নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ অমূল্যকুমার দাশগুপ্তের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৫ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:৫৪



লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত। হাল আমলের পাঠকের কাছে অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত খুব একটা পরিচিত নাম নয়। বাজার চলতি সাহিত্যের ইতিহাসের বইপত্রেও তাঁর প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। তবে 'সম্বুদ্ধ' নামে তাকে অনেকেই চেনে। এ নামেই লেখালেখি করতেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা জাতীয় গ্রন্থে সম্বুদ্ধ ও তাঁর রচনা সম্বন্ধে কিছু বাক্য ব্যয় করা হয়েছে। তিনি মূলত শিশুদের জন্যই লিখতেন। তার জীবিতকালে এবং মৃত্যুর বেশকিছু বছর পরও অনেক শিশুর কাছে ছিলেন প্রিয় লেখক। শিকার কাহিনী লেখায় পারদর্শী এই লেখক ১৯৭৩ সালের আজকের দিনে মৃত্যুৃবরণ করেন। আজ তাঁর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। শিক্ষাবিদ অমূল্যকুমার দাশগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।



অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত ১৯১১ সালের ১৫ অক্টোবর বরিশাল জেলার নান্দিকাঠি থানার কুলকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশালের সজনীকান্ত প্রদত্ত অমূল্যকুমারের নাম সম্বুদ্ধ। এই জ্ঞানী মানুষটি পড়াশোনা করেছেন বরিশাল ও কলকাতায়। অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং শনিবারের চিঠির সহ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। কর্ম জীবনে কিছুদিন সাংবাদিকতা করলেও শিক্ষকতার পেশাতেই কেটেছে তার জীবনের বেশির ভাগ সময়। তিনি বিভিন্ন মেয়াদে বরিশাল বি.এম. কলেজ, দৌলতপুর বি.এল. কলেজ, ফরিদপুর রামাদিয়া কলেজ, পাবনা এডোয়ার্ড কলেজ ও কাঁথি পি.কে. কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেন। তিনি অনুশীলন দলের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে ব্রিটিশবিরোধী সহিংস আন্দোলনে যোগদান করেন এবং কারাবরণ করেন।



শিকার কাহিনী লেখায় পারদর্শী ছিলেন অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ ১। ডায়লেকটিক (১৯৩৯) ২। শিকার কাহিনী (১৯৪৬), ৩। বাঘ-সাপ-ভূত, ৪। ছেলে-ধরা জয়ন্ত (গোয়েন্দা কাহিনী-১৯৬৬)। ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় বসে লেখা এবং সে সময়ে রামধনু নামে একটি পত্রিকায় ছাপা হওয়া তার বিরূপকথা শিরোনামের গল্পটি তার বানানরীতি অবিকল রেখেই সংযোজিত হলো। আশা করি, এটি পড়ার পর তার অন্যান্য লেখার প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়বে।



বিরূপকথা

এক রাজা। আর সেই রাজার রাজ্য।

মস্ত বড় রাজ্য, অগুনতি প্রজা, গিজগিজ করছে লোকজন, সৈন্য-সামন্ত; ফলে, ফুলে, ফসলে লক্ষ্মীশ্রী উপছে পড়ছে। রাজ্যের কোথাও অভাব নেই, দুঃখ নেই।

রাজা আছেন, আছেন মন্ত্রী, সেনাপতি, পাত্র, মিত্র; আর আছেন তার আশ্রিত দৈবজ্ঞ বামুন_ প্রকাণ্ড পণ্ডিত। আকাশের তারা আর পাতালের বালি, সব গুণে বলে দেন; তার গণনার জোরে আগে থাকতে ভবিষ্যৎ জেনেশুনে রাজা রাজ্য শাসন করেন।

এমনি করে যায়_ দিন। কিন্তু চিরকাল গেল না। এহেন রাজার রাজ্যেও রাক্ষস এলো।

কোথা থেকে এলো কেউ জানে না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল রাজ্যের লোক নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। তারপরে জানা গেল রাক্ষস এসেছে, রাজধানীর বাইরে পাহাড়ের ওপরে তার আস্তানা। রোজ রাত্রে সে পাহাড় থেকে নেমে আসে, মানুষ, ঘোড়া, উট, হাতি যা পায় খেয়ে সাবাড় করে।

রাজ্যে আতঙ্ক লেগে গেল। লোকেরা গিয়ে রাজাকে বললে, 'মহারাজ, বাঁচান।'

রাজা বললেন, 'সেনাপতি!'

