নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বপরিবারে বেড়াতে যাচ্ছি তাই রোদ ছায়ার মত আবহাওয়া মনে মনে চাইছিলাম । সকালে বাসা থেকে রওয়ানা হয়ে আটটার আগেই বিমান বন্দর রেলষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম । আমাদের গন্তব্য চট্রগ্রাম । চট্রগ্রাম যাওয়ার জন্য বাসের চেয়ে ট্রেনে ভ্রমণ আরামদায়ক তবে অবশ্যই যদি সময়ের কোন বাধা না থাকে । আমার ছোট্ট মেয়ে কখনো ট্রেনে চড়েনি তাই এবার বহু বছর পর সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনে করে যাব । ট্রেনের সমস্যা একটাই সময়মত ষ্টেশনে আসতে হয় । আগে টিকিট কিনে নিতে হয় । এখানে একটা চক্র কেন যেন এই লাভজনক ও আরামদায়ক রেলভ্রমন থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে তৎপর, রেলওয়ের কর্মচারীরা এর সাথে আছে কিনা জানা যায় না । এক সপ্তাহ আগে এলেও বলে যে সিট নাই । অথচ ট্রেনে অনেক সিট খালি । ভাবলাম হয়ত ষ্টেশন অনুযায়ী কোটা সিস্টেমে সিট বরাদ্ধ, তাও দেখি ঠিকনা । ঢাকা থেকে অন্যান্য ষ্টেশনে লোক নামার পর সিট আরও খালি হয়ে গেছে ।
একটার পর একটা আপ এবং ডাউন ট্রেন আসছে যাত্রীরা কোলাহল করে উঠানামা করছে । সকালে প্লাটফর্ম ভর্তি লোকজন । ৮-২৫ এর দিকে যাত্রী একটু কম মনে হলো । ট্রেন আজ লেট হবে তবে তেমন লেট হলো না । যথাসময়ে ট্রেন এলো কুলির সাথে আগেই রফা হয়ে গিয়েছিল । ট্রেনে নিজেদের আসনে গিয়ে বসলাম । ষ্টেশনে আমার মেয়ে ট্রেন গুলোর আসা যাওয়া দেখছিল । এখন সে রোমাঞ্চিত যে সে ট্রেন দেখতে পেয়েছে । ছয় বছরের শিশুর জন্য ট্রেনে ভ্রমণ বেশ আনন্দের অভিজ্ঞতা ।
সিন্ধা চেয়ার কোচের সিটগুলো ও পরিবেশ বেশ সুন্দর এসিও ভাল সার্ভিস দিচ্ছে । কোরআন তেলওয়াত এর সাথে যাত্রা শুরু হলো এবং যাত্রা পথে বাংলা গান ভালই লাগছিল । এই কোচগুলো নতুন, ভারতে তৈরী । দিল্লী থেকে আগ্রাক্যান্ট যাওয়ার সময় ভূপাল এক্সপ্রেসের কামরাগুলোও এর মত তবে এখানে দু সিটের মাঝে ফাঁকা জায়গা একটু বেশী না ছড়ানো যায় । ভুপাল এক্সপ্রেসে নাস্তা খেতে দেয় আর এখানে বুফেকারের খাবার ওয়েটারদের কাছ থেকে কিনে খেতে হয় । বেশ আরামদায়ক ভ্রমণ হবে আশা করছিলাম । আমার মেয়ে বেশ খুশী সব কিছুই তার কাছে নতুন । আমার পাশে বসা ভ্রদ্রলোক ব্যবসায়ী । ট্রাভেল এজেন্সী আছে চট্রগ্রামে। হজ্জ কাফেলা নিয়ে যায় হজ্জের সময় । তার দুই ছেলে দু’জনেই পড়াশোনায় ভাল এবং আচার ব্যবহারে মার্জিত। একজন গর্বিত পিতা মনে হলো তাকে। ওপেন হার্ট সার্জারী করেছেন এ্যাপেলো হাসপাতালে তবে জটিলতা হয়েছে কিছুটা । সমস্যা হয় মাঝে মাঝে। সমস্ত সুখের মাঝেও যেন একটু অসুখ। তিনি বিভিন্ন দেশে সপরিবারে ভ্রমণ করেছেন এবং বেশ ধার্মিক। তার বড় ছেলে থাইল্যান্ড থেকে বিবিএ শেষ করে এখন বাংলাদেশে, ভবিষ্যতে ব্যবসাতে যোগ দেবে। গল্প করে সময় কেটে গেল