নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
আজ ৩ সেপ্টেম্বর। আন্তর্জাতিক সিডও Convention on Elimination of all forms of Discrimination Against women (CEDAW) দিবস। ‘সিডও’ হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত সনদসমূহের অন্যতম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বা সনদ যা নারীর প্রতি বৈষম্যকে কমিয়ে আনার কথা বলে। বিশ্বের সকল মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। যার মর্মবাণী হচ্ছে ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী’। কিন্তু দেখা গেল যে, বিশ্বের দেশে দেশে নারী চরমভাবে অবহেলিত এবং দানবের মতো টিকে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতা জাতিসংঘের মূললক্ষ্যকে ব্যাহত করছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসমতা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার নারীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের নারীর প্রতি বৈষম্য দুর করার ঘোষণা এবং তার ১২ বছর পর ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ১৩০টি সদস্য রাষ্ট্রের ভোটে সাধারণ পরিষদে সনদ হিসেবে সিডও গ্রহন করা হয়। সিডও শব্দটিকে বিস্তারিত করে বলা যায়, ‘দ্য কনভেনশন অন দি অ্যালিমিনেশন অব অল ফরম্স অব ডিসক্রিমিনেশন এ্যাগেইনস্ট উইমেন’ (CEDAW)।আরেকটু সহজবোধ্য করে একে বলা যায় ‘বিল অব রাইটস ফর উইমেন্স’ অর্থাৎ নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্য দিবস।
সিডও আসলে নারীর মানবাধিকার সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। এতে অনুমোদনকারী হিসেবে একটি রাষ্ট্রের অনেক ব্যাপারেই সচেতন এবং তৎপর হয়ে ওঠার তাগিদ রয়েছে। সমাজব্যবস্থা এবং প্রচলিত আইনে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বিষয়গুলিকে সরিয়ে ফেলতে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এই সিডও সনদ প্ররোচিত করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালের ১ মার্চ এই সনদে স্বাক্ষর করা হয় এবং ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই সনদটি কার্যকর হয়। সংক্ষেপে এই হলো সিডও সনদ। সিডও সনদ কার্যকরের তারিখটি প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সিডও দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশেও ৩ সেপ্টেম্বর এই দিবসটি পালিত হয়েছে। ১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া এই সনদকে বলা হয় নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি। বিশেষ এই দিনটিকে বেছে নেয়া হয় আন্তর্জাতিকভাবে উদযাপন করার একটি দিবস হিসেবে। জাতিসংঘের এই সিডও সনদটির তিনটি মূলনীতি হচ্ছেঃ
১। সমতার নীতি, অর্থ্যাৎ নারী-পুরুষের মধ্যে জীবনের সব ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার সমতা নিশ্চিত করা এবং সম-ফলাফলের নিশ্চয়তা বিধান করা,
২। বৈষম্যহীনতার নীতি বা যে সব ক্ষেত্রে নারী হওয়ার কারণের বৈষম্যের শিকার হয়েছে তা দুর করা এবং
৩। রাষ্ট্রে দায়বদ্ধতার নীতি, অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রকে তার নিজ দেশে সমাজে, পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে সহ জীবনের সকল পর্যায়ে নারীর প্রতি যে বৈষম্য রয়েছে, তা চিহ্নিত করা এবং বিষয়ে নীতি ঘোষণা করা, তা দুর করতে আইনগত ও প্রশাসনিক সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহন করা।
জাতিসংঘের সদস্য ১৯৪টি দেশের মধ্যে ১৮৭টি দেশ সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ দেশই সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সনদ বা সিডও সনদ অনুমোদন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, স্বাক্ষরের ৩১ বছরেও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সনে ১৩ (ক) এবং ১৬-১ এর (চ) ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করলেও সনদের প্রাণ বলে অভিহিত ২নং ধারা এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ধারা ১৬-১ এর (গ) থেকে এখনো আপত্তি বহাল রেখেছে। সিডও সনদের ২নং ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার নীতিমালা গ্রহণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ১৬-১ এর (গ) ধারায় বিয়ে , বিয়েতে পছন্দ-অপছন্দ এবং বিয়ে বিচ্ছেদকালে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের ও দায়-দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সিডও সনদের দুইটি ধারায় সরকারের আপত্তি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে এবং বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখনো যে কোনো বয়সের নারীর বিরুদ্ধে যে মাত্রায় সহিংসতা ঘটছে তা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এছাড়া এই দুইটি ধারার বিষয়ে আপত্তি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।