প্রস্তাবনা
সনেট সম্পর্কে যাঁদের ধারণা সীমিত, অথচ সনেট লিখতে আগ্রহী, এ পোস্টটি তাঁদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। সনেটের উপর যাঁদের স্বচ্ছ ও সম্যক ধারণা রয়েছে, তাঁরা কমেন্টের মাধ্যমে বাড়তি জ্ঞান যোগ করে পোস্টকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
********
প্রথম পর্ব
********
সনেট কী
পাঠকগণ এ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন ধরে নিচ্ছি। সনেট হলো ১৪ পঙ্ক্তি বিশিষ্ট কবিতা। ইতালীয় Sonetto (sound-piece : ধ্বনিখণ্ড) হতে সনেট শব্দের উদ্ভব। ইতালীয় ভাষাতেই সনেটের প্রথম বিকাশ হয়েছিল। Dante Alighieri (১২৬৫-১৩২১ খ্রিঃ), Cino da Pistoia (১২৬৫-১৩৩৬), Francesco Petrarca (১৩০৪-১৩৭৪), Giovanni Boccacio (১৩১৩-১৩৭৫), Tarquato Tasso (১৫০৪-৯৫) প্রমুখ কবিগণ সনেটকে বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা দান করেন। ইতালীয় ভাষায় পেত্রার্কার হাতেই সনেট পূর্ণতা লাভ করে। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষায় সনেট রচিত হলে পেত্রার্কার রীতিই অনুসৃত হতে থাকে, যা থেকে কবিগণ নিজস্ব স্বকীয়তা দ্বারা নিজ নিজ রীতির উদ্ভাবন করত তাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
আদি ইতালীয় সনেটে দুটি ভাগ থাকে : প্রথম ভাগে ৮টি এবং দ্বিতীয় ভাগে ৬টি পঙ্ক্তি থাকে। প্রথম অংশটিকে অষ্টক এবং দ্বিতীয় অংশটিকে ষটক বলা হয়। সাধারণত অষ্টকটি দুটি এক-প্রকার মিলযুক্ত চৌপদিকা বা চতুষ্ক যোগে গঠিত। ষটকে দুই বা তিন প্রকার ভিন্নতর অন্ত্যমিল বিভিন্নভাবে ব্যবস্থিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো সনেটের ষটক একটি চতুষ্ক ও অন্তিমে একটি শ্লোক থাকতে পারে; কিংবা ষটকের শুরু হয় একটি সমিল শ্লোক এবং শেষ হয় একটি চৌপদিকা দ্বারা। ১৬ পঙ্ক্তির সনেটও লেখা হয়েছিল, তার সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং তা অসমাদৃত।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাভাষায় সনেটের প্রবর্তক ও সবচেয়ে সার্থক সনেটকবি। তিনি সনেটের প্রতিশব্দ করেন 'চতুর্দশপদী'। তিনি এ দ্বারা ১৪ পঙ্ক্তি বোঝাতেন, কিন্তু অনেক ছন্দবিজ্ঞানী এ-দ্বারা পঙ্ক্তির 'পদ' বা ছন্দ-পর্ব বুঝতেন। 'চতুর্দশপদী' কথাটা দ্ব্যর্থবোধক হওয়ায় সনেটের প্রতিশব্দ হিসেবে বহুল প্রচলিত হতে পারে নি।
সনেটের কনসেপ্ট বা ভাবপ্রবাহ
আদি ইতালীয় সনেটের অষ্টকে ও ষটকে যথাক্রমে ভাবের আবর্তন ও নিবর্তন বিধৃত হয়ে থাকে। অষ্টকে যে বক্তব্যের পরিবেশনা, ষটকে তার পরিপূরক রূপ অথবা বিপরীত দিক অঙ্কন করে পরিশেষে আবেগের উপসংহার করা হয়। খাঁটি সনেটের আদর্শ রূপবন্ধন সম্বন্ধে স্বনামখ্যাত ইংরেজ কবি ও সমালোচক Theodore Watts-Dunton (১৮৩২-১৯১৪) বলেছেন :