সেনাপতি বললেন, 'সৈন্যগণ!'

সৈন্যগণ বললেনঃ 'হাজির!'

সেনাপতি বললেনঃ 'চল, কুইক মাচ্র্চ।'

পরদিন সকালবেলা। রাজা সভায় বসেছেন। রাজা বললেন, 'মন্ত্রী রাক্ষসের খবর কী?'

মন্ত্রী বললেন, 'খবর এখনও পাই নি।'

হেনকালে সভার দোরে হৈ-চৈ; ভগ্নদূত এসেছে।

রাজা বললেন, 'কী সংবাদ, দূত?'

ভগ্নদূত ভগ্নস্বরে বললে, 'মহারাজা, সংবাদ ভালো নয়। নূতন সেনাপতি স্থির করুন।'

রাজা বললেন, 'তার মানে?'

ভগ্নদূত বললেন, 'সেনাপতি, সৈন্যগণ সবশুদুব্দ রাক্ষসের পেটে গেছে। ফেরবার আশা নেই।'

সেই দিন দিনদুপুরে রাক্ষস, বলা নেই কওয়া নেই, রাজধানীতে ঢুকে রাজার পাটহস্তীটিকে খেয়ে গেল।

প্রজারা আর নিষেধ মানে না; রাজ্য ছেড়ে সব পালাচ্ছে।

রাজা বললেন, 'মন্ত্রী!'

মন্ত্রী বললেন, 'মহারাজ, আমাকে দিয়ে হবে না।'

রাজা বললেন, 'দৈবজ্ঞ!'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'নিশ্চয়। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না মহারাজ। রাক্ষস বিদ্রারণ যজ্ঞ করতে হবে। তালিকা দিচ্ছি, জিনিসপত্রগুলো আনিয়ে নিন।'

জিনিস কিনতে যাবার লোক নেই। বাজারের রাস্তাতেই রাক্ষসটার বেশী আনাগোনা।

দৈবজ্ঞ বললেন, 'মহারাজ, জিনিসপত্র কিনে নেব'খন। আপনি হুকুম দিন, আমাকে টাকা দেওয়া হোক।'

কোষাধ্যক্ষ গুণে গুণে দু'লক্ষ টাকা বার করে দিলেন।

সমস্ত রাত জেগে রাজবাড়ির উঠোনে বসে দৈবজ্ঞ যজ্ঞ করলেন।

ভোরবেলায় খবর এল, রাত্তিরে রাক্ষস এসে দৈবজ্ঞের বৌ, ছেলেপুলে সব খেয়ে গেছে; বাড়ির দরজার বটগাছটা শুদ্ধ।

রাজা বললেন, 'দৈবজ্ঞ!'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'মহারাজ, এটা ম্লেচ্ছ দেশীয় রাক্ষস। শাস্ত্রীয় মন্ত্র একে লাগবে না।'

রাজা বললেন, 'অতএব?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'অতএব স্থান ত্যাগের দুর্জ্জনঃ। রাজ্য ছেড়ে পালাতে হবে সমস্ত প্রজা-পরিজন শুদুব্দ।'

রাজা বললেন, 'কোথায়?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'সে আমি গুণে বার করেছি। এখান থেকে তেরশ-তেত্রিশ ক্রোশ দূরে এক অভিনব রাজ্য আছে। সেই রাজ্যে আমরা যাব।'

'কি করে?'

'জাহাজে করে। বড় বড় জাহাজ যত পাওয়া যায় জোগাড় করা হোক। সমস্ত প্রজা নিয়ে আমরা জাহাজে চড়ব। জাহাজ কখন কোন দিকে চালাতে হবে সে সব আমি গুণে গুণে বলে দেব।'

তারপর ফিসফিসিয়ে বললেন, 'সেই রাজ্যের রাজার মেয়ে কলাবতী রাজকন্যা। তার রূপে জগৎ আলো; আপনার গলায় মালা দেবেন বলে তিনি প্রতীক্ষা করছেন।'

রাজা বললেন, 'চুপ চুপ, আস্তে বল। বড় রাণী শুনতে পাবেন।'

রাজার রাণী কিন্তু একটিই। কল্পনায় রাজা তাকে ছোট রাণীর সঙ্গে তুলনা করে ফেললেন।

জাহাজ তৈরি হলো। রাজ্যসুদুব্দ লোকজন, জীবজন্তু, খাবার-দাবার সব নিয়ে রাজা গিয়ে জাহাজে উঠলেন।

শুভক্ষণে দুর্গা বলে জাহাজ ছেড়ে দিলে। জাহাজের পালে হাওয়া লাগল। জাহাজ তীরবেগে ছুটল, তখন দেখা গেল রাক্ষসটা ছুটে এসে সমুদ্রের কিনারায় দাঁড়িয়েছে।

পলায়মান খাদ্যবৃন্দের জয়োল্লাস শুনে তার সে কি কাতর বিলাপ!

দৈবজ্ঞ জাহাজের ওপর থেকে গলা বাড়িয়ে তাকে ভেংচি কেটে দিলেন।

জাহাজ চলছে। দিন নেই, রাত নেই, চলছেই, চলছেই, চলছেই। কিন্তু কলাবতী রাজকন্যার দেশ আর কত দূর!

দৈবজ্ঞ থেকে থেকে খড়ি পাতেন, যন্ত্রপাতি নিয়ে তারার আলো মাপেন, আর বলেন, এইবারে একটু ডানদিকে, এবারে ঈশান কোণ বরাবর।

মাঝিরা পালা করে জাহাজের হাল ধরে।

রাজা বলেন, 'দৈবজ্ঞ!'

দৈবজ্ঞ বলেন, 'মহারাজ আর ক'টা দিন। একটু ধৈর্য ধরে থাকুন।'

কিন্তু মন যদি বা ধৈর্য মানে, পেট মানে কই? জাহাজের খাবার ফুরিয়ে গেলে, জীবজন্তু যা ছিল সব কেটেকুটে খেয়ে সারা হয়ে গেল_ সমুদ্র আর সারা হয় না।

লোকেরা বললে, 'দৈবজ্ঞ ঠাকুর!'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'এই এসে পড়েছি। আর দুটো দিন জোর।'

দ্বিতীয় দিনে ডাঙা কিন্তু সত্যিই দেখা গেল। লোকেদের আমোদ দেখে কে?

কলাবতী রাজকন্যা মালা নিয়ে বসে আছেন, রাজা ভালো করে সাজ-পোশাক করে নিলেন, চোখে সুর্ম্মা পরলেন_ দাঁত পর্যন্ত মাজলেন সেদিন।

রাণী কানাঘুষোয় সবই শুনেছিলেন, বললেন, 'ব্যাপার কি, মহারাজ?'

রাজা বললেন, 'কিচ্ছু না।'

রাণী বললেন, 'তা রাজসভায় যাচ্ছ, আমি কি এমনি ঘুঁটেকুড়োনী সেজে যাব নাকি? আমাকেও তো একটু বলতে হয়!'

রাজা ব্যস্ত হয়ে বললেন, 'তুমি কোথায় যাবে? দাঁড়াও, আগে দেখি, অজানপুরী অচিন ঠাঁই। অভ্যর্থনার নমুনাটা বুঝি, তবে তো?'

জাহাজ ডাঙায় ভিড়ল, রাজা, প্রজা, সব হুড়মুড় করে ডাঙায় নেমে চোঁচা দৌড়। পেটে আগুন জ্বলছে। লোকালয় পেলে খেয়ে প্রাণে বাঁচে।

জাহাজে রইলেন শুধু রাণী আর তার সখীরা।

দৌড় দৌড় দৌড়, লোকজন আর চোখে পড়ে না। দূরে উঁচু মতন একটা চুড়ো দেখা যাচ্ছে, রাজপ্রাসাদই হবে। সেই দিক পানে সব দৌড়োচ্ছেন। দৌড়োতেই দৌড়োতে রাজা বললেন, 'মন্ত্রী, এ রাজ্যের লোকজন সব কই? পথে মানুষের সাড়াশব্দ নেই যে!'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'মানুষ কি আর কেউ ঘরে আছে মহারাজ, সব এখন স্বয়ংবর সভায়।'

রাজা বললেন, 'দৌড়োও।'

ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে এক সময় দেখা গেল সামনেই মস্ত বড় সিংহদ্বার। ব্যস, থামা নেই, ভাবা নেই_ হুড়মুড় করে সিংহদ্বার দিয়ে সব ঢুকে পড়লেন, আগে আগে রাজা, মন্ত্রী, দৈবজ্ঞ, পাত্র, মিত্র; তার পেছনে সব প্রজা।

ঢুকেই, সব থ। সেটা রাজসভাই; কিন্তু কলাবতী রাজকন্যার দেশের নয়।

সিংহাসনে বসে আছেন বিকট মূর্তি রাক্ষস-রাজ; সভা ভর্তি সব রাক্ষস-পারিষদ। পথ ভুল করে তারা রাক্ষসের দেশে এসে পড়েছেন।

রাজা বললেন, 'মন্ত্রী!'

মন্ত্রী বললেন, 'দৈবজ্ঞ!'

দৈবজ্ঞ চিঁ চিঁ করে বললেন, 'আজ্ঞে?'

রাক্ষস-রাজ বিরাট গম্ভীর স্বরে বললেন, 'কে তোমরা? কি চাও?'

রাজা ঢোঁক গিলে বললেন, 'আজ্ঞে, আমরা মানুষ।'

'মানুষ!' সভাসুদ্ধ রাক্ষস জিভ চাটলে।

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'মানুষের আমরা নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি; শুনেছি তারা খুব সুখাদ্য হয়। ভালোই হয়েছে এসেছ।'

মন্ত্রী তাড়াতাড়ি বললেন, 'আজ্ঞে, আপনি ঠিকই শুনেছেন, মানুষ সুখাদ্য, তবে সব সময়ে নয়। তারিয়ে খেতে হলে তাদের অন্তত দুটি বচ্ছর খুব যত্নে রেখে খাইয়ে মোটা করতে হয়।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'বেশ, তাই করা যাবে। তোমাদের সরলতা দেখে খুশি হলাম। তা, তোমরা এখানে এলে কি করে?'

রাজা বললেন, 'আজ্ঞে, আমাদের দেশে একটা, মানে ইয়ে গিয়ে বড্ড ইয়ে করছিল কিনা, তাই'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'কিয়ে গিয়ে?'

মন্ত্রী তাড়াতাড়ি বললেন, 'আজ্ঞে, তাই বলে ঠিক নয়, মানে আমরা সমুদ্র-ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। খাবার ফুরিয়ে গেছে বলে এখানে নেমেছি।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'বেশ, তা খাবার পাবে।'

রাক্ষস-মন্ত্রী ভাণ্ডার খুলে দিলেন; বললেন, 'এস মানুষেরা, খাবার নাও।'

খাবার পুঁটুলি বেঁধে তারা জাহাজে চলল।

এদিকে রাক্ষস-রাজ বললেন, 'তা তোমাদের সঙ্গে ততক্ষণ আলাপ পরিচয়টা হোক। তোমাদের কোনটা কে?'

মন্ত্রী পরিচয় দিলেন, 'ইনি হচ্ছেন আমাদের রাজা, আমি মন্ত্রী, এরা পাত্রমিত্র, আর এই ইনি দৈবজ্ঞ।'

রাক্ষস-রাজ হঠাৎ প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন 'দৈবজ্ঞ! তাই নাকি! দৈবজ্ঞরা শুনেছি কোথায় কি হচ্ছে সব গুণে বলে দিতে পারে!'

দৈবজ্ঞ তিড়িংবিড়িং করে বললেন, 'আজ্ঞে, নিশ্চয় পারি। বলে দেওয়া তো সামান্য কথা, যাকে আপনি সামনে দেখতে চান, মন্তরের জোরে টেনে নিয়ে আসতে পারি সহস্র যোজন দূর থেকে।'

রাক্ষস-রাজ একটুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর বললেন, 'দেখ আমার একমাত্র ছেলের আজ এক বছর ধরে খোঁজ নেই। বেঁচে আছে কি নেই তাও জানি নে। তুমি তার কথা আমাকে গুণে বলতে পারবে?'

দৈবজ্ঞ ততক্ষণে ট্যাঁক থেকে খড়িমাটির ডেলা বার করে ফেলেছেন। বললেন, 'নিশ্চয় পারব।'

মন্ত্রী ফিসফিসিয়ে বললেন, 'এই, কর কী?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'দাঁড়ান না।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'এক বছর আগে আমার ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মানুষ খেতে চেয়েছিল, আমি দিতে পারিনি বলে সে রাগ করে চলে গেল। বলে গেল, মানুষ খেতে পেলে তবেই বাড়ি ফিরব। সেই থেকে তার আর খোঁজ নেই। তার কথা যদি গুণে বলতে পার, তবে তোমাদের প্রচুর পুরস্কার।'

রাক্ষস-রাণী কেঁদে কেঁদে প্রায় অন্ধ; তিনি চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, 'যদি পার, তোমরা যত ধনরত্ন চাও দেব। তোমাদের থাকতে রাজপ্রাসাদের ঘর ছেড়ে দেব।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'আর যদি না পার তা হ'লে'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'আলবৎ পারব।'

দৈবজ্ঞ খড়ি পাতলেন। গুণে-টুনে দেখে শেষে বললেন, 'রাজপুত্র বেঁচে আছেন, ভালো আছেন।'

রাক্ষস-রাণী বললেন, 'কোথায় আছে?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'এখান থেকে বহুদূরে, এক রাজ্যে। শরীর-গতিক ভালোই আছে, চিন্তার কারণ নেই।'

রাক্ষস-রাণী বললেন, 'মানুষ খেতে পায় তো?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'দেদার। মানুষই তো খাচ্ছেন দিনরাত। খেতে খেতে দস্তুরমত মোটা হয়ে গেছেন।'

রাক্ষস-রাণী বললেন, 'বল কী! এতই মানুষ সেখানে?'

'হবে না, মানুষেরই রাজ্য যে! খান না কত খাবেন_ খেয়ে খেয়ে পেটের অসুখ বাধালেও মানুষ ফুরোবে না।'

'পেটের অসুখ বাধিয়েছে? তবে যে বললে ভালো আছে!'

'আজ্ঞে না, অসুখ হবে কেন! এখন উঠতি বয়স, এই তো হচ্ছে খেয়ে নেবার সময়।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'বাড়ি ফিরবে কবে বলতে পার?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'একটু দেরি হবে। ধরুন বছর খানেক। মানে সেই দেশের রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হচ্ছে কিনা। বিয়ে করে একেবারে বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।'

'তা এক বছর কেন?'

'সমানে অকাল পড়েছে। তাই বিয়ে আটকে রয়েছে।'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'বেশ, এবারে যাও তোমরা বিশ্রাম কর গে। এই এক বছর তোমরা আমার রাজ্যে অতিথি। এক বছর পরে যদি রাজপুত্র ফেরে, তোমরা দেশে ফিরে যাবে। আর যদি না ফেরে... ও কি! কে! কে!'

রাজসভার মধ্যে হঠাৎ মহা হৈ-চৈ। একজন অতি শীর্ণকায় দুর্বল রাক্ষস রাজসভায় ঢুকল; এদিক-ওদিক তাকিয়ে, তারপর ধুঁকতে ধুঁকতে ছুটে গিয়ে রাক্ষস-রাজের পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল। বলল, 'বাবা!'

রাক্ষস-রাজ তাকে বুকে টেনে নিলেন। রাক্ষস-রাণী কেঁদে উঠলেন, 'বাছা রে, একি তোর চেহারা!'

সত্যিই, বেচারীর গায়ে শুধু হাড় ক'খানা আর চামড়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সভা নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ। রাক্ষস-রাজ বললেন, 'বাছা রে, তোর এ অবস্থা কেন?'

রাজপুত্র ধুঁকতে ধুঁকতে বললে, 'মানুষের দেশে গিয়াছিলাম। কিন্তু সে দেশের মানুষগুলো আমাকে ফাঁকি দেবে বলে সবসুদ্ধ জাহাজে চড়ে কোথায় পালিয়ে গেল। আমি সেই শূন্য রাজ্যে একলা পড়ে রইলাম। নির্জ্জন, নির্জ্জানোয়ার খাঁ খাঁ মরুভূমি দেশ, না খেয়ে না খেয়ে এই দশা হয়েছে। আবার যে বাড়ি ফিরে তোমাদের শ্রীচরণ দর্শন করব তা স্বপ্নেও ভাবিনি।'

সকলের চোখে জলের ধারা নেমে এল।

তার পর রাক্ষস-রাজ হঠাৎ গর্জ্জন করে বললেন, 'দৈবজ্ঞ!'

দৈবজ্ঞ চিঁচিঁ করে বলতে যাচ্ছেন 'আজ্ঞে'!

ইতিমধ্যে রাক্ষস-রাজপুত্র এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে 'এ কি! এই তো তারা!'

রাক্ষস-রাজ বললেন, 'কারা!'

আর কারা! মন্ত্রী বললেন, 'মহারাজ, দৌড়োন।'

দৌড় দৌড় দৌড়।

রাজা, মন্ত্রী, পাত্র, মিত্র, দৈবজ্ঞ, প্রজাবৃন্দ, সবাই দৌড়োচ্ছে_

চটকা ভেঙে পিছু নিতে রাক্ষস সেনার যা দেরী, এর মধ্যে জাহাজে উঠতে হবে, তবে যদি প্রাণ বাঁচে!

তার পর পেছনে রাক্ষস সেনার গর্জন শোনা গেল, কোথায় লাগে সমুদ্র-গর্জ্জন?

পড়ি তো মরি করে সব গিয়ে জাহাজে উঠল। রাজা বললেন, 'কাছি কাট। পাল তোল।'

রাক্ষস সেনা হাঁপাতে হাঁপাতে সমুদ্রের ধারে এসে পেঁৗছল; তাদের নিশ্বাসের ঝড়ে পাল ফুলে উঠে জাহাজ-মাঝ-সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। এবারকার মত প্রাণ বাঁচল।

কিন্তু তারপর?

রাজা বললেন, 'মন্ত্রী, এবার কোন দিকে যাই?'

দৈবজ্ঞ বললেন, 'তার জন্যে চিন্তা কি মহারাজ, আমি খড়ি পেতে গুণে বলে দিচ্ছি।'

রাজা বললেন, 'এই, কে আছ, দৈবজ্ঞটাকে ধরে জলে ফেলে দাও।'




শিক্ষাবিদ অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত ১৯৭৩ সালের ৫ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের কাঁথিতে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা ভাষার এই শিক্ষাবিদ তাঁর মহাপ্রয়াণের তিন দশক পার না হতেই আজ মৃতপ্রায়, বিস্মৃত তো তিনি অনেককাল থেকেই। লেখকের এই অকালমৃত্যু কিন্তু লেখকের দোষে নয়। তাহলে কার দোষে? অধ্যাপকের? অধ্যাপিতের? প্রকাশকের? পাঠকের? যার দোষেই হোক, দোষটা দূর করতে হবে। কারণ,অমূল্যকুমার দাশগুপ্তে অবিস্মরণীয় কৃতি চিরস্থায়ী হয়ে আছে তার ডায়লেকটিক, শিকার কাহিনী, বাঘ-সাপ-ভূত, ছেলে-ধরা জয়ন্ত ও বিরূপকথা'র অনবদ্য গল্পমালায়। না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া লেখক অমূল্যকুমার দাশগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৩৯

প্রামানিক বলেছেন: লেখক অমূল্যকুমার দাশগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

০৫ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:০৪

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
ধন্যবাদ প্রামানিক ভাই
লেখক অমূল্যকুমার দাসগু্প্তের
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।
ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.