দেশ নিয়ে আমি বলতে গেলে একরকম হতাশায় ছিলাম। সব সময় মনে হতো, ইহজীবনে একটা সুন্দর, সুশৃংখল দেশ বোধহয় আমি দেখে যেতে পারবো না। বৃটেনের মতো একটা সুশৃংখল দেশে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে হতাশা আরো বেশীই ছিল। যতোই এদেশটাকে দেখি, ততোই আমার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। আমাদের দেশটা কেন এদের মতো হয় না! এদের থেকে তো আমরা কোন অংশেই কম না। শুধু যদি একটু... ... ...!!!
'এই শুধু যদি একটু' তেই আটকে যেতাম। এখানেই ছিল আমাদের ঘাটতি। সবাই আমরা জানি সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু সেটাকে তুলে ধরবে কে? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধাই তো মূল সমস্যা। যুগ যুগ ধরে এই সমস্যা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে; বিক্ষিপ্তভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে। সবাই যার যার সেফজোনে থেকে আলোচনা করেছে। সেইসব আলোচনাতে কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। আমাদের সহজাত জাতীগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা ভালো কোন পরামর্শে সহজে কান দিই না। সবসময় নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখি। কিন্তু বছরের পর বছর সকালে বাড়ী থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় একখন্ডে বাড়ী ফেরার নিশ্চয়তাহীনতা, বাড়ী থেকে বের হলেই সীমাহীন ভোগান্তি, রাস্তায় চলতে প্রতিপদে দুর্ভোগ ইত্যাদির কারনে সবার মধ্যেই একটা ক্ষোভ দানা বাধছিল দিনের পর দিন। কাজেই একটা আন্দোলন ডিউ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সরকারকে, সিস্টেমটাকে একটা ঝাকি দেয়ার আন্দোলন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ঝাকিটা দিল কারা? স্কুল পড়ুয়া কচি-কাচার দল! অথচ এদের সম্পর্কে কি ভূল ধারনাটাই না ছিল আমার, আমাদের অনেকের। এদেরকে মোবাইলনির্ভর, ডিজিটাল বিপথগামী বলতেও পিছপা হইনি আমরা। সন্দেহ প্রকাশ করেছি এদের কাছ থেকে দেশ ও সমাজ ভবিষ্যতে কি উপকার পাবে তা নিয়ে। কিন্তু এই এক একটি বাচ্চা যে আনবিক বোমার পরিমান শক্তি বুকে ধারন করে আছে, তা বুঝিনি। এটাই আমাদের ব্যর্থতা। ওরা বড়দেরকে, এই সিস্টেমটাকে, সরকারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে; তোমরা যা করছো, তা ভূল। তোমরা আমাদের কাছ থেকে শেখো জনগনকে কিভাবে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হয়। ওরা ওদের কাজ করেছে। এখন ওদের কাছ থেকে শিখে এই শিক্ষাটা মাঠ-পর্যায়ে কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের, বড়দের।
অনেকে বলেন, সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে সবকিছু ঠিকভাবে পরিচালিত করার; জনগনেরও তেমনি দায়িত্ব আছে নিয়ম-কানুন মেনে চলার। এই কথাটা অনেকাংশেই ভূল। সরকার এবং একমাত্র সরকারেরই দায়িত্ব জনগনকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা। শুধু আমরা বাংলাদেশীরা না, সব দেশের সব মানুষের মধ্যেই প্রবনতা আছে নিয়ম ভঙ্গ করার। নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য কোন শাস্তি যদি না থাকে, তাহলে মানুষ মাত্রই নিয়ম ভাঙবে। বৃটেনের রাস্তাঘাটে যত্রতত্র অসংখ্য ক্যামেরা আছে। প্রতিটা সিগন্যালে, পথচারী পারাপারের স্থানে, এখানে-সেখানে ক্যামেরা। এদেশের মানুষ যদি সভ্য-ভব্যই হবে, তাহলে এতো ক্যামেরা কেন? আপনি সিগন্যাল অমান্য করেছেন? ভূল জায়গায় গাড়ী পার্ক করেছেন? নির্ধারিত স্পীডের চেয়ে বেশী স্পীডে গাড়ী চালিয়েছেন? কিছুদিনের মধ্যে অবধারিতভাবেই আপনার ঠিকানায় জরিমানার চিঠি প্রমানসহ এসে যাবে। আপনার লাইসেন্স থেকে কিছু পয়েন্টও কাটা যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরও অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে, জরিমানা দেয়। তাহলে?
