সূচনা
এ পর্বের শুরুতেই ছন্দ সম্পর্কে কিছু সাধারণ আলোচনা করছি, যাতে পর্বের শেষের দিকে আলোচিত কবিতাগুলোর ছন্দ বুঝতে পাঠকের সুবিধা হয়।
কবি আবদুল কাদির লিখেছেন, 'শব্দের সুমিত ও সুনিমিত বিন্যাসকে বলা হয় ছন্দ।' তিনি তাঁর ছন্দ সমীক্ষণ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, 'কবি তাঁর অন্তরের স্বতোৎসারিত আনন্দের প্রেরণাতেই কাব্য রচনা করেন। ছন্দশাস্ত্রীর কাজ হচ্ছে সেই কাব্যের রূপ নির্মাণে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বা প্রেরণা দিয়েছে যে-সকল নিয়ম, সেগুলি আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ করে তাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ। একটা ভাষায় কবিতা যখন সুগঠিত রস-রূপ লাভ করে, তখনই তার গঠনতত্ত্ব আবিষ্কারের সময় আসে।' এ-কথা বলার অর্থ এই যে, কবিতা লিখবার আগেই কবিকে ছন্দশিক্ষা লাভ করতে হবে তা অপরিহার্য নয়। এমনকি ছন্দ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না রেখেও পরিপূর্ণ ও সার্থক কবিতা রচনা সম্ভব, যেমন আদিকালে লেখা হতো। কবিগণ কবিতা লিখবার কালে নিজের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে ছন্দ সৃষ্টির কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলেছেন, ছন্দ সমীক্ষকের কাজ হলো সেই নিয়মগুলো সূত্রস্থ করা।
যদিও বলেছি যে, কবিতা লিখবার জন্য ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা কবির জন্য অপরিহার্য নয়, তবু ছন্দ সমীক্ষা অধ্যয়নে দেখা যায় যে, এ যাবত ছন্দের উপর যতো গবেষণা ও অধ্যয়ন হয়েছে, তা স্বয়ং রথী-মহারথী কবিদের দ্বারাই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, আবদুল কাদির- এঁরা সবাই ছন্দের উপর করেছেন বিস্তর গবেষণা। তাঁরা যেমন পূর্বসূরি কবিগণের কবিতা ব্যবচ্ছেদ পূর্বক ছন্দ নিরীক্ষা করেছেন, স্বরচিত কবিতায়ও সার্থক ভাবে ছন্দ প্রয়োগ হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও অনেক গবেষণা করেছেন, এবং অপরাপর কবিবৃন্দের সাথে তা শেয়ার করেছেন; এর ফলে সনাতনী ছন্দের বাইরে নব নব ছন্দের সৃষ্টি হয়েছে, যে ধারা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। আমার মনে হয়, একজন কবিই হতে পারেন একজন নিপুণ ও দক্ষ ছন্দশাস্ত্রী। ছন্দশাস্ত্রী হবার সাধ না থাকুক, অন্তত নিখুঁত ছন্দের একটা কবিতা লিখতে হলে ছন্দ সম্পর্কে আমাদের অন্তত প্রাথমিক ধারণা থাকা উচিত। এখানে সেই প্রাথমিক জ্ঞানের উপরই আলোকপাত করা হচ্ছে।
মনে রাখা দরকার যে, ছন্দ সমীক্ষা খুব জটিল বিষয়। অনেক ক্ষেত্রেই ছন্দবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। আমি এখানে মতবিভেদ সমূহ বাদ দিয়ে সর্বসম্মত বিষয় সমূহের মধ্যে সীমাব্ধ থাকবার চেষ্টা করবো। আর বলে নিচ্ছি, এ সম্পর্কে আমার জ্ঞানও অতি সীমিত; ভুল চোখে পড়ামাত্র সূত্র সহ উল্লেখ করলে সংশোধন করে দেবো।
ছন্দের প্রকারভেদ
বাংলা কবিতার মূল ছন্দ ৩ প্রকার। যথা:
ক) অক্ষরবৃত্ত। পঙ্ক্তির অক্ষর গোনা হয় যে ছন্দ-প্রকরণে।
এতো টাকা নিলে বাবা দূরে দিলে বিয়ে।>>১৪ অক্ষর
এখন কেন কান্ছো বাবা গাম্ছা মুড়ি দিয়ে।।>>১৭ অক্ষর
খ) স্বরবৃত্ত। পঙ্ক্তির স্বর বা সিলেবল গোনা হয় যে ছন্দ-প্রকরণে।
এ । তো । টা । কা । নি । লে । বা । বা । দূ । রে । দি । লে । বি । য়ে ।>>১৪ স্বর
এ । খন । কে । ন । কান্ । ছো । বা । বা । গাম্ । ছা । মু । ড়ি । দি । য়ে ।।>>১৪ স্বর
গ) মাত্রাবৃত্ত। পঙ্ক্তির মাত্রা গোনা হয় যে ছন্দ-প্রকরণে।
এ । তো । টা । কা । নি । লে । বা । বা । দূ । রে । দি । লে । বি । য়ে ।>>১৪ মাত্রা
এ । খ । ন । কে । ন । কা । ন্ । ছো । বা । বা । গা । ম্ । ছা । মু । ড়ি । দি । য়ে ।।>>১৭ মাত্রা
এ ছাড়াও, উপরোক্ত ৩ ছন্দের সমন্বয়ে নিম্নোক্ত ৩ প্রকার নতুন ছন্দ গঠিত হয়:
ক) মাত্রাক্ষরবৃত্ত। মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত উভয় নিরীখে উত্তীর্ণ।
খ) স্বরমাত্রাবৃত্ত। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় নিরীখে উত্তীর্ণ।
গ) স্বরাক্ষরবৃত্ত। স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত উভয় নিরীখে উত্তীর্ণ।
