এক.
সারাদিন অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসে সরিষার তেল ছাড়াই রাতে ভাল ঘুম হওয়ার কথা, কিন্তু হয় না কারন অফিসের বেশিভাগ সময়ই কাটে আমার ঝিমুনিতে। অনেক কসরতের পর মাত্র চোখটা লেগে আসছিল এমন সময় মোবাইল চিৎকার দিয়ে বলল, “স্যার স্যার স্যার কল; স্যার স্যার স্যার কল”। ছাপোষা কেরানী, সবাইকে স্যার ডাকতে ডাকতে জিহ্বাই আমার ক্ষয় হওয়ার জোগার তাই অফিস থেকে ফিরেই প্রথম কাজ হল মোবাইলের রিং টোন “স্যার স্যার স্যার কল” সেট করে কারও কলের জন্য অপেক্ষা করা। তাই বলে রাত তিনটার সময়? চোখেমুখে চরম বিরক্তির ভাব নিয়ে বালিসের কাছে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে নামটা দেখেই পিলে চমকে উঠলাম।
ধরবো? নাহ, থাক; ধরবো না। একবার ভাবলাম অর্ধাঙ্গিনী মৈনাক পর্বত কুম্ভকর্ণকে ডেকে বলতে বলি যে আমি বাসায় নাই, অফিসের জরুরী কাজে চিটাগাং গিয়েছি; এতে আমার আসলেই নাই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিতে পেরে ভয়ে ভয়ে ধরে বললাম, “হ্যালো?”
- “হ্যাঁ দোস্ত, বাদঁর কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারিস?”, আগে পিছে কিছু না বলে, কোন কুশলাদি না জিজ্ঞেস করে তার মুখে বিশ্বব্রক্ষান্ডের কঠিনতম এই প্রশ্ন শুনে আমি বিষ্ময়ে বাকহারা!
পাছে অর্ধাঙ্গিনীর ঘুম ভেঙ্গে যায় আর রাতটা ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে স্টেশনেই কাটাতে হয় এ ভয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। নিচু গলায় বলাম, “হারামজাদা, আমি কি বাঁদরের সওদাগর? তবে একটা জেলা আছে বান্দরবন; নিশ্চয় সেখানে বনে বাদারে লাখ বাদঁর ঘুরে বেড়ায়। তুই সেখানে গিয়ে এইসব বাদঁরের সাথে দোস্তি পাতাতে পারিস”।
- “আরে বাদঁরের দোস্তি দিয়ে আমি কি করব? তুই যথেষ্ঠ”, নির্বিকার ভাবে বলল দোস্ত আমার কিন্তু প্রশংসা নাকি তিরষ্কার বুঝলাম না, “আসলে একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্য দুটা বাদঁর খুঁজছিলাম আর কি! এ শহরে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারিস?”
“সেটাত জানি না, তবে শুনেছি ঢাকার কাঁটাবনে নাকি পশুপাখির দোকান আছে, তুই ঐখানে যোগাযোগ করতে পারিস”, প্রায় ফিসফিস করে বললাম; এরি মাঝে মৈনাকপর্বত ভুবন প্রকম্পিত করে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলে আমার হৃদপিন্ড প্রায় গলার কাছে উঠে আলজিহ্বায় কড়া নাড়ানাড়ি শুরু করে; আলত করে ঢোক গিলে হৃদপীন্ডটিকে স্বস্থানে পাঠিয়ে একটু স্বস্থি লাভ করি।
- “ওদের কি অনলাইন বুকিং দেওয়ার সিস্টেম আছে? হোম-ডেলিভারী?”
