পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ.......
জীবনে কিছু সময়, কিছু দিনের কথা আমৃত্যু মনে থাকে তেমন বেশ কয়েকটি দিন তারিখ আমার জীবনেও খোদাই হয়ে আছে....মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের ১ম সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল আমাদের বৃহত্তর যৌথ পরিবারের সদস্যদের এবং বৃহত্তর যৌথ পরিবারের অনেক সদস্যদের লাইসেন্স করা স্মল আর্মস এবং সিভিল গান দিয়ে.....মুক্তিযুদ্ধ খুব কাছে থেকে দেখেছি। শুধু সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়াতেই একজন বীর উত্তম, একজন বীর বিক্রম এবং চারজন বীর প্রতীক খেতাব পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের উপর কিছু লেখালেখি করার সুযোগ হয়েছিল।
ইতিপূর্বে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়া সম্পর্কে লিখেছিলাম, এবার মুক্তিযুদ্ধে মহকুমা সদর পিরোজপুর এবং নিয়ে লেখা প্রকাশ করছিঃ-
পিরোজপুর মহকুমা ছিল সুন্দরবন সাব-সেক্টরের অন্তর্গত। ২৫ মার্চ এর আগেই পিরোজপুর সরকারি স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ এনায়েত হোসেন খান ছিলেন বেসামরিক প্রধান। ছাত্রইউনিয়নের ফজলু গ্রুপ ও বাদল রবি গ্রুপ পৃথক দুটো ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। আগরতালা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সুবেদার তাজুল ইসলাম ট্রেনিং এর নেতৃত্ব দেন। মহকুমা প্রশাসন বিশেষ করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান পিরোজপুর ট্রেজারিতে রক্ষিত কয়েক কোটি টাকা এবং চার শতাধিক রাইফেল বন্দুক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। প্রায় একই সাথে মহাকুমার সকল থানার পুলিশের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়- যেখানে থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদ বা সহযোগিতা ছিলো। স্থানীয় ভাবে গঠিত মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল পিরোজপুর ট্রেজারির অর্থ ২য় সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার সুন্দনবনে অবস্থান রত লেঃ জিয়াউদ্দীন এর নিকট স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু ভাসানী ন্যাপের ফজলু গ্রুপের সদস্যরা পিরোজপুর ট্রেজারির বেশীরভাগ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পিরোজপুর থেকে একটা লঞ্চ ভর্তি করে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা আর কয়েকশত রাইফেল বন্দুক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলমগীর ১ম সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়ায় নিয়ে আসেন।
২৬ এপ্রিল বরিশাল পতনের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ৫ মে পাকসেনারা পিরোজপুর দখল করে নেয়। পাকিস্তানী দালালেরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফজলুল হক খোকনকে ধরিয়ে দেয়। পাকসেনারা ফজলুল হক খোকন, বিধান চন্দ্র, সেলিম প্রমুখখে গুলি করে হত্যা করে। ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুককে বরিশালে গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়। পাকসেনারা ফারুকের মাথায় বাংলাদেশের পতাকার স্ট্যান্ড ঢুকিয়ে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ফারুক "জয় বাংলা" ধ্বনি দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বরিশাল পতনের পর লেঃ জিয়াউদ্দীন সহযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবনে চলে যান। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। শরণখোলার শামসুদ্দীন, মোরেলগঞ্জের মধু, আসাদ, মঠবাড়িয়ার শহিদুল আলম বাদল (আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি সাওগাতুল আলম সগীর ভাইয়ের ছোট ভাই), আলতাফ হোসেন(সেকেন্ড ওয়ার কোর্সের অফিসার, রক্ষীবাহিনী লিডার, পরে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন), মজিবুল হক মজনু, সুবেদার গাফফার, সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক খলিলুর রহমান চান মিয়া, নৌবাহিনীর সিম্যান নাসিরউদ্দীন, করপোরাল কবীর, বরকত প্রমুখদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে তার ক্যাম্প ছিল। প্রধান ক্যাম্প ছিল সুন্দরবনের বগীতে।
