somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মাঈনউদ্দিন মইনুল
উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী। শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার জন্য কাজ করি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে কৌতূহলী।

মৃত্যুকথা পর্ব ৩: পৃথিবীর ‘খ্যাতিমানদের’ জীবনের শেষ কথা। মাঈনউদ্দিন মইনুল।

০৭ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিজের জীবনের ঘটনা দিয়ে তৃতীয় পর্বটি শুরু করছি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমার বাবা মারা যান আশির দশকের শেষে। প্রচণ্ড ধূমপান আর অনবরত চা পান করতেন তিনি খালি পেটেও। কিডনি সমস্যার সমাধানের চেষ্টার পূর্বেই তিনি মারা যান, অনেকটা অকালেই, কারণ তিনি কেবল ষাট অতিক্রম করেছিলেন তখন। চার ভাইয়ের মধ্যে শুধু একজন ভাই তখন উপার্জন সক্ষম। সবচেয়ে ছোটভাই তখনও ভালোমতো স্কুল শুরু করে নি। আমি হাইস্কুলে। এক ভাই লেখাপড়া ছাড়া আর চাকরি ধরা’র মাঝখানে অবস্থান করছিলেন। পরিস্থিতি যে কতটুকু ঘোরতর, তা আমরা কেউ টের পাই নি। সে বয়সেই ছিলাম না। কিন্তু বুঝেছিলেন আমার মুমূর্ষু বাবা, কারণ আমার দাদার সময় থেকেই স্বচ্চলতায় ভাটি পড়েছিলো। অবশিষ্ট ছিলো মাত্র কিছু নগণ্য জমি আর ভিটা বাড়ি। হয়তো মৃত্যুর পূর্বে প্রতিটি সেকেন্ড তার কেটেছে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কী বলেছিলেন আমার ততটা খেয়াল নেই। শুধু মনে আছে, ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার ভঙ্গি করে তিনি তার হাতের চারটি আঙ্গুল তুলে ধরেছিলেন আমার মায়ের দিকে। দুঃখিনী মায়ের অবশিষ্ট সম্বল বলতে ছিলাম কেবল আমরা চারটি ভাই! সৃষ্টিকর্তার কৃপায়, আমাদের মাঝেই মা আজ আছেন।

মানব জীবনের সর্বশেষ আত্মমূল্যায়নের উপলক্ষ হলো মৃত্যু। তবে এই মূল্যায়নের সুফল দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিছু করার সুযোগ আর পান না – সেটি কেবলই পরবর্তি প্রজন্মের জন্য। মোনালিসা’র মতো অনবদ্য চিত্রকর্মের নির্মাতা লিওনার্দো দ্য ভিন্চির [১] মৃত্যু-সময়ের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, সকল মানুষের অন্তরে রোপিত আছে একটি অসন্তুষ্ট অন্তরাত্মা যা মানুষকে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যায়।

বিবর্তনবাদের প্রবর্তক ডারউইন [৫] তার মৃত্যুর পূর্বে ঘোষণা দিয়ে গেলেন যে তিনি মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছেন না। ‘লাইফ এন্ড লেটারস অভ চার্লস ডারউইন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জীবনের প্রতিটি ঘণ্টাকে তিনি কাজে লাগাবার করার চেষ্টা করেছেন। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি একটি ঘণ্টাও নষ্ট করার সাহস পায়, সে জীবনের মূল্য খুঁজে পায় নি।”

বিপ্লব সফল করতে হলে প্রয়োজন আত্মবিসর্জন। এ কথা মাস্টারদা সূর্যসেন কত আগেই জানিয়ে গেছেন (১৯৩০)।
মৃত্যুর পূর্বে চে জানিয়ে গেলেন যে, মৃত্যু কেবল মানুষকে শেষ করে, বিপ্লবকে নয়। বিপ্লবীকে মারলেই যে বিপ্লব নিহত হয় না, এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যটি জানিয়ে গেলেন কিংবদন্তী বিপ্লবী চে গুয়েভারা [১২]।
চে’র জীবন আমাদেরকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছে। তবে অমূল্য উপহারটি হলো এই যে, মানুষের জীবন কেবলই জীবনধারণের জন্য নয়, জীবন বিসর্জনের মধ্যেও জীবনের উদ্দেশ্য রোপিত থাকে।

মৃত্যুকে বাড়ি ফেরার সাথে তুলনা করেছেন উপন্যাসিক ও’ হেনরি [৯]।
যার আসল নাম সিডনি উইলিয়াম পোর্টার। মৃত্যুর পূর্বে মার্কিন কবি এমিলি ডিকিনসন ‘ভেতরে’ যেতে চেয়েছেন, কারণ বাইরে ‘কুয়াশা’ পড়ছে [৭]।
অর্থাৎ মৃত্যুর ওপারে তিনি আশ্রয় দেখতে পেয়েছেন। বলা বাহুল্য, কবি রবার্ট ব্রাউনিং তার অধিকাংশ লেখায় মৃত্যু এবং এর পরবর্তি জীবনকে মানবজাতির অনিবার্য গন্তব্য তথা ‘পরিপূর্ণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

‘কালো আলো’ – কী ভীষণ সত্য এক রূপক দিয়ে মৃত্যুকে বর্ণনা করলেন ফরাসি লেখক কবি ও নাট্যকার ভিকটর হুগো। কালো রঙ্গের আলো কি কেউ দেখেছেন কখনও? মৃত্যুর পূর্বে ভিকটর হুগো তা দেখে গেছেন। যা-হোক তিনি তো একে আলো হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন। তবে আর ভয় কিসের?