বেশ। ট্রেনের গতি মোটামুটি ভালই মুহুরী নদী,ফেনী নদী পার হয়ে ট্রেন চট্রগ্রামের সীমানায় প্রবেশ করল। বিকাল ৩-৩০ এ আমরা চট্রগ্রাম ষ্টেশনে এসে পৌঁছালাম। কিছু মিষ্টি কেনার জন্য চট্রগ্রামের ওয়েল ফুড এ গেলাম। বেশ ভাল ও মানসম্পন্ন মিষ্টি বানায় এরা । আগে সুইটম্যাক্স ছিল মিষ্টিতে সেরা । বিকেল বেলা বৃষ্টি এলো বাইরে যাইনি বৃষ্টি কমে আসলে চট্রগ্রামের পাহাড়ের দৃশ্য দেখলাম। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামের সৌন্দর্য আলাদা । আমাদের পরবর্তী দিনের গন্তব্য কাপ্তাই হয়ে রাংগামাটি।
সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি ও হয়ে গেছে এক পশলা। পাহাড়ী পথে কাপ্তাই যেতে হবে । চট্রগ্রাম শহরের বহদ্দার হাট ছাড়ার সাথে সাথেই মুষলধারে বৃষ্টি । সারা রাস্তাই বৃষ্টি ছিল । বর্ষায় ভ্রমণ এখনো তেমন গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেনি কিন্তু এ ভ্রমনেরও মজা আছে । বৃষ্টির কারণে গরম অনেক কমে গিয়েছিল এবং রাস্তার দু’পাশের জমিগুলোতে পানি থই থই করছিল। কাপ্তাই এর পাহাড়ী রাস্তার চড়াই উৎরাই গুলো বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক থাকলেও আমরা সীমিত গতিতে মাইক্রো নিয়ে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও আকাশে মেঘ ছিল । পাহাড়ের চড়াই থেকে দুই পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা অনেক নীচের নদীর দৃশ্য অপূর্ব লাগছিল । নীচে পাহাড়ের ঢালে পাহাড়ী মানুষজনের বাড়ীঘর গুলো খেলনা বাড়ির মত সাজানো মনে হচ্ছিল। বৃষ্টি পাহাড় গুলোর সবুজ গাছপালা ও ঘাসগুলোকে আরো সবুজ ও আকর্ষনীয় রুপ দিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে পাহাড়ের ছোট খাট ভূমিধ্বস ও তার মাঝে গাছের শিকড় ও ডালপালা রাস্তার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল যদিও আমাদের তেমন অসুবিধা হয়নি। পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুক্ষণ পরপরই মাঝারি ও ছোট ছোট ঝর্ণা গুলোর পানি নীচে পড়ছিল । সে এক অপূর্ব দৃশ্য । আমার মেয়েটা আরামে শুয়ে থাকলেও ঝর্ণা গুলো দেখে খুশিতে ওয়াও বলে উঠছিল । কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে অনুমতি নিয়ে ভেতরে গেলাম। সেখানে উপর থেকে দাড়িয়ে নীচে পানির দ্রুত বেগে এগিয়ে যাওয়া দেখছিলাম। এই পানি গুলো টারবাইনের পাখাকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বেড়িয়ে যায়। নীচে বেশ স্রোত । এর পর যেখানে স্লুইস গেইট দিয়ে পানির লেবেল ঠিক রাখা হয় সেখানে গেলাম। বিশাল বাঁধ অনেক গুলো গেইট । এগুলোর মাধ্যমে পানির লেবেল নিয়ন্ত্রন করা হয়। পানি বেড়ে গেলে আস্তে করে লোহার গেইট তুলে পানি বের করে দেয়া হয়। নীচ থেকেই দেখলাম প্রচুর মাছ এই লেকে ।
