নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাসবিহারী বসু। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারা জীবন বিভিন্ন দেশ হতে অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ ও বিপ্লবী কর্মী তৈরীর কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সংগঠক। রাসবিহারী বসুর প্রারম্ভিক সাংগঠনিক শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করেন। ভারত ছাড়াও জাপানে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন এই বিপ্লবী। দিল্লিতে গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জএর ওপর এক ব্যর্থ বোমা হামলায় নেতৃত্ব দানের কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়াতে সক্ষম হন এবং ১৯২৩ সালে জাপানে পালিয়ে যান। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন রাসবিহারী বসু। এই বীর বাঙালি শুধু বিপ্লবীই ছিলেন না- একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং অনুবাদকও ছিলেন। কিন্তু তার সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম কিছু জানে না বললেই চলে। বৃটিশ-ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী তথা চরমপন্থী বিপ্লবী বীর রাসবিহারী বসুর জীবন থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ম এবং তরুণ জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের অনেক কিছু শেখার আছে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৯৪৫ সালের আজকের দিনে টোকিওতে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ এই বিপ্লবীর ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকী। রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসুর মৃত্যুবাষিীকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদের অন্যতম বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৮৮৬ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাবা বিনোদবিহারী বসু ছিলেন ভারত সরকারের প্রেসে একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। রাসবিহারীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র চন্দ্রনগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন । শৈশবে রাসবিহারী বসুর পড়াশুনার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। তাই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।তিনি সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। স্কুলে পড়াশুনার সময় চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সাথে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের (দেশমাতৃকার তরে জীবন উৎসর্গ করা) সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্বান্ত নেন।
জীবনের প্রথম থেকেই রাসবিহারী বসু স্বাধীনতা মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হেয়ে পড়েন। ১৯১২ সালে এই তরুণ বীর বাঙালি ভারতে বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যা এবং আরেকটি সিপাহি বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে মহাষড়যন্ত্র করেছিলেন, যা ইতিহাসে দিল্লী ষড়যন্ত্র এবং লাহোর ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতায় অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। রাসবিহারী বসুকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ১২,০০০ রুপি তথা ৫ হাজার বৃটিশ পাউন্ডের পুরস্কার ঘোষণা করে। এই সময় তিনি কাশী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি এমনভাবে চলতেন যাতে কেউ কোন ধরনের সন্দেহ না করতে পারে। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তিনি কখনো নারী বেশে, কখনো দারোয়ান, কাজের লোক, সন্ন্যাসি বেশে চলাফেরা করতেন। ১৯১৫ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীর বেশে কলকাতাগামী ট্রেনে জাপানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্টেশনে স্টেশনে তাঁর ছবিসহ পোস্টার লাগানো থাকায় রাসবিহারী বসু নানা কৌশল অবলম্বন করে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে জাপানে পৌঁছেন।
(স্ত্রী সোমা তোশিকো'র সাথে রাসবিহারী বসু)
জাপানে এসে তিনি জানতে পারেন চীনা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী-নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেন জাপানে অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ড. সান-ইয়াৎ সেন এবং প্যান্-এশিয়ানিজমের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা তোয়ামা মিৎসুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জাপানে রাসবিহারী বসু তোয়ামা মিৎসুরুর তত্ত্বাবধানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান নাকামুরায়া'র মালিকের বড় কন্যা সোমা তোশিকোকে বিয়ে করেন। ওই বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করা আর সেইসঙ্গে অক্লান্তভাবে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক বছর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবন যাপন করতে হয়েছে তাদের। শাশুড়ি সোমা কোক্কোর ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে দু’সন্তানের জনক হন রাসবিহারী বসু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপে শান্তি স্থাপিত হয়। রাসবিহারী বসুরও পলাতক জীবনের ইতি ঘটে। জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে মুক্তির আলোয় বেরিয়ে আসেন। কিন্তু দাম্পত্য সুখ বেশিদিন তাদের ভাগ্যে সইল না। তাঁর স্ত্রী তোশিকো বসু দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। পত্নীবিয়োগের পর রাসবিহারি বসু ১৯২৭ সালে নাকামুরায়া প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতীয় তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংসের কারি প্রচলন করেন। রাসবিহারী বসুর এই কারি রেস্টুরেন্ট ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’এখনও জাপানে জনপ্রিয়।
(নাকামুরায়া’তে কবিগুরুর সঙ্গে রাসবিহারী বসু ও স্ত্রী সোমা তোশিকো )
১৯৩২ সালে ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন বৃটিশদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। কাজেই তারা সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পলাতক বিপ্লবীদেরকে গ্রেপ্তার করা যায়। রাসবিহারী বসু জাপানে বিয়ে করে জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ফলে সে সুযোগ নস্যাৎ হয়। ১৯৪১ সালে বহু বছরের পরাধীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই বছর রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিও, য়োকোহামা, ওসাকা, কোবে, নাগাসাকি প্রভৃতি জায়গায় বসবাসরত ৭০ জনেরও বেশি ভারতীয় জড়ো হয়ে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র মহাসভা আহবান করেন এবং লীগের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিওতে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র আয়োজনে একটি মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শিরোনাম ছিল: 'আমেরিকা-বৃটেন ধ্বংস করো। ১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ'র প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সেই সম্মেলনে একটি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই সম্মেলনে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে 'স্বাধীন ভারত সরকার' গঠিত হলে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন রাসবিহারি বসু।
কিন্তু বহুকাঙ্খিত স্বাধীন ভারতকে দেখার সৌভাগ্য হযনি রাসবিহারী বসুর। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত অসুস্থ রাসবিহারী বসু ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে রাসবিহারী বসুকে জাপান সরকার সম্মানসূচক ‘সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৪৫ সালে ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দ ফৌজকে ভেঙ্গে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান । কেউ জানে না কোথায় আছেন তিনি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে তাঁকে বৃটিশ সরকার (কিছুদিন পর জানা যায় নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান)। তবে বৃটিশদের আর কোনো শক্তি ছিল না ভারতীয়দেরকে দাবিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসক পাক-ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে লেজ গুটায়। অর্জিত হয় বহুকাঙ্খিত ভারতের স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য বিপ্লবী জীবন বিপন্ন করে লড়াই- সংগ্রাম করেছেন।
নানাবিধ কাজের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে প্রচুর লেখা স্থানীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজ ব্যয়ে ‘মান্থলি নিউ এশিয়া’ নামে একটি তথ্যভিত্তিক ইংরেজি কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫-১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ তার এক বন্ধু বান মিয়াও’র সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন ‘সাইগো নো উতা’ নামে। সম্ভবত এটাই প্রথম অনুবাদ ‘শেষের কবিতা’র বিদেশি কোনো ভাষায়। চরমপন্থি বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন এতে প্রমাণিত হয়। স্বদেশি হিসেবে তার দেশাত্মবোধ নিয়ে রচিত ‘শোওনেন আজিয়া নো শোওরি’ বা ‘তরুণ এশিয়ার জয়’ একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি জাপানের টোকিও শহরের নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করেন। আজ এই বিপ্লবীর ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসুর মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সম্পাদনাঃ নূর মোহাম্মদ নূরু
২২ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৪৩
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ,
মন্তব্য প্রদানের জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:১৩
রাজীব নুর বলেছেন: ধন্যবাদ নূর ভাই।