নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইরাকী কেমিক্যাল বোমায় নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ
সোলেমানিয়া থেকে হালাবজা প্রায় ৯৫ কিঃ মিঃ । মোটামুটি সমতল ভূমির উপর দিয়েই রাস্তা । এটা ইরান সীমান্ত বরাবর একটা শহর । হালাবজা শহর নতুন ভাবে গড়ে উঠেছে, নাম দিয়েছে নিউ হালাবজা। কেমিক্যাল বোমায় বিস্ফোরণের পর জীবিত ও আহত মানুষগুলো মূল হালাবজা শহর ছেড়ে একটু দুরে নতুন বসতি গড়ে নিয়েছে। বর্তমানে বিধ্বস্থ শহরটাকে পুরানো হালাবজা বলে। হালাবজা ইরানী সীমান্ত থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দুরে। ১৯৮৮ সালের মার্চে কুর্দি পেসমার্গার যোদ্ধারা ইরানের সহযোগীতায় হালাবজা দখল করে নেয়। এর জবাবে সাদ্দাম সরকার আর্টিলারি ও বিমান এর সাহায্যে কেমিক্যাল বোমা নিক্ষেপ করে। কেমিক্যাল বোমায় ক্ষয়ক্ষতি ছিল মারাত্বক। প্রায় ৫০০০ নিরীহ কুর্দি এতে নিহত হয় এবং ৭০০০ এর মত নিরীহ মানুষ মারাত্বক ভাবে আহত হয় ও পঙ্গুত্ব বরণ করে।
বর্তমানে সেখানে অল্প কিছু লোক বসবাস করছে । সমগ্র কুর্দিস্থানের জনসংখ্যা ২০ লক্ষ তার মাঝে সোলেমানিয়া গভর্ণরেটে থাকে ৪ লক্ষ। কোন শহর কিংবা গ্রামই আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ না। সোলেমানিয়া থেকে ইরানী সীমান্ত শহর থাওইলার পথে রওয়ানা হলাম। সোলেমানিয়া থেকে বের হয়ে আরাবাত, সাইদ সাদিক ইত্যাদি ছোটছোট জনপদ পেরিয়ে হালাবজা এসে পৌছালাম। অনুন্নত কিছু গ্রাম্য দোকান ও বাড়িঘর। দুরে পাহাড়ের উপর ৪/৫ টা বাড়ি নিয়ে একটা গ্রাম । গ্রামে গেলে কুকুরের ডাক শোনা যায় এই কুকুরগুলো ছাগল, ভেড়াকে পাহারা দেয়। এছাড়া গ্রামে মুরগী পালন করা হয়। কিছু চাষাবাদ ও হয় পাহাড়ের উপত্যকায়, নিচু সমতল ভূমিতে। দু পাহাড়ের ফাকে এ ধরনের সমতল ভূমি আছে । মাটি উর্বর ভাল ফসল ফলে বৃষ্টি বা পানি পেলে । কুর্দিস্থানের সমস্যা হলো এখানে পানির বেশ অভাব তাই চাষাবাদ মুলত বৃষ্টি ও বরফ গলা পানির উপর নির্ভরশীল। বছরের এই সময়টা অর্থ্যাৎ শীতের বরফ গলা শুরু হলেই সারা কুর্দিস্থান হঠাৎ সবুজ হয়ে যায় । পাহাড় সমতল সব সবুজে ঢাকা । গাছে গাছে অজস্র ফল, তিন, আপেল, আংগুর, নাসúাতি, আরো কতকি। ফলের দেশ এই কুর্দিস্থান। ৩/৪ মাসেই সব পরিপূর্ণতা পায় তার পর গরমের শুরুতে তা নি®প্রভ হতে হতে শীতের আগমন পর্যন্ত এই অঞ্চল রুক্ষ হয়ে যায় । এও এক বিচিত্র প্রকৃতির খেয়াল ।
এখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি। এ সময় হঠাৎ ইচ্ছা হলো সেই কেমিক্যাল বোমায় আক্রান্ত শহরটা একটু ভালভাবে দেখে যাই। স্থানীয় লোকজন আমাদের দেখে এগিয়ে এল । আমাদেরকে পুরাতন হালাবজা যাবার পথ দেখিয়ে দিল। ইরান ও ইরাকের মধ্যে তখন যুদ্ধ চলছিল । কুর্দিস্থানে ইরাকীদের রাসায়নিক হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে হালাবজারীররা ইরানি সেনাদের স্বাগত জানিয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগী কেমিক্যাল আলি ওই কুর্দি জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬ মার্চ ১৯৮৮ সালে ইরাকের হালাবজা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল । সেই নির্বিচার সহিংসতা থেকে কুর্দিদের এই শহরটির শিশু ও নারীদেরও রেহাই দেওয়া হইনি । প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের অনুগত সেনারা সেদিন নিজ দেশের কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষকে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে হত্যা করেছিল । হালাবজা জাদুঘরে সেই সব মারণাস্ত্রের (বোমা) কয়েকটি নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের দুই দিন আগে থেকে হালাবজা শহরে সাধারণ বোমাবর্ষণ করা হয়। গ্যাসের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে সাদ্দামের আমলে ইরাকের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেমিক্যাল আলি শহরটির সব বাড়ী ঘরের জানালা ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন । এসব অস্ত্রের কাঁচামাল রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার কারণে এখনো অনেক নারী-পুরুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে । শহরের কয়েকটি এলাকায় এখনো বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব রয়ে গেছে । মানুষ সেসব স্থান এড়িয়ে চলে। এই শহরে ভিএক্স, সারিন, টাবুন প্রভৃতি বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস-সংবলিত বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব রাসায়নিক পদার্থ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিষাক্ত গ্যাসের চেয়েও মারাত্মক ছিল । এই ঘনাটি জানজানি হওয়ার তিন বছর পর ইরাকের উত্তরাঞ্চলে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ফলে সাদ্দমের বাহিনী কুর্দিদের ওপর নতুন করে হামলা চালাতে পারেনি । আজো স্থানীয় লোকজন ২৫ বছর আগের সেই ভয়াবহ দিনটিকে ভুলতে পারেনি। শহরটা পরিত্যক্ত মানুষজন নেই। ভাংগা ঘরবাড়ী আছে কিছু। পাহাড়ের উপর কেমিক্যাল বোমায় নিহত শহরবাসীর স্মরণে একটা স্মৃতিসৌধ, নির্মাণ করা হয়েছে। সাধারণ সৃতিসৌধ, কিন্তু এখানের কান্না ভেজা মর্মান্তিক ঘটনার কথা বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয় এই সৌধ। শরীরে নানা ধরনের মারাত্বক আঘাত/জ্বালা নিয়ে যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও করুন। মানুষের জীবন থেমে থাকে না। হালাবজা বাসীও তাই নতুন উদ্যমে নতুন জায়গায় তাদের জীবন যাপন শুরু করেছে। মনুমেন্টের পাশে কিছু ছবি তুললাম। ১৯৯৩ তে এসে ১৯৮৮ র ক্ষয়ক্ষতি তেমন বোঝা না গেলেও চারপার্শ্বের নির্জনতা মনে করিয়ে দেয় এলাকাবাসী কি মারাত্বক সময় পার করেছিল তখন।
হালাবজার স্মৃতিসৌধের সামনে দাড়ালে দুরের পাহাড় সারি ও মাঝের ধু ধু প্রান্তর দেখা যায়। পাহাড় গুলোতে মাঝে মাঝে ছিটে ফোটা সবুজের দেখা মেলে। সমতল ভূমিতে কখনো হলুদ বালি ও কাকড় বিছানো, কখনো ঘাসের বিস্তার। ইরান ইরাক সীমান্ত জুড়ে লক্ষ লক্ষ মাইন বসানো হয়েছিল সীমান্তেকে সংরক্ষিত করার জন্য । কুর্দিস্থানের এই মাইন এখনো মানুষের মনে বিভীষিকা হয়ে আছে। আজ অবধি মানুষ এই মাইনে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। রাস্তাথেকে বাইরে গেলেই মাইনে পা পড়ার স¤ভাবনা তাই যে কোন কাজ রাস্তার সীমায় সারতে হবে বাইরে গেলেই মৃত্যু ফাঁদ।
সাদ্দাম সরকার এই সীমান্ত এলাকায় কোন মানুষ বসবাস করুক এটা চায়নি। এইসব এলাকার কুর্দিদের সাথে ইরানের সীমান্তপারের কুর্দিদের যোগাযোগ আছে এবং তারা ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানকে সহায়তা করবে এই ভেবে সব কুর্দিদেরকে তাদের নিজস্ব গ্রাম ও শহর ছেড়ে স্যাটেলাইট টাউন এ আসার আদেশ দেয়া হয়েছিল। জোরকরে অনেককে ধরেও আনা হয়েছিল। তবে কুর্দিরা স্বাধীনচেতা তারা স্যাটেলাইট শহরের এপার্টমেন্টে থাকবে কেন। আবার তারা ফিরে গিয়েছিল তাদের জনপদে সেখানের খোলামাঠ, পাহাড়, দিগন্ত তাদের হাতছানি দেয়। পশু পালন করে, কষ্ট করে পানি সংগ্রহ করে হলেও তারা স্বাধীন জীবন চায়। তাই শেষমেষ ইরাকী সরকার কেমিকেল বোমা মেরে এলাকা সাফ করার চেষ্টা করেছিল। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। মানুষের স্বাধীনতা কতদিন হরণ করে রাখা সম্ভব। হালাবজার মানুষ তাই মনে একবুক ঘৃণা নিয়ে এখনো একটু দুরে গিয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে। মাইনের কারনে তারা তাদের জমিগুলোতে চাষাবাদ বা পশুপালন করতে পারছে না। মাঝে মাঝে সাহস করে কেউকেউ চাষাবাদ করে ও পশুর পালকে ছেড়ে দেয়, ফলে কিছু মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব এখনো বরণ করতে হচ্ছে মানুষেকে। স্বার্থের সংঘাত এভাবে দশকের পর দশক ধরে কুর্দিদেরকে নানা ভোগান্তির শিকারে পরিনত করছে। হালাবজার রাস্তা তেমন ভালনা। স্থানীয় প্রশাসন ও এর অর্থনৈতিক অবস্থা অনুন্নত । তবে বোঝা যায় এক সময় প্রাণ চাঞ্চল্য ছিল এখানে । হালাবজার পথে যেতে যেতে অনেক ছোট খাট রাস্তা পড়ল এগুলো গ্রাম গুলোকে সংযুক্ত করেছে । এছাড়াও অনেক রাস্তা দিয়ে ঘোরা পথে সোলেমানিয়াতে যাওয়া যায় যদিও রাস্তার পাশে মাইন পোতা এবং রাস্তাগুলো বিপজ্জনক, নুড়ি পাথরের ও মাঝে মাঝে গর্তও রয়েছে । পাহাড়ের ঢালে বানানো এসব রাস্তায় গাড়ী চালাতে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয় । এখানে রাস্তাগুলোতে গাড়ী কম । ১০০-১২০ কিঃ মিঃ বেগে গাড়ী চালানো যায় যা আমাদের দেশে কল্পনাতীত । হালাবজাতে বেশী সময় থাকা যাবে না, আমাদের গন্তব্য আরও দুরে। দুপুরের পরে নিরাপদ সড়ক দিয়ে তাওইলা শহরে পৌছালাম। শহরের অবস্থা দেখে ও মেয়রের সাথে আলাপ করে আবার সুলেমানিয়ায় ফেরা। সর্বমোট ২৭৫ কিলোমিটার ড্রাইভ করে ইরানের সীমান্তবর্তী শহরগুলো পর্যবেক্ষণ করা হলো। সাথে রইল ইতিহাসের একটা অংশের সাথে নিজের একাত্মতা।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:০৭
শোভন শামস বলেছেন: বাকি লিখা গুলো পরবেন আশাকরি । ধন্যবাদ।
২| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:০৫
মনিরা সুলতানা বলেছেন: ইতিহাসের একটা অংশের সাথে নিজের একাত্মতা।
++++ দিলাম
১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৬
শোভন শামস বলেছেন: ধন্যবাদ। +++
৩| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:২৭
জুন বলেছেন: যে যার কর্মফলের কঠিন শাস্তি পেয়ে গেছে। শুধু খারাপ লাগে নিরীহ মানুষগুলোর জন্য যারা অকারনে ভুগছে কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের নিষ্ঠুরতায়। history repeats itself এ কথাটা সব শাসকরাই মনে হয় ভুলে যায়। যার পরিনতিও সেই একই রকম হয়।
আপনি খুব সুন্দর করে সাবলীল ভাষায় লিখেন।পড়তে ভালোলাগে।পরিচিত গাড়ী দেখে আরো ভালোলাগলো।
+
১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৪৪
শোভন শামস বলেছেন: কুর্দিস্তানের হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছি এই গাড়িতে ।
কত জনপদ , কত মানুষ , কত কি দেখা হয়েছিল।
প্রতিদিন ফিরে এসে ডাইরি লিখতাম।
সেখান থেকে কিছু নিতে এই লিখা।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ উৎসাহ দেবার জন্য।
সাথে থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৪৭
মিত্রাক্ষর বলেছেন: আপনার পোস্টটা পরে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
অনেক ধন্যবাদ।