ইন্টারনেটে কিভাবে বাঁদর কেনা যায়; তার উপর আবার হোম-ডেলিভারী!, “কি জানি দোস্ত! আজকাল ত শুনি ইন্টারনেটে দুনিয়ার সব কিছুই পাওয়া যায়, তুই খোঁজ নিয়ে দেখতে পারিস; ইন্টারনেট, কম্পিউটার এইসব ব্যাপারে আমার বিন্দু মাত্র ধারনা নাই”, মৈনাকপর্বত হালকা নাক ডাকা শুরু করলে আমিও গলার স্বর একটু বাড়িয়ে দেই।
- তোরা যে কি না? এই যুগে এসে কেউ যদি বলে ইন্টার্নেট বুঝি না তার আসলে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে থাকা উচিত, আফ্রিকার জঙ্গলেও গিয়ে দেখবি জংলিরা নেংটি পড়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছে আর একটু পরপর আনন্দে উলুউলু দিচ্ছে।
আরও কি কি যেন বলছিল, কর্ণকুহরে প্রবেশেই আটকে দেই। শেষে ফিসফিস করে বললাম, “তোর ভাবী ঘুমাচ্ছে, কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে, তোর বাদঁর ত বুঝে পেয়েছিস, এইবার রাখি”, বলে আর সময় না দিয়ে দিলাম লাইনটা কেটে।
- হঠাৎ দেখি আধশোয়া হয়ে পাখির নীড়ে মত চোখ তুলে “এই মাঝরাতে ফিসফিসিয়ে কার সাথে কথা বলা হচ্ছে শুনি?” আরে না, নাটরের বনলতা সেন না, আমার অর্ধাঙ্গিনী শুধায়।
ভাব বাচ্যে সম্মোধন! ঝড়ের পূর্বাভাস। সাইক্লোন, টর্নেডোতেও মোড় নিতে পারে যে কোন সময়, ব্যাটা জীবনানন্দ, জীবন আনন্দেই কাটিয়েছ; তাইত চোখকে দেখ পাখির নীড়, কলমপেষা কেরানী হলে তখন দেখতে ‘সর্বনাশ’!
আমতা আমতা করে বললাম, “সাইন্টিষ্ট খাস্তগীর”
দুই.
ভাগ্যিস প্লাস্টিকের সেন্ডেল পড়ে বাজারে এসেছিলাম; মাছ বাজারে পা দিয়েই যেন অন্য গ্রহে এসে পড়েছি। অবশ্য এই গ্রহভ্রমন আমাকে প্রতি শুক্রবারেই করতে হয়। কাদা মাড়াতে মাড়াতে এগিয়ে যাচ্ছি আর একেক জনের ডালার উপর নানান জাতের মাছ দেখছি, সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ের যখন মুটামুটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি তখন দাম কিঞ্চিত কমানোর আশায় মাছের পেটে হালকা চাপ দিয়ে বললাম, “এই মিঞা, তোমার মাছ ত নরম, ভাগায় পাঁচ টাকা কম পাবা।”
বিক্রেতা মৃদু ঊম্মা প্রকাশ করে বলল, “স্যার কি যে বলেন না! একদম তাজা মাছ, কেঁচকি মাছ ত তাই খালি চোখে কাঙ্কা দেখা যাচ্ছে না, আপনার কাছে যদি আতশি কাচ থাকে তাহলে দেখতেন টকটকে লাল কাঙ্কা।”
অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে কেঁচকি মাছের কাঙ্কা পরীক্ষা করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, তাই আর কথা না বাড়িয়ে তিনভাগা নিয়ে কেটে পড়লাম। একটু সামনে এগোতেই দেখি কতক শিশুকিশোর ছোট খাট একটা জটলা পাকিয়ে আছে আর তাদের মাঝে লম্বামত একজন হেটে যাচ্ছে। পেছন থেকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। আরে! খাস্তগীর না? তাই ত, খাস্তগীরই ত! কিন্তু ওর এই অবস্থা কেন? হাটার গতি একটু বাড়িয়ে দিয়ে কাছাকাছি গিয়ে ডাক দিলাম, “খাস্তগীর, এই খাস্তগীর”।
মনে হল মুহূর্তক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে, কি জানি! না কি আমারই চোখের ভুল। আমিও আর একটু এগিয়ে জোরেই আবার ডাকি, “এই, খাস্তগীর, খাস্তগীর?”
- এইবার আর পালানোর পথ না পেয়ে ঘুরে মৃদু কাষ্ঠ হাসি হেসে বলে, “আরে দোস্ত, কি ব্যাপার? অনেক দিন পর, কেমন আছিস”
আমি আছি ভাল, কিন্তু তোর এই অবস্থা কেন?
- কোন অবস্থা?
এই যে দুই কাঁধে দুই বাঁদর নিয়ে ঘুরছিস?
