নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মেঘহীন পরিষ্কার নীল আকাশের তীব্র সূর্যের আলো মেখে তাবু নামে ছোট্ট জনপদে এলাম। এই জনপদ থেকে লাইবেরিয়ার সীমান্ত ৩০ কিঃমিঃ। একটু বন্ধুর পাহাড়ী এলাকা, রাস্তা ঘাট লাল মাটির, এলাকা অনুন্নত, মানুষজন তেমন নেই। লাইবেরিয়া থেকে বিদ্রোহীরা এসব জায়গায় মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে। তাবু থেকে ঠিক হলো সান পেড্রোতে রাত কাটাবো। সাগর ,পাহাড়, নীলাকাশ নিয়ে স্যান পেড্রো, এটা আইভরিকোষ্টের একটা বন্দর নগরী। দেশের দক্ষিণে বলে সরকার সমর্থিত ইয়ং পেট্রিয়টদের নিয়ন্ত্রনে।
যুদ্ধাবস্থার কারণে পোর্টের কাজকর্ম এখন থেমে থেমে চলছে। সাগরপাড় ঘেষে অনেক হোটেল। রাস্তা গুলো ওয়ান ওয়ে মাঝে আইল্যান্ডে সুন্দর গাছ গাছালী। প্রত্যেকটা হোটেলের সামনেই তাদের নিজস্ব বিচ। বোঝাই যায় এক সময় পর্যটকে ভরে থাকত এই হোটেলগুলো। হোটেল মালিকরা বেশীরভাগই বিত্তশালী আইভরিয়ান কিংবা ফরাসী। স্থানীয় লোকজন কর্মচারী হিসেবে এগুলো দেখাশোনা করে। হোটেল ইনোটেলে (ঊহড়ঃবষ) চেক ইন করলাম। সুন্দর রিসিপশন একটু ভেতরে গেলে বিশাল খোলা বারান্দায় বসার জায়গা, বার, সিড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে গেলে নীল পরিস্কার সুইমিং পুল। দেখলেই নেমে যেতে ইচ্ছে করে। জায়গার কোন অভাব নেই তাই কোন কিছুই আঁটসাট করে বানানো হয়নি। অনেকগুলো ভিলা আছে এদের, প্রতিটা রুমই সাগরের দিকে মুখ করে বানানো। সামনে বারান্দা। রুমগুলোতে হট ওয়াটার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আছে। আবহাওয়া একটু গরম হলেও সন্ধ্যার সময় সাগরের হাওয়া øিগ্ধ আমেজ নিয়ে আসে। সুইমিং পুলের পাশে কিছুক্ষণ কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে বসে বসে সাগরের গর্জন উপভোগ করছিলাম। হোটেলে নতুন এক অতিথি চেকইন করছে। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলল ইন্ডিয়ান? পরিচয় দিলাম ভদ্রলোক গুজরাট থেকে জাহাজে করে রওয়ানা হয়ে আজ বিকেলেই সানপেড্রোতে পৌছালো,কাঠ ব্যবসায়ী। নামটা মনে আসছে না। তিনি শুনেছেন এখানে ভাল কাঠ পাওয়া যায় তাই চলে এসেছেন। তেমন কাউকে চেনেন না তবে বেশ আত্মবিশ্বাসী, বললেন সব কিছু চিনে নেবেন। তিনি জেনেছেন আরো অনেক ভারতীয় কাঠ ব্যবসায়ী এদেশ থেকে কাঠ নিয়ে যায় এবং আইভরি কোষ্টে অনেক ভারতীয় লোক আছে। আবিদজানের ভারতীয় দূতাবাস ও নাকি তাদের সহায়তা করে। তবে তার ধারনা নেই সানপেড্রো থেকে আবিদজান কিভাবে যেতে হবে। যুদ্ধ বিধ্বস্থ এ সময়ে আবিদজানের রাস্তা নিরাপদ নয়। আটলান্টিক পাড় ঘেষে যে রাস্তা আবিদজান থেকে সানপেড্রো এসেছে তা কয়েক জায়গায় বিধ্বস্থ হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে যাতায়াত।
ভারতীয় লোকটি আশা করছে সে ভালভাবেই কাঠ সংগ্রহ করতে পারবে এবং বন্দরে সে একটা জাহাজ ঠিক করে এসেছে। এই জাহাজে কাঠ বোঝাই করে সে গুজরাট রওয়ানা হবে। তিনি আশা করছেন ব্যবসাতে এবার প্রচুর লাভ হবে, কারণ ভারতে প্রচুর চাহিদা আছে কাঠের এবং এখানে কাঠ বেশ সস্তাও কোয়ালিটি উন্নত মানের। সন্ধ্যার দিকে সাগরের গর্জনই শুধু শুনা যাচ্ছিল। বিকেলে বৃষ্টি হওয়াতে সুইমিং পুল এলাকাতে কিছু পানি জমেছে। হোটেলে তেমন বোর্ডার নেই বলে বারে জন সমাগম নেই। রাতে ডিনার শেষে আবার হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলের কটেজ গুলো বেশ সুন্দর । এক ব্লকে ২/৩টা করে রুম। টেবিল ল্যাম্প, এসি, হট ওয়াটার সব সুবিধাই আছে। কটেজ থেকে ও ঝোপঝাড় পেড়িয়ে সাগর বেলায় যাওয়া যায়। রাতে আর সাগর পাড়ে গেলাম না। সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুম এসে গেল। নাইজেরিয়ান একজন বোর্ডার ছিল পাশের রুমে সন্ধ্যার পরেই সে বারে চলে গেল। ফরাসী ভাষা সে কিছু কিছু জানে। রাত ১১টার পর রুমে ফিরে এলো তবে একা মনে হলো না। সাথে রাতের অতিথি নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ হাসাহাসির শব্দও শুনলাম ঘুমাতে যাওয়ার আগে। ভোর বেলা তার রুম থেকে বিদায় নিয়ে কে যেন চলে গেল। সকালে উঠে এমন ভাবখানা কিছুই হয়নি। আসলে এসব দেশে এগুলো তেমন একটা ধত্যব্যের মধ্যে আনে না।