টিপটিপ বৃষ্টি ঝড়ছিল। লেকে বোট ট্রিপের ব্যবস্থা আছে কিন্তু বৃষ্টির জন্য সেই প্রোগ্রাম বাদ দিলাম। পাহাড়ের উপর থেকে অপূর্ব সুন্দর কাপ্তাই লেকের ছবি তুললাম। দুপুরে খাবার খেয়ে রাংগামাটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, কাপ্তাই রাংগামাটি লিংক রোড দিয়ে । রাস্তা ভালই আমাদের মাইক্রো এগিয়ে চলল। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছিল এবং থেমে যাবে বলে মনে হলো। পাহাড়ের গা ঘেষে এঁকে বেকে রাস্তা এগিয়ে চলছে। কখনো চড়াই কখনও উৎরাই । পাহাড়ের চ’ড়াগুলোর কাছাকাছি আসলে নীচের পাহাড় গুলো ও দুরের পাহাড়ের দৃশ্যাবলী মনটাকে ভরিয়ে দেয়। জনমানব বেশ কম, পাহাড় গুলোতে কৃত্রিমতার ছোয়া এখনো পড়েনি। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি আমদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির গতি কমিয়ে তাদেরকে পার হতে দিচ্ছিলাম আমরা। অনেক সময় রাস্তার খুব কাছেই গিরিখাদ। একবার রাস্তার বাইরে গেলে নির্ঘাত বিপদ। এইসব পাহাড়ী পথে উদ্ধার অভিযান কতটুকু সফল হবে তা ভাবার বিষয়। রাংগামাটি কাপ্তাইয়ের চেয়ে সাজানো গুছানো এবং এখানে পর্যটকদের জন্য অনেক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা আমাদের রেষ্ট হাউস ‘ গাঙশালিক’ এ চলে এলাম। এখান থেকে লেক ও পাহাড়ের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । রেষ্ট হাউজের সামনে সুন্দর সবুজ ঘাষের মধ্যে পায়ে হাটা রাস্তা । একটু এগিয়ে গেলে ঢাল লেকে নেমে গেছে। নীচে লেকের পানি দেখা যাচ্ছে । সোজা চোখ তুলে দেখলে ছোট পাহাড় দ্বীপের মত দাড়িয়ে আছে। একটু দুরে দুরে বড় পাহাড় গুলো এবং এগুলোর ফাঁকে লেকের পানি । মনে হয় সমস্ত পাহাড় গুলো পানিতে ভাসছে। দুর পাহাড়ে পাহাড়ী মানুষজন বাস করে। লেকের মধ্যে বেশ দুরে বড় সিমেন্ট দিয়ে বানানো ছাউনি। সেখানে চেয়ারে বসে লেকের দৃশ্য দেখে সময় কাটানো যায়। এই এলাকায় এধরনের দুটো কটেজ আছে। অনেকটা সুইজারল্যান্ডের ছবিতে যে রকম কটেজ দেখা যায় সে আদলে বানানো চারিদিক কাঁচ দিয়ে ঘেরা, রুমে বসে পর্দা সরিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখা যায় । দুই কটেজের মাঝে ছোট সুইমিং পুল । আমার ছেলে মেয়ে ও আমি মিলে সাঁতার কাটতে নেমে গেলাম। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল । সাঁতার এর চেয়ে ঝাপাঝাপিই বেশী হল। মেয়েটাকে একটু সাঁতার শেখাতে চেষ্টা করলাম। কটেজটা অপূর্ব সুন্দর ঢুকতে ছোট বারান্দা এবং বসার হল। দুপাশে দুটো বেড় রুম। হলের মধ্যেই ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। অন্য দুইদিক কাঁচের দেয়াল ও কাচের দরজা। তাই এখানে বসে সব দেখা যায় । লেকের অন্য দিকে কটেজের পেছনে পাহাড় সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প দেখা যায়। মধ্যে ছোট্ট একটু নালার মত। একটা ছোট বাশের সাকো দিয়ে অন্য পারে গিয়ে সেই ক্যাম্পে যেতে হয়। নালার পানি বৃষ্টির প্র একটু একটু বাড়ছিল। এই নালাটা কটেজ পার হয়ে পাহাড়ের নীচদিয়ে লেকে এসে মিশেছে।
একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল এর ভালো দিকটা হলো এতে গরম কমে গেছে এবং একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এসেছে। গরম চা খেলাম। এখানে খাবার ও চা আনার জন্য ওয়েটার আছে। সার্ভিস ভাল। বিকেল বেলা রাংগামাটির ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে বের হলাম। কটেজ থেকে বেশ দুরে। পাহাড়ের আঁকা বাকা পথ পেরিয়ে বাজার দোকানপাট এর মাঝ দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে পর্যটনের এলাকায় চলে এলাম। এখানে পর্যটনের মোটেল আছে এবং তার সামনে টিকেট কাউন্টারে ১০ টাকার টিকেট কেটে ঝুলন্ত ব্রিজে গেলাম। ব্রিজের নীচের পানি এবার কম। বৃষ্টি হওয়াতে আস্তে আস্তে পানি বাড়বে। এই বর্ষায় পর্যটক তেমন নেই। অনেক গুলো নৌকা দাড়ানো আছে ওপারে । লোকজন নেই । নৌকা গুলো ঘন্টায় দুইশত টাকা করে ভাড়া। অনেক পর্যটক প্রকৃতি দেখতে পেদা টিং টিং এলাকায় নৌকা করে ঘুরে আসছে। এখানে জলপ্রপাত দেখা যায় । বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম ব্রিজ ও আশেপাশের এলাকার। বেশ ভালই হলো ছবিগুলো। এরপর আমরা উপজাতীয়দের বানানো কাপড়চোপর এর দোকান গুলোতে গেলাম । এখানে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী তাঁতে কাপড় তৈরী করে এখন মিলেও কিছু কিছু কাপড় তৈরী হচ্ছে। এগুলোর বৈশিষ্ট হলো উজ্জল নজর কাড়া রং। আমাদের সবার জন্যই কিছু কিছু জিনিষ কেনা হলো। স্কার্ট,টপস,ত্রিপিস শার্ট বেশ সুলভ মুল্যে দেখতেও ভাল । সুভ্যেনির হিসেবে কেনা যায়। তেমন বেশী দাম চায় না। দোকানীরা সবই পাহাড়ি মহিলা এবং এরা স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিনতে কিনতে রাত নেমে এলো। বৃষ্টি থামছে না। আমরা ফিরে এলাম কটেজে। রাতে কেনাকাটার জিনিষ গুলো গোছালাম। অন্ধকার রাত, বৃষ্টি, চারদিকে পানি বাড়ছে লেকে ও পাহাড়ে তেমন কোন আলো নেই তাই সবই অন্ধকার । অন্ধকারে বৃষ্টির শব্দ কিছুক্ষণ অনুভব করে ঘুমের কোলে হারিয়ে গেলাম।
আশা করছিলাম একটা সোনালী সকালের । কারণ সকালে বোটে করে শুভলং ও পেদা টিং টিং ঘুরে আসার প্লান তারপর রওয়ানা হব চট্রগ্রামের পথে কক্স বাজারের দিকে । সকালে খুব ভোরে উঠে পর্দা সরিয়ে দেখলাম মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ৯-৩০ এ বোট জার্নির কথা নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করছি বৃষ্টি যদি একটু কমে । লাঞ্চের অর্ডার দিলাম কারণ দেরী হবে বুঝতে পারছি। কক্সবাজারে বিকেল নাগাদ পৌঁছা যাবে না তাই আপাতত রাংগামাটির নৌকাভ্রমণটা উপভোগ করতে চাইছিলাম। বৃষ্টি আর থামেই না। পরে ১০টার দিকে বৃষ্টি একটু কমে আসায় সবাই