- “ও! এদের কথা বলছিস”, আরে এটা কিছু না, শুধু একটু গ্যাসের সমস্যা। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বলল সে কথাটা।
কিন্তু আমার মন বলছে ব্যাটা বড় ধরনের কোন ঝামেলা পাকিয়েছে, আর এখন আমার কাছে লুকাতে চাচ্ছে। তাই ধরে টেনে অদূরেই “চান্দের মামা হোটেল ও রেস্তোরা” নামের রেস্তোরার ক্যাবিনে গিয়ে ঢুকলাম কাঁধে দুই বাঁদর সহ। এই ধরনের কেবিনগুলো সাধারনত উঠতি বয়সের স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা ডেটিং এর জন্য ব্যাবহার করে; তাই কেবিন জুড়ে নানান নীতি কথার পোষ্টার, “শালীনতা বজায় রাখুন”, “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত”, “ব্যবহারে বংশের পরিচয়”। কিছু রসিক ছেলেপিলে এই সকল পোষ্টারের উপর আবার মিষ্টিমধুর ভাষায় তাদের জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য লিখে রেখেছে, দুচারটা চিত্রাংকন প্রতিভার স্ফুরনও দেখা গেল।
হ্যাঁ, কি যেন বলছিলি গ্যাসের সমস্যা?
- আরে তেমন কিছু না
আমি কোন কথা না বলে চুপকরে তাকিয়ে থাকি তার দিকে, জানি খাস্তগীর নিজের বাদর-কীর্তির কথা সবিস্তারে বলার জন্য মুখিয়ে আছে।
- কিছুক্ষণ পর, মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে প্রায় ফিসফিস করে যেন খুব গোপন কথা ফাস করছে এমন ভাবে বলল, “আমি আসলে লাভিং গ্যাস নিয়ে কাজ করছি”।
মাত্র গ্লাস তুলে মুখে নিয়েছিলাম, পানিটা গলায় আটকে গেল, অনেক কসরত করে কোন রকমে কাশিটা আটকালাম, “কি! কি গ্যাস বললি?”
- লাভিং গ্যাস, এত অবাক হওয়ার কি আছে? ক্রায়িং গ্যাস আছে, লাফিং গ্যাস আছে তাহলে লাভিং গ্যাসের কি সমস্যা?
ক্রায়িং গ্যাস মানে?
- আরে, বাংলায় কাঁদানে গ্যাস বলে যেটাকে, আর কি।
বাদঁর দুটো হঠাত করে খাস্তগীরের কাধে মৃদু লাফালাফি শুরু করল। আমি বললাম, “এই শাখামৃগ দুটাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরছিস কেন? তোর কাঁধ ত আর শাখা না”
- মৃদু হেসে, “আরে শাখামৃগ বলছিস কেন? এর নাম মলি আর এটার নাম ডলি”, হাত দিয়ে একবার ডান আরেকবার বা কাধে ইঙ্গিত করে বলে সে।
ও! দুটোই বাঁদরী?
- আর বলিস না, সেই যে তোর কাছ থেকে ফোনে জায়গার নাম নিলাম না? তারপর তাদের সাথে যোগাযোগ করে বললাম আমার দুইটা সুস্থ, তেজী ও বদমেজাজি বাঁদর লাগবে। তারা অনেক দিন ঘুরিয়ে শেষে এই দুটা বাঁদরনী দিয়ে বলে গেল, “এই দুটার মত তেজি আর বদমেজাজি বাঁদরী আর বাঁদর সমাজে নেই” গ্যারান্টি কার্ডও দিয়ে গেছে। আমিও আর উচ্চবাচ্চ করিনি, আমার কাজ হলেই হল।
কিন্তু তোর কাজটাই ত বুঝতে পারছি না!
- মুচকি হেসে, “যদি বুঝতেই পারতিস তাহলে তুই খাস্তগীর হতি”
হুমম
- আচ্ছা, দুনিয়ার মুল সমস্যা কি বলতে পারিস?
চমকে উঠলাম, কিছুদিন আগে খাদ্য সমস্যা নিয়ে যে ঝামেলা গিয়েছে সেটা মনে করে একটু ভয়ও পেলাম, এবার না জানি কোন ঘাপলা বাধায়! হাজার রকমের সমস্যা আছে দুনিয়াতে, এখন কোনটা সেটা আমি কিভাবে বলব? জনসংখ্যার সমস্যা? নাকি দারিদ্রতা? নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা?