সমুদ্রতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতন যেমন তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন, সনেটের ভাবতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতনও সেরূপ তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন। ফেনিলোচ্ছল সাগরতরঙ্গ যেমন ক্রমশ স্ফীত ও বর্ধিতকায় হয়ে বেলাভূমির উপর উৎপতিত হয়, এবং নিমেষমাত্র স্থির থেকে আবার উজান বেগে সাগরগর্ভে অপসারিত হয়, সেরূপ ভাবের তরঙ্গ ছন্দোময়ী শব্দধারায় অষ্টকে উচ্ছলিত হয়ে বিপরীত আবর্তনে ষটকে অবসানপ্রাপ্ত হয়।
সনেটের গাঢ় ও গভীর ভাবপ্রবাহ অষ্টকে সর্বোচ্চ আয়তন ও বেগ লাভ করে এবং তার পরই ষটকে তা দ্রুত প্রশমিত হয়ে ক্রমে অতলে নিঃশেষিত হয়। যে দুটি চতুষ্ক-যোগে অষ্টক গঠিত হয়, তার প্রথমটিতে থাকে বক্তব্যের উদ্বোধন বা প্রস্তাবনা, দ্বিতীয়টিতে থাকে বিশ্লেষণ বা কারণ-নির্দেশ। যে-দুটি ত্রিপদিকা যোগে ষটক গঠিত হয়, তার প্রথম দিকে থাকে বিষয়ের পরিপূরক হিসাবে তার বিপরীত বা অপর দিকের বর্ণনা, দ্বিতীয়টিতে থাকে সমগ্র ভাববস্তুর একটি মীমাংসা কিংবা ভাবের প্রারম্ভিক উপলব্ধিতে উপসংহার। খাঁটি পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টকের দুটি চতুষ্ক যেমন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত নয়, ষটকের দুটি ত্রিপদিকাও তেমনি পূর্ণ ভাবযতি দ্বারা পরস্পর থেকে বিযুক্ত। কোনো দৈব মুহূর্তে স্বতস্ফূর্ত ভাবের প্রেরণায় কবিচিত্ত যখন রূপের দিব্য বিভায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে, সনেট সেই বিরল ভাবমুহূর্তের অসীমস্পর্শী আলোড়নের অখণ্ড বাণীমূর্তি, - সেই অপরূপ রসমূর্তিকে ভাস্কর্যপ্রতিম করে গড়ে তুলবার জন্যই এরূপ কঠিন নিয়মবন্ধনের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু সর্বত্র এমন কঠোর নিয়ম-নিগড় দৃষ্ট হয় না, - বহু সনেটে প্রথম চতুষ্কের প্রাচীর ডিঙিয়ে অথবা ত্রিপদিকার নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করে ভাবরাশি পরবর্তী পঙ্ক্তিতে প্রবহমান হতে দেখা যায়।
উইয়াটিয়ান সনেটের শ্লোকটিতে থাকে সমগ্র ভাবসামগ্রীর সারস্যতা বা সিদ্ধান্ত। শেক্সপীয়রীয় সনেটের প্রথম চতুষ্কে থাকে উপক্রমণিকা, দ্বিতীয় চতুষ্কে বিষয়ের বিশ্লেষণ, তৃতীয়টিতে সমগ্রভাবে মর্মরূপায়ণ এবং অন্তিম শ্লোকে সিদ্ধান্ত বা মন্তব্য। অন্তিম শ্লোকটিতে সমগ্র কবিতাটির মূল মর্ম সংহত হয়ে শুধু বিস্ময়কর মাধুর্য বিস্তার করে না, তা মনের মধ্যে প্রবল রেখাপাত সৃষ্টি করত ভাব ও রূপের সম্পূর্ণতা সাধন করে। গোবিন্দচন্দ্র দাসের অন্তিম শ্লোক সমগ্র ভাবনার সার-মণ্ডিত হয়ে এপিগ্রামের আকারে শোভিত, তন্মধ্যে অনেক শ্লকই প্রবচনরূপে প্রচলিত হবার উপযোগী।