সনদের ধারা-২ এবং ১৬-১ এর (গ) অংশটি কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক শরীয়া আইনের বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য নয়বলে মত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কিভাবে এটা কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আজ পর্যন্ত তার কোনো ব্যাখ্যা বাংলাদেশ দিতে পারেনি। যদিও সরকার গত দুই দশক ধরে বলছে, সিডও সনদের ধারা ২ অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনাধীন। কারণ এই ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহার ব্যতীত সিডও সনদ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’
সিডিও সনদের ধারা-২ কে বলা হয় এই সনদের প্রাণ এবং ১৬-১ এর (গ) অংশটি নারীর মানবাধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাই এদেশের নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন সব ব্যক্তি ও সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের কাছে সিডও সনদের সিডও সনদের সংরক্ষিত ধারাগুলো প্রত্যাহার করে সিডিও সনদের পূর্ণ অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন আশা করেন। বর্তমান সরকার অনেক নারী বান্ধব কাজ করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে সরকার গত দুই দশকে বেশ কিছু আইন, নীতিমালা ও কর্মসূচী নিলেও নারী প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ঘুষ,রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও ডাক্তারের পুরুষতান্ত্রিক মানষিকতা, অপরাধীর প্রভাব, সম্পদ ও শক্তি সহিংসতার শিকার নারীকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও নারীরা ৮০ম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়া হয় না (যেমন গার্মেন্টস শিল্প) শ্রম আইন থাকলেও নারীরা এর সুফল পাচ্ছেন না। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানীর অভিযোগটিও আজ বহু পুরনো। পুরুষদের পাশাপাশি নারীও উন্নয়নের ধারক-বাহক,কিন্তু এই ধারক-বাহক যখন সমাজের একাংশের কায়েমী গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন রাষ্ট্রে দায়বদ্ধতা প্রদর্শনের স্থানটি কতখানি দেখতে পাওয়া যায় ? কতখানি দেখতে পাওয়া যায় আক্রান্ত ও নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে যথাযথভাবে, যথাযথ সময়ে, যথাযথ প্রতিষ্ঠান ও তার দায়িত্বপ্রাপ্তরা অগ্রসর-অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছেন ? এসব প্রশ্ন আজ এ দেশের তরুণী-কিশোরী নারীর মধ্যে বয়ে চলেছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এদেশের উন্নয়নে নারীর অবদান অনেক কিন্তু তারপরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে আজ নারীরা পিছিয়ে আছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়ে খুবই আন্তরিক। সরকার নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইন হয়েছে, যৌনহয় রানীর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, মায়ের পরিচয় দেবার অধিকারের স্বীকৃতি মিলেছে, অপ্রচলিত পেশায় অধিক সংখ্যাক নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জেন্ডার বাজেটিং এর পরিধি ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এগুলো ইতিবাচক দিক সন্দেহ নেই। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদের স্বাক্ষর করার ৩০ বছর পরেও বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা আশানুরূপভাবে কমেনি। বরং ঘরে বা বাহিরে প্রতিনিয়ত সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন বাংলাদেশের নারীরা। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীরা নানা ভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোন না কোন সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন। সিডও সনদ শুধু নারীর অধিকার রক্ষার কথা বলে না। বলে, একজন মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার রক্ষা করার কথা। সারা বিশ্বে সিডও সনদ পূর্ণ বাস্তবায়নে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও কাজ করে চলেছেন। সবার ঐক্য এবং প্রচেষ্টাতেই সম্ভব অধিকার রক্ষা এবং বাস্তবায়নের কাজটি। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত মানবাধিকার দলিল এ সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেত্রীরা। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা আনায়নে নিশ্চিতকরণ এবং মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের এবং বৈষম্য দূর করনের জন্য সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরী।
©somewhere in net ltd.