উপরোক্ত প্রকারভেদ হলো ছন্দের প্রাথমিক পাঠ, যা জানা যে-কোনো কবির জন্য বাঞ্ছনীয়।
মাত্রা/স্বর/কলা
একটি ধ্বনির উচ্চারণে যে স্বল্পতম সময় লাগে, তার মূল্য এক মাত্রা। সকল স্বরান্ত বর্ণ বা মুক্তস্বর (Open Syllable) এক মাত্রা এবং হলন্ত অক্ষর বা বদ্ধস্বর (Closed Syllable) দুই মাত্রা।
উদাহরণ : স্বরান্ত বর্ণ বা মুক্তস্বর : প্রবেশিলা সভাতলে>প্র । বে। শি । লা । স । ভা । ত । লে । > ৮ মাত্রা
হলন্ত বা বদ্ধস্বর> চিত্রাঙ্গদা>'ত্রা' এবং 'ঙ্গ' ২ মাত্রা করে> চি । ত্ । রা । ঙ্ । গ । দা । > ৬ মাত্রা
বাংলা কবিতার ছন্দে স্বর (Syllable) বা মাত্রাকে (mora) একক বা কলারূপে গণ্য করা হয়। স্বরান্ত অক্ষর এক কলা। হলন্ত অক্ষর সংশ্লিষ্ট হয়ে এক কলা ও বিশ্লিষ্ট হয়ে দুই কলা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতায় শব্দের মধ্যস্থিত স্বর এবং শব্দের শেষ অবস্থিত মাত্রা হচ্ছে একক। স্বরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত স্বরকলা এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সর্বদা মাত্রাকলা হচ্ছে একক।
মাত্রাবৃত্তে যুগ্মধ্বনি সর্বদা দুই মাত্রা হয়।
স্বরবৃত্ত বাংলার আদি ছন্দ। কালক্রমে সংস্কৃতের প্রভাবে তা সংহত হয়ে অক্ষরবৃত্তে এবং সম্প্রসারিত হয়ে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সৃষ্টি করেছে। গ্রাম্য ছড়াগানে, ব্রত কথায়, মন্ত্রে, প্রবচনে, আদিম স্বরবৃত্তের চেহারা পরিলক্ষিত হয়।
জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে? এই পঙ্ক্তির বিভাজন দেখা যাক :
অক্ষর বিন্যাসে>>জ । ন্ম । ভূ । মি । র । ক্ষা । হে । তু । কে । ড । রে । ম । রি । তে =১৪ অক্ষর
স্বর বিন্যাসে>>জন্ । ম । ভূ । মি । রক্ । ষা । হে । তু । কে । ড । রে । ম । রি । তে =১৪ স্বর
মাত্রা বিন্যাসে>>জ ।ন্ । ম । ভূ । মি । র । ক্ । ষা । হে । তু । কে । ড । রে । ম । রি । তে =১৬ মাত্রা
উপরের পঙ্ক্তিটির মতো আরো কিছু পঙ্ক্তি দেখুন, যেগুলোতে কোনো বদ্ধ ধ্বনি নেই, ফলে ১৪টি অক্ষরই ১৪টি স্বর, বা উলটোভাবে ১৪টি স্বরই ১৪টি অক্ষর। এই রীতির নাম স্বরাক্ষরবৃত্ত।
ক) প্রবেশিলা সভাতলে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
খ) চিত্রবাঘিনীরে যথা রোধে কিরাতিনী।
গ) কৌটা খুলি রক্ষোবধূ যত্নে দিলা ফোঁটা।
ঘ) গম্ভীরে অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী।
ঙ) শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে টঙ্কারিলা ধনু।
চ) পুরিল নিকুঞ্জপুঞ্জ প্রভাতী সঙ্গীতে।
সমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত
এ ধরনের ছন্দে কবিতার পঙ্ক্তিগুলো অসমান থাকে, কিন্তু পঙ্ক্তিগুলো অন্ত্যমিল সম্পন্ন হয়। একটা গদ্য পড়ার মতো করে এ কবিতা আবৃত্তি করা যায় বা করতে হয়।
১
'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্যই উধাও।'
২
কহে গদা সহাস বদনে,
'করেছিনু যাত্রা আজি অতি শুভক্ষণে
আমরা দুজনে।'
৩
হে ভুবন,
আমি যতোক্ষণ
তোমারে না বেসেছিনু ভালো
ততোক্ষণ তব আলো
খুঁজে খুঁজে পাই নাই তার সব ধন।
ততোক্ষণ
নিখিল গগন
হাতে নিয়ে দীপ তার শূন্যে শূন্যে ছিল পথ চেয়ে।
৪
বৃষ্টিধারা শ্রাবণে ঝরে গগনে,
শীতল পবন বহে সঘনে,
কনক-বিজুরি নাচে রে, অশনি গর্জন করে।
নিষ্ঠুর অন্তর মম প্রিয়তম নাই ঘরে।।
অধ্যাপক শ্রীশঙ্ঘ ঘোষ শেষোক্তটিকে বলেছেন 'বাংলা ফ্রি ভার্সের যথার্থ উদাহরণ।' কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর মতে ফ্রি-ভার্স কোনো মুক্তক বা গদ্যছন্দ নয়, ফ্রি-ভার্স হলো একই কবিতায় একাধিক রকম ছন্দের প্রয়োগ, যাতে গদ্য ও পদ্যের মিশেল থাকে। এখানে আমার নিজের লেখা একটি কবিতার উদাহরণ দেয়া গেলো।
মূল পর্ব এখান থেকে শুরু
সনেটে পঙ্ক্তির সংখ্যা
বাংলা ভাষার সনেট সাধারণত ১৪ বা ১৮ অক্ষরের পঙ্ক্তিতে রচিত। মধুসূদন দত্ত, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, প্রমথ চৌধুরী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ ও প্রমথনাথ বিশীর সব সনেট ১৪ অক্ষরে লেখা। দেবেন্দ্রনাথ সেন ১৪ বা ১৮ অক্ষরে তাঁর প্রায় সব সনেট লিখেছেন। নিচে তাঁর ১৬ অক্ষরে লেখা একটি সনেট উদ্ধৃত হলো।
ভালোবাসার জয়
বৃথা ও ঘৃণার হাসি, বৃথা ও কথার ছল;
রবির কিরণ আমি, তুমি মালঞ্চের ফুল!