প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী রীতিতে লেখা সনেটগুলির ভাবাবয়ব ত্রিধা-বিভক্ত, তাতে অষ্টক ও শেষ চতুষ্কটির মধ্যে সেতুবন্ধ-স্বরূপ স্বতন্ত্রভাবে একটি সমিল শ্লোক অবস্থিত।
অন্ত্যমিল-বৈচিত্র্য
খাঁটি পেত্রার্কীয় সনেটের অষ্টকে ২ প্রকার, যথা- (১) ১ম, ৪র্থ, ৫ম ও ৮ম পঙ্ক্তিতে, এবং (২) ২য়, ৩য়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঙ্ক্তিতে মিল থাকে। ষটকে দুই বা তিন প্রকার ভিন্নতর অন্ত্যমিল বিভিন্নভাবে ব্যবস্থিত হয়ে থাকে। খাঁটি পেত্রার্কীয় অন্ত্যমিল নিম্নরূপ :
কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘগঘ
কখখক : কখখক :: গঘঙ : গঘঙ
অষ্টকের মিলবিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে খাঁটি পেত্রার্কীয় রীতির ষটকে নিম্নের চার প্রকার মিলবিন্যাসও ব্যবহৃত হয় :
কখখক : কখখক :: গঘগ : গগঘ
কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘঘগ
কখখক : কখখক :: গঘঘ : গঘগ
কখখক : কখখক :: গঘঙ : ঙঘগ
বাংলাভাষায় রচিত প্রথম সনেটের নাম 'কবি-মাতৃভাষা', যেটি রচনা করেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি মোট ১০৮টি সনেট রচনা করেন। Sir Thomas Wyatt ১৫২৭ সনে ইতালি গমন করেন। সেখানে তিনি পেত্রার্কার কয়েকটি সনেট ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং ইংরেজি ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন। ইতালীয় সনেটে দুটি ভাগ থাকলেও ইংরেজ কবি স্যার থমাস উইয়াট ষটকটিকে একটি চতুষ্ক ও শেষ দু পঙ্ক্তিযগোগে একটি শ্লোক- এ দুভাগে বিভক্ত করেছেন, এভাবে :
কখখক : কখখক :: গঘঘগ : ঙঙ
কখখক : কখখক :: গঘগঘ : ঙঙ
বাংলা ভাষায় এই অভিনব রূপবন্ধ প্রথম প্রবর্তন করেন দেবেন্দ্রনাথ সেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’, ‘জয়দেব’ ও ‘কাশীরাম দাস’ এভাবে তিনভাগে বিভক্ত সনেট :
কখকখ : খকখক :: গঘঘগ : ঙঙ
কখখক : খকখক :: গঘঘগ : ঙঙ
কখকখ : কখকখ :: গঘগঘ : ঙঙ
উইলিয়াম ওয়ার্ডস্আর্থ প্রায় ৫০০ সনেট লিখেছিলেন। উইলিয়াম হেনরি হাডসন তাঁর Wordsworth and His Poetry বইয়ে ওয়ার্ডস্আর্থকে The Greatest of English sonnet-writers হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি পেত্রার্কীয় রীতিতে সনেট লিখলেও ইতিহাসে তাঁর বিশেষ অবদান তাঁর উদ্ভাবিত নতুন রূপকল্পে যা নিম্নরূপ :
কখখক : কগগক :: ঘঙঙঘ : চচ
কখখক : কগগক :: ঘঙঘঙ : চচ
উইলিয়াম শেক্সপীয়র ১৫৪টি সনেট লেখেন, যার অন্ত্যমিল নিম্নরূপ :
কখকখ : গঘগঘ :: ঙচঙচ : ছছ
এডমন্ড স্পেনসার ৮৭টিরও বেশি সনেট লিখেছেন নিম্নের ছাঁচে, যা সনেটের ইতিহাসে স্পেনসারীয় রীতি নামে অভিহিত :