জিয়াউদ্দীন মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে নেন। সুন্দরবন মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকায় হাজার হাজার শরণার্থী ও ছাত্রযুবকদের ভারতে যেতে সুবিধা হয়। শত শত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে সুন্দরবন পথে পটুয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন স্থানে যেত। পাকবাহিনী সুন্দরবন দখন করার জন্য নৌ ও বিমান হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কয়েকটি গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পাক সেনারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী কোনদিন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি। লেঃ জিয়াউদ্দিন পিরোজপুর হতে টুঙ্গিপাড়ায় চলে যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা *হেমায়েত উদ্দিন (বীর বিক্রম) এর উপর কোটালিপাড়া- টুঙ্গিপাড়া এলাকার দায়িত্ব দিয়ে তিনি সুন্দরবনে চলে যান।
*পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই নানা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কজনকে নিয়ে ছোট্ট পরিসরে গঠিত হলেও অচিরেই তা একক কমান্ডে বৃহৎ বাহিনীতে পরিনত হয়ে ৭২টি গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী, যার সদস্য সংখ্যা ছিলো ৪৫০০-৫০০০ জন। এই বাহিনী অনেক গুলো সম্মুখ যুদ্ধ করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় হরিনাহাটি, মাটিভাঙ্গা, বাঁশবাড়িয়া, ঝনঝনিয়া, জহরের কান্দি, কোটালীপাড়া সদর প্রভৃতি স্থানে। অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে বীর বিক্রম পদক প্রদান করা হয়।
এ সময় বাগেরহাটে শামসুল আলম, কবীর আহমদ, আলতাফ হোসেন এর নেতৃত্বে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায় কয়েক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অবস্থান করেন। তারা লেঃ জিয়াউদ্দিনকে কমান্ডার হিসেবে গ্রহণ করেন। জিয়াউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবন অবস্থান করতেন। ইতোমধ্যে পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল ও বাগেরহাট মহকুমা থেকে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনে একত্রিত হয়। জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহ চলতে থাকে। জুলাই মাসে লেঃ জিয়াউদ্দিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারতে অবস্থিত নবম সেক্টর হেড কোয়ার্টারে উপস্থিত হন। তিনি নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও জেনারেল এমএজি ওসমানীর সাথে দেখা করেন। হিরন পয়েন্ট ও মংলা পোর্টে জাহাজ আক্রমণ করার জন্য জিয়াউদ্দিন নৌ কামান্ডো চাইলেন। তাকে ৩৪ জন নৌ কমান্ডো দেয়া হয়। অস্ত্র ও ২০০ লিস্পেট মাইন নিয়ে তিনি জুলাই মাসের ২২ তারিখে সুন্দরবন যাত্রা করেন।
জিয়াউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রায়ন্দা এবং ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম এর নির্দেশে সহঅধিনায়ক শামসুল আলম (আমার বড়ো ভাই জিসি শামস) মঠবাড়িয়া থানা আক্রমণ করে। অন্যদিকে লেঃ আলতাফ, মজিবুল হক মজনু, শহিদুল আলম ১৫ অক্টোবর তুষখালী আক্রমণ করে খাদ্য গুদাম হতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২২০০ মণ চাল-গম নিয়ে আসে।
লেঃ জিয়াউদ্দীন তখন ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দীন। তিনি ১০ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর রায়েন্দা ক্যাম্প আক্রমণ করেন এবং তিন দিন ধরে যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে মোরলগঞ্জের আসাদ, পাথরঘাটার আলাউদ্দীন এবং বরিশাল শহরের কলেজ রোডের টিপু শহীদ হন। শহীদ জোবায়ের আহম্মদ টিপু বরিশাল বিএম স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আলাউদ্দীন (আলো) পাথরঘাটা থানার কাকচিরা গ্রামে জন্ম। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম এবং ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দীনের বাহিনী যৌথভাবে বামনা, মঠবাড়িয়া ও পিরোজপুর থানা দখল করে। ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর এর নেতৃত্বে কাঠালিয়া, রাজাপুর, বেতাগী, ঝালকাঠি থানা আক্রমণ করে। চতুর্দিকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ।
(আমার লেখা "মুক্তিযুদ্ধের টুকরো স্মৃতি" থেকে...যা ধারাবাহিক ভাবে দশ পর্ব প্রকাশিত হয়েছিলো দৈনিক ভোরের কাগযে এবং দৈনিক ইত্তেফাকে দুই পর্ব.)