১.
ছুটির দিন; বারান্দায় বসে আয়েস করে সদ্য ভাজ ভাঙ্গা পত্রিকা পড়ছিলাম, আর মনে মনে সরকারের পিন্ডি চটকাচ্ছিলাম, এমন সময় বেরসিকের মত মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো খস্তগীরের দরাজ কণ্ঠ।
কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে বললো, "দোস্ত, আজ রাতে তোর দাওয়াত। একটু বিকাল বিকাল চলে আসবি, অনেক গল্প জমে আছে। তোর জন্য বিশেষ কবুতরের ফ্রাই রান্না হবে। আমি এস.এম.এসে বাসার ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি", এই কথাগুলো বলেই আমাকে কোন রকম সুযোগ না দিয়ে লাইনটা কেটে দিলো।
আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে দাওয়াত হলো বাহানা, নিশ্চই নতুন কোন ঝামেলা পাঁকানোর মতলবে আছে এই পাগল। বিশেষ কবুতরের ফ্রাই? দিব্যলোকে ভেসে উঠলো, পরীক্ষাগারে কবুতরকে মুরগীর মত বড় করার গবেষণায় ব্যার্থ বিকলাঙ্গ বিকৃত কোন এক প্রাণীর ফ্রাই করা দেহ। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে গেলো। গলায় আটকে থাকা দমটা এক ঢোকে পাকস্হলীতে পাঠিয়ে দিয়ে, করুন মুখ করে পাশে পিস্তল নিয়ে খেলতে থাকা ছেলের দিকে তাকালাম। কি জানি ছেলে কি বুঝলো, হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিয়ে আব্বু আব্বু করে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাচ্চারা নাকি ফেরেস্তা; সে কি আমার কোন রকম আশংকা আঁচ করতে পরেছে?
দুরু দুর বক্ষে দীপ্ত পদক্ষেপে রোদ থাকতে থাকতে খস্তগীরের বাড়ি হাজির হলাম। ভেবেছিলাম সমগ্র বাড়ি জুড়ে থাকবে কবুতরের জঞ্জালে ভরপুর, আর তাদের বিষ্টার গন্ধে মৌ মৌ করবে চারদিক, নানান যন্ত্রপাতি এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে, বিছানার উপর স্তূপ হয়ে থাকবে বই আর জার্নাল পেপারের প্রিন্ট আর রান্নাঘর পূর্ণ থাকবে নানা রকমের টেস্টটিউব আর ক্যামিকেল ভর্তি জারে।
কিন্তু ঘরে পা রেখেই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম, চমৎকার মিস্টি গন্ধ নাকে টের পেলাম, নিশ্চই মেহমানের আগমন উপলক্ষে সুগন্ধি ছড়িয়েছে ঘরে। সারা ঘর ছিমছাম; সবকিছু এমন টিপটপ গোছানো দেখে একটু অবাকই হলাম। কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, "কিরে? তোর কবুতরের ল্যাবরেটোরি কৈ?"
কবুতরের ল্যাবরেটোরি মানে ?
মানে তোর কবুতরের গবেষণাগারের কথা বলছি?
তীর্যক একটা চাহনী দিয়ে খস্তগীর বললো, "তুই কি আমাকে পশুর পাখির গবেষক মনে করিস নাকি?"
আরে , না ! ঐ যে, ঐদিন বাজারে কবুতরকে ঘুষি মারতে দেখেছিলাম!
ও ! ঐটা তো আমি কবুতরের সাহস পরীক্ষা করে দেখছিলাম। মানুষের মত পশু পাখীও দুই ধরনের; পরিশ্রমী আর অলস। অলস কবুতর গুলো বেশিভাগ সময়ই ঝিমিয়ে কাটায়; সেই কারনে এদের মাংশ হয় নরম আর চর্বি বেশি থাকে, খেতেও বেশ মজা।
ওর কথা শুনে আমার প্রায় ভিমরী খাওয়ার দশা; অতঃপর বিশেষ কবুতরের ফ্রাই এর রহস্য উম্মোচন হলো।
২.
কবুতরের আস্ত একটা রান মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বললাম, "কী? তুই বলতে চাচ্ছিস, ঘ্রাণও এক ধরনের কম্পন?"
