(১)
-ইমাদ তোমার আম্মুকে একটু ডাক দাও
-কেন স্যার ?
-কথা বলবো ।
-কি কথা বলবেন স্যার ?
-একটা জরুরী কথা বলবো
-জরুরী কথাটা কি স্যার ?
-সেটা তোমার আম্মুকেই বলতে চাচ্ছিলাম । তুমি কি উনাকে ডাক দিতে পারবে ?
ইমাদ প্রশ্ন ছাড়া কথা বলতে পারে না । ক্লাস থ্রিতে পড়া ইমাদের যেকোন বাক্য শুরু হয় কি বা কেন দিয়ে । ফায়েজ মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে । ইচ্ছে হয় বাচ্চার কান বরাবর এক চটকানা দিয়ে বয়ড়া বানিয়ে দিতে । ফায়েজের হাজারো অপূর্ণ ইচ্ছার মতো এই ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে যায় । স্টুডেন্টদের কানে চটকানা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । চটকানা দেয়া দূর হস্ত সে এখন পর্যন্ত তার কোন স্টুডেন্টকে উচ্চস্বরে ধমক দেয়নি । কোনকারণে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও ফায়েজ বিরক্তি গিলে দুপাশের গাল ঈষৎ ফুলিয়ে ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসার অভিনয় করে যায় । যে ছেলের স্টুডেন্ট পড়িয়ে মাস চালাতে হয় তার বিরক্ত হওয়া মানায় না ।
--ও মা ! তুমি তো পুডিং শেষ করোনি । পুডিংটা নিজ হাতে বানিয়েছিলাম । খেতে বাজে হয়েছে , তাই না ?
--না না । তা হবে কেন । আসলে সকালের দিকে একটু ফুড পয়জনিং এর মতো হয়েছিল তো তাই আর পুডিং মানে খাইনি । ফায়েজ ভালো বিব্রত । কি বলবে সে বুঝতে পারছে না
পয়জনিং ময়জনিং কিচ্ছু না । ঘটনা হচ্ছে মেসে প্রতিদিন সকাল রাত দুই বেলা ডিম তরকারির স্বাদ নিতে নিতে ডিম জিনিসটার প্রতি ফায়েজের চরম অনীহা এসে গেছে । আজকেও মিলে গিয়ে দেখে এক ড্রাম ঝোলের মধ্যে অর্ধেক মুরগীর ডিম উঁকি দিচ্ছে । দূর ছাতা বলে সে আর ডাইনিং এ ই বসেনি । ফায়েজ আশায় ছিল ইমাদদের বাসায় আজ বিকালের স্পেশাল কোন নাস্তায় সে তার ক্ষুধা মিটিয়ে নিবে । বড়লোকের বাচ্চাদের পড়ানোর এই এক বিশাল সুবিধা । নিত্যদিন প্লেটভর্তি মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় ।
কপালের লিখন , না যায় ডিম খণ্ডন ।
ইমাদদের বুয়া আম্বিয়ার মা যখন টেবিলে প্লেটে চারপিস পুডিং সাজিয়ে দিয়ে গেল সেটা দেখে ফায়েজের কেমন যেনো বমি বমি ভাব হচ্ছিল । মনে হচ্ছিল একপিস পুডিং মুখে দিলেই ঘর ভাসিয়ে বমি হয়ে যাবে । কিন্তু এখন শিরিন সুলতানার প্রশ্ন শুনে ফায়েজ কিছুটা “ কি হবে , কি হবে “ অবস্থায় পড়ে গেছে । স্টুডেন্টের মা যদি ভেবে বসেন তার বানানো পুডিং খেতে খারাপ হয়তো সেটা ফায়েজের মাসের শেষ তারিখে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জনের উপর আকস্মিক প্রভাব ফেলতে পারে ।
