নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
পাল সাম্রাজ্যের আমলের প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। অতীশ দীপঙ্কর এক আজন্ম জ্ঞানচর্চাকারীর নাম। শৈশব থেকে মৃত্যু অব্দি শিখিয়েছেন প্রেম, দয়া আর ত্যাগের বাণী। বিক্রমশীলা মহাবিহারে দরজার ডানপাশের নাগার্জুনের ছবি অঙ্কিত ছিল আর বামপাশে অতীশের। এ থেকে প্রমাণিত হয় জ্ঞানে তার মর্যাদা নাগার্জুনের তুল্য বলে সেই সময়েই স্বীকৃত। বিবিসি ২০০৪ সালে সর্বকালের সেরা বাঙালির তালিকায় আঠারোতম বলে গণ্য করেছে তাকে। বাংলার মাটিতে জন্ম নেয়া অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এমন এক প্রদীপ; যে আলোকিত করেছে গোটা প্রাচ্যকে। দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথপ্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে ব্কা'-গ্দাম্স নামে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। বৌদ্ধমত প্রচার ও সংস্কারে অতীশের অবদানকে এখনও স্মরণ করা হয় কৃতজ্ঞচিত্তে। বোধিপথপ্রদীপ নামক রচনাতে তিনি মাধ্যমিক মহাযান মতবাদের সাথে হীনযান এবং বজ্রযান মতবাদের সমন্বয় করেন। উল্লেখ করে যান সাধকের ক্রম অগ্রসরমান পথের বিবরণ। বোধিচিত্ত অর্জন থেকে পারমিতা ধ্যান অব্দি। সেই সাথে প্রবর্তন করেন এমন এক শিক্ষাপদ্ধতি; যার ভেতর দিয়ে ব্যক্তির মানসিক ও নৈতিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তিব্বতে ধর্মচর্চার ইতিহাসই বদলে যায় তার পদার্পণে। দ্রোমতন তার শিক্ষাকে ধরে রেখেই প্রতিষ্ঠা করেন বৌদ্ধধর্মের কদম ধারা।আজ এই এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকের ৯৬৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দের আজকের দিনে তিনি লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর এর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ সালে (জন্মতারিখ জানা যায়নি) আধুনিক মুন্সীগঞ্জ জেলায় বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়েনের বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা ও অডিটরিয়াম অবস্থিত। তরি পিতা তখনকার পাল সাম্রাজ্যের অধীনে সামন্তরাজ বিত্ত আর ক্ষমতায় সুপরিচিত রাজা কল্যাণশ্রী। তার মাতা স্ত্রী প্রভাবতী। খুব সম্ভবত স্নিগ্ধতার দিকে নজর দিয়েই নাম রাখা হয়েছিল চন্দ্রগর্ভ। কিন্তু কে জানতো, এই শিশুটাই চাঁদকে ছাড়িয়ে যাবে স্নিগ্ধতায়? প্রজ্ঞা ও চিন্তা দিয়ে বদলে দেবে গোটা জনপদের জীবন? নাম পৌছে যাবে সুমাত্রা থেকে তিব্বত অব্দি? বাংলার মাটি ও বাতাসে বেড়ে ওঠা সেই সন্তানকে পরবর্তী ইতিহাস চেনে অতীশ দীপঙ্কর নামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে চন্দ্রগর্ভের অবস্থান দ্বিতীয়। বড় ভাই পদ্মগর্ভ এবং ছোট ভাই শ্রীগর্ভ। অতীশ দীপঙ্কর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। মাত্র তিন বছর থেকেই ব্যাকরণ আর গণিতে প্রতিভার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান। মা প্রভাবতী ছিলেন ব্রাহ্মণকন্যা; তার কাছেই নেন বেদের প্রথম পাঠ। পিতা দেন তন্ত্রোপসনার হাতেখড়ি। রপ্ত হতে থাকে চিকিৎসাবিদ্যা। আস্তে আস্তে জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন হয়ে গেলেন। আর তা এতটাই জেঁকে বসলো যে, ৯৯২ সালে মাত্র দশ বছর বয়সেই প্রাসাদ জীবনে বিরক্ত হয়ে শুরু করেন নির্জনবাস। বনে অতীশের সাথে সাক্ষাৎ হয় জেতারির ।জ্ঞানতত্ত্ব এবং তন্ত্রে বিস্ময়কর দখলের কারণে রাজা মহীপালের সময়েই পণ্ডিত খেতাব পান জেতারি। পাঠদান করতেন জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান বিক্রমশীলায়। সেখানে অতীশ বুদ্ধধর্ম এবং মতবাদ সংক্রান্ত জটিল বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। জেতারিই তাকে মগদের নালন্দায় প্রেরণ করেন বোধিভদ্রের কাছে। নালন্দার খ্যাতি তখন ভারত জুড়ে। ৯৯৪ সালে বোধিভদ্রের কাছে পৌঁছান অতীশ। রপ্ত করেন চিত্তকে জাগরিত করার শাস্ত্র। বিদ্যাকোকিলের থেকে শূন্যবাদ এবং কৃষ্ণগিরির অভধুতিপের কাছে তন্ত্র ও মহাযান বৌদ্ধ মতবাদে সমৃদ্ধ হন। কর্মচক্রের সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম ধারণাগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠে তার কাছে। হৃদয় উন্মোচিত হয় ধর্মের প্রতি। আঠারো বছর বয়স অব্দি এখানেই ছিলেন। রপ্ত করেন হীনযানী ত্রিপিটক, বৈশেষিক দর্শন, মহাযানী ত্রিপিটক, মাধ্যমিক ও যোগাচারীদের অধিবিদ্যা। বৌদ্ধধর্মের অনুধ্যানিক বিজ্ঞান এবং গুঢ়তত্ত্ব তাকে আকৃষ্ট করেছে বিশেষভাবে। এই জন্যই যান কৃষ্ণগিরি বিহারের রাহুলগুপ্তের কাছে। একজন রাজপুত্রকে এভাবে দুনিয়াবি সম্পত্তির সাথে সংশ্রবহীন অবস্থায় দেখে রাহুলগুপ্ত বিস্মিত হলেন। পরম স্নেহে শেখালেন আধ্যাত্মিক চর্চা, যোগ, ভাষা এবং দৈব তত্ত্ব। একুশ থেকে উনত্রিশ বছর বয়স অব্দি চারটি প্রধান ঘরানার তন্ত্রসাধনা নিয়ে জ্ঞান লাভ করেন অতীশ। পরবর্তীতে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বোধগয়ার মতিবিহারে গমন করেন মহাসাঙ্ঘিক ধারার পণ্ডিত শীলরক্ষিতের কাছে। সেখানে স্বীয় প্রতিভার জন্য লাভ করেন ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’ উপাধি। একশো সাতান্ন জন আধ্যাত্মিক গুরুর সংস্পর্শে থেকে অর্জন করেন বিদ্যা। সেই সময়ের সূত্র এবং তন্ত্রের বাইরেও সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন। দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে স্বদেশে ফিরে আসার পর তিনি বিক্রমশীলা বিহারে অধ্যাপনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথপ্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে ব্কা'-গ্দাম্স নামে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। কয়েক বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের পর ১০৪২ সালে তিব্বতের থোলিংয়ে পৌঁছালো কাফেলা। ভারতীয় ওস্তাদকে বরণ করে নেবার জন্য তিনশো অশ্বারোহী প্রেরণ করা হয় সাদা কাপড়ে সাজিয়ে। অতীশের বয়স তখন ৬০ বছর। সাথে পরহিতভদ্র এবং লোতসওয়ার মতো কয়েকজন শিষ্য। কোনোরূপ বিশ্রামে যাননি তিনি। প্রজ্ঞার আলো বিস্তারের জন্য দৌড়ে বেড়ালেন তিব্বতের এপাশ থেকে ওপাশ। দলে দলে সাধুরা আসলো বোধিধর্মের দীক্ষা নিতে। ইতোমধ্যে রিনচেন চেংপো অনুবাদক হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। অতীশের সাথে আলোচনা হলো সূত্র ও মন্ত্র নিয়ে। একসাথে তারা বিশটিরও বেশি অনুবাদে কাজ করলেন। ধ্যান এবং চর্চা শিক্ষা দেন অতীশ; প্রয়োগ করেন সুমাত্রা থেকে শিখে আসা সেই বিদ্যাও।
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। এসব গ্রন্থ তিব্বতের ধর্ম প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। তিব্বতে তিনি অনেক সংস্কৃত পুথি আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে বঙ্গদেশে পাঠান। অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি ভোট (তিব্বতি) ভাষায় অনুবাদও করেন। তিব্বতি ভাষায় তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতিরা তাঁকে ‘অতীশ’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর মূল সংস্কৃত ও বাংলা রচনার প্রায় সবগুলিই কালক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তিব্বতি ভাষায় সেগুলির অনুবাদ সংরক্ষিত আছে। তিব্বতি মহাগ্রন্থ ত্যঞ্জুরে তাঁর ৭৯টি গ্রন্থের তিববতি অনুবাদ সংরক্ষিত আছে। তাঁর রচিত প্রধান কয়েকটি গ্রন্থ হলো: বোধিপথপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, বোধিসত্ত্বমান্যাবলি, মধ্যমকরত্নপ্রদীপ, মহাযানপথ সাধন সংগ্রহ, শিক্ষাসমুচ্চয় অভিসাম্য, প্রজ্ঞাপারমিতাপিন্ডার্থপ্রদীপ, একবীরসাধন, বিমলরত্নলেখ প্রভৃতি। বিমলরত্নলেখ মূলত মগধরাজ নয়পালের উদ্দেশে লেখা দীপঙ্করের একটি সংস্কৃত চিঠি। চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ নামক গ্রন্থে দীপঙ্কর রচিত অনেকগুলি সংকীর্তনের পদ পাওয়া যায়। সন্ন্যাসী হওয়ার আগে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বিয়ে করেছিলেন। এক বার নয়, পাঁচবার। খুব অল্প বয়সে। তখন অবশ্য তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। ৯ ছেলের বাবা হয়েছিলেন তিনি। এদের মধ্যে একজনেরই মাত্র নাম জানা যায়। সেই ছেলের নাম পুণ্যশ্রী। অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর পদে বসানো হল। তিব্বতের সামাজিক ঐতিহ্যে লামারা তাঁরই ধর্মীয় উত্তরসূরী। তিব্বতেই জীবনের শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে গেছেন অতীশ দীপঙ্কর। বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর ( দ্বিমত আছে) ৭৩ বছর বয়সে লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুন অতীশের দেহভস্ম তেজগাঁও বিমান বন্দর দিয়ে স্বদেশের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে এসে পৌঁছে। আজ এই এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকের ৯৬৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর এর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
©somewhere in net ltd.
১| ১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৩:১৬
রাজীব নুর বলেছেন: অতীশ দীপঙ্কর গ্রেট ম্যান।