জ্বী, প্রত্যেকটা ঘ্রাণই একেক ফ্রিকোয়েন্সির কম্পন; যেমন শব্দ এক ধরনের কম্পন। আর আমাদের কান যেমন শব্দ কম্পনের রিসিভার ঠিক তেমনি আমাদের নাকও এক ধরনের ঘ্রাণ কম্পনের রিসিভার। আমাদের কান যেমন বিশ থেকে বিশ হাজার হার্জের বাইরের শব্দ শুনতে পায় না, ঠিক তেমনি আমাদের নাকের ও একটা লিমিট আছে ঘ্রাণ রিসিভ করার। তবে এই লিমিটটা শব্দ কম্পনের মত ফ্রিকোয়েন্সির উপর নির্ভরশীল নয়, এটা নির্ভর করে ঘ্রাণ কম্পনের পাওয়ারের উপর। আমাদের নাকের রিসিভিং লিমিট হলো ১২.৫ মাইক্রোওয়াট থেকে ১৯.২ মিলিওয়াট পাওয়ার পর্যন্ত। প্রতিটি বস্তু থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমান পাওয়ারের কম্পন নির্গত হয়। যদি এই কম্পনের পাওয়ার আমাদের নাকের রিসিভিং লিমিটের বাইরে হয় তাহলে আমার এই ঘ্রাণ অনুভব করতে পারবো না।কুকুরের নাকের লিমিট ৮ ন্যানোওয়াট থেকে ২৫ ওয়াট পর্যন্ত, ফলে কুকুর এমন সব ভিন্ন রকমের ঘ্রাণ অনুভব করতে পারে যেগুলো আমাদের ধারনারও বাইরে। যেহেতু এই রিসিভিং লিমিট ঘ্রাণ কম্পনের পাওয়ারের উপর নির্ভর করে তাই এটার সাথে দুরত্বের একটা সম্পর্ক আছে, কোন একটি ঘ্রাণের উৎস থেকে আমাদের নাক যত দুরে থাকবে আমরা ঘ্রাণ তত কম পাবো, গন্ধ কম্পনের পাওয়ার দুরত্বের সাথে সাথে কমতে থাকে।
খস্তগীরের জটিল গানিতিক হিসেব নিকেস, তত্ত্ব, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাথা মন্ডু কিছু না বুঝলেও আমি থুতনিতে হাত রেখে বিজ্ঞের মত জিজ্ঞেস করলাম, "শব্দ কম্পনটা না হয় বুঝলাম কিন্তু ঘ্রাণও কম্পন এটা কেমন যেন আজগুবি লাগছে !
-কেন! আজগুবি লাগার কি আছে ? জানিস নাকি যে তুই নিজেই একটা কম্পন?
এইবার সত্যি সত্যি বিষম খেলাম। বেশ কিছুক্ষণ দম বন্ধ ছিলো, শেষে কাশতে কাশতে বললাম, "মানে? তুই কি মানুষকেও কম্পনে রুপান্তরীত করতে চাচ্ছিস না কি?"
-স্ট্রীং থিউরি মতে পরমানুর একক হলো কতগুলো এক মাত্রার স্ট্রীং এর কম্পন। সেই হিসাবে যে কোন বস্তুই আসলে অসীম সংখ্যক স্ট্রীং এর কম্পন ছাড়া কিছু না।
নিজের অজান্তেই আমার হাত শরীরের বিভিন্ন জায়গার বুলাতে লাগলাম, এই পিঠ, এই পা, এই মুখ হাত, এই আমি আসলে কতক দড়ির নাচানাচি বই কিছু না! মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠলো।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এখন আমরা ক্যামেরায় যে ছবি তুলি সেগুলো আসলে ত্রিমাত্রিক জগৎ এর কিছু জিনিসকে দ্বিমাত্রিক তলে প্রতিস্হাপিত করে ঐ বস্তুর আকার, আয়তন, রং ইত্যাদি সেভ করা হয়। কিন্তু ঘ্রাণ ধরে রাখার মত কোন ক্যামেরা আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। আর এটাই আমি করতে চাচ্ছি, একবার চিন্তা করে দেখ যে তুই একটা গোলাপ ফুলের ছবি তুললি সাথে সাথে ঐ ফুলের ঘ্রাণটাও সেভ হয়ে থাকলো ছবির সাথে।
কিন্তু এটা কি এতোই সহজ?