বৃথা তব উপহাস, শাণিত কথার শূল;
রূপের পতঙ্গ তুমি, আমি শ্যাম দুর্বাদল!
জানো না কি রবিরশ্মি যেই পুষ্পে গিয়ে পড়ে,
সেই পুষ্প হয়ে যায় কিরণে কিরণময়?
জানো না কি প্রজাপতি যেই পুষ্পে বসে উড়ে,
আহরিয়া তারি বর্ণ হয় গো সুবর্ণময়?
আমার সোহাগকুঞ্জে বসিয়া বসিয়া তুমি
ভুলে গিয়ে ঘৃণা হাসি, কণ্ঠমণি হবে, ধনি!
জানো না কি, ভালোবাসা ধরার পরশমণি
ঘৃণার রাজত্ব হবে দিবানিশি চুমি চুমি?
আজি তুমি মন-সাধে হেসে লও ঘৃণাহাসি,
কালি এ বক্ষেতে শোবে আপনি আপনি আসি।
(গোলাপগুচ্ছ)
১২ অক্ষরের পঙ্ক্তি নির্মাণের পরীক্ষা করেন অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯)। তাঁর 'ডুবছে তপন' সনেটটি দেখুন।
ডুবেছে তপন, আলোক-জীবন;
ধরণীর বুক ছাইছে আঁধার!
ফিরিছে পথিক, মলিন বদন;
জগতের কাজ নাহি যেন আর!
যে আলোক গেলো, গেলো একেবারে?
রহিল না প্রেম, গেলো কি সমূলে?
ধীরে আসে বায়ু, মুছে শ্রম-ধারে,
যে ভুলে- যেন গো একেবারে ভুলে!
ডুবেছে তপন, প্রত্যক্ষের আলো,
দলে দলে তারা ফুটিছে আবার।
কোটি চক্ষু মেলি ঘেরে চারি ধার,
সমষ্টির যেন ভগ্নকণা-জাল!
যে আছিস এক, হলো শত শত!
কণায় কণায় প্রেমের জগত!
(ভুল)
নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯৮০৯) তাঁর 'অবকাশরঞ্জিনী' কাব্যে ১২ অক্ষরে লেখা 'প্রতিকৃতি' ও 'কবির উপহার' শীর্ষক দুটি কবিতাকে সনেট হিসাবে উল্লেখ করেন। 'প্রতিকৃতি' কবিতাটি দেখুন।
পূর্ণচন্দ্র-নিভ ফুল্লচন্দ্র মুখে,
মহিমার হাসি ভাসিছে তায়;
পতি-গরবেতে গরবিত বুকে,
গরব-তরঙ্গ খেলিয়া যায়।
পূর্ণ কলেবর, চিত্র পূর্ণতার,
পবিত্র মাধুরী, কোমলতাময়;
পূর্ণ সিন্ধু-জলে, উচ্ছ্বাস-আঁধার,
ফুটন্ত জ্যোৎস্না হতেছে লয়।
পতি-ভালোবাসা অঙ্গে অঙ্গে মাখা
পত-ভালোবাসা হৃদয় ভরে;
পতি-ভালোবাসা নাহি যায় রাখা,
হৃদয় ভরিয়া উথলি পড়ে।
সোনার পুতুলে অঙ্গ সুশোভন,
শিরে পতি শিব চন্দ্রের মতন।।
এ কবিতাটির ভাব-বিভাগ ই মিল-বিন্যাসে শেক্সপীয়রীয় পদ্ধতির লক্ষ্যগোচর হলেও আকৃতি ও প্রকৃতিতে এটি সনেটকল্প নয়। এর পঙ্ক্তিগুলো অসমান। ৯টি পঙ্ক্তি ১২ অক্ষর, এবং ৫টি পঙ্ক্তি ১১ অক্ষরযুক্ত। বলা বাহুল্য যে, পঙ্ক্তিদৈর্ঘ্যের অসমতা সনেটে অচল।
১০ অক্ষরযুক্ত পঙ্ক্তিতে সনেট রচনার চেষ্টা করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও বুদ্ধদেব বসু। সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র্যের 'কামাল' কবিতাটি ১০ অক্ষরের পঙ্ক্তিযুক্ত।
প্রাণে যার জ্বলে অনির্বাণ
বহ্নিশিখা, সেই শুধু পারে
অগ্নিমন্ত্র শিখাতে সবারে;
প্রাণ দিতে পারে প্রাণবান।
তাদেরে যাহারা মুহ্যমান
দাসত্বের শৃংখলের ভারে।
নির্বীর্যের তরে এ-সংসারে
বীরহস্তে মুক্তির কৃপাণ।
তুরস্কের নব জন্মদাতা
বজ্রপাণি বীরেন্দ্র কামাল।
তুমি আর নাহি এ জগতে।
তোমার আসন রবে পাতা
নিখিলের মর্মে চিরকাল;
ধর্মযোদ্ধা অমর মরতে।।
রবীন্দ্রনাথ ২০ অক্ষরবিশিষ্ট পঙ্ক্তি যোগে লিখেছেন 'যৌবন-স্বপ্ন', 'ক্ষণিক মিলন' ও 'সন্ধ্যার বিদায়' শিরোনামযুক্ত সনেট।
ক্ষণিক মিলন
আকাশের দুই দিক হতে দুইখানি মেঘ এল ভেসে ,
দুইখানি দিশাহারা মেঘ — কে জানে এসেছে কোথা হতে!