কখকখ : খগখগ :: গঘগঘ : ঙঙ
কিন্তু এই রীতিটি বিশেষ জনপ্রিয় হয় নি। অন্যপক্ষে শেক্সপীয়রের অনুসৃত রীতিটি ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে।
পেত্রার্কীয় ও শেক্সপীয়রীয় রীতির তুলনা। পেত্রার্কীয় রীতির সনেট অধিকতর ইম্প্রেসিভ, অন্যপক্ষে শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেট অধিকতর এক্সপ্রেসিভ। তবে Joseph Angus, M. A, D.D. (Examiner in English Language, Literature and History to the University of London) শেক্সপীয়রীয় রীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন - The worst form for the Sonnet. যে-রীতি পেত্রার্কীয় রীতি নামে কথিত, তা পেত্রার্কার আবির্ভাবের পূর্বেও প্রচলিত ছিল; কিন্তু পেত্রার্কার কৃতিত্ব হলো তিনি সেই ক্লাসিক্যাল ছন্দোবন্ধের আকারের সাথে তাঁর স্ব-অনুভূত ব্যক্তিগত বিশিষ্ট ভাব-প্রেরণা সম্পূর্ণ সুসমঞ্জস করে আশ্চর্য সুন্দররূপে মূর্ত করতে সমর্থ হোন, ফলে তা পেত্রার্কীয় রীতি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তদ্রূপ, শেক্সপীয়রের পূর্বে তথাকথিত শেক্সপীয়রীয় পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, কিন্তু শেক্সপীয়রের সুদক্ষ লেখনিগুণেই তা অনবদ্য ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং কালক্রমে ইংরেজি রীতি নামে অভিহিত হয়। পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টকের ৮ পঙ্ক্তির জন্য দুই প্রকার রাইম-এর প্রয়োজন, এবং ইতালীয় ভাষায় রাইমিং সিলেবল্স প্রচুর বিধায় তাঁর পক্ষে এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী ছিল। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় রাইমের এরূপ প্রাচুর্য নেই, তাতে একই রাইম-এর চারটি শব্দযোজনা সর্বদা সহজসাধ্য নয়, সেজন্যই ইংরেজি ভাষায় পেত্রার্কীয়, উইয়াটীয় বা স্পেনসারীয় পদ্ধতি সুপ্রশস্থ বিবেচিত হয় নি,- শেক্সপীয়রীয় রীতিই সে-ভাষার প্রকৃতির অধিকতর উপযোগী। এই রোমান্টিক রীতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রাণ, হৃদয়ের ভাষা, স্মৃতি, হদয়-আসন, কেন, পবিত্র প্রেম, অস্তাচলের পরপারে, স্বপ্নরুদ্ধ, অক্ষমতা, জাগিবার চেষ্টা, কবির অহঙ্কার, বিজনে, সত্য, ক্ষুদ্র আমি, প্রভৃতি সনেট রচনা করেন। কবি গোবিন্দ চন্দ্রদাস তাঁর ফুলরেণু কাব্যের ১২০টি সনেটই এ রীতিতে রচনা করেন।