নতুন জিনিস আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত কঠিনই থাকে, একবার আবিষ্কার হয়ে গেলে তা হয়ে যায় একেবারে সহজবোধ্য। আর কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি; মূলত কাজটার দুইটা অংশ, ঘ্রাণ কেপচার ও ঘ্রাণ ইমিটার ডিভাইস। ঘ্রাণ কেপচার ডিভাইসের কাজ হলো যখন কোন ছবি তোলা হবে তখন ফ্রেমের মধ্যে থাকা ঐ বস্তুর ঘ্রাণ কম্পন রেকর্ড করে রাখা, আর ঘ্রাণ ইমিটার ডিভাইস পুনরায় সেই কম্পনকে নির্গত করবে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো এই ইমিটার ডিভাইসের পাওয়ার এমপ্লিফাই করে ঘ্রাণের ক্ষমতা হাজার গুণ বাড়িয়ে নেওয়া যাবে।
দস্তগীরের চোখ জ্বলজ্বল করছিলো আবিষ্কারের নেশায়, একটু চমকে উঠলাম ভিতর ভিতর; না জানি এই পাগল আবার কোন বিপদ ডেকে আনে! বাড়ি ফিরার পথে বারবার মনে হচ্ছিলো, "আমার অস্হিত্ব কতক একক মাত্রার দড়ির কম্পন ছাড়া কিছু নয়"। নিজের অজান্তেই বারবার সারা শরীরে হাত বুলাচ্ছিলাম; অবশেষে প্রতিজ্ঞা করলাম, ভুলেও দস্তগীরের ছায়া মাড়াতে যাবো না, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে কথা।
৩.
তাবত দুনিয়ার একমাত্র আমিই কি দস্তগীরের নিকটজন; নাকি এটা আমার নিয়তি যে তার সাথে না চাইলেও জড়িয়ে পড়তে হবে? না হলে ক্লিনিকের অভ্যর্থনা থেকে আমাকেই কেন ফোন করা হলো? এড়িয়ে চলবো সিদ্ধান্ত নিলেও প্রাণ প্রিয় বন্ধু দুর্ঘটনাজনিত কারনে ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে আছে আর এই সময়ে দেখা না করাটা অমানবিক হয়ে যায়। সাতপাঁচ ভেবে শেষমেষ ক্লিনিকে গিয়ে হাজির হলাম। কেবিনে ঢুকতেই ডাক্তার আমাকে বললেন, "আপনি কি উনার আত্মীয় হন?"
না, আসলে আমরা কলেজ ফ্রেন্ড।
ও, আসলে দুঘটনার পর থেকে আপনার বন্ধু স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ডাক্তারি ভাষায় আমরা এক বলি, এ্যামনেসিয়া। উনি এখন কাউকেই চিনতে পারছেন না; এমন কি নিজের নামটাও ভুলে গেছেন।
একটু চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম, একটু অন্যরকম, অচেনা অচেনা লাগছে চেহারাটা; আমি ধীরে ধীরে তার বেডের পাশে বসলাম।
দস্তগীর ফিসফিস করে বললো, "দোস্ত, কেবিনের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পাশে এসে বস"
অবাক হলাম, কৌতুহলও জেগে উঠলো, আমি তাড়াতাড়ি কেবিনের দরজাটা আটকিয়ে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দস্তগীর বললো, "বুঝলি, সবই আমার কপাল; শুধু কপাল ফাটা না হলে কি এমন দুর্ঘটনার মধ্যে পড়তে হয়?"
কি হয়েছে ? ঝেড়ে কাশ।
আর বলিস না! তোকে তো আমার এসসিসির কথা বলেছিলাম বিস্তারিত।
এসসিসি কি জিনিস ?