সহসা থামিল থমকিয়া আকাশের মাঝখানে এসে।
দোঁহাপানে চাহিল দুজনে চতুর্থীর চাঁদের আলোতে।
ক্ষীণালোকে বুঝি মনে পড়ে দুই অচেনার চেনাশোনা ,
মনে পড়ে কোন্ ছায়া দ্বীপে , কোন্ কুহেলিকা - ঘের দেশে ,
কোন্ সন্ধ্যাসাগরের কূলে দুজনের ছিল আনাগোনা!
মেলে দোঁহে তবুও মেলে না , তিলেক বিরহ রহে মাঝে —
চেনা বলে মিলিবারে চায় , অচেনা বলিয়া মরে লাজে।
মিলনের বাসনার মাঝে আধখানি চাঁদের বিকাশ —
দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুয়ি , মাঝে যেন শরমের হাস!
দুখানি অলস আঁখিপাতা , মাঝে সুখস্বপন - আভাস!
দোঁহার পরশ লয়ে দোঁহে ভেসে গেল , কহিল না কথা —
বলে গেল সন্ধ্যার কাহিনী , লয়ে গেল উষার বারতা।
সন্ধ্যার বিদায়
সন্ধ্যা যায় , সন্ধ্যা ফিরে চায় , শিথিল কবরী পড়ে খুলে—
যেতে যেতে কনক - আঁচল বেধে যায় বকুলকাননে,
চরণের পরশরাঙিমা রেখে যায় যমুনার কূলে—
নীরবে - বিদায় - চাওয়া চোখে , গ্রন্থি - বাঁধা রক্তিম দুকূলে
আঁধারের ম্লানবধূ যায় বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল নয়নে।
যমুনা কাঁদিতে চাহে বুঝি , কেন রে কাঁদে না কণ্ঠ তুলে—
বিস্ফারিত হৃদয় বহিয়া চলে যায় আপনার মনে।
মাঝে মাঝে ঝাউবন হতে গভীর নিশ্বাস ফেলে ধরা।
সপ্ত ঋষি দাঁড়াইল আসি নন্দনের সুরতরুমূলে—
চেয়ে থাকে পশ্চিমের পথে , ভুলে যায় আশীর্বাদ করা।
নিশীথিনী রহিল জাগিয়া বদন ঢাকিয়া এলোচুলে।
কেহ আর কহিল না কথা , একটিও বহিল না শ্বাস—
আপনার সমাধি - মাঝারে নিরাশা নীরবে করে বাস।
যৌবন-স্বপ্ন
আমার যৌবনস্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর পরশের মতো।
পরানে পুলক বিকাশিয়া বহে কেন দক্ষিণা বাতাস
যেথা ছিল যত বিরহিণী সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস!
বসন্তের কুসুমকাননে গোলাপের আঁখি কেন নত?
জগতের যত লাজময়ী যেন মোর আঁখির সকাশ?
কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে , মরমের শরমে বিব্রত!
প্রতি নিশি ঘুমাই যখন পাশে এসে বসে যেন কেহ,
সচকিত স্বপনের মতো জাগরণে পলায় সলাজে।
যেন কার আঁচলের বায় উষার পরশি যায় দেহ,
শত নূপুরের রুনুঝুনু বনে যেন গুঞ্জরিয়া বাজে।
মদির প্রাণের ব্যাকুলতা ফুটে ফুটে বকুলমুকুলে;
কে আমারে করেছে পাগল — শূন্যে কেন চাই আঁখি তুলে!
যেন কোন্ উর্বশীর আঁখি চেয়ে আছে আকাশের মাঝে!
বুদ্ধদেব বসুর 'সুদূরিকা', শামসুল হুদার 'একটি স্বপ্ন' ও 'ভারমুক্ত' এবং আ. ন. ম. বজলুর রশীদের 'আষাঢ়' ও 'ঊর্ণনাভ' ২২ অক্ষরের সনেট। বুদ্ধদেব বসুর 'অসূর্যস্পর্শ্যা' ও 'আর কিছু নাহি সাধ' এবং জীবনানন্দ দাশের 'রূপশী বাংলা' ২৬ অক্ষরের সনেট। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১০, ১১, ১২, ১৬, ২০, ২২ বা ২৬ অক্ষরের পঙ্ক্তিযুক্ত সনেটের ঘনপিনদ্ধ রূপমূর্তি ও সংগীত-সুষমা সৃষ্টির মোটেই অনুকূল নয়।
এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'চতুর্দশপদী কবিতা' প্রবন্ধে বলেছেন :
পয়ারের অক্ষর সংখ্যা ১৪। যতোই না নব নব ছন্দ আবিষ্কৃত হোক, বাঙালির মনে সেই সনাতন পয়ার যে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে তা কখনো হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না। ... কিন্তু সনেট রচনার এ কতোখানি উপযোগী তা ভাববার বিষয়। ১৪ অক্ষরের ১৪টি লাইনে কতোটুকু কথাই বা বলা যায়?... আমার মনে হয়, ১৮ অক্ষরের ছন্দই বাংলায় সনেট রচনার সবচেয়ে উপযোগী।
অন্যপক্ষে মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন :
সনেটে ১৪টি এক ছন্দের পঙ্ক্তি থাকে। ইংরেজিতে Iambic Pentameter ছন্দই সনেটের ছন্দ; বাংলাতেও টাহার অনুরুপ ১৪ অক্ষরের পয়ারই ছন্দের সংগীতগুণ বৃদ্ধি পায়, ভাব একটু ছাড়া পায়- কিন্তু সনেটের সংহতিগুণ ক্ষুণ্ণ হয়। বাংলায় ঐ পয়ার-পঙ্ক্তিই যে সনেটের বিশেষ উপযোগী, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু দীর্ঘ পয়ারেও (১৮ অক্ষরে) সনেটের ছন্দধ্বনি একটু গভীর ও গম্ভীর হইবার অবকাশ পায় বলিয়া, তেমন ছন্দও বাংলায় গ্রাহ্য হইয়াছে। মধুসূদন বাংলা সনেটের জন্য ১৪-অক্ষরই নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন, এবং কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন এই ১৪ অক্ষরেই সনেটের কাব্যরসকে পূর্ণরূপ দান করিয়া প্রমাণ করিয়াচেন যে, বাংলা সনেটের পঙ্ক্তি উহা অপেক্ষা দীর্ঘতর না হইলেও চলে।