ইমাদের মা শিরিন সুলতানা টেবিলে কাছে দাড়িয়ে । তিনি ভুরু কুঁচকে পুডিং এর প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছেন । ফায়েজ বুঝতে পারছে না তিনি রেগে আছেন কিনা । এর আগে শিরিন সুলতানার বানানো সব অখাদ্য ফায়েজ গিলেছে । আজকের চারপিস পুডিং এর জন্য কি তিনি ছেলের টিচার হিসেবে ফায়েজকে নট করে দিবেন ? অসম্ভব নয় । কোটিপতির আকর্ষণীয় সুন্দরী স্ত্রীদের পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয় ।
ফায়েজ এইসব ভাবতে ভাবতেই এক পিস পুডিং মুখে পুরে নিল ।
শিরিন সুলতানা অবাক হয়ে বলল – করছো কি ! তুমি আবার পুডিং মুখে দিচ্ছো কেন । ফেলে দাও । আমি বুয়াকে তোমার জন্য বেলের শরবত নিয়ে আসতে বলছি । ফুড পয়জিং এ বেলের শরবত উপকারী ।
শিরিন সুলতানা ফায়েজকে কিছু বলার সুযোগ না আম্বিয়ার মা , আম্বিয়ার মা বলতে বলতে চলে গেলেন ।
ফায়েজ লজ্জা পাচ্ছে । তার মতো ছাপোষা মানুষকে কেউ গুরুত্ব দিলে তার লজ্জা লাগে ।
কিছুক্ষণের মধ্যে বড় এক গ্লাসে আম্বিয়ার মা বেলের শরবত দিয়ে গেল । ফায়েজ চুকচুক করে বরফ কুঁচি মেশানো বেলের শরবত খাচ্ছে । বেলের শরবত এতো সুস্বাদু কবে থেকে হল ! ফায়েজ বাড়িতে বেলের শরবত খেয়েছে । তখন ভালো লাগত না । ছাবা ছাবা আঁশ থাকতো , টপাক করে বিচি পেটে ডুকে যেত । কেমন যেন কটু গন্ধ । কিন্তু আজকের বেল মনে হয় বাইরের দেশের । ফ্লেবারটা অন্য রকম । স্বাদটাও দারুন ।
শরবত শেষ করে গ্লাস টেবিলে রাখার মুহূর্তেই শিরিন সুলতানা আসলেন । তিনি ফায়েজের মুখোমুখি সোফায় গা এগিয়ে দিলেন । ফায়েজ লক্ষ্য করেছে ভদ্রমহিলার সব কিছুতেই আভিজাত্য প্রকাশ পায় । এই যে উনি যে বসেছেন মনে হচ্ছে মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যবয়সী কোন সম্রাজ্ঞী চারিদিক দূতি ছড়িয়ে সিংহাসন অধিকার করে আছেন ।
--ইমাদ বলল , তুমি নাকি জরুরী কি বলবে ? কি ? শিরিন সুলতানা কৌতূহলী ।
-- না , মানে গতকাল আমার বেতনের খামে ৫০০ টাকা বেশি এসে গিয়েছিল । ফায়েজ মানিব্যাগ হাতে নিয়ে ৫০০ টাকার একটা চকচকে নোট টেবিলের উপর রাখলো ।
শিরিন সুলতানা মুচকি হেসে বলল – এইটা আবার ফেরত দিতে হয় নাকি ? বোকা ! হয়তো ভুলে চলে গেছে । রেখে দাও । তোমার কাজে লাগবে ।
ফায়েজ টাকাটা হাতে নিল না । তেমনি বসে রইলো । শিরিন সুলতানাও কোন কথা বলছে না । তিনি ঘাড় আলতো বাঁকা করে ফায়েজকে দেখছেন ।
ফায়েজ গতকাল মেসে ফিরে বেতনের খাম খুলে যখন ৫০০ টাকা অতিরিক্ত আবিষ্কার করে , মনে মনে সে খুশি ই হয়েছিল ।
