভব। তবে আর কেন লেখা? লেখা বিষয়ে ব্রিটিশ গল্পকার এবং কমিক লেখক নীল গেইম্যান বলেছেন, আগামিকাল কিয়ামত আসতে পারে, আজই হলো লেখার মোক্ষম সময়। তাই লেখা ছাড়া আর সবকিছুই আজ গৌণ। আমার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়, তাই তো ব্লগিং করি!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:১৬