নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, সুখ্যাত লেখক, ব্যতিক্রমী অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। তিনি জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন ও লিখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সাহসী ভূমিকা তাঁকে বিশেষ গৌরব দান করে ৷ ১৯৭৫ পরবর্তী স্বাধীনতা ইতিহাস বিকৃতির কালেও তিনি তাঁর লেখায়, সভা-সমিতিতে, বক্তৃতা-ভাষণে তাঁর প্রগতিশীল কার্যাবলী অক্ষুন্ন রাখেন৷ বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য নাটক কাব্য ও গবেষণাগ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে কবীর চৌধুরী সরকার কর্তৃক দেশের জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হয়েছেন। একজন সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন উদার এবং মুক্তমনা মানুষ ছিলেন তিনি। প্রয়াত এই কর্মী-পুরুষ গত কয়েক দশক ধরে জাতির মননশীলতার বিকাশ এবং কুসংস্কার ও মতান্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছিলেন তার কর্মপ্রচেষ্টা। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ২০১১ সালের আজকের দিনে ঢাকার বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন। আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
কবীর চৌধুরী ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর, ডাক নাম মাণিক। তবে তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামের মুন্সী বাড়ি। পিতা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম। শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরীর ছোট ভাই। কবীর চৌধুরীর পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় নিজ গৃহেই। পরিবারের সাহচর্যে তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্সে ১৯৪৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ শ্রেণীতে ১৯৪৪ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
পরে ১৯৫৭-৫৮ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তিধারী হিসেবে আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন সাহিত্য সম্পর্কে এবং ১৯৬৩-৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন এবং দীর্ঘ জীবন বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। স্বেচ্ছায় সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন৷ এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে "কালচার স্টাডিজ" কোর্সে গ্রাজ্যুয়েট স্তরে শিক্ষা দান করেছেন তিনি। কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে একাধিক পেশায় নিয়োজিত থাকলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ সহজাত ৷ বাংলা ও ইংরেজীতে মৌলিক সমালোচনামূলক গ্রন্থসহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গেছে ৷ তাছাড়া তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অনুদিত গল্প-কবিতা ভারত, সোভিয়েট ইউনিয়ন, হাঙ্গেরী, বুলগেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার পত্র-পত্রিকায় এবং সংকলন-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থাবলীঃ
গল্প গ্রন্থঃ ১। রূপকথার কাহিনী (১৯৫৯), ২। ব্ল্যাক টিউলিপ (১৯৮৯), ৩। দ্যা কাউন্ট অব মন্টে ক্রিস্টো (১৯৮৯),
গবেষণা-প্রবন্ধঃ ১। ইউরোপের দশ নাট্যকার (১৯৮৫), ২। শেক্সপীয়র ও তাঁর মানুষেরা (১৯৮৫), ৩। শেক্সপীয়র ও গ্লোব থিয়েটার (১৯৮৭), ৪। অভিব্যক্তিবাদী নাটক (১৯৮৭), ৫। এ্যাবসার্ড নাটক ( ১৯৮৫), ৬। ফরাসী নাটকের কথা (১৯৯০), ৭। ছয় সঙ্গী (১৯৬৪), ৭। আধুনিক মার্কিন সাহিত্য (১৯৮০), ৮। প্রাচীন ইংরেজী কাব্য সাহিত্য (১৯৮০), ৯। শেক্সপীয়র থেকে ডিলান টমাস (১৯৮১), ১০। আমেরিকার সমাজ ও সাহিত্য (১৯৬৮), ১১। সপ্তরথী (১৯৭০), ১২। মার্কিন উপন্যাস ও তার এতিহ্য (১৯৭০), ১৩। অবিস্মরণীয় বই (১৯৬০), ১৪। মানুষের শিল্পকর্ম (২০০৬)।
বাংলা অনুবাদঃ ১। শেখভের গল্প (১৯৬৯), ২। সমুদ্রের স্বাদ (১৯৭০), ৩। গ্রেট গ্যাটসবি (১৯৭১), ৪। দি গ্রেপস অব র্যথ (১৯৮৯), ৫। রূপান্তর (১৯৯০), ৬। বেউলফ (১৯৮৫), ৭। অল দি কিংস মেন (১৯৯২), ৮। দি গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়ার রিং (২০০৭), ৯। গল্প উপন্যাসে প্রতিকৃতি চিত্র (২০০৭),
নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তরঃ ১। আহবান (১৯৫৬), ২। শত্রু (১৯৬২), ৩। পাঁচটি একাঙ্কিকা (১৯৬৩), ৪। অচেনা (১৯৬৯), ৫। শহীদের প্রতীক্ষায় (১৯৫৯), ৬। হেক্টর (১৯৬৯), ৭। ছায়া বাসনা (১৯৬৬), ৮। সেই নিরালা প্রান্তর (১৯৬৬), ৯। সম্রাট জোনস (১৯৬৪), ১০। অমা রজনীর পথে (১৯৬৬), ১১। প্রাণের চেয়ে প্রিয় (১৯৭০), ১২। লিসিসস্ট্রাটা (১৯৮৪)
কাব্যনুবাদঃ ১। ভাৎসারোভের কবিতা (১৯৮০), ২। আধুনিক বুলগেরীয়া কবিতা (১৯৮০), ৩। রিস্তো বোতেভর কবিতা (১৯৮৮), ৪। রিস্তো স্নির্নেনস্কির কবিতা (১৯৮৯), ৫। কাহলিল জিবরানের কবিতা (১৯৯২)
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য কবীর চৌধুরী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যথাঃ গভর্ণর স্বর্ণ পদক, হাবিব সাহিত্য পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, কাজী মাহবুবউল্লাহ পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার, শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার, লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক এবং ভারতের উইলিয়াম কেরী পদকসহ অসংখ্য পদকে ভূষিত হন ৷জীবনভর যুক্তি আর জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৯ বছর বয়সে ঢাকার নয়াপল্টনস্থ নিজ বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। এই বয়সেও কাজই তাঁর কাছে ছিল মুখ্য৷ মৃত্যুকে নিয়ে ভাবতেন না তিনি৷ মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি মৃত্যু নিয়ে এমন চিন্তার কথাই জানিয়েছিলেন স্বজনদের। মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে কী করা হবে সে-সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ
(১) আমি মৃত্যুর পর দ্রুত সমাহিত হতে চাই। চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে হলেই ভালো হতো।
(২) নিকটস্থ মসজিদে নামাজ-এ-জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। একটি জানাজাই হবে। তার বেশি নয়।
(৩) আমার মরদেহ শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি কোথাও কারো শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে রাখা হবে না।
(৪) কোনো মিলাদ, কুলখানি, চল্লিশা ইত্যাদি হবে না।
(৫) সর্বসাধারণের জন্যে যে গোরস্তানে আমি সেখানে সমাহিত হতে চাই, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের পর আরেকজন সমাহিত হতে পারবেন, আমার কবরের ওপরেই।
তাঁর অভিপ্রায় - সম্পূর্ণ না হলেও - অনেকটাই পূরণ করা হয়েছিল ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বরে। কবীর চৌধুরী কি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মবিলোপের কথা ভেবেছিলেন? তা বোধহয় নয়। তাঁর মতো মানুষের তো অজানা থাকার কথা নয় যে, অনেকে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন এবং তিনি তাঁদেরই একজন। বাংলাদেশের শীর্ষ অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাব্রতী এবং সুশীল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব কবীর চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবাষিীকী আজ। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
©somewhere in net ltd.