অনিয়মিত রূপকল্প। শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেটের স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্লোকটিকে অষ্টকের পরে সন্নিবেশ করে প্রমথ চৌধুরী সনেটের ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায় সংযোজন করেন। তিনি এর প্রেরণা লাভ করেছিলেন ফরাসীয় রীতি হতে। ফরাসী ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন ক্লেমেন্ট ম্যারট (১৪৯৬-১৫৪৪)। তিনি পেত্রার্কার ৬টি সনেট অনুবাদ করেন। তাঁর দুই অনুবর্তী Pierre de Ronsard (১৫২৪-৮৫) এবং Joachim Du Bellay (১৫২৫-৬০) ইতালীয় রীতির ভিত্তিতে ফরাসী ভাষায় সনেট রচনার নুতন ধারার প্রবর্তন করেন। ফরাসী সনেটের রূপকল্প :
কখখক : কখখক :: গগঘ : ঙঙঘ
ফরাসী কবি Jose-Maria Heredia (১৮৪২-১৯০৫) রচিত 'বিস্মৃতি' ও 'অকালমৃতা' নামক দুটি সনেটের অনুবাদ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যার ছন্দোবন্ধ নিম্নরূপ :
কখখক : কখখক :: গগঘ : ঙঘঙ
উপরোক্ত ফরাসী রীতি ভেঙে প্রমথ চৌধুরী নিম্নের নতুন রূপকল্পের প্রবর্তন করেন :
কখখক : কখখক :: গগ : ঘঙঙঘ
কখখক : কখখক :: গগ :ঘঙঘঙ
প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী-ঘেঁষা আদর্শের অনুসরণে কান্তিচন্দ্র ঘোষ, রিয়াজউদ্দীন চৌধুরী ও রাধারাণী দেবী বহু সনেট নির্মাণ করেছেন। এভাবে ত্রিধা-বিভক্ত হতে গিয়ে অনেক সনেট একেবারে যথেচ্চাচারের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নিচে এরূপ অনিয়মিত ধাঁচের রূপকল্প দেখুন :
প্রমথ চৌধুরীর 'ও' শীর্ষক সনেট : কখখক : গঘঘগ :: ঙঙ : চছচছ
রিয়াজউদ্দীন চৌধুরীর 'শাহজাহান (২) : কখখক : গঘঘগ :: ঙঙ : চছচছ
প্রিয়নাথ সেনের 'অব্যক্ত বাসনা' : কখকখ : গঘগঘ :: ঙঙ : চছছচ
রাধারাণী দেবীর 'বিগত অতীত' : কখকখ : গঘগঘ :: ঙঙ : চছচছ
রবীন্দ্রনাথের 'বাহু' : কখখক : কগকগ :: ঘঙঘঙ : চচ
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'বিপন্না' : কখকখ : খকখক :: গগ : ঘঙঘঙ
সুকান্ত ভট্টচার্যের 'অলক্ষ্যে' : কখখক : কগগক :: ঘঘঙ : চঙচ
সানাউল হকের 'সম্ভবা অনন্যা' কাব্যের ৩৮ পৃষ্ঠার সনেট :
কখ খক : গঘ গঘ :: ঙচ ঙচ ঙচ
শামসুর রাহমানের 'স্টেজে' ও 'একজন বেকারের উক্তি' :
কখ খক : গঘঘগ :: ঙচছ ঙচছ
আল মাহমুদের 'লোকান্তর' ও 'আমি' : কখ খক : গঘঘগ :: ঙচচ ঙচঙ
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের 'সাতাশে এপ্রিল' : কখ খক : গঘ ঘগ :: ঙচছ চছঙ
বাংলা ভাষায় অনিয়মিত ধাঁচে অনেক সনেট রচিত হয়েছে; তন্মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রবর্তিত নিচের দুটি পদ্ধতি উল্লেখনীয়। তাঁর 'পরাজয়', 'গ্রীষ্মের ফল' এবং 'আমি সনেটের মিলবিন্যাস নিম্নরূপ :
কখখক : গঘঘগ :: ঙচচঙ : ছছ
এ পদ্ধতিতে শশাঙ্কমোহন সেনের 'নিস্তব্ধতা', মোহিতলাল মজুমদারের 'প্রণয়-ভীরু', সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'জিজ্ঞাসা' ও 'অহেতুকী', বুদ্ধদেব বসুর 'নেশা', তালিম হোসেনের 'আলাপ : সঞ্চারী', মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর 'ভাটিয়ালি বাউলের সুর' ও ফজল শাহাবুদ্দীনের 'পতিতা' সনেট বিরচিত।