কবি আবদুল কাদির উপরোক্ত প্রবন্ধে লিখেছেন :
এ-কথা সত্য যে, দেবেন্দ্রনাথ সেনের ১৪-অক্ষরের কোনো কোনো সনেটে কাব্যরস যে-রূপ আদ্যান্তসঞ্চারী হয়েছে, তাঁর ১৮-অক্ষরের সনেটগুলিতে তার ন্যূনতা সুপরিস্ফুট। এই তারতম্যের কারণ এই যে, পয়ারের পঙ্ক্তিতে তদনুরূপ পূর্ণ গতি সঞ্চারের জন্য প্রয়োজন সযত্ন পরিচর্যার। দেবেন্দ্রনাথের অলস কবি-প্রকৃতিতে সেই যত্নপরতার অভাব ছিল বলে তাঁর ১৮-অক্ষরের সনেটগুলি ততোখানি নিটোল ও রসসমৃদ্ধ হয় নি। প্রসঙ্গত তুলনীয় যে, সুদক্ষ লিপিকুশলতার গুণে মোহিতলাল মজুমদারের 'দেবেন্দ্র-মঙ্গল'-এর ১৪ অক্ষরের ১৬টি সনেট অপেক্ষা তাঁর 'ছন্দ-চতুর্দশী'র ১৮-অক্ষরের ৪৪টি সনেট রূপ-সৌকর্যে ও রস-সংকেতে উৎকৃষ্টতর। মধুসূদন দত্ত, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, দেবেন্দ্রনাথ সেন ও অক্ষয়কুমার বড়াল ১৪-অক্ষরের সনেটের ভাব-সংযম ও ছন্দ-প্রবাহ পূর্ণরূপে প্রকটিত করে প্রশ্নাতীতরূপে এর উপযোগিতা প্রতিপন্ন করেছেন, আর মোহিতলাল মজুমদার ১৮-অক্ষরে অনেক অনবদ্য সনেট সংরচন করে এই আদর্শের দিকে আগ্রহ বৃদ্ধি করেছেন। ফলে সাম্প্রতিককালে ১৪-অক্ষরের অপেক্ষা ১৮-অক্ষরে সনেট রচিত হচ্ছে বেশি। তবে তার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি শুধু কবির দৈবী প্রতিভার উপর নির্ভরশীল নয়, ১৮-অক্ষরে সনেটের গাঢ়বদ্ধতা ও ছন্দধ্বনি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অধিকন্তু আবশ্যক হয় শিল্পীর অধিকতর দায়িত্ব ও নিষ্ঠা; অন্যথা একটি এককেন্দ্রিক ভাব বা ভাবনা অখণ্ড ঐকতানময় সুর-সৌষম্য ও ভাস্কর্য-বিনিন্দিত সুমসৃণ বাণী-দেহ লাভ করে না।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'রূপসী বাংলা'র বেশির ভাগ কবিতা লিখেছেন ২২ অক্ষরের পঙ্ক্তিতে, এবং অনেক কবিতা লিখেছেন ২৬ অক্ষরের পঙ্ক্তি যোগে। কোথাও কোথাও সনেটীয় রূপকল্প বজায় রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু একই কবিতায় অক্ষরের তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। অনেক সনেটে আবার সনেটীয় ৮+৬ পঙ্ক্তির বিভাজন না রেখে মাত্র একটি স্তবকে কবিতা শেষ করেছেন। কবি আবদুল কাদির তাঁর 'ছন্দ সমীক্ষণ পুস্তকে' 'বাংলা সনেটের রূপ ও রীতি' প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশের এসব কবিতাকে 'সনেটের অযত্নখচিত বিস্রস্ত রূপ' হিসাবে উল্লেখ করেছেন। নিচে এরূপ ২২ ও ২৬ অক্ষরের পঙ্ক্তিযুক্ত কিছু সনেট সন্নিবেশ করা হলো।
বাংলার মুখ আমি
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম- বট- কাঁঠালের- হিজলের অশথের করে আছে চুপ;
ফণিমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে!
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল- বট- তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিল : বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বথ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল- একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।
যতদিন বেঁচে আছি
যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে- আরো নীল- আরো নীল হয়ে
আমি যে দেখিতে চাই;- সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে
কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে;
আমি যে দেখিতে চাই,- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে;
পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে
ধানসিঁড়িটির পথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে,
যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,
যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনো এক সুন্দরীর শব
জন্দন চিতায় চড়ে- আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা;
যেখানে শুকায় পদ্ম- বহু দিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব;
যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিককুমার
কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর !
মানুষের ব্যথা আমি : ২৬ অক্ষর
মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে — হাসির আস্বাদ
পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে কড়ির মতন শাদা মেঘের পাহাড়ে
সূর্যের রাঙা ঘোড়া; পক্ষিরাজের মতো কমলা রঙের পাখা ঝাড়ে
রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ
উঠেছে আনন্দে জেগে — নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ
চলে গেছে কলরবে; — দেখেছি সবুজ ঘাস — যত দূর চোখ যেতে পারে;
ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল, — পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে
ঢেকে আছে; — দেখিয়াছি বাসমতী, কাশবন আকাঙ্খার রক্ত, অপরাধ
মুছায়ে দিতেছে যেন বার বার কোন এক রহস্যের কুয়াশার থেকে
যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে
রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে
আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু — আমাদের বিস্মিত নীরব
রেখে দেয় — পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আচঁড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে
তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।
আমাদের রূঢ় কথা : ২৬ অক্ষর
আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ;
তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে
ডুবে যাবে? কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না সরে
পিরামিড্ বেবিলন শেষ হল — ঝরে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস;
তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা কোনোদিন হল না প্রকাশ:
যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে,
কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে
নতুন স্পন্দন পায় নতুন আগ্রহে গন্ধে ভরে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস;
তখন আমরা ওই নক্ষত্রের দিকে চাই — মনে হয় সব অস্পষ্টতা
ধীরে ধীরে ঝরিতেছে, — যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে,
যেই শানি — মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে — কয় নাকো কথা,
যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে,
আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ — অন্ধ মৃত হিম,---------২২ অক্ষর
একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম।
বাতাসে ধানের শব্দ : ২৬ অক্ষর
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে;
সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন
রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন;
ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে
মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে,
নির্জন আমের ডালে দুলে যায় — দুলে যায় — বাতাসের সাথে বহুক্ষণ,
শুধু কথা, গান নয় — নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন
বুঝিয়াছি; শুপুরীর সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে নড়ে,
দিনরাত কথা নয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব
ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী মরে গেছে — দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে
তবু ওই পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসে
আম নিম জামরুলে; প্রসন্ন প্রাণের স্রোত — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই কিছু,
ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু,
চেয়ে দেখি ঘুম নাই — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ- মাখা ঘাসে।
মধুসূদন দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দাস, প্রমথ চৌধুরী, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ- তাঁরা সবাই সনেটে একমাত্র অক্ষরবৃত্ত রীতির প্রয়োগ করেন। ফলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সনেট রচনার ঐতিহ্যই বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই ঐতিহ্য ভঙ্গ করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রথম সনেট লেখেন তাঁর 'ইচ্ছা-মুক্তি' ('ম্যাকসুইনীর মৃত্যু উপলক্ষে' ১৩২৭ বঙ্গাব্দে 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত), যা ১৮-সিলেবলের পঙ্ক্তিতে শেক্ষপীয়রীয় ছাঁচে নির্মিত।
কে তাহারে বন্দি করে? ফন্দি এঁটে বাঁধবে কে সিন্ধুকে?
মুক্তপুরুষ মুক্তি তাহার হাতের মুঠায় মুক্তা হয়ে আছে;
'মুক্ত হবোই!' এ-কথা যে বলতে পারে জোর করে বুক ঠুকে-
পাষাণ-কারা তাসের গৃহ, লোহার শিকল ব্যর্থ যে তার কাছে।
(বেলাশেষের গান)
উপরেরটি ৪+৪+৪+৪+২ সিলেবলের পঙ্ক্তি। নিচে দেখুন কুমুদরঞ্জন মল্লিক রচিত 'বলিদান' শীর্ষক ৪+৪+২ সিলেবলের একটি কবিতা।
মা গো, আমার গা মুছিয়ে দিয়ে
তাড়াতাড়ি পরাও কাপড় খান,
আজকে আমি ভুলুর সাথে গিয়ে
আসবো দেখে কেমন বলিদান।
দেখে 'বলি' কেমন আমোদ হবে।
নাচবে সবাই, বললে ভুলু মোরে,
'মা' 'মা' বলে ডাকবে যখন সবে
বাজাবে ঢোল খাজ্জি-মাঝো করে।
শেষে যখন ফিরলো খোকা বাড়ি,
মুখটি মলিন, চোখ যে ছলছল,
জননী তার শুধায় তাড়াতাড়ি-
কেমন 'বলি' দেখলি বাছা বল?
কেঁদে খোকা বললে : কোথায় বলি?
শুধু আহা কাটছে ছাগলগুলি।
এই চটুল লাস্যময় লোকচ্ছন্দে সনেটের গম্ভীর গাঢ়পিনদ্ধ ভাবমূর্তি নির্মাণ দুরূহ। আ. ন. ম. বজলুর রশীদের 'এক ঝাঁক পাখি' কাব্যের 'একটি নিভৃতি' ও 'প্রাচীন আঙ্গিকে' ৪+৪+৪+২=১৪ সিলেবলের পঙ্ক্তিতে রচিত; তাতেও নাচুনে ছন্দের বিশেষত্বই প্রবলতর। তবে স্বরবৃত্তে সনেট প্রণয়নের সাধনা এ যাবৎ বিশেষ হয় নি, সুতরাং এর সম্ভাবনা এখনো প্রতিভাবানদের পরীক্ষাসাপেক্ষ।
বাংলা ভাষার আদি ছন্দ স্বরবৃত্ত, এবং আধুনিক ছন্দ মাতাবৃত্ত। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রথম সনেট লেখেন কবি গোলাম মোস্তফা। ৬+৬+২=১৪ মাত্রার পঙ্ক্তিতে রচিত তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ' কবিতাটি দেখুন :
আকাশে ভুবনে বসেছে যাদুর মেলা,
নিতি নব নব খেলিতেছে যাদুকর;
রবি শশী তারা ঝঞ্ঝা অশনি-খেলা,
লুকোচুরি কতো চলেছে নিরন্তর!
আমরা বসিয়া দেখিতেছি সারা বেলা,
কিছু বুঝি নাকো- বিস্মিত অন্তর!
হাসা-কাঁদা আর ভাঙা-গড়া হেলাফেলা
সকলেরি মাঝে ভরা যাদু-মন্তর!
