১
রাইসা। যাকে সে ভালোবেসেছিল, সে এক টগবগে তরুণ, যার ভিতরে অফুরন্ত জোয়ার ছিল, আর মগজে ছিল অপরিমেয় মেধা। কিন্তু ছোটো এক টুকরো বাসযোগ্য জমি ছাড়া প্রেমিকের অন্য কোনো সম্পদ ছিল না। অতএব, সবকিছু সূত্রানুযায়ীই ঘটে গেলো- অবুঝ ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত বন্ধনে গড়ালো না। রাইসা ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে’ সুখ পায় না, ওর শূন্য বুক আর খাঁ-খাঁ অন্তর লু-হাওয়াময় মরুভূমি। চন্দন-পালঙ্কে শুয়ে কী লাভ, তার চেয়ে গাছতলা কতো ভালো ছিল, যদি পাওয়া যেতো আরাধ্য প্রেমিককে! সেই যুবকের বুকে এখনো ওর জন্য ভালোবাসার বান ডাকে কিনা রাইসা জানে না।
২
আফরোজার প্রেম করে বিয়ে হলো পাড়ার ছেলে জুম্মনের সাথে। জুম্মন তাকে সারাবেলা প্রেম দেয়। কিন্তু সারাদিনে একবেলাও ওদের ঠিকমতো খাবার জোটে না। খালি পেটে প্রেম জমে?
৩
কলমির প্রাণসখী ছিল রেহানা। একসাথেই সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। ওর মাথায় কিছু ছিল না, ওর ছিল শরীর-ভরা যৌবন, ফরসা ধবধবে চেহারা। কলমি ঐ বয়সেই ভাবতো, ও ছেলে হলে প্রিয় সখীকে আদর করতে করতে বড় করতো নিজের মতো করে, তারপর বিয়ে করতো নিজেই। কিন্তু মাতবর বাড়ির মূর্খ পোলা হাছন মিয়ার সাথে রেহানার বিয়ে হয়ে গেলো- স্কুলে যেদিন ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হলো, সেদিনই। হাছন মিয়া রেহানাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে।
হাছন মিয়ার বয়স রেহানার বাবার বয়সের চেয়ে বছর পাঁচেক কম হবে বৈকি। হাডুডু খেলার বয়সে রেহানার বাবা হাছন মিয়ার সাথে কত হাডুডু খেলেছে! আঠার-উনিশ বছর বয়সের কালে রেহানার বাবা বিয়ে করেছিল, হাছন মিয়া বিদেশে চাকরি করতে করতে এই বয়সে পৌঁছলো।
দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মাতবর বাড়ির বড় বউ এখন রেহানা। অবশ্য কলমিরও মাতবর বাড়িতেই বিয়ে হয়েছে, তবে মাতবর বাড়ির কোনো ছেলের সাথে নয়, ঐ বাড়ির এক রাখালের সাথে। কদম আলি ওর জামাইর নাম। কদম আলি বারো মাস মাতবর বাড়িতে থাকে। ধান-পাট কাটার মৌসুম এলে কাজের চাপ বেড়ে যায়। মাতবর-গিন্নির কথামতো কদম আলি তার বউকেও মাতবর বাড়িতে নিয়ে আসে কাজের জন্য।
প্রথম-প্রথম কলমির খুব লজ্জা হতো, প্রিয় সখীর স্বামীর বাড়িতে চাকরানির কাজ! রেহানাও বোধ হয় ওর সংকোচ বোধের জিনিসটা ধরতে পেরেছিল। তাই নিজে থেকেই বান্ধবীর সাথে খুব সহজভাবে মিশতো। মাঝে মাঝে ঘরের কেবিনে ডেকে নিয়ে গল্প করতো। এখন আর আগের মতো টান নেই। কলমিরও গা-সওয়া হয়ে গেছে। রেহানার মেজাজে কেমন একটু মাতবর-গিন্নির ভাব চলে এসেছে, দেমাগী ভাব। কলমিকে আদেশের সুরে কাজকর্মের ফরমায়েশ দিয়ে থাকে।
কষ্টের সংসারে রেহানার সুখ দেখে কলমির মাঝে মাঝে কান্না পায়, মাঝে মাঝে হিংসা হয়, মাঝে মাঝে আবার ভাগ্যকে গালিও দেয়- ওরও তো ওরকম একটা সুখের সংসার হতে পারতো।
৪
পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে রিয়ার। এত সুন্দর ফ্লাটবাড়ি! এত সুন্দর খাট! সে দৌড়ে ছুটে চলে ড্রয়িং রুমে। কিচেনে যায়। বাথরুমের শাওয়ার কাভার, বাথটাব- আহ, সবকিছুতে শিল্পের ছোঁয়া- রিয়ার কী যে ভালো লাগছে! কী যে ভালো লাগছে!
কোথা থেকে চিলের মতো উড়ে এসে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয় রুশো। তারপর বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। তামাম পৃথিবীতে সুনামি বয়ে যায়।
নিথর শরীরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রিয়া। পাশে বিভোরে ঘুমোয় রুদ্র। এ আগুনে সবকিছু জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়- সোনার পালঙ্ক, তকতকে মেঝে, ড্রয়িংরুম- সবকিছুতে যেন বিষ মাখানো। কীভাবে, কতদিন এ গনগনে শরীর টেনে নেবে জ্বলন্ত তসলিমা!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৩৬