আরে,এসসিসি হলো স্মেল কেপচার ক্যামেরা। যাই হোক, এসসিসি বানানো শেষ করেছি আজ ভোরে। একশটা ছবি তুলার মত মেমোরিও যুক্ত করেছি। তর সইতে না পেরে ভোরেই এসসিসিটা নিয়ে ফিল্ড টেস্ট করার জন্য বের হই। আমার বাসার পাশে একটা ছোট নার্সারি আছে, বাঁশের বেড়া টপকিয়ে ওটার মধ্যে ঢুকে পড়ি। প্রথমে একটা গোলাপ ফুলের ছবি তুলি। একেবারে পার্ফেক্ট ! এসসিসি থেকে একদম তাজা গোলাপের গন্ধ আসতে থাকে। খুশিতে আমি ঘ্রাণ ইমিটারটাকে একশ গুণ বাড়িয়ে আরেকটা গন্ধরাজ ফুলের ছবি তুলি। চমৎকার ফালাফল ! ইচ্ছা হচ্ছিলো চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠতে !
কিন্তু এর পরই ঘটলো আসল বিপর্যয়; হঠাৎ দেখি যে একটা টবের উপর ছোট একটা পোঁকা। ভাবলাম এটার উপর একটা পরীক্ষা চালিয়ে দেখলে মন্দ হয় না। যেই মাত্র না ক্যামেরার ক্লিক বাটনে টিপ দিলাম অমনি তা ফেঁসে যায়। তিন চার সেকেন্ডের মধ্যে পুরা একশ টা ছবি উঠে মেমরী ফুল হয়ে যায়, আর ঘ্রাণ ইমিটারে সেট করা ছিলো এক হাজার গুণ। বুঝতেই পারছিস; একশটা ছবি, প্রতিটির এক হাজার গুণ শক্তিশালী গন্ধ একসাথে নির্গত করছে !
হুমম! সমস্যা কি হলো তাতে?
আরে ! ঐ পোঁকাটা ছিলো গান্ধীপোঁকা! বিকট দুর্গন্ধে চারদিকে কেয়ামতের বিভীষিকা নেমে আসে! দশ সেকেন্ডের মধ্যে আমি অজ্ঞ্যান হয়ে যাই। তারপর এই হাসপাতালে এসে জ্ঞ্যান ফিরে। ডাক্তার আর নার্সদের আলাপ শুনে যতটুকু বুঝেছি, নার্সারীর আশে পাশে একশ মিটারে মধ্যে কেউ যেতে পারছিলো না। আরও বেশ কয়েকজন বিকট দুর্গন্ধে জ্ঞ্যান হারায়। অবশেষে দমকল বাহিনীর লোকজন মাস্ক পড়ে নার্সারীতে ঢুকে প্রথমে গন্ধের উৎস, ক্যামেরাটাকে ভেঙ্গে গুড়াগুড়া করে। তারপর উদ্ধার কাজ চালায়।
শেষে দস্তগীর মুখটা করুন করে বলে, "দেখ, গন্ধের চোটে আমার ভ্রু জোড়া ঝড়ে গেছে!
অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললাম, "ঠিক আছে বুঝলাম, কিন্তু তুই স্মৃতিভ্রষ্টের ভান করছিস কেন?"
বুঝলি না! বাইরে দেখ পুলিশের লোকজন ঘুরাঘুরি করছে, যদি বুঝতে পারে এই ঘটনার পিছনে আমার হাত তাহলে আমি শেষ। তুই তো জানিস পুলিশকে আমার ভীষণ ভয়।
হাসতে হাসতে বললাম, "আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখছি কি করা যায়।"
পরিশিষ্ঠঃ
ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পেপার নিয়ে বসলাম, লালকালির বিশাল হেডলাইন প্রথম পাতায় - "রহস্যজনক মহাজাগতিক বস্তু প্রকোপে লন্ডভন্ড ঢাকার জনজীবন"
বিস্তারিত: 'গতকাল প্রাতে মহাকাশ থেকে এক রহস্যজনক বস্তুর ঢাকার প্রাণকেন্দ্র উত্তরায় পাঁচ নাম্বারের নার্সারীতে পতিত হয়। মুহূর্তেই সম্পূর্ণ এলাকা ছড়িয়ে পড়ে বিকট দুর্গন্ধ। অনেকেই এর প্রকোপে সঙ্গা হারিয়ে ফেলেন। এদের সবারই রহস্যজনক ভাবে ভ্রু ঝড়ে পড়ে। সঙ্গা হারিয়ে ফেলে ঐ এলাকার সকল কাক পর্যন্ত.........."