কবি! তুমি সেই মায়াবীর ছোটো ছেলে,
পিতার ঘরের অনেক খবর জানো;
কেমন করিয়া কীসে কোন্ খেলা খেলে,
তুমি সেই বাণী গোপনে বহিয়া আনো।
দর্শক মোরা, কিছু জানাশোনা নাই;
যাহা বলো, শুনি অবাক হইয়া তাই।
মোতাহার হোসেন চৌধুরীর 'উতলা রজনী' ৬+৬+৫=১৭ মাত্রার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'কাব্যজিজ্ঞাসা-৫' ৬+৬+৩=১৫ মাত্রার এবং মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর 'জ্যোৎস্নারাতে' ও আ. ন. ম. বজলুর রশীদের 'আত্মকৃতি' ৬+৬+৬+২=২০ মাত্রার সনেট। নিচে দেখুন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অবিনশ্বর' কবিতাটি, যা হলো ৫+৫+৪=১৪ মাত্রার সনেট।
বরষা পুন এসেছে ঘন গৌরবে:
কুহরি কেকা নাচিছে মেলি পুচ্ছটি,
মুক্ত মন সিক্ত ক্ষিতি সৌরভে,
দিকের সীমা মুছিয়া দিছে কুজ্ঝটি।
যুগান্তরে কদম পুলকাঞ্চিত
আবার যবে খুঁজিয়া পাবে ধন্যতা,
আমারি ভাগে সময়-নেমী লাঞ্ছিত
পথের রজে ঘটিবে শুধু অন্যথা।
জলদ-যানে বৈতরিণী উত্তরে
যক্ষ যথা বিহরে আজো অনঙ্গে
তেমনি আমি ভ্রমিব সখী সন্তরে
নবোত্থিত মানস-রস-তরঙ্গে,
আমারো বাণী বাজিবে তব অন্তরে
বায়ুর গানে, মেঘের মৃদু মৃদঙ্গে।
নিচে দেখুন ১৮ মাত্রার দীর্ঘপয়ার-বন্ধে রচিত অজিতকুমার দত্তের 'রাজা' শীর্ষক সনেটটি।
জরি আর পুঁতি গাঁথা জমকালো চোগা-চাপকানে
জাঁদরেল চেহারার পার্ট করে যাত্রার রাজা:
উষ্ণীব আভরণ সবি আছে আয়োজন যা যা,
রাজসিক হাবভাব, রাজকীয় চাল সবি জানে।
ভোর হলে এই সাজ ফিরে যাবে ভাড়ার দোকানে;
ঘরে আছে হেঁটো ধূতি, কড়া সাজা দু'ছিলিম গাঁজা,
হুকুমের জরু আছে, আছে তাড়ি আর তেলে ভাজা,-
আরেক রাজার পার্ট- ভাষাটা তফাৎ, একই মানে;
কিছু মেতে বীররসে, কিছু কিছু করুণ রসের
বিগলিত অভিনয়ে আসর-বাসর করে মাত,
জীবনের পালাগানে মেডেল-ইনাম নেয় জিতে,
কখনো নিজেরে ঢাকে নেশা দিয়ে, কখনো জরিতে,
যতো মিছে অভিনয় ততো তার পাবার বরাত,
কেননা সে জেনে গেছে সিধে পথ দেশের-দশের।।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনূদিত কবিতা 'প্রাচীন প্রেম'' মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত সনেট। নিচে দেখুন।
প্রবীণ বয়সে বসি, পার্শ্বে উনান,
সূতা পাকইবে যবে মোমবাতি জ্বালি,
গাহিবে এ-কথা : 'কবি রচেছিল গান
এ শুভ্র কেশ যবে ছিল গো সোনালি।'
সে-কথা তোমার দাসী বিস্ময়ে শুনি
রজনির কাজ শেষে ঘুমাবে যখন,
কবি-নাম শুনি জেগে গা'বে গুনগুনি-
'ধন্য সে কবি তাঁর অমর লেখন।'
সেদিন কবরে রবে মোর এই কায়া
মধুর মরণে, শ্যাম তরু দিবে ছায়া।
দুঃঝে জরায় তুমি হবে নতদেহ
স্মরিয়া গর্ব তব আর প্রেম মোর।
হে মানিনী, কথা শোনো, মনে আনো স্নেহ-
আজকে জীবনফুলে গাঁথো মায়া-ডোর।
আবদুল কাদির তাঁর প্রবন্ধটি শেষ কথায় লিখেছেন :
মোদ্দা কথা, অক্ষরবৃত্তে যেমন ৮+৬ অক্ষরের পয়ার ও ৮+১০ অক্ষরের দীর্ঘপয়ার, তেমনই মাত্রাবৃত্তে ৮+৬ মাত্রার পয়ার ও ৮+১০ মাত্রার দীর্ঘপয়ার ভঙ্গিই সার্থক সনেট রচনার সর্বাধিক উপযোগী। কিন্তু মাত্রাবৃত্তের এই দুই ছন্দোবন্ধে সনেট রচনার চেষ্টা বেশি হয় নি। আমার ধারণা যে, সেরূপ চেষ্টা সুফলপ্রসূ হবে এবং তাতে বাংলা সনেটের সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের ব্লগীয় সনেটের হালচাল
'সনেট' লিখে সামহোয়্যারইন ব্লগে সার্চ দেয়ার পর অসংখ্য লিংক জড়ো হলো। তা থেকে কয়েকটি লিংক ওপেন করে যে সনেটগুলো পেয়েছি, এখন তার উপর নাতিদীর্ঘ একটু আলোচনা করছি।
সামহোয়্যারইন ব্লগে সেলিম তাহেরের লেখা ৩টি সনেট।
অন্তরেতে আর
ঘরেতে জনম মোর ঘরেতেই বাস------ক
তবুও কান্দিয়া মরি করি হাহুতাশ------ক
বিবি বাচ্চা সুখ আছে যেন আসমান-----খ
বাবা আছে মা আছে ফেরেস্তা সমান----খ
খোদারে স্মরণ করি নবীরে সালাম-----গ
ঈমানে বান্ধিয়া পড়ি নামাজ কালাম----গ
এ শরীলে দিছ বল, সবি তো তোমার--ঘ
হুকুমও সদা মানে অন্তর আমার।------ঘ
আচানক্ কি যে হইল ঠার না পাই-----ঙ
বেগানা নারীর রুপে অন্তর ডুবাই------ঙ
পিরীত অনলে পুড়ি হইয়াছি ছাই---------ঙ (অথবা চ)
কোন্ রাহে যাই খোদা কী করিগো সাঁই!--ঙ (অথবা চ)
কিতাবেতে বলে এক, অন্তরেতে আর-----ছ
কেন গড়িলে না মন করিয়া অসাড়?-------ছ
ঝাঁসির রাণী
কিচ্ছা নয় এ, তবু কিচ্ছার বাড়া ভাই
ঝাঁসির রাণীর কথা বলিবারে চাই
বলিয়া কাম কি, শুধু স্মরিবার তরে
চলেন বোলাই আজ ঝাঁসির রাণীরে।
ভাতার মরিল যবে রাজ্যপাট রেখে
অবলা সতী নারী চক্ষে আন্ধার দ্যাখে
বীরগর্ভা নয় রাণী নাইরে সন্তান
কে ধরে রাজ্যের হাল কে করে সন্ধান?