হিসাব করে মাস পাড় করা ফায়েজদের জন্য অতিরিক্ত ৫০০ টাকা অবশ্যই আশীর্বাদক । কিন্তু পরক্ষনেও ফায়েজের মনে হল ৫০০ টাকাটা তার ফেরত দেয়া দরকার । এমনও তো হতে পারে ৫০০ টাকার নোট ইচ্ছাকৃতভাবে তার খামে এসেছে । বড়লোকদের অনেক খেয়ালের ভিতর এইটাও একটা খেয়াল । তাদের বাচ্চাকে পড়ানো গৃহশিক্ষক কতোটা লোভী ৫০০ টাকা অতিরিক্তভাবে খামে ভরে সেটা পরীক্ষার করা হচ্ছে না , এই গ্যারান্টি কে দিবে ? এই পরীক্ষায় যদি ফায়েজ ফেল করে তবে হয়তো তাকে আর ইমাদের শিক্ষকদের লিস্টে রাখা হবে না । পাঁচ হাজার টাকার কাছে পাঁচশ থাকা জলাঞ্জলি দেয়া সে ক্ষেত্রে কিছুই না ।
কে জানে এই খেয়ালি পরীক্ষায় পাস করলে ফায়েজকে হয়তো আরও বড় কোন পুরস্কার দেয়া হতে পারে । বিত্তবানদের হাতেই স্বর্গ থাকে , এই শহরে ধাক্কা খেয়ে ফায়েজ এই সত্য ভালমতোই শিখেছে ।
নীরবতা ভাঙলেন শিরিন সুলতানা । তিনি কিছুটা কৌতুকের ঢঙে ফায়েজকে বললেন
– ঠিক আছে , তুমি যদি ৫০০ টাকা বিনাকারনে নিতে না চাও , তবে আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দাও । পারবে ?
ফায়েজ ঘাড় কাঁত করে জানালো – সে পারবে ।
শিরিন সুলতানা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন । ভিতরের রুমে চলে যাওয়ার দুই মিনিটের মাথায় তিনি কালো প্যাকেট হাতে ফিরলেন । এবার তিনি ফায়েজের বিপরীত সোফায় না বসে বসেছেন ঠিক তার পাশের সোফায় । ভদ্রমহিলার গা থেকে বিদেশী কোন পারফিউমের হালকা সুবাস আসছে ।
শিরিন সুলতানা ফায়েজের চোখে সরাসরি তাকিয়ে বললেন –
--ধানমন্ডীর সাতের শওকত শপিং মলের দ্বিতীয়তলায়
জোনাকি লেডিস হাউজ থেকে এই প্যাকেট এক্সচেঞ্জ করে আনতে হবে । তাদের বলবে কালোর বদলে সেইম সাইজের লালটা দিতে । রিসিট ভিতরে আছে । চেক করে নিও । তুমি ক্যাবে যাবে , ক্যাবে আসবে । ট্যাক্সি ভাড়ায় টেবিলের ঐ ৫০০ টাকা খরচ হয়ে যাবে । এখন রওনা দিলে ৭ টার মাঝে ফিরে আসতে পারবে ।
ফায়েজ জি আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ালো । দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসলেন শিরিন সুলতানা নিজে । দরজা আটকানোর সময় তিনি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন – আমি অপেক্ষায় থাকবো ।
ফায়েজ রাস্তায় নামলো । গলির শেষ মাথায় একটা ইয়েলো ক্যাব । আপডাউন হিসেবে তাতে উঠে বসলো । ক্যাব চলছে ধানমণ্ডির উদ্দেশ্যে । রাস্তার মাঝখানে একবার দোকান থেকে দুইটা বেনসন কিনে নিল । তারপর আরামসে সিটে হেলান দিয়ে অনেকদিন পর বেনসনে কষে টান লাগাল ।