এদের সাথে আমাদের পার্থক্য এক জায়গাতেই। এখানে ধরা পড়লে আপনার রক্ষা নাই। শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। ঘুষ, ক্ষমতার বাহাদুরী কিংবা কোন ক্ষমতাশালীর ফোনকল; কোনকিছুই আপনাকে রক্ষা করবে না। এই যে সিস্টেম, এই সিস্টেমটাকে তৈরী এবং রক্ষনাবেক্ষন করে সরকার। জনগনকে বাধ্য করে এই সিস্টেম অনুযায়ী চলতে। জনগনও এই সিস্টেমে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষনিকের উত্তেজনা বা ভূলে কেউ যদিও বা এই সিস্টেমের বিপক্ষে কিছু করেই বসে, এমন শিক্ষাই পায় যে ভবিষ্যতে কিছু করার আগে দশবার চিন্তা করে। আর আমরা বাইরে থেকে এসে এসব দেখে ভাবি, আহা, কি সুশৃংখল আর সুসভ্য জাতী! এদিকে আমাদের তো সর্ষের মধ্যেই ভুত!! তাই আমরা বিশ্বে অসভ্য, উসৃংখল জাতী হিসাবে পরিচিত!!!
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন আমি এখানে নতুন। একটা জরুরী কাজে লন্ডন যাবার ট্রেন ধরতে হবে। সময় নাই। নতুন একটা পার্কিং স্পটে গাড়ী রেখে দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি ওখানে নোটিশ টাঙ্গানো, তিন ঘন্টার বেশী গাড়ী রাখা যাবে না। পরবর্তী তিনদিন ভয়ে ভয়ে থাকলাম কখন না জানি জরিমানার চিঠি আসে! না আসাতে ভাবলাম ব্যাটারা বোধহয় আমাকে ধরতে পারে নাই। ৫ম দিন চিঠি হাজির, আমার গাড়ীর কয়েকটা ছবিসহ। একসপ্তাহের মধ্যে দিলে ৫০ পাউন্ড জরিমানা। না দিলে এরপর প্রতি সপ্তাহে ১০ পাউন্ড করে বাড়তে থাকবে! পরদিনই টাকা ব্যাংকে জমা দিলাম। এই এক শিক্ষার কারনে আজ এতোগুলো বছর পার করলাম এই দেশে, আর একপয়সাও জরিমানা দেই নাই।
তাহলে আইনকে শক্ত হাতে প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব কার? সরকারেরই তো, নাকি? যেই দেশে সরকার ঠিক, সেই দেশে সবকিছুই ঠিক হতে বাধ্য।
আমাদের আইন আছে, আইনের কোন প্রয়োগ নাই। শাস্তি তিন বছর নাকি পাচ বছর তাতে কি যায় আসে? অতীতে আমরা কয়জনকে তিন বছরের শাস্তি ভোগ করতে দেখেছি? আর ভবিষ্যতে কয়জনকে পাচ বছরের শাস্তি ভোগ করতে দেখবো? এই আন্দোলন থেকে যদি সরকার কোন শিক্ষা গ্রহন না করে তাহলে বলতেই হবে আমাদের মতো অভাগা জাতী এই দুনিয়াতে আর একটাও নাই। এখন সরকারকেই ঠিক করতে হবে তারা এই জাতীকে একটি সুশৃংখল জাতীতে পরিনত করবে নাকি জনগনকে আবার পথে নামতে বাধ্য করবে।
আর আন্দোলনে অংশগ্রহন করা বাচ্চাদেরকে বলবো, বড়রা যা করতে পারে নাই তোমরা তা করে দেখিয়েছো; দারুনভাবেই দেখিয়েছো। তোমাদের সম্পর্কে যে ভূল ধারনা আমাদের মনে ছিল, তার জন্য আমরা দুঃখিত এবং লজ্জিত। আমাদের তোমরা ক্ষমা কোরো। আজ আমরা তোমাদের নিয়ে গর্বিত। একদিন তোমাদের ছেলেমেয়েরাও তোমাদের নিয়ে গর্ব অনুভব করবে। আজ আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, শত বিশৃংখলার মাঝেও তোমরা যে শৃংখলার নজীর দেখিয়েছো তা জাতী যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। আজ আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, এই বাচ্চারাই একদিন এই বাংলাদেশকে বদলে দিবে, অবশ্যই দিবে।
আসুন, আমরা সবাই আবার আশায় বুক বাধি।
ছবিটা নেট থেকে নেয়া।