মিলে বোটে উঠলাম। হালকা বৃষ্টিতে বোট এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই বৃষ্টির স্বাধ পাচ্ছিল। বাতাস তেমন ছিলনা বলে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আবহাওয়া কেন যেন প্রসন্ন ছিল না। একটু পরে বৃষ্টি বেড়ে গেল। নৌকা চলছিল তখনো । বাতাস ও বৃষ্টির বেগ আরেকটু বাড়ার পর বোট ঘুরানোর জন্য বললাম। তখন বাতাসও বাড়ছিল। ৫ মিনিটের মধ্যে হঠাৎ বাতাসের বেগ বেড়ে গেল সাথে বৃষ্টি। বাচ্চা দুটো বেশ ভয় পেল। বাতাসে প্লাষ্টিকের চেয়ার গুলো নৌকার পাটাতনে পড়ে গেল , সবাই দাড়িয়ে গেল বোটে । জোরে বাতাস টের পেয়ে বোটের মাঝি বোটকে একটা ছোট পাহাড়ের আড়ালে নিয়ে রশি বেধে রাখল। সামনে থেকে বেশ জোরে বাতাস আসছে। ১৫ মিনিটের মত আমরা সেখানে অপেক্ষা করলাম। উপরে চাকমাদের বাড়ি ছিল। বাড়ীর লোকজন কোন সমস্যা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করল এবং বলল এ বাতাসে যাওয়া যাবে। আমাদের একটু দুরে দিয়ে বাতাস উপেক্ষা করে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে একজন এগিয়ে গেল। বাতাস তার কাছে কোন বাধা না। বাতাস একটু কমে আসাতে আবার রওয়ানা হলাম। সব কাপড় চোপড় মোটামুটি ভিজে গেছে। যাক ভাল ভাবে ঘাটে এসে পৌঁছালাম। রাংগামাটি লেকে বৃষ্টির মধ্যে বোটে ভ্রমণ এটাও একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ।
রুমে এসে ফ্রেস হয়ে নিলাম। কটেজের নীচে ছোট নালাটা এখন জীবন্ত হয়ে গেছে। বাঁশের সাকোটা পানির তোড়ে ভেসে গেছে। দুর দুরান্ত থেকে অনেক জিনিষ পত্র ভেসে আসছে। স্রোতে এটা লেকের পানিতে মিলছে। লেকের দিকে তাকালে এখন খালের ঘোলা পানির একটা লাইন দেখা যায় সেখানে নানা রকম জিনিষ ভাসছে।
রাংগামাটি লেকের দৃশ্য
কটেজ এলাকার দৃশ্য, রাংগামাটি
গাঙশালিক কটেজ, রাংগামাটি
ঝুলন্ত সেতু , রাংগামাটি
লাঞ্চ করে রওয়ানা দিলাম কক্সবাজারের পথে । রাংগামাটি চট্রগ্রাম ভালই ভালই বৃষ্টি হলো। চট্রগ্রামে আসতে আসতে ৫টা বেজে গেল। “ ওয়েল ফুড” খাবারের দোকানে ঢুকে বিস্কিট কিনলাম। এছাড়া বাসকিন রবিন থেকে আইসক্রিম খেলাম ও নাস্তা করলাম এদের ফ্লাক্স দিয়ে । এরপর ফ্রেস হয়ে কক্সবাজারের পথে রওয়ানা হলাম। ড্রাইভারকে চা নাস্তা খাইয়ে ফ্রেস ও ফিট বানালাম। বৃষ্টি অল্প অল্প পড়ছিল। শেষ ফিলিং ষ্টেশন থেকে গ্যাস ভরে নিলাম মাইক্রোবাসে। কক্সবাজারের রাস্তার দুপাশে বেশ পানি হয়েছে। যেদিকে দুচোখ যায় সেখানে পানির সাগর। আস্তে আস্তে গাড়ী চলছে। আমাদের তাড়া ছিল না। গান বাজছিল গাড়ীতে । আমার মেয়ে আমার কোলে মজা করে বসে আরাম করছিল। পথে একটা মসজিদের পাশে থেমে মাগরেবের নামাজ পড়ে নিলাম। ফিলিং ষ্টেশনে আছরের নামাজ পড়েছিলাম। রাত ১০ টার দিকে কক্সবাজার বিডিআর রেষ্ট হাউজে পৌঁছালাম। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে গেছে। রুমে জিনিসপত্র রেখে বীচ এর সামনে দিয়ে কলাতলী পয়েন্ট এর মার্কেটে গেলাম। আজ রাতে কারো খেতে ইচ্ছে করছিল না। আসার পথে প্রায় ১২ পিসের এক বালতি চিকেন ফ্রাই কিনে এনেছিলাম। পথেই তা শেষ । এই মার্কেট টা এখন সুন্দর ভাবে বানানো ও সাজানো হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে । সেন্ডেল, জুতা রাখার ব্যাগ, ও অন্যান্য ছোট খাট বার্মিজ জিনিসপত্র কিনতে কিনতে সময় কেটে গেল। রাতে রুমে এসে গোসল করে ফ্রেস হলাম। রাতে সাগর পারের গর্জন শুনলাম। বাজার করে আসার পথে বৃষ্টি ছিল তাই পানির কাছে যাইনি। ৩ নং সংকেত ছিল আজ। এবারের কক্সবাজার ভ্রমণ হয়ত ছুয়ে দেখার মত । সাগরে ছোটাছুটি গোসল করার মত সময় পাব না। যদি আবহাওয়া ভাল না হয়।
সকাল বেলা উঠে বাতাস ও হালকা বৃষ্টির মধ্যে সাগরের পাড়ে ঘুরে আসলাম। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠেতে চাচ্ছেনা । দশটা বেজে গেল বৃষ্টি বাড়ছে তাই সাগর পাড়ে আর যাওয়া হলো না। দ্রুত রেডি হয়ে বান্দরবানের পথে রওয়ানা হলাম। বৃষ্টি আর কমে না। পথে ডুলাহাজরা সাফারী পার্ক সেখানে গাড়ী নিয়ে ঢুকে পড়লাম। সিংহ,হাতি,কুমির এগুলো রাখা আছে। বৃষ্টিতে নেমে দেখা হলো না। গাড়ী চলতে চলতে দেখছিলাম গতি কমিয়ে,চেষ্টা ভালই,আরও উন্নত ও পর্যটক বান্ধব করা যাবে এবং সে সাথে প্রচারও বাড়াতে হবে। অনেক রাস্তা পানির নীচে চলে গেছে। আমাদের গাড়ীর চাকা পাংচার হয়ে গেল। বৃষ্টির মধ্যে মেরামত করে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম পথে স্পেয়ার চাকাটাও মেরামত করিয়ে নিলাম । দুরের পথে সব সময় প্রস্তুত হয়ে যাওয়াই ভাল । বান্দরবান পৌঁছাতে পৌঁছাতে ২ টা বেজে গেল । লাঞ্চ করে করে রেডি হয়ে নিলাম। পাহাড়ী পথে প্রায় ৩০/৩৫ কিঃমিঃ পাড়ি দিয়ে আমাদের গন্তব্য নীল গিরি। এটা বান্দরবান থানচি রোডে চিম্বুক পার হয়ে যেতে হয়।
নীলগিরির পথে বান্দরবন
নীলগিরি পথে,বান্দরবন
নীলগিরি এলাকা, বান্দরবন
পাহাড়ি পথ সুন্দর ভাবে বানানো চড়াই উৎরাই পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। দুপাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তা বেশ ভাল। হালকা বৃষ্টি হওয়াতে ভেজা রাস্তা। দুর পাহাড়ের চুড়াগুলো মেঘে ঢাকা। বান্দরবনে ঢুকতেই খুব সুন্দর বিল বোর্ড দেখলাম পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য দর্শনীয় জায়গাগুলোর ছবি বিলবোর্ডে দিয়ে রেখেছে।
বান্দরবনে ঢুকতেই এই বিলবোর্ড দেখা যায়