দেবেন্দ্রনাথ সেনের 'পিপাসা' সনেটের মিল-বিন্যাস :
কখ খক : গঘ ঘগ :: ঙচঙচ : ছছ
এ পদ্ধতিতে আজিজর রহমানের 'চিরকুমারী', সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অপচয়' ও 'জাদুঘর', এবং মোতাহের চৌধুরীর 'শরতে' বিরচিত।
এ ধরনের অনিয়মিত ধাঁচগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রচলিত রীতিগুলির নানা প্রকার মিশ্রণ ও রকমফের। রবীন্দ্রনাথের সনেটে অনিয়মিত ধাঁচের দৃষ্টান্ত সমধিক।
শুধু আধুনিক বাঙালি কবিরাই নহেন, স্বনামখ্যাত ফরাসী কবি Paul Verlaine (১৮৪৪-৯৬) তাঁর অনেক সনেটে মিলের পদ্ধতিতে অনিয়মতন্ত্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁর কয়েকটি সনেটে ষটকের পরে অষ্টকের অবস্থান বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। শশাঙ্কমোহন সেনের 'শান্তি' ও 'ডুবারি' শীর্ষক সনেটদ্বয়ে এই রীতি অনুসৃত হয়েছে, তবে তা কোথাও আদৃত হয় নি।
পৃথিবীর সব ভাষায়ই সনেটের আকৃতি ১৪ পঙ্ক্তিতে নিবদ্ধ। প্রসিদ্ধ ইংরেজ কবি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটি (১৮২৮-৮২) ১৬ পঙ্ক্তি বিশিষ্ট ৩টি 'প্রলম্বিত' সনেট লিখেছিলেন, যার মিলবিন্যাস : কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘগঘ : ঙঙ
Guido Orlandi-এর একটি সনেটের মিলবিন্যাস :
কখখক : কখখক :: গঘঙ : গঘঙ : ঙঙ
১৪ পঙ্ক্তিযুক্ত এবং সনেটীয় অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতামাত্রই সনেট নয়।। রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি তাঁর 'চৈতালি', 'স্মরণ' ও 'নৈবেদ্য' কাব্যের চতুর্দশ-পঙ্ক্তি কবিতাগুলি। কাহ্নপাদ হতে ঈশ্বরগুপ্ত পর্যন্ত বহু কবি বাংলা ভাষায় চতুর্দশ-পঙ্ক্তি কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলো আসলে ৭টি সমিল পয়ার-শ্লোকের সমষ্টি, তাতে সনেটের গুরুগম্ভীর ভাব ও সংহত গঠনশৈলি দৃষ্ট হয় না। রবীন্দ্রনাথের উক্ত চতুর্দশ-পঙ্ক্তিযুক্ত কবিতাগুলিও সনাতন প্রণালীতেই অন্ত্যমিলযুক্ত যুগ্ম-পঙ্ক্তিতে রচিত, তাতে সনেটের সুব্যবস্থিত মিলবৈচিত্র্য নেই, কিন্তু রোমান্টিক সনেটের অনেক লক্ষণই বহুলাংশে বিদ্যমান। ফলে রবীন্দ্রনাথের এই রচনাগুলি বিশ্বকাব্যধারায় নিঃসন্দেহে এক নতুন সংযোজন। একটি কবিতাকে আদর্শ সনেট বলা যাবে তখনই, যখন এর ভাব-প্রবাহ সনেটীয় রীতিতে প্রবহমান থাকবে, এবং এর অন্ত্যমিলও সনেটীয় রীতি দ্বারা বিরচিত হবে। এর ব্যতিক্রম হলে তা একটা সাধারণ গীতিকবিতার মর্যাদা প্রাপ্ত হবে।
পরের পর্ব : পঙ্ক্তি-বৈচিত্র্য
দ্বিতীয় পর্ব
সূত্র : বাংলা সনেটের রূপ ও রীতি (ছন্দ সমীক্ষণ), আবদুল কাদির
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৩৭