আ:হা রে তাজ্জব যাই- সে কালের কথা
অবলা নারীই দ্যাখো হয় দেশমাতা
শনৈ: শনৈ: রবে নাংগা তলোয়ার হাতে
ছুটে যায় রাণী দ্যাখো শত্রু মুন্ডপাতে;
কে বলে অবলা নারী? তার মুখে ছাই
ঝাঁসির রাণীরে কোটি সালাম জানাই।
লখিন্দরের প্রেম
"সোনার চান্দ রে মোর পিত্লা ঘুঘুরে
আসগো যতন করি বসাই আদরে
এই নাও গজমতি পীরিতির হার
সদা সুখে রবে তুমি হইয়া আমার-"
কতযে মনসা দেবী কাতর নয়নে
নিবেদন করে প্রেম লখিন্দর সনে
কিবা দেবী কিবা ধর্ম কি-ই বা ঈশ্বর
খারিজ করিয়া লখি কহিল সত্বর
'মনুষ্যে বসতি মোর এভুবনে বাস
ধরিত্রি নারীতে তাই মজাই বিশ্বাস'।
শুনিয়া চটিয়া উঠি দেবী করে পণ
বাসর রাতেই লখি হইবে নিধন
এ কিচ্ছার জানি শেষ হয় না এক্ষণে-
মনুষ্যে বসতি প্রেম, আমার বিধানে।
অর্থাৎ, তাঁর প্রতিটা কবিতার রূপকল্প ককখখগগঘঘঙঙচচছছ। বাংলায় আদিকালে যেভাবে ১৪ পঙ্ক্তিবিশিষ্ট কবিতা লেখা হতো এ সনেটগুলোর রূপকল্পও তদ্রূপ। পরবর্তীতে রূপকল্পের যে বিবর্তন আমরা লক্ষ করেছি, বিশেষ করে 'অনিয়মিত ধারা'র রূপকল্প, সেলিম তাহের তা থেকেও রূপকল্পের যথেচ্ছ অনিয়ম করেছেন। রূপকল্পে এ কবিতায় কোনো সনেটীয় রীতি অনুসরণ করা হয় নি।
নাবিক হ্যাডক সনেট নাম দিয়ে লিখেছেন 'কাঠপুতুল'।
লেখক বালক, ক্রমাগত শব্দ খোঁজে অব্যক্ত উনুনে----------ক
কাঠপুতুলপুরাণে লেখা ছিলো কিছু শবের ঠিকানা-----------খ
অথবা বিষণ্ণতার ছাপ রাখা কোনো সরল উদ্যানে-----------ক
পড়ে থাকে, দিনলিপি--রাজকুমারীর অনির্ণেয় ডানা।--------খ
অন্দরমহলে ইতস্তত কুড়িয়ে পাওয়া চিরকুটে---------------গ
চূর্ণবাদী সমু্দ্রের ঢেউ, লবণাক্ত চুলের আভাস।-------------ঘ
তাকে আপাত আশ্রয় করে, বৃষ্টিবন্দী স্মৃতিগুলো খুটে--------গ
জটিল জলের ঘোরে আঁকি, আমারই নিস্তব্ধ অভ্যাস।--------ঘ
মেঘপাখির পালকে ছাপা, অভিমানি পুনরাবৃত্তিতে-----------ঙ
পাবে ধূসরগন্ধী চাদর, এক দ্বিপ্রহরের নির্জন----------------চ
স্মরণীয় হবে আপাতত--কখনোবা সেই কথকতা শীতে,-----ঙ
ময়দানমুখী অভিনব ঘাসচাষে, বাচিক খনন।---------------চ
বোধিবৃক্ষে যাই পুর্নবার, আশেপাশে সময়ের তুলো----------ছ
তুলে আনি নির্জলা তরঙ্গ, ভবিষ্যৎ স্নায়বিক ধুলো।----------ছ
রূপকল্পে সনেটীয় রীতির প্রয়োগ পাওয়া গেলেও পঙ্ক্তিতে অসমান অক্ষর/স্বর/মাত্রার দরুণ এটি সনেট হিসেব গ্রহণযোগ্য নয়। কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে রয়েছে ২০ অক্ষর/২৩ মাত্রা/১৮ স্বর এবং দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ২০ অক্ষর/২০ মাত্রা/১৭ মাত্রা। সনেটে এ ধরনের অসমতা অচল।
প্রথম পর্ব
বাকি অংশ মন্তব্যের ঘরে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:০৫