নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যারা নতুন ঢাকা শহরে এসেছেন, তাদের কাছে ট্রাফিক জ্যাম হয়তো একটা অসহ্য যন্ত্রণা মনে হতে পারে যেন সময় এখানে থমকে গেছে আর গাড়ি চলার কোনো অবস্থা নেই। কিন্তু যারা এই মহানগরে বেশ কিছুদিন ধরে বেঁচে আছেন, আমরা ভালো করেই জানি যে ট্রাফিক জ্যাম কেবল সামান্য একটি বাধা নয় এটা ঢাকার সবচেয়ে স্থায়ী বিনোদন।
একটু ভেবে দেখুন। আমাদের আর কী বিনোদনের সুযোগ আছে? যদি তাই থাকে তবে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না কেন? বেলা যত বাড়ে, কাজের চাপও নাকি জ্যামেতিক হারে বাড়তে থাকে। অথচ ততক্ষনে ছুটির ঘন্টা বেজে যাবার কথা। কিন্তু ছুটির ঘন্টা বাজনা ওয়ালাও একটু ওয়েট করে কেননা ওয়েটিং এ ওভার টাইম বাড়ে! আর গিয়েও বা কি করার? বাচ্চা পড়ানো, কাপড় কাচা বা রান্নার মতন কাজতো সব করে রাখে শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’। টিভি? ওহ হো, সেটা আবার কি? সারা দিন ফোর জি তে রিলস আর শর্টস দেখে টিভিতে নতুন কিইবা পাওয়ার আছে। টিভি, বিগ নো নো।
হ্যাঁ, শপিং মল আছে, যেখানে আপনি প্রায় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা পাবেন যখন কারেন চলে যাবে। এলাকা উঠতি, ফুটন্ত আনাড়িকচিকদমরা গিজগিজ করবে। আপনি সেই ‘মৌচাকেঢিল’ দিতে যেতে পারবেন কি না সেটাও একটা ব্যপার কারন অনলাইন আর এফ কর্মাসে আপনি সারাদিন টুকটাক কেনাকাটা করেছেন। ভাবিদের শপহপিং এর ভিডিও দেখে ‘টোরিব্রচ’ এক একটা ব্যাগ ওর্ডার করে ফেলেছেন ভাবির সাথে কথা বলার জন্যে। তাই মলের গ্রাউন্ড ফেøার থেকে উঠে ফ্লোর এ, বি করে সি তে যাওয়া হলেও কেনার মতন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মিরপুরের ক্রিকেট ম্যাচ আছে, কিন্তুস্টেডিয়ামের বাইরে এমন ট্রাফিক জ্যাম থাকে যে আপনি চাইলেও কোনো ওভার মিস করবেন না, ম্যাচে যান আর না-ই যান। কিন্তু এইসব তো ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের মহৎ রম্য রূপের সামনে একেবারেই তুচ্ছ।
দৃশ্যটি কল্পনা করুন — আপনি এয়ারপোর্ট রোডে আটকে আছেন, এক ইঞ্চিও এগোচ্ছে না। আপনা আপনি গভীর শ্বাস চলে আসে। মোবাইলে রিলসগুলো ঠিক আসছে না। ডাটা কনজেসান! নেটওয়ার্ক লোড নিতে পারছে না। ঠিক যেমন বৃষ্টিতে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ ইফেক্ট ধরা পরে শহরের ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনায়। আপনি পড়ে আছেন আপনার চিন্তাভাবনা আর চারপাশের কর্কশ হর্নের সুরে। লন্ডন সিম্ফনি ওর্কেস্ট্রার মতন মনে হবে। টুংটাং হয়েই যাচ্ছে কোথাও না কোথাও থেকে। এটা যেন হতাশার এক অদ্ভুত সিম্ফনি — সিসটাইন চ্যাপেল এর মতো। আপনার পাশে থাকা গাড়ি সমানে হেমস্টার হুইল টিপে যাচ্ছে নয়তো টিকটক ভিডিও স্ক্রল করছে, মনে হয় কখনোই লাল বাতি সবুজ হওয়ার কথা তার মনে পড়বে না। পড়বেই বা কেন? রাস্তার লালবাতির লালবাতি কবেই জ্বলে গেছে। রিকশাওয়ালা জিগজ্যাগ করে লেন পার করছে। তার চলাচল যেন এক নিখুঁত নৃত্য — স্বয়ং শামিম আরা নীপা নয় তো যেন নিউ সোনার বাংলা রওশন সার্কাসের ঘটি হাতা স্যান্ডো গ্যেঞ্জি পড়া মহিলাদের দুর্দান্ত এক্রোব্যাটিক কাজ। এটা ছেড়ে দ্রুত এগোতে যাবেন কেন? এটা তো জীবন — রঙিন সত্তায় ভরা!
এ ছাড়া, কোথায় পাবেন এত অসাধারণ মানবিক নাটক? প্রতিটি মোড় যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এক নতুন পর্বে, যেখানে ঢাকার রাস্তায় চলছে এক অন্তহীন সোপ ওপেরা বা মেগা সিরিয়ার। ঐ যে বিলাসবহুল এসইউভির ভদ্রলোক, কেতাদুরস্থ জসিম ভাই, তাকে আমি চিনি। এত বেশি কাজ থাকে তার যে উনি সময় করে পাইলসের চিকিৎসা করাতে পারে না। তাই জ্যামে বসে গাড়ির লেদার সিটের হিটার চালু রাখেন। গায়ে এসি’র বাতাস আর পশ্চাদ দেশে উষ্নটা উনি উপভোগ করেন। কিন্তু যখন গরম তেতিয়ে ওঠে তখন তিনি মনে করেন হর্ন বাজালে সামনে থাকা গাড়িগুলো ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। টিপতে থাকেন হর্ন। আর রিকশাওয়ালা? পানের খিলি মুখে দিয়ে অনায়াসে দুই লেন ব্লক করে রাখছে একটিমাত্র কনুই দিয়ে । এসবের চেয়ে জীবন্ত নাটক কোথায় পাবেন?
আর ভাবুন তো, ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে আমরা সমাজিকীকরণের আর কী উপায় রাখতাম? পার্ক, সিনেমা হল, বা সংস্কৃতি উৎসবের দরকার কী, যখন আমাদের আছে যানজটের মাঝে থেমে থাকা একটি জনগোষ্ঠী? এটা তো শহরের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক স্থান — সিইও, ছাত্র, রিকশাওয়ালা, এমনকি পথের মাঝখানে ঘুরে বেড়ানো কুকুর, সবাই একই জ্যামে আটকে থাকে। এটি প্রায় সমাজতন্ত্রের মতো, যেখানে প্রত্যেকে তাদের ন্যায্য ভাগের হতাশা প্রাপ্ত হয়।
আসলে, আমি বলবো ঢাকার ট্রাফিক জ্যামই একমাত্র সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্থান। আসল জ্যামে কোনো ভিআইপি লেন নেই (আসলে আছে, কিন্তু ধরি আপাতত নাই। উনি চলে গেছেন। অরেকজন আসুক তারপর না হয় হিসেবে নেয়া যাবে)। সবাইকেই সহ্য করতে হয়। এই যানজটে আমরা সবাই সময় পাই নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করতে, বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে। টলস্টয় নাকি পাঁচ বছরে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছেন; আপনি ‘ফাউস্ট’ এর তরজমা বা আরও বড় কিছু লিখতে পারবেন শুধু ফার্মগেট পার হতে হতে।
কিছু নিন্দুক বলবেন যে ঢাকার রাস্তা ঠিক করা উচিত, ফ্লাইওভার বা মেট্রো ব্যবস্থা ট্রাফিক “সমস্যা” সমাধান করবে। কিন্তু এরা বোঝে না আমাদের কী আছে। আপনি কি পিরামিড ভেঙে ফেলবেন কারণ তা একটু পুরোনো? ভেনিসের সব পানি ছেচে ফেলবেন একটু গন্ধ আছে বলে? ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এবং ট্রাফিক জ্যাম ছাড়া আমাদের অভিযোগ করারই বা কী থাকবে? এই জ্যাম আমাদের জীবনকে উদ্দেশ্য দেয়, আমাদের একত্র করে রাখে।
তাই, পরের বার যখন ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকবেন, মনে রাখবেন এটাই আসল জীবন — ‘এ্যজ গুড এ্যজ ইট গেটস’। শান্তু থাকুন, পিঠের দিকে যা আছে তাতে হেলান দিয়ে উপভোগ করুন। কেননা — নিরাস হইওনা বান্দা, যদি মমিন হও। জয়ী তুমি হবেই।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৮
মুনতাসির বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৩
অপু তানভীর বলেছেন: আমাদের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে সেটার আদর্শ প্রতিফলন কেবল এই ট্রাফিক জ্যামেই । এই কথাটা অবশ্য একদম সঠিক বলেছেন । এখন কেবল কেবল মাত্র ভিআইপিদের এই জ্যামে আটকাতে পারলেই শতভাগ সমাজতন্ত্রের প্রতিফল হবে !
অবশ্য আমাকে এখন আর জ্যামে পড়তে হয় না । সাইকেন নিয়ে চিপাচাপা দিয়ে ঠিকই বের হয়ে যাই !
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৭
মুনতাসির বলেছেন: তা ঠিক ই বলেছেন। সাইকেল তো দারুণ। জ্যামের চিপায় চাপায় ঘাও গুলো এড়িয়ে আমিও চালিয়েছি। অনেক অনেক বছর। বয়স একটা ব্যাপার। সাথে যখন চিন্তা যোগ হয় তখন সাইকেল খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এটা আমার অভিজ্ঞতা। তাই এখন চুটকি পুল্কাই জ্যামে বসে!
৩| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৯
হাইজেনবার্গ ০৬ বলেছেন: স্যার আপনি কে?? পোষ্টের শিরনামে জ্যাক আর হেলেন হান্টের মুভির নাম দেখে পোষ্টা পড়লাম।পইড়া খুশি হয়া হাপায়া গেলাম। দারুন পোস্ট।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২০
মুনতাসির বলেছেন: আনসারতেনিটি প্রিঞ্চিপাল হইয়া থাকি
৪| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯
আমি সাজিদ বলেছেন: চমৎকার লেখা। প্লাস আর কমেন্ট করতেই ব্লগে ঢুকলাম।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২১
মুনতাসির বলেছেন: ধন্যবাদ
৫| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: খুব সুন্দর লিখা। মাশাআল্লাহ
৬| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৩৩
শাহিন-৯৯ বলেছেন:
কিছু কিছু লাইনতো মাষ্টার ক্লাস সাহিত্যিক ভাবনা। খুবই চমৎকার হয়েছে। প্লাস।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৯
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: লেখাটি আগাগোড় পড়লাম; চমৎকার লিখেছেন।