- হাসি তার সমগ্র মুখে ছড়িয়ে পড়ে, আরে তুইত দেখি দুনিয়ার কোন খবরই রাখিস না! আরে, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গিয়ে ভালবাসার অভাব, আর বাকি গুলোত এর উপসর্গ মাত্র। দুনিয়াজুড়ে যে এত অরাজকতা তার মুলেই হল ঘৃণা আধিক্য আর ভালবাসার না থাকা। একবার ভাবত, রাস্তায় বিক্ষোভ হচ্ছে আর পুলিশ তাদের হাসতে হাসতে ভালবেসে আলতো লাঠিচার্জ করছে, আবার বিক্ষোভকারীরাও পুলিশের দিকে হাসতে হাসতে ঢিল ছুঁড়ে মারছে, বুকে জড়িয়ে ধরে লাথি মারছে; রাস্তায় পকেটমার ধরা পড়েছে সবাই মিলে তাকে আচ্ছা মতন না বানিয়ে আরও কয়েকজনের মানিব্যাগের সব টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছে, আর সে এই টাকা না নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে; মানুষে মানুষে কোন ঘৃণা নেই, কোন উগ্রপন্থী নেই, নেই কোন জঙ্গিবাদ, সবাই সবাইকে শুধু ভালবাসছে, তাহলে কি দুনিয়ার আর কোন সমস্যা থাকত? বলতে বলতে একটু উদাস হয়ে যায় খাস্তগীর, কি জানি হয়ত দিবাস্বপ্নে মাদাম-তুসোর জাদুঘরে নিজের মোমের মূর্তি উদ্ভোধন করছে!
দ্বিমত করার মত কিছু পেলাম না, কিন্তু ঠিক কেন যেন ভরসাও পাচ্ছিলাম না; কি জানি! হয়ত ভালোই হবে। দেখাই যাক না! সবই বুঝলাম কিন্তু এই মলি-ডলি কেন? তাকিয়ে দেখি বাঁদর দুটো পরম ভালবাসায় দস্তগিরের দুই কাধে বসে আছে, চরম তৃপ্তির সঙ্গে তার গালের সাথে গাল ঘসছে, অদ্ভুত আবেগে নয়নে নয়ন রেখে হারিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায়, যদি বাংলা সিনেমা হত তাহলে এতক্ষণে কোমর দুলিয়ে গান শুরু হয়ে যেত “চোখ যে মনের কথা বলে”।
- আরে, মলি-ডলি হল আমার গিনিপিগ, লাভিং গ্যাসের প্রথম টেষ্টটা এদের উপরই করেছি।
মানে? তুই অলরেডি লাভিং গ্যাস আবিষ্কার করে ফেলেছিস? ছানাভরা চোখে তার দিকে তাকাই আমি।
- তা আর বলতে! এটা এমন কি কঠিন কাজ? আমাদের ব্রেনের একেকটা অংশ একেকটা অনুভুতি নিয়ন্ত্রণ করে, আমার গ্যাস ভালবাসা অংশে শুধু একটু স্টিমুলেসন দিবে এই যা! মলি-ডলির উপর পরীক্ষাও করে ফেলেছি। শুধু একটা সমস্যা হয়েছে বাঁদর দুটো একে অপরকে ভাল না বেসে আমাকে ভালবেসে ফেলেছে, আর সেই থেকে এই দুটাকে কাঁধ থেকে নামাতে পারছি না, মুখটা একটু করুন করে বলে বন্ধু আমার। আর মাড়ির দাঁত সব কেলিয়ে দিয়ে একটা হাসি দিয়ে খাস্তগীরের গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মলি, আর ডলি হালকা লাফিয়ে উঠে মাথা উপর নিচ করে “উঊঊঊঊ” শব্দ করে যেন সায় দেয় তার কথায়।
বন্ধুর এ দুরবস্থা দেখে মায়ায় লাগল, “এই ভালবাসা কি পার্মানেন্ট না কি”
- আরে না, তিন থেকে বড় জোড় চার সপ্তাহের মত স্থায়ী হবে এই ভালবাসা। প্রথম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এটা উর্ধমুখি তারপর থেক আস্তে আস্তে এর প্রভাব নিচের দিকে নেমে আসবে।
যাক, বাচা গেল। মলি-ডলির কয় সপ্তাহ বাকি?
- “মাত্র গতপরশু ডোজ দিয়েছি, এদের ভালবাসার পরিমান আগামী দুই সপ্তাহ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে”, তার কথায় নিশ্চিত আতঙ্ক ঝড়ে পরছিল।
আমি আর সামনে চিন্তা করতে পারছিলাম না। বিলটা দিয়ে রেস্তোরা থেকে বের হয়ে গেলাম, খাস্তগীর বের হয় নি, মলি-ডলির খাওয়া নাকি এখনও আসেনি, তাই।
তিন.