শেষ কথা:

খ্যাতিমানদের মৃত্যুকালীন শেষকথাগুলো এমনভাবে অন্তরে গেঁথে আছে, যার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। মৃত্যু জীবনের চেয়েও সত্য, কিন্তু একে মেনে নিতে পারাটা অত্যন্ত কঠিন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কি ‘ভালো মানুষ হওয়ার’ মতোই কঠিন, নাকি দু’টোই এক। মৃত্যু-ভয়ই কি মানুষের পরিপূর্ণতার পথে বাধা, নাকি ওটি একটি দরওয়াজা? মৃত্যু ভয় কি আমাদেরকে ভালো হবার বা মহৎ হবার পথকে বাধাগ্রস্ত করে, নাকি উৎসাহিত করে? মৃত্যুর প্রতি অনীহা কি আমাদেরকে মানবিক উৎকর্ষতা সাধনের প্রচেষ্টাকে সংকোচিত করে? মৃত্যু কি জীবনের ফাঁদ, নাকি জীবনের পরিপূর্ণতা? প্রশ্নগুলোর চূড়ান্ত উত্তর কারও জানা থাকলে দয়া করে সহভাগিতা করবেন!



__________________________________________________
তৃতীয় পর্বের পরিশিষ্ট:

১) “ঈশ্বর ও মানবজাতিকে আমি হতাশ করেছি, কারণ আমার কাজগুলো যথাযথ মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারে নি।” লিওনার্দো দ্য ভিন্চি, ইটালিয়ান চিত্রশিল্পী। মৃত্যু ১৫১৯।
২) “মৃত্যুকে নির্ভীকভাবে গ্রহণ করে যারা, তাদের জন্য পরকালে কী আছে আমি খুব জানতে চাই।” পাদ্রির প্রতি পিয়েট্রো পেরুগিনো, ইটালিয়ান চিত্রশিল্পী। মৃত্যু ১৫২৩।
৩) “আমি আমার সর্বশেষ ভ্রমণে যাচ্ছি – অন্ধকারে একটি বড় পদক্ষেপ।” থমাস হব্স, লেখক, মৃত্যু ১৬৭৯
৪) “আমি তোমায় ভালোবাসি, সারাহ। চিরদিনের জন্য, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” স্ত্রীর প্রতি জেমস কে পোক, যুক্তরাষ্টের প্রেজিডেন্ট, মৃত্যু ১৮৪৯
৫) “মরতে আমি বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছি না।” চার্লস ডারউইন, বিবর্তনবাদের প্রচলক, মৃত্যু ১৮৮২
৬) “কালো আলো দেখতে পাচ্ছি।” ভিকটর হুগো, লেখক, মৃত্যু ১৮৮৫
৭) “আমাকে ভেতরে যেতে হবে, কুয়াশা বেড়ে যাচ্ছে।” এমিলি ডিকিনসন, কবি, মৃত্যু ১৮৮৬
৮) “হয় দেয়ালের ছবিটি যাবে, নতুবা আমি।” অসকার ওয়াইল্ড, লেখক, ১৯০০
৯) “আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও। অন্ধকারে আমি বাড়ি ফিরতে চাই না।” ও’ হেনরি (উইলিয়াম সিডনি পোর্টার), লেখক, মৃত্যু ১৯১০
১০) “ওখানে অনেক সুন্দর!” থমাস আলভা এডিসন, বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক, মৃত্যু ১৯৩১
১১) “কিছুরই মূল্য নেই, কিছুরই মূল্য নেই।” লুইস বি মেয়ার, চলচ্চিত্র প্রযোজক, মৃত্যু ১৯৫৭
১২) “আমি জানি, তুই আমাকে মারতে এসেছিস। গুলি কর, কাপুরুষ! তুই তো শুধু একজন মানুষই মারবি।” গুপ্তঘাতকের প্রতি আরনেস্টো চে গুয়েভারা, মৃত্যু ১৯৬৭
১৩) “হায় ঈশ্বর! একি হলো!” ডায়ানা স্পেনসার, ওয়েলসের রাজকন্যা, মৃত্যু ১৯৯৭


মৃত্যুকথার পূর্বের পর্বগুলো:
মৃত্যুকথা পর্ব ১: জীবন ও মৃত্যুর অজানা বন্ধন
মৃত্যুকথা পর্ব ২: পৃথিবীর ‘ক্ষমতাবানদের’ জীবনের শেষ কথা
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:১০
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×