নীলগিরি ও অন্যান্য জায়গার মনোরম ছবি । রাস্তায় কিছুদুর পর পর প্রতিটি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের ছবি দিয়ে বোর্ড লাগানো আছে। । এতে ঐ উপজাতীয়দের সম্পর্কীত তথ্য লেখা আছে। এভাবে বড় বোর্ডে পাহাড়গুলোরও নাম লিখা আছে। একটা নাম বেশ মজা লাগল লং বাই টিং টিং পাড়া । এছাড়া ফারুক পাড়া ও অন্যান্য অনেক পাড়া পথে পরে। প্রতিটা পাড়ায় ছোট ছোট দোকান আছে। রাস্তার পাশেই দু’চারটা ঘর পাহাড়ের ঢালে আরো কিছু ঘর আছে। পাড়াগুলো সাধারণত পানির সহজ উৎসের কাছে গড়ে উঠে। ছোট্ট দোকানে কলা ও আনারস বিক্রির জন্য রাখা আছে। পাহাড় জুড়ে অসংখ্য কলা ও আনারসের বাগান, অপূর্ব দৃশ্য। পাহাড়ের চুড়ার দিকে একটা বাঁকে গাড়ি থামালাম। মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো ঝিকমিক করছিল নীচে। দেখলাম একটা পাহাড়ী নদীতে রোদ পড়ে ঝকমক করছে। বহুদুরের,অনেক নীচে নদী,দুরের পাহাড়গুলো মেঘে ঢাকা,মাঝে মাঝে মেঘ সরে চূড়া দেখা দেখা যাচ্ছিল। ক্যামেরা ক্লিক করে উঠল । সন্ধার আগে গন্তব্যে যেতে হবে তাই এখানে দেরী না করে রওয়ানা হলাম। কিছুদুর পরপরই পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট পানির ধারা ঝরনার মত অনেক উপর থেকে নীচে পড়ছে। একদিকে সবুজ পাহাড় অন্যদিকে গভীর খাদ ও দুরে পাহাড়। দু’এক জায়গায় বেশ বিপজ্জনক খাদ রাস্তার পাশে। মেরামতের কাজ চলছে। মাঝে মাঝে উল্টাদিক থেকে আসা ট্রাক ও জীপকে সাইড দিতে গিয়ে থামতে হচ্ছে। খুব সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতে হয়। ডান দিকে তাকালে দুরের মেঘের রাজ্য যা পাহাড় গুলোকে ঢেকে রেখেছে, মেঘের মধ্যদিয়ে চলার সময় মেঘ আমাদের গাড়ীর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। বাচ্চারা মেঘ ধরার খেলা করছে। সবাই খুশী, পথে তেমন বৃষ্টি ছিলনা তবে মেঘগুলোর ফোটা পড়ছে রাস্তায়, রাস্তা ভেজা ও পিচ্ছিল । ৬-৩০ এর দিকেই পাহাড়ের উপর মেঘে অন্ধকার হয়ে গেল। আমাদের গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম তখন হালকা বৃষ্টি ও মেঘে ঢাকা কটেজ গুলো অপূর্ব লাগছিল। মেঘ ও বৃষ্টির ফোটা মাথায় নিয়ে আমরা অপূর্ব সুন্দর পাহাড় চূড়ার মনোরম কটেজ লীনায় এসে পৌঁছালাম।
নীলগিরি রিসোর্ট,বান্দরবন
ঝিরঝিরে বৃষ্টি মেঘ ও হাওয়ার খেলা । কাপড় চোপড় বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল । কটেজ এর সামনে ছোট্ট একটুখানি বারান্দা। ফ্লোর ভিজে গেছে বৃষ্টি ও মেঘে । ভেতরে সুন্দর ড্রইং রুম এরপর কমন স্পেস ও এক্সট্রা টয়লেট এবং তারপর উঠে মাস্টার বেড রুম,মাস্টার বেড রুমের দুই পার্শ্বে কাঁচ লাগানো পর্দা দিয়ে ঢাকা ব্যবস্থা ও একপাসে একটা ছোট্ট বারান্দা সেখান থেকে পাহাড়ের নীচ ও দুরের পাহাড়ের রুপ দেখা যায়। । সাথে সুন্দর এটাচ বাথরুম সব মিলিয়ে পাহাড় চুড়ায় অত্যাধুনিক মনোরম ও আরামপ্রদ থাকার ব্যবস্থা। চারিদিকে মেঘে ঢাকা থাকায় তখন তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না । টিভি ও ডিসের লাইনও আছে। তবে নিজস্ব জেনারেটরের থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় বলে রাত ৮ টা থেকে তা চালু হয় ও ১১ টার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। রাতে তেমন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। সন্ধার সময় ডাইনিং এ চা খেতে গেলাম। কাঁচের বিশাল ডাইনিং হল বার আছে সেখানে কোমল পানীয় ও অন্যান্য খাবার আইটেম বিক্রি হয় । চা এর অর্ডার দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল । জুতা খুলে রেখে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা এতে ফ্লোর পরিচ্ছন্ন থাকে ও পরিচ্ছন্ন কর্মীর সংখ্যা কমানো যায়।
একটাই সমস্যা এখানে তা হলো পানি । খাবার এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য পানি বান্দরবন থেকে আনতে হয়। খাবার পানি ১ টাকা লিটার হিসেবে কেনার ব্যবস্থা আছে। বর্ষায় তেমন সমস্যা হয় না করন বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা আছে এবং তা দিয়ে কাজ চলে যায় । চা খেয়ে হালকা বৃষ্টি ও মেঘের মাঝে ঘুরতে বের হলাম। একটা সুন্দর অবজারভেশন ডেক আছে। মেঘ ছাড়া যদিও কিছুই দেখা যাচ্ছিল না তবুও মেঘের সাথে ছবি তুললাম। সন্ধা হয় হয় তখন কটেজে ফিরে এলাম। আমাদের সাথে পানি ও শুকনা খাবার বেশ আছে কোন সমস্যা নেই। সন্ধার পরে পাশের কটেজে গিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। তারপর ডিনারের জন্য আবার ডাইনিং হলে এলাম। আজ রাতে চিকেন ভুনা, বসনিয়ান পরাটা,ঘন ডাল ও পুডিং এর উপাদেয় ডিনার । ডিনার করে বাইরে বেরোতেই সব অন্ধকার। মেঘে ঢেকেগেছে কটেজ গুলোর আলো। ঘোলা ঘোলা ভাব, রাতে আর তেমন কান কাজ নেই । শীতের রাত হলে তারা দেখে রাত পার করা যেত। একটু মশা আছে স্প্রে করে দিতে হয়। তাছাড়া পাহাড়ের পোকামাকড় আলোর টানে কটেজের কাছে চলে আসে। নেট খোলা থাকলে ভেতরে চলে যায় তাই একটু সতর্ক হতে হয়। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনটা ভরে গেল। বৃষ্টি ছিল না সূর্যের লালচে আভা মেঘের উপর পড়ে আকাশের রং বদলে গেছে। হালকা আধাঁর, মেঘ এর মাঝে সামনের পাহাড় সারি নীচের দিকে তাকালে ছোট ছোট দুই তিনটা পাহাড়ীদের বাড়ী, অদ্ভুত দৃশ্য । অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল কারন মেঘ একটু কম ছিল এবং বৃষ্টির সেই ঘোলা ভাব ছিল না। ছবি তুলতে বের হলাম। রিসোর্ট এর আশে পাশের কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ছবি তুললাম। এই ফাঁকে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম। চট্রগ্রাম ফিরতে হবে তাই সবকিছু নিয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলাম। আরো ২/১ দিন থাকলে খুবই ভাল লাগত সময় নিয়ে নীলগিরি ঘুরতে আসব ভবিষ্যতে । একটা সুন্দর সময় নীলগিরি হিল রিসোর্টে কাটানোর অভিজ্ঞতা হলো ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:০৯
মনিরা সুলতানা বলেছেন: ইশশ আপনার বর্ণনা শুনে , বর্ষা তে যেতে ইচ্ছে করছে ...
রাঙ্গামাটি । ইনশাল্লাহ যাব