সকালে শহর দেখতে বের হলাম, সানপেড্রো পাহাড় আর সাগরের কোলে গড়ে উঠা জনপদ। পাহাড় গুলোতে সবুজ গাছ পালা রয়েছে। বৃষ্টি বেশ হয় এখানে। রাস্তা গুলো একসময় পিচঢালা থাকলেও এখন অযতেœ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু কিছু রাস্তা নুড়ি বিছানো তবে অবস্থা ভালই। বিশাল একটা ফ্যাক্টরী কম্পাউন্ডে এলাম এর ভেতর বেশ কিছু খালি গোডাউন এবং কয়েকটা ঘর রয়েছে। বর্তমানে এটা বন্ধ এবং সবকিছু প্রায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর বিশাল এলাকায় যুদ্ধ বিরতীর পর শান্তি প্রক্রিয়ায় শুরুতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয়ার জন্য জায়গা ঠিক করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত জায়গা কাজেই তেমন কোনো সমস্যা হবে না। রুয়ান্ডার অধিবাসী দুজন মহিলা কর্মকর্তা স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে তাদের কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হচ্ছিলেন। এরপর জাহাজ ঘাটা দেখার জন্য রওয়ানা হলাম। এখানে জেলেরা সাগরের মাছ এনে বিক্রি করে। সানপোড্রো একটা বড় মৎস ব্যবসা কেন্দ্র। মাছকে ফরাসীতে বলে পয়সোঁ। বিশাল বিশাল মাছ উঠেছে আড়তে। পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসেছে আশে পাশের এলাকা থেকে। বিদেশি আমরা কয়েকজন মাত্র, এশিয়ান মাত্র দুজন। মাছের বাজার আমাদের দেশের মতই। কাঁদা কাদা অবস্থা। মাছ পছন্দের পর সুন্দর করে কেটে বরফ দিয়ে মজবুত ভাবে প্যাকেট করে দেয় জেলেরা। সব ব্যবস্থাই এখানে আছে এবং কর্মীরা বেশ দক্ষ। মাছের প্যাকেট গুলো গাড়ীতে তুলে দিল। ভাল ভাবে মোড়ক করে দিল যাতে পানি বাইরে না আসে। দুপুরে হালকা খাওয়া দাওয়া হলো সাথে ড্রিংকস।
আবিদজান থেকে সানপেড্রোতে এসে একটু পরিবর্তনের ছোয়া পেলাম। আবিদজান হলো জাঁক জমকপূর্ণ নগর,সেখানে স্যান পেড্রো প্রকৃতির কোলে পাহাড় ও সাগর দিয়ে গড়া বিশ্রাম ও প্রমোদের উপযুক্ত জায়গা। যুদ্ধ থাকাতে পর্যটক অনেক কমে গেলেও এর বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যুক্ত হোটেল গুলো দেখলেই বোঝা যায় এক সময় সমঝদার পর্যটকরা এখানে তাদের অবসর কাটাতে ভীড় জমাতো। একটা এয়ার ষ্ট্রীপ আছে ছোট খাট বিমান ও হেলিকপ্টার এখানে নামে। বিমানবন্দরের অবস্থা ঢিলেঢালা কাষ্টম পুলিশ,এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সবার মধ্যে একটু ঢিলেমি ভাব। প্লেন তেমন একটা আসে না বেতনও নিয়মিত হয় না, তাই এ অবস্থা। আমাদের ফিরতে হবে আবিদজানে, বাহন হেলিকপ্টার, পাইলট ইউক্রেনের। হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রোটরে প্রান এলো তারপর যন্ত্র ফড়িং উড়াল দিল আকাশে। আটলান্টিক ডানে রেখে বামে পাহাড় ও বন দেখতে দেখতে আবিদজানের পথে। দুরে সাগরের মাঝে ছোট ছোট কতগুলো বিন্দুর মত জাহাজ দেখা যায়। এগুলোর বেশির ভাগ তেলবাহী ট্যাংকার এবং কিছু কার্গো শিপ। এই বিশাল সাগরের বুকে ওগুলোকে ছোট ছোট অলংকারের মত লাগছিল। বিকেল হয়ে আসছে আর লেগুন ঘেরা আবিদজান কাছে চলে আসছে। দূর থেকে আবিদজান পোর্ট, তেল শোধনাগারের চিমনী দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে আমরা আবিদজান এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। পশ্চিম আফ্রিকার সুন্দর পর্যটন শহর সানপেড্রো থেকে সুন্দর কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকৃতি ও সাগরের সাথে কিছু সময় অবস্থান করে ফিরে এলাম ব্যস্ততার শহর আবিদজানে।
©somewhere in net ltd.