নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার কান্ত কবি নামে খ্যাত রজনীকান্ত সেন। ঈশ্বরের আরাধনায় তার ভক্তিমূলক এবং দেশাত্ববোধক গুনগুলি খুবই জনপ্রিয়। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁকে পঞ্চদিক পালের একজন বিবেচনা করা হয়। অপর চারজন হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, ডি.এল.রায় ও অতুলপ্রসাদ সেন। পঞ্চকবির অন্যতম কবি বাঙালির অহংকার কবি রজনীকান্ত সেন একাধারে ছিলেন সফল আইনবিদ, সংগীতশিল্পী এবং বাংলা গীতিকাব্যের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ‘কান্তকবি’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে যথাঃ ১। দেশাত্মবোধক গান, ২। ভক্তিমূলক গান, ৩। প্রীতিমূলক গান এবং ৪। হাস্যরসের গান। তবে রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক।১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালে স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই' গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব গণ আলোড়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ক্ষণজন্মা এই অমর সঙ্গীতকার ও লেখক ১৮৬৫ সালের আজকের দিনে কাটোয়াতে জন্মগ্রহন করেন। আজ কান্ত কবির সার্ধশততম জন্মমৃত্যুবার্ষিকী। কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন এর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই পিতার কর্মস্থল কাটোয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি, সিরাজগঞ্জ (পুরাতন পাবনা জেলার মহকুমা) জেলার বেলকুচি উপজেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার সহদেবপুরে। রজীকান্তের প্রপিতামহ যোগিরাম সেন তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ির জমিদার যুগলকিশোর সেনগুপ্তের কন্যা করুণাময়ীকে বিয়ে করেন। যোগিরাম সেনের অকালমৃত্যু হয়। তখন করুণাময়ী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। বাল্যবিধবা করুণাময়ী আশ্রয় নেন তাঁর সহোদর শ্যামকিশোরের বাড়িতে। এখানেই তাঁর কোলজুড়ে আসে পুত্র গোলকনাথ সেন, যিনি রজনীকান্তের পিতামহ। গোলকনাথ মামাবাড়িতেই বেড়ে উঠতে থাকে। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মামা শ্যামকিশোর ভাঙাবাড়িতেই একটি বাড়ি আর কিছু জমি দান করেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল পাবনা জেলার সিরাজগনঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়িতে সেন পরিবারের স্থায়ী বসবাস। সহদেবপুরের অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে গোলকনাথের বিয়ে হয়। তাদের দুই ছেলে গোবিন্দনাথ ও গুরুপ্রসাদ। কনিষ্ঠ সন্তান গুরুপ্রসাদ ও তার স্ত্রী মনোমোহিনী দেবীর সন্তান রজনীকান্ত। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত। শৈশব থেকেই রজনীকান্ত যেমন চঞ্চল তেমনি দুরন্ত ছিলেন। দুষ্টুমিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। কতবার যে গাছ থেকে পড়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। পড়াশোনার ধারকাছ দিয়ে ঘেঁষতে চাইতেন না। তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। শৈশবকাল থেকেই তি্নি ছিলেন সংগীতপ্রিয়। কোথাও কোনো সুমধুর গান শুনলেই সুর, তালসহ তৎক্ষণাৎ তা কণ্ঠস্থ করতে পারতেন। এমনই ধারালো ছিল তাঁর স্মরণশক্তি। তার বাবাও একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফলে শৈশবে সংগীত অনুশীলনের সুযোগ ঘটে। ছেলেবেলাতেই পিতার কাছে রজনীকান্ত সঙ্গীতে হাতেখড়ি নেন। আবৃত্তি করতেও তিনি পছন্দ করতেন। কলেজ জীবনে অভিষেক ও বিদায় অনুষ্ঠানে তার গান গাওয়া হতো। গান লেখায় তার সময় বেশি লাগত না। স্বদেশি আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় তার গান ছিল প্রেরণার উৎস। তার উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলোঃ
১। নমো নমো নমো জননি বঙ্গ !
২। আমরা নেহাত্ গরীব আমরা নেহাত্ ছোট
৩। তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে
৪। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
৫। কাঙাল ইত্যাদি
অল্প সময়ে তাঁরগানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এখনও বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক শিল্পী তার গানগুলো গেয়ে ধাকেন। এ ছাড়া আধ্যাত্মিক গানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তার গানগুলো হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘারানার। এতে কীর্তন, বাউল ও টপ্পার যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তাঁর কাব্য ও সঙ্গীত নির্ভর গ্রন্থের সংখ্যা মোট আটটি। জীবদ্দশায় তার তিনটি বই প্রকাশ হয়ঃ ১। বাণী (১৯০২), ২। কল্যাণী (১৯০৫) ও ৩। অমৃত (১৯১০)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি যথাঃ ১। অভয়া (১৯১০), ২। আনন্দময়ী (১৯১০), ৩। বিশ্রাম (১৯১০), ৪। । সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩) ও ৫। শেষদান (১৯১৬)। এর মধ্যে বাণী ও কল্যাণী গানের সঙ্কলন।
রজনীকান্তের জন্ম কটোয়াতে হলেও তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু রাজশাহীতে। তার দুই কাকাতো ভাই বরদাগোবিন্দ সেন ও কালীকুমার সেন তখন রাজশাহীতে ওকালতি করেন এবং তাঁদের ছিল খুব ভালো পসার। ওখানে থেকেই রজনীকান্ত পড়াশোনা করতেন। মূলত কালীকুমারের কাছেই তিনি পাঠাভ্যাস করতেন। কালীকুমার নিজেও কবিতা লিখতেন। ‘মনের প্রতি উপদেশ’ নামের একটি বই বেরিয়েছিল তাঁর। রাজশাহীতে স্কুলজীবন শুরু করলেও রজনীকান্ত কোচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগেএন্ট্রান্স (১৮৮৩) পাস করেন। ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিমাসে দশ রূপি বৃত্তি পেতেন। ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফএ পাস করেন। এর পর সিটি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে বিএ পাস করেন। বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় তিনি পিতৃহারা হন। ১৮৯১-তে বিএল পাস করে রাজশাহী আদালতে আইন ব্যবসায় যোগদান করেন। এই সময় তিনি কিছুদিন নাটোর ও নওগাঁও-তে অস্থায়ী মুন্সেফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বিএল পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে সিরাজগঞ্জ থেকে কুঞ্জবিহারী দে’র সম্পাদনায় ‘আশালতা’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা বের হয় ১২৯৭ এর ভাদ্র মাসে। এর প্রথম সংখ্যাতেই রজনীকান্তের প্রথম লেখা কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতার শিরোনাম ছিল ‘আশা’। তাঁর এতটাই প্রতিভা ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গান লিখতে পারতেন, কাব্য রচনা করতে পারতেন। তবে রজনীকান্তের প্রথম দিকের রচনাগুলো বড্ড গুরুগম্ভীর ছিল। শব্দ ব্যবহারেও ছিল তৎসম শব্দের আধিক্য, যার উচ্চ সাহিত্যমূল্য থাকলেও সাধারণ পাঠকের জন্য তা খুব সহজবোধ্য ছিল সেটি বলা যায় না।
তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-কর্ম এবং অবিস্মরণীয় আধ্যাত্মিক গানগুলো রচনার জন্য রজনীকান্তকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী ১৯৮৯ সালে রজনীকান্ত সেন শিরোনামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল অসম্ভব ব্যথায় পরিপূর্ণ। ১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর প্রদাহজনিত কারণে সমস্যা ভোগ করতে থাকেন। রুগ্ন অবস্থায় কবিকে কলকাতা, কাশীতে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোন ফল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোগাক্রান্ত কবি রজনীকান্তকে দেখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছিলেন, “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। :শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।: আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।” কবি রোগাশয্যায় মেডিকেলে থেকেও বহু গীতি কবিতা লিখেছেন। রোগ শয্যায় তিনি পুত্র শচীনের বিবাহ সম্পন্ন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর আরো পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে “আনন্দময়ী”। এটি আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতের সংকলন। ওই বছরই প্রকাশিত হয় “বিশ্রাম” ও “অভয়া” (কাব্য)। “সদ্ভাব কুসুম” (নীতি কবিতা) ১৯১৩ সালে এবং “শেষ দান” (কাব্য) প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। শেষ দান কাব্যটি কবির জীবনের শেষ কাব্য। এই কাব্যের কবিতাগুলো কবি হাসপাতালের রোগ শয্যায় নির্বাক জীবনে লেখেন। ক্ষণজন্মা এই কবি মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাত্রি সাড়ে আট ঘটিকার সময় লোকান্তরিত হন। ক্ষণজন্মা অমর সঙ্গীতকার ও লেখক রজনীকান্ত সেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও বাঙালি চিরকাল তাঁকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখবেন।
রজনীকান্ত সেন পঞ্চকবির অন্তর্ভুক্ত হলেও চর্চা নেই তার অমূল্য সাহিত্য কীর্তির। এমনকি তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন রাজশাহীর বসত বাড়িটিও সংরক্ষণ করা হয়নি আজো। আবর্জনা-ময়লা ফেলে পুঁতে ফেলা হয়েছে এ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে। অথচ কবি নজরুল এ বাড়িটির সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে কবি রজনীকান্ত সেন’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার, আজো তুমি গানের মাঝে অমর হয়ে আছো, তোমার জন্য গভীর শ্রদ্ধা । আজ কবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন এর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
২৬ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৩১
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন: ধন্যবাদ কাবলি ভাই
গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন এর
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:২৭
কাবিল বলেছেন: রজনীকান্ত সেন এর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।