আমি বুঝতে পারছি না, কোনভাবেই বুঝতে পারছি না যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হল উদ্ধার করার জন্য কেনো ছাত্রদের রাস্তায় নামার প্রয়োজন পড়ে? কেনই বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বেদখল হয়, কিভাবে হয়েছিলো? কারা করেছিলো? কার চোখের সামনে করেছিলো?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বেদখল হওয়া ছাত্রবাসগুলো খবর কি প্রশাসনের কাছে নাই? ছিলো না? এটা কি শিক্ষামন্ত্রী সহ অন্যরা জানতেন না? স্থানীয় নেতারা জানতেন না? গণ্যমান্য বিশিষ্টরা জানতেন না? সবচেয়ে বিষ্ময়কর বিষয় হলো তারা সবাই জানতেন। কিন্তু হাতপা গুটিয়ে বসে ছিলেন এতকাল। আজকে শিক্ষামন্ত্রীর আহবান শুনেই বোঝা যায় আসল চিত্র। তিনি স্বয়ং ‘বেদখল’ হলগুলো ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যেসব অবকাঠামের অধিকাংশই বর্তমানে সংসদ সদস্য, পুলিশ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর সূত্রে জানা যায়,
বিশ্ববিদ্যালয়ে তিব্বত হলসহ অবৈধ দখলে থাকা ছাত্রবাসগুলো উদ্ধারের দাবিতে চলতি মাসের শুরু থেকে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ঢাকা-৭ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম ২০০০ সাল থেকে তিব্বত হল দখল করে রেখেছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পাটুয়াটুলী ওয়াইজঘাট এলাকার জিএল পার্থ লেইনে ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠা জামিতে তিব্বত হল সাংসদ হাজী সেলিম ২০০০ সাল থেকে দখল করে আছেন। হলের মূলভবনের বেশিরভাগ অংশ ভেঙে তিনি স্ত্রীর নামে ‘গুলশানআরা সিটি মার্কেট’ নির্মাণ করেছেন।
আরমানিটোলার এসি রায় রোডে আবদুর রহমান হলটি এখন পুলিশ সদস্যদের আবাস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আরমানিটোলা মাহুতটুলির ১, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠা জমিতে শহীদ আনোয়ার শফিক হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
যদুনাথ বসাক লেন, টিপু সুলতান রোডের সাইদুর রহমান হল ও রউফমজুমদার দুটির বর্তমানে কোনো অস্তিত্বই নেই। সাইদুর রহমান হলের জমিতে এখন হার্ডওয়ারের দোকান রয়েছে।
পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭ নম্বর রমাকান্ত নন্দী লেনের শহীদ আজমল হোসেন হল দখল করে একসময় পুলিশ সদস্যদের কিছু পরিবার থাকত। এর কিছু অংশে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সমিতি। ১৯৯৬ সালে এর একাংশ দখল করেন স্থানীয় মোশারফ হোসেন খান।
বংশালের ২৬, মালিটোলায় বজলুর রহমান হলের ভবনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের ছাত্ররা হলটি ছাড়তে বাধ্য হন।
গোপীমোহন বসাক লেনের নজরুল ইসলাম হলের ২০ কাঠা জমিতে গড়ে ওঠেছে জামেয়া শরীয়াবাগ জান্নাত মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সাবেক কমিশনার আওলাদ হোসেন দিলীপ এর তত্ত্বাবধান করেন। হলটির একাংশ দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন বিটিভির সাবেক ক্যামেরাম্যান গোলামুন্নবী।
তাঁতীবাজারের ঝুলনবাড়ী লেইনে শহীদ শাহাবুদ্দিন হল দুই যুগেরও বেশি সময় পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন।
পাটুয়াটুলীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ছয়তলা আবাসস্থলের জায়গায় তৈরি হয়েছে ক্রাউন মার্কেট। জনৈক ওবায়দুল্লাহ এর মালিকানার দাবিদার। একসময় ছাত্রহল হিসেবেও ব্যবহৃত হতো ভবনটি।'
এত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থাসমূহের দখলে থাকায় ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন ছাড়া কোন উপায় নেই হয়তো। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রোববার পুরান ঢাকার ইসলামপুর এলাকায় ওই হলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করলে তাদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। পুলিশের রাবার বুলেট ও টিয়ার শেলে এক শিক্ষকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
Jagannath University Students Network নামক ফেসবুকের পেজে আহত শিক্ষকের ছবিসহ নিচের লেখাটি প্রকাশ করেছে:
'আমি ড. শামসোজ্জুহা কে দেখনি। তিনি পাকিস্তানি পেটোয়া পুলিশ বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,"কোন ছাত্রের বুকে গুলি লাগার আগে সে গুলি যেন আমার বুক ভেদ করে যায়।" তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। আমি প্রায়ই ভাবতাম এমন শিক্ষক এই দেশে আর নেই ।
কিন্তু আমি আজ ড. শামসোজ্জুহা'র প্রতিমূর্তি দেখছি। আমি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার এর কথা বলছি। তিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে আসার পর পুলিশের ছোড়া "ছুড়রা" গুলিতে তার পিঠ রিতিমত ঝাঁজরা হয়ে যায়। প্রায় ৩০ টির মত স্প্লিনটার বিদ্ধ হয় তাঁর মাথায়, পিঠে।কয়েক মিনিটেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় উনার সারা শরীর। তিনি স্পিল্টারের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। আশেপাশের ছাত্ররা উনাকে নিয়ে হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে ছোটাছুটি করতে থাকে । তিনি তখন অজ্ঞান প্রায়। ভাল করে কথা আসছিলনা মুখ দিয়ে। তারপরও তিনি বলতে থাকেন, "আমাকে নিয়ে কেউ ব্যস্ত হয়না,তোমরা আমাকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাও। আমার কথা ভেবেও না, তোমরা কোনভাবেই পিছু হটনা।আমাকে নিয়ে ছুটাছুটি করলে তোমাদের লক্ষ্য পূরণ হবেনা, আমাকে ফেলে তোমরা স্যামনে এগিয়ে যাও"
আমি অবাক হয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, অনেক শিক্ষক যখন ডিপার্টমেন্টের গেটে তালা লাগিয়ে ভিতরে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে ছিলেন, তখন তিনিও তো পারতেন তাদের মত নিরাপদে বসে থাকতে। ছাত্রদের হলের ব্যবস্থা হলে উনার তো কন লাভ হবেনা। কি দরকার ছিল ছাত্রদের হলের দাবি আদায়ের জন্য রক্ত দেয়ার ??? কিন্তু তিনি ঠিকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদের কাঁধে কাধ মিলয়ে মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পুলিশের "ছুড়রা" গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে উনার দেহ।
স্যালুট স্যার আপনাকে। আপনার মত আরও কয়েকজন শিক্ষক যদি আমাদের থাকতো, তাহলে আমাদের আবাসন সহ সকল সমস্যা আরও অনেক আগেই দূর হত।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলকারী এক রাজনৈতিক সন্ত্রাসীর হাত থেকে শিক্ষাঙ্গনকে রক্ষা করার জোরালো দাবী জানাই।
তিব্বত হল মুভমেন্টের প্রেক্ষিত জানার জন্য পড়ুন -
১. আম্মানসুরার ব্লগ 'তিব্বত হলের সাত কাহন '।
২. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ও ছবির ফেসবুক এ্যালবাম ।
৩. আম্মানসুরার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্লগ
'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলো বেদখল হবার পেছনের কিছু ঘটনা '।
৪. সংবাদ সূত্র: জগন্নাথের হল ‘ফিরিয়ে দেয়ার’ আহ্বান নাহিদের
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০১