ফায়েজ নিজের বিচক্ষণতায় নিজেই মুগ্ধ । তার ধারনা সত্য হচ্ছে । ৫০০ টাকার বিনিময়ে বড় কোন অপরচুনেটি শীঘ্রই তার কপালে আসচ্ছে । ইমাদদের পয়সার অভাব নেই । বেশ কিছু বড় কোম্পানির সরাসরি অংশীদার তারা । আছে হাউজিং প্রপার্টির বিজনেস । ফায়েজ যদি ঠিকমতো তাদের ফ্যামিলির সার্ভিস দিতে পারে তবে ভবিষ্যতে গৃহশিক্ষককের ছাইপাস অবস্থান থেকে ভালো চাকুরী সময়ের ব্যাপার হবে । শিরিন সুলতানার একটা ফোনকল চাকুরী পাওয়ার জন্য যথেষ্ট । ফায়েজ ভিতরে ভিতরে দারুন উত্তেজনা অনুভব করছে । উত্তেজনায় সে বা পা ঝাঁকায় । আজকে বাঁ পা’র ঝাঁকুনিতে ভুমিকম্প না ঘটলেই হয় ।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফায়েজ প্যাকেটের দিকে তাকালো । শিরিন সুলতানা বলেছিলেন ভিতরে রিসিট আছে । রিসিট চেক করতে ফায়েজ প্যাকেটের ভিতর হাত দিয়ে জমে গেল । বিস্ফোরিত চোখে সে প্যাকেট থেকে বের করে আনলো সাদা রঙের একটি ব্রা । সাইজ লিখা 36 DD
ফায়েজের মাথা ঝিম ঝিম করছে । প্রচুর ঘাম হচ্ছে । ফায়েজ বুঝতে পারছে তার সাদা কান টকটকে লাল হয়ে আসছে ।
ফায়েজের মোবাইল বের করে দেখল আজ মঙ্গলবার । আজ ৭ টায় ইমাদের ক্যারাটে ক্লাস । আম্বিয়ার মা তাকে সেখানে নিয়ে যায় । প্রতি মঙ্গলবার । ফায়েজ এইটাও জানে ইমাদের বাবা গত পরশু সিঙ্গাপুর গিয়েছেন । আসবেন নেক্সট উইক । ফায়েজের কানে বেজে যাচ্ছে শিরিন সুলতানার মৃদুস্বরে বলা কথাটি – আমি অপেক্ষায় থাকবো ।
ইয়োলে ক্যাব শওকত শপিং মলের নীচে ব্রেক কষলো । দোতলায় জোনাকি লেডিস হাউজ । ফায়েজ ক্যাব থেকে নেমে সোজা দোতলায় উঠবার সিঁড়ি বরাবর এগিয়ে যাচ্ছে ।
(২)
দীর্ঘক্ষন অপেক্ষা করেছেন ইয়োলো ক্যাব চালক মতিন মিয়া । ঘড়িতে ৭ টা বেজে গেছে । আর অপেক্ষা করা যায় না । ক্যাব জমা দিতে হবে । কিছু বাটপারের জন্য মাঝে মাঝে এমন খারাপ দিন যায় । আজ মতিন মিয়ার তেমনি এক খারাপ দিন । ভাড়াটা মাইর গেল । নাম না জানা ঐ যুবক প্যাসেঞ্জারের উদ্দেশ্যের তিনি বিশ্রী একটা খিস্তি দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে তিনি চললেন গ্যারেজে । গ্যারেজে ক্যাব রেখে ওস্তাদের হাতে চাবি গাড়ি জমা দেয়ার আগে তিনি পিছনের সিটে কিছু পড়ে থাকতে দেখলেন । দরজা খুলে পিছনের সিট থেকে মতিন মিয়া একটা কালো প্যাকেট উদ্ধার করলেন ।
প্যাকেটের ভিতরে ছিল সাদা রঙের ব্রা আর ৫০০ টাকার চকচকে একটি নোট ।
=============================================
অনুগল্প - যৌনাবেগ - পুলিশ ইন অ্যাকশন
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:১৪