নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
এক
আমি যখন দুঃসংবাদটা শুনলাম, আমার পায়ের নিচে তখন ভূ-কম্পন হলো, ঝড়ের মুখে বারোয়ারি মেলার ছেঁড়া-ফোঁড়া তাঁবুর মতো দুলে উঠলো আকাশটা! ধানমন্ডির ছোট বোনের বাসা থেকে স্টাফ কোয়ার্টারে ফিরে বাসায় ঢোকার আগে কিছু দরকারি জিনিস কেনার জন্য মাঠের ভেতর দিয়ে কোয়ার্টারের দোকানের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই ফোন বাজলো-
‘হ্যালো.....; ফোন আমার ব্যাগে ছিল বুঝতে পারি নি। কী হয়েছে?’
শুনে আমি স্তব্ধ! অবচেতনেই পা থমকে গেল। আমার পায়ের নিচে বর্ষায় গজানো নতুন সবুজ ঘাস, আর মাথার ভেতরে উপকূলের ধূসর সুনামি!
‘আমি আসছি...!’ বলার পর ওপাশ থেকে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো, না আমি-ই কেটে দিলাম জানি না। স্তব্ধ-স্থাণু মূর্তির মতো আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। সামনে থেকে আসা শীতল বাতাসে যেন আগুনের আঁচ আর সর্ষে দানার মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আগুনের ফুলকি! অসহ্য লাগলো! অথচ অন্য সময় হলে বাতাস আর বৃষ্টির ফোঁটায় নিজেকে সঁপে দিতাম। অবোধ বালিকার মতো আকাশের দিকে হাঁ করে দু-চার ফোঁটা পুড়ে নিতাম মুখেও।
আমি দাঁড়িয়েই রইলাম মাঠের মধ্যে। আমার ডান হাতের মুঠোয় মোবাইল, বাঁ হাতটা নিজের অজান্তেই স্পর্শ করলো আমার পেট। আত্মস্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম যেন! শূন্যে তাকিয়ে গুটিয়ে নিলাম চোখের পাতা। সর্ষে দানাগুলো মসুরদানায় রূপান্তরিত হয়ে আছড়ে পড়লো মুখে।
দুই
শীতের বিকেল। বসে ছিলাম গ্রামের বাড়ির বারান্দায় পাশ্চাত্যগামী বিষন্ন রোদ্দুরে, আমি একাই। আচমকা তলপেটে ঢুঁস খেয়ে আমি আঁৎকে উঠলাম! ঢুঁসের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে এক অদ্ভত ভাললাগায় বুঁদ হয়ে রইলাম গোটা বিকেল। সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ঢুঁস খেতে থাকলাম। বুঝলাম, এ বড় দুষ্টু! আমার হাড় জ্বালাবে!
এরপর থেকে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কতো রকমের গল্প করতাম, গান শোনাতাম, ছড়া শোনাতাম, রূপকথার গল্প বলতাম! আর মাঝে মাঝেই ও ভেতর থেকে হাত-পা ছুঁড়ে, মাথা দিয়ে মৃদু ঢুঁস দিয়ে আমার কথায় সায় দিতো। পরপর দু’বার ঢুঁস দিলে বুঝতাম, ও বুঝতে পারে নি। গল্পের ঐ জায়গাটা আবার সুন্দরভাবে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতাম। ও হয়তো তখন মাড়ি কেলিয়ে হাসতো। আমি ওর হাসি টের পেতাম! অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমার সে কী পাগলামি!
বাইশ বছর। অথচ এখনও অনুভূতিগুলো কতো জীবন্ত!