আজ সকাল সকাল একটা খবর পড়ে বেশ হাসলাম, যখনই ঘটনাটা মনে পড়ছে তখনই পেট ফেটে হাসি আসছে আর অনেক কষ্টে তা নিবারন করছি। ছুটির দিন, বারান্দায় বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি আর দৈনিকের পাতা উল্টাচ্ছিলাম, প্রথম পাতার একেবারে শেষের কলামে খবরটি ছাপা হয়েছে। “কৈ আমার মাতঙ্গ সোনা, চা আর কতদূর?”, বউকে আহ্লাদ করে মাতঙ্গ ডাকি, ভাগ্যিস সে বাংলায় কাচা না হলে এই মাতঙ্গের পায়ের নিচেই চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া ছিল অবধারিত।
- “আসছে আমার সিরাজদ্দৌলার নাতি! হুকুম করবে আর হাজির! একদম চুপ করে বসে থাক, যখন হবে আমি নিয়ে আসব”, রন্ধনশালা থেকে ততোধিক উচ্চস্বরে ভেসে আসে বৃংহিতকণ্ঠ।
কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে সে হাজির, এসে দেখে আমার মুখে মুচকি হাসছি, কিছুটা অবাক হয়; হয়ত আশা করেছিল ঝাড়ি খেয়ে মুখ কাল করে বসে থাকব। আমি বেতের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বললাম বস তোমাকে একটা খবর পড়ে শোনাই। গলা খাকাড়ি দিয়ে পড়া শুরু করলাম,
“উম্মাদ ভক্তের” কবলে প্রধাণমন্ত্রী
গতকাল দিবাগত রাত ৭:১৫ টায় প্রধাণমন্ত্রীর বাসভবনের
সামনে এক ব্যাক্তিকে চিৎকার চেচামেচিরত অবস্থায়
দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আটক করলে সে বলতে
থাকে, “আমি প্রধাণমন্ত্রীর প্রেমিক, আই লাভ ইউ
প্রাইম- মিনিষ্টার, আমি তোমাকে ছাড়া বাচব না”, তারপর
সে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে প্রধাণমন্ত্রীর নাম লিখতে
থাকে। ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে উম্মাদ কোন
ভক্ত ভেবে তাড়িয়ে দেয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তার কিছুক্ষণ
পর মাননিয় প্রধাণমন্ত্রী দাপ্তরিক কাজ সেরে নিজ
বাসভবনে ফিরার সময় তার বহরের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে
সেই “উম্মাদ ভক্ত”, ক্রমাগত চিৎকার দিয়ে শুধু একবার
প্রধাণমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। তারপর হঠাৎ বাংলা
সিনেমার নায়কদের মত নেচে নেচে রোমান্টিক গান
গাওয়া শুরু করে,
“সবার জীবনে প্রেম আসে তাইত সবাই
ভাল বাসে, প্রথম যারে লাগে ভাল যায় না ভোলা
কভু তারে”।
এক পর্যায়ে সে এক গাছ থেকে আরেক গাছে
দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে ও গাছের গুড়ি জড়িয়ে ধরে নেচে
নেচে গান গাইতে থাকে। অতঃপর এসএসএফের
কর্মকর্তা এগিয়ে এসে তাকে সেনাবাহিনীর একজন মেজর
হিসাবে সনাক্ত করেন এবং মিলিটারি পুলিশ এসে তাকে
গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতার অবস্থায় ও উক্ত মেজর
চিৎকার করে প্রধাণমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে গাইতে থাকেন,
“যেও না সাথী, চলেছ একেলা কোথা, পথ খুঁজে পাবে
নাকো শুধু একা।”
কি কারনে সেনাবাহিনীর উক্ত কর্মকর্তার এমন মতিভ্রম
হল সেটা এখনও অজানা তবে উনি মাদকাসক্ত কিনা তা
খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তিনটি
পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ধারন করা হচ্ছে
এর পিছনে বিরুধীদলের কোন ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
(নিজস্ব প্রতিবেদক)
পড়া শেষ করে আমি উচ্চস্বরে হা হা করে হাসতে থাকি, বউ আমার দিকে কিছুক্ষণ চোখ পাকিয়ে থেকে বলে, “এখানে হাসি কি হল? দেশে কি পাগলের অভাব আছে নাকি? তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি”
চুপসে গেলাম হঠাৎ করে, ঠিক এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠে আমাকে উদ্ধার করল।
- হ্যালো, দোস্ত, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, তুই কি এক্ষণি একটু আমার বাসায় আসতে পারবি?”
“কি ঝামেলা?”
- বড় ধরনের ঝামেলা, ফোনে বলা যাবে না। তুই এক্ষণি চলে আয়। বলেই ফোনটা কেটে দিল খাস্তগীর।
কালবিলম্ব না করে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে গেলাম তার বাসায়। একি দশা হয়েছে তার! চোখ ফুলে লাল, চুলগুলো উসক-খুসক, চশমার কাচ ঘোলা হয়ে আছে, মনে হয় কতদিন মুছে না। সার্টের বোতামের ক্রম উল্টা পাল্টা হয়ে আছে। আমাকে দেখেই যেন হাপ ছেড়ে বাচল; ফিসফিস করে বলল “আজকের খবরের কাগজ পড়েছিস?”
ওর আচরনের কিছু বুঝতে পারছিলাম না; বললাম, “তুই এমন ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন? আর খবরের কাগজ পড়েই বের হয়েছি, তুই কোন খবরের কথা বলছিস”
- এই যে এই খবরটা পড়েছিস।
চমকে উঠলাম; যা বুঝার বুঝে গিয়েছি, “মানে! প্রধাণমন্ত্রীকে ঘীরে উম্মাদ ভক্তের কান্ড কারখানা পিছনে তোর লাভিং গ্যাসের কোন সংযোগ আছে? মাই গড! কিভাবে কি হল? খুলে বল জলদি”
- আমি নিজেও ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। আমার লাভিং গ্যাসের ফিল্ড টেস্ট সফল হওয়ার পর আমি ভেবে দেখলাম প্রধাণমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর মাঝে যদি একে ওপরে প্রতি ভালবাসা জাগিয়ে তুলতে পারি তবে আমাদের যাবতিয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একজন বলবে ‘আপা আপনিই প্রধাণমন্ত্রী হন’, আরেক জন বলতে ‘না ভাবি, এত কষ্ট দেশ চালান! দরকার নেই আমার, আপনি প্রধাণমন্ত্রী হন’ ।
- ভেবে দেখেছিস মুহূর্তেই আমাদের যাবতিয় সমস্যার সমাধান! কিন্তু সমস্যা হয়ে দাড়াল তাদের দুজনের কাছে লাভিং গ্যাসটা পৌছান, অনেক ভেবে একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলাম, দুইটা খামে গ্যাস ভরে প্রধাণমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তাদের কাছে পাঠান চিঠিপত্র সব নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন খুলে ভাল মত পরীক্ষা করে তারপর পার করে।
বুঝলাম, কিন্তু ঐ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এতটা পাগলাম কেন করল আর খামে তোর ঠিকানা দেস নি ত?
- “আরে আমি কি অত বোকা নাকি? প্রেরকের জায়গায় হোয়াইট হাউজের ঠিকানায় দিয়ে দিয়েছি। আর যুগের পর যুগ ধরে আমাদের প্রধাণমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রীর বুকে একে অপরের প্রতি যে তীব্র ঘৃণা জমা হয়েছে সেই কারনে গ্যাসের পাওয়ার বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম”, ফ্যাকাসে কাষ্ঠ হাসি দিয়ে উত্তর দেয় সে।
হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন অনেক কাজ, এই ল্যাবের সব আলামত ধ্বংস করতে হবে, লাভিং গ্যাসের সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছু নষ্ট করতে হবে। খাস্তগীরকে সব বুঝিয়ে বললাম কি করতে হবে; বেচারা মিনমিন করতে করতে রাজি হল, তারপর বললাম, “দোস্ত, বিশ্ববাসীর চিন্তা বাদ, এবার নিজের চিন্তা কর, লাভিং গ্যাস আসলে দরকার তোর। আমি বলি কি ভাল মত একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে থিতু হ এবার”
সে কি বুঝল আল্লাহ জানে, তবে তার চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল। আমি চিনি এই দৃষ্টি, নির্ঘাত নতুন যুগান্তকারী কোন আইডিয়া চলে এসেছে তার মাথায়।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বাঁদরী দুটো পরম আবেগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষছে আর এজন আরেক জনকে কলা ছিলিয়ে ছিলিয়ে খাওয়াচ্ছে, নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল আমার বুকচিড়ে।
--------------------------- সমাপ্ত --------------------
এই সিরিজের পূর্বের গল্পগুলো
( কল্পগল্প ) --- খস্তগীরের বিস্ময়কর চিত্রগ্রহন যন্ত্র
( কল্পগল্প ) --- খস্তগীরের স্বাদ সূচক