নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম দিকের মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক জাজ্বল্যমান তারকার নাম সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। রাজনৈতিক চেতনা, শিক্ষা, সর্বোপরি স্বাধিকার আদায়ের চেতনা বিকাশে যারা রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন সিরাজীর স্থান অন্যতম। তবে ব্রিটিশ আমলেই জন্ম, আর ব্রিটিশ আমলেই মৃত্যু বলে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারেননি। পারেননি মুক্ত বিহঙ্গের মতো মুক্ত আকাশে ডানা মেলতে। কিন্তু মুক্তচিন্তার অধিকারী এ স্বাপ্নিক মানুষটি মুক্তির চেতনায় ছিলেন সদা বিভোর। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় জেল-জুলুম, টর্চার সেল, নির্যাতন, নিপীড়ন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। মানবতার মুক্তি এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য দেশব্যাপী চষে বেড়িয়েছেন এই হৃদয়বান মানুষটি। সরকারের হুমকি কিংবা পুলিশের ডান্ডাবেরী তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। মুসলিম জাতির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে তাঁর কলম চালিত হয়েছিলো অপ্রতিহত গতিতে। তাঁর কলমের তুলিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠেছে ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য আর শান শওকত। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আনলবর্ষী বক্তা, কবি ও বাগ্মী ইসমাইল হোসেন সিরাজীর আজ ১৩৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৮০ সালের আজকের দিনে তিনি সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নবযুগের নতুন জীবন চেতনা ও সাংস্কৃতিক বোধ জাগ্রতকারী কবি ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত সৈয়দ ইসমাইল হোসেন ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই সিরাজগঞ্জের বাণীকুঞ্জ গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ও ধর্মীয় কারণে তিনি নামের শেষে 'সিরাজী' গ্রহণ করেন। লেখাপড়া করেন জ্ঞানদায়িনী মাইনর স্কুল এবং বিএল হাইস্কুলে। তার পরিবার এতই দরিদ্র ছিল যে তার পড়াশুনার খরচ চালাতে পারত না। তবে নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় লেখা পড়া চালিয়ে যান তিনি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর সহযোগিতায় ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ'। ১৯০৮ সালে কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে কাব্যে রাজদ্রোহ প্রচার এবং মুসলমান সমাজের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে ১৯১০ সালের মার্চে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই বছরের ০৯ সেপ্টেম্বর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান। ১৯১২ সালের ১৪ মে হাজারীবাগ জেল থেকে মুক্তি পান সিরাজী। একই বছর বলকান যুদ্ধের সময় তিনি একদল চিকিৎসকের সাথে তুরস্কে যান। পরবর্তীতে প্রথমে তিনি কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন। সিরাজীই উপমহাদেশের প্রথম কবি যিনি স্বাধীনতার জন্য, জাতীয় জাগরণের জন্য কবিতা লিখে জেলের ঘানি টানেন। শুধু তাই নয় তাঁর কণ্ঠ রোধ করার জন্য তাঁর বক্তৃতা ও সভাস্থলে ব্রিটিশ সরকার ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করেছিলো।
বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের নবজাগরণের অন্যতম জাতীয় বীর, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থঃ ১। উচ্ছ্বাস (১৯০৭), ২। নব উদ্দীপনা (১৯০৭), ৩। উদ্বোধন (১৯০৮), ৪। স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), ৫। মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯),৬। মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)। উপন্যাসঃ ১। রায়নন্দিনী (১৯১৫), ২। তারাবাঈ (১৯১৬), ৩। নূরউদ্দীন (১৯১৯)। প্রবন্ধ গ্রন্থঃ ১। মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), ২। স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), ৩। আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), ৪। সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), ৫। তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩), ভ্রমণ কাহিনীঃ ১। তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থঃ ১। সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), ২। প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি। তাঁর অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহঃ ১। সুধাঞ্জলী, ২। গৌরব কাহিনী, ৩। কুসুমাঞ্জলী, ৪। আবে হায়াৎ, ৫। কাব্য, ৬। কুসুমোদ্যান, ৭। পুস্পাঞ্জলী এবং অসমাপ্ত উপন্যাসঃ ১। বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং ২। জাহানারা।
১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই অগ্নিপুরুষ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইন্তেকাল করেন। মাত্র বায়ান্ন বছর দুই দিন বেঁচে ছিলেন এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। এই স্বল্পকালীন সময়ে এশিয়া-ইউরোপ ভ্রমণ করেছেন তিনি। বলকান যুদ্ধে তাঁর সেবার খ্যাতি এতই বিশাল ছিলো, যার কারণে লন্ডন থেকে প্রকাশিত 'ডেইলি নিউজ' পত্রিকায় ১৯১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ওপর একটি বড় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রবন্ধের পরতে পরতে ছিলো ইসমাইল হোসেনের প্রশংসা আর প্রশস্তি। এই বিরল সৌভাগ্য ভারতীয় মুসলিমের জন্যে তখন ছিলো অকল্পনীয়। তাঁর জীবনাবসানে ব্রিটিশ সরকার হারায় তাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বনদ্বীকে, অন্যদিকে বাঙালিরা হারায় তাদের শ্রেষ্ঠ সুহৃদকে। অগ্নিপুরুষ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী কেবল ভারতের গৌরব ছিলেন তাই নয়, তিনি ইসলাম জগতের নেতা ছিলেন। আজ তাঁর ১৩৫তম জন্মবাার্ষিকী। মহাকবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, পর্যটক, সাংবাদিক, সাধক ও বাগ্মী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.