সোহাগ। আমার একমাত্র পুত্র। আমার কলিজার টুকরো। যার সুখের জন্য আমি নিজের স্বর্গের জায়গাটুকুও ছেড়ে দিতে রাজি, যার মঙ্গলের জন্য আমি নিজের সবটুকু অর্জন বিলিয়ে দিতে রাজি, যার জন্য আমি আমার নিজের ক্যারিয়ারটা একরকম বিসর্জন দিয়েছি।
আমি ক্যারিয়ারের কথা বলছি, তার মানে এই নয় আমি খুব শিক্ষিত একজন মা। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে থাকতেই আমার বিয়ে হলো একজন সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে। বিয়ের পরও আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলাম। একদিকে সংসার আরেকদিকে লেখাপড়া। সংসারের চাপ সামলাতে লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হতো। কিন্তু এই ক্ষতি মেনে নেওয়া ছাড়া তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বিবাহিত মেয়ের কি-ই বা করার ছিল! সংসার সামলে ঐভাবেই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। ততোদিনে আমি জেনে গেছি আমার সন্তানের আগমন বার্তা।
আমার স্বামী মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে ঢাকায় এলো। স্টাফ কোয়ার্টার পেলো। ওদিকে গ্রামে আমার কোল জুড়ে এলো ফুটফুটে পুত্র সন্তান। আমার সোহাগ। কয়েকমাস পরই আমার স্বামী আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলো। আমার রেজাল্ট বের হলো, প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম। ভর্তি পরীক্ষার ফরম জমা দেওয়ার সময়ও এসে গেল।
স্বামীকে অনার্সে ভর্তির কথা বলতেই সে বললো, ‘ভর্তি না হয় হলে, কিন্তু বাবুকে রেখে তুমি কাস করবে কীভাবে?’
‘আগে ভর্তি তো হই। তারপর না হয় দেখা যাবে। দরকার হলে একজন কাজের ঝি রেখে নেব।’
আমার চোখে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস, কাসরুম, করিডর। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি চান্স নাও পাই অন্ততপক্ষে ইডেনে, হোম ইকোনোমিক্সে ভর্তির আশা।
কিন্তু উত্তর পেলাম, ‘দেখা যাবে বললেই তো হয় না। যা করার আগে থেকে ভেবে চিন্তে করতে হয়।’
আমি বুঝলাম আমার অনার্স পড়ার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ। তবু বললাম, ‘তা বলে আমি আর পড়বো না?’
‘তুমি পড়বে না, আমি তো সেকথা বলিনি। বাবু একটু বড় হোক। তারপর অনার্সে না হোক ডিগ্রিতে কোনো কলেজে ভর্তি হোয়ো।’
অনার্স দূরে থাক আমার আর কোনোদিন ডিগ্রিতেও ভর্তি হওয়া হলো না। দেড় বছর পরই আবার আমার পেটে এলো শুভ্রা। ততোদিনে আমার স্বপ্নরা ঘুমিয়ে পড়েলো। আমার স্বপ্ন তখন সন্তানদের ঘিরে। আমার জীবনের যতো স্বপ্ন, যতো আশা-আকাক্সক্ষা সব আমি সঁপে দিলাম আমার দুই সন্তানের জীবনে।
তিন
আমি মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েই রইলাম। আকাশের হাঁক শুনে আমার সম্বিত ফিরলো। শরীর কাঁপতে লাগলো। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো-মাথার ওপরের আকাশ, ছন্দে আসা বাতাস, চতুর্দিকের গাছপালা, বৃষ্টিদানা, সমস্ত প্রকৃতি আমার জরায়ুর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করছে; আমার নারী জনমের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে তারা বিদ্রুপের হাসি হাসছে! আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো। উহ্! আমি যদি কালা হয়ে যেতে পারতাম, অন্ধ হয়ে যেতে পারতাম!
সকালে যখন পত্রিকায় খবরটা পড়েছিলাম, তখন মনে মনে বলেছিলাম, কোন মায়ের সন্তান এরা! কিন্তু এখন? আমার সকালে ছিটানো থুথু যে বিকেলে আমার গায়েই পড়বে, তা কি দুঃস্বপ্নেও কখনও ভেবেছিলাম আমি!
আমি বাসায় ফিরলাম। শুভ্রা দরজা খুলে দিলো, আমার মেয়ে। ওর চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। ও-ই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে সব। আমি দরজা লাগিয়ে সোফায় এসে বসলাম। পিছন পিছন শুভ্রাও এসে বসলো আমার পাশে।
‘মা, ভাইয়াকে একটা ফোন করবে?’ উৎকণ্ঠিত শুভ্রা বললো।
আমি শুভ্রার দিকে তাকালাম। ওর উৎকণ্ঠা আমাকে ভাবালো। এই উৎকণ্ঠা ওর ভাইয়ার জন্য নিশ্চিত। ওর ভাইয়া এখন কোথায় আছে, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় কিনা, ধরা পড়লে কী ধরনের শাস্তি হবে, ভাইয়ার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে কিনা, এসব ভেবে উৎকণ্ঠিত ছোটবোন। আমি শতভাগ নিশ্চিত ও একবারও এর বাইরে অন্যকিছু ভাবছে না। মানুষ কী এমনই! নিজে আর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথাই আগে চিন্তা করে? ভুলে যায় ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ?
কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি এমন ভয়ানক শান্ত কেন? শুরুর উত্তেজনা কোথায় উবে গেছে। আমি যেন পাথর, অথচ আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিক্তিতে ঝুলছে!
‘কী দেখছো অমন করে? ভাইয়াকে একটা ফোন দাও। আমি ফোন দিয়েছি, ধরছে না।’ শুভ্রা আমাকে তাড়া দিলো।
ছেলেকে ফোন করতে আমার রুচিতে বাঁধলো। আমি ওকে ফোন করে কী বলবো? এমন পরিস্থিতিতে একজন মা তার ছেলেকে ফোন করে কি বলতে পারে আমি তা জানি না। ওকে বলার মতো কোনো কথা মনের মধ্যে সাজাতে পারলাম না। ফোন করার কথা ভাবতেই আমার জিভ যেন আড়ষ্ট হয়ে এলো, এ যেন শব্দরাশির নীরব প্রতিবাদ! আমি আমার স্বামীকে ফোন করে সব জানালাম। শুভ্রার মতো সে-ও উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, ‘সোহাগ কোথায়?’
‘জানি না।’
‘তুমি ওকে ফোন করেছিলে?’
‘না।’
‘আশ্চর্য মা তুমি! ঠিক আছে আমি দেখছি। আর সোহাগ বাসায় এলে ওকে বাসায় রেখো না। বাইরে কোথাও থাকতে বোলো। আমি আসছি।’
‘কী করবে ভাবছো?’
‘ফোনে এতো কথা বলা যাবে না। রাখছি।’
ফোনের লাইন কেটে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুভ্রার কাছে পানি চাইলাম। ও পানি দিলো, পানিতে বিষের স্বাদ!
সাত নম্বর বিল্ডিংয়ের নাজমা ভাবী এলো আমার কাছে। খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করে চলে গেল। নাজমা ভাবী সোহাগের বন্ধু জাহিদের মা। জাহিদকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। আমাদের বাসায়ও পুলিশ এসেছিল। ফিরে গেছে। সোহাগ সকাল থেকেই বাসায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা বলে সকালে বেরিয়েছে। এখন প্রায় সন্ধে।
আমি কী করবো? আমার কী করা উচিৎ? মগজের অলি-গলিতে ভাবনার উৎপাত। রাত পোহালেই খবরটা জানাজানি হয়ে যাবে। আত্মীয়-স্বজনরা ফোন করবে। সহমর্মীতার আড়ালে মুখ টিপে হাসবে। কোয়ার্টারের মানুষ এমনিতেই মুখিয়ে থাকে মুখরোচক গল্পের জন্য। কার ছেলে কার মেয়ের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে, কার স্বামী কার সাথে শোয়াশুয়ি করছে, কার ঘরের সামনে কার পায়ের জুতো দেখেছে, কার মেয়ে অ্যাবরশন করিয়েছে, কার ছেলে ক’টা মেয়ের মন ভেঙেছে, কার মেয়ে দ্বিতীয়বার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ফিরে এসেছে; এসব গল্পের দারুণ কাটতি কোয়ার্টারে! কোনো পরিবারে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সামনে দেখা হলে দুঃখী দুঃখী ভাব দেখায়, সহমর্মীতা জানায়, দরদী গলায় দুটো উপদেশও দেয়। আর পরক্ষণেই অন্যদের কাছে কুটিল জাবর কাটে! সেই শুরু থেকে দেখে আসছি, এটাই কোয়ার্টারের রীতি-সংস্কৃতি! এজন্য কোয়ার্টারে কারো কাছে দুঃখের কথা পাড়তে নেই। এখানে বন্ধু ভেবে কারো কাছে ব্যথার ঝাঁপি খোলা মানে নিজেকে সস্তা স্ক্যান্ডাল ম্যাগাজিনে তুলে ধরা! এখানে ব্যথার আলপিনগুলো সংগোপনে নিজের কাছেই যত্ন করে রাখতে হয়।
জাহিদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, আমাদের বাসায়ও পুলিশ এসেছিল, কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। যখন কোয়ার্টারের সবাই খবরটা জানবে, আমি মুখ দেখাবো কেমন করে! বাইরে বের হলে লোকজন অন্য কারণে হাসলেও আমার মনে হবে, সবাই আমাকে দেখেই হাসছে। এই মানসিক যন্ত্রণা আমি সইবো কেমন করে! একবার ভাবলাম আমি আত্মহত্যা করবো। এ মুখ আর আমি কাউকে দেখাবো না। তারপর ভাবলাম, না, আত্মহত্যা করবো না। এটা কোনো সমাধান নয়। লোকলজ্জার ভয়ে আমি স্বার্থপরের মতো আত্মহত্যা করতে পারি না। গর্ভে পাপ ধরেছি আমি। এ পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্য আমাকেই করতে হবে।
সারারাত্রিতে গভীর মিলন হলো দু-চোখের পাতার। গভীর রাতে অকারণে ধোয়া বাসনগুলো বারবার মেজেছি আর ধুয়েছি নির্ভার থাকতে, দীর্ঘক্ষণ গোসল করেছি, পানির সাথে সঙ্গমে মেতেছি। কিন্তু চাইলইে কী আর নির্ভার থাকা যায়!
চার
সকালে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাদিয়াকে আমি দেখতে গেলাম। নাদিয়া মেয়েটির ছদ্মনাম। পত্রিকার নিউজে এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। কেবিনে ঢুকে দেখি ওর মাথার কাছে ভাতের থালা হাতে বসে আছেন একজন মহিলা। ওকে খাওয়াতে চাইছেন। কিন্তু খেতে চাইছে না ও। বালিশে ঠেস দিয়ে পাথুরে মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। কেবিনে তৃতীয় একজনের অস্তিত্ব টের পেয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। দৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন উদাসীনতা। নাদিয়া যথার্থ সুন্দরী। কিন্তু ওর সকল সৌন্ধর্য যেন এই দু-দিনেই হরণ হয়ে গেছে। দু-চোখের নিচে যেন শীতের ধু ধু বালুচরে পড়ে আছে দুটো ডিঙ্গি নৌকা!
ভাতের থালা হাতে মহিলার জিজ্ঞাসু চোখের কৌতুহল নিবারণ করতে নিজের পরিচয় দিলাম একজন মানবাধিকারকর্মী বলে। জানতে পারলাম তিনি নাদিয়ার মা।
আমি বেডে বসে নাদিয়ার হাতে হাত রাখলাম। ও মুখ ঘুরিয়েই রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ-ই যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠলো, ‘কেন এসেছেন আপনি? আপনি পারবেন আমার সম্মান ফিরিয়ে দিতে? আপনারা শুধু মুখেই বড় বড় কথা বলেন। সভা-সেমিনার করেন আর মিডিয়ায় কাভারেজ পেতে হ্যাংলামিপনা করেন। কারো সর্বনাশ হওয়ার পর যান করুণা দেখাতে।’
বলতে বলতে হাঁটুর কাছে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো নাদিয়া। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর বুকের হাহাকার জাগানিয়া বাতাস আছড়ে পড়লো আমার বুকেও। আমার বুকের মধ্যে ও অবিরত কাঁদতে লাগলো। কাঁদুক, যতো খুিশ কাঁদুক, কেঁদে হালকা হোক।
আমি ওর মাকে বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আমি ওর সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।’
ওর মা টেবিলে ভাতের থালা ঢেকে রেখে বাইরে চলে গেলেন।
আমার বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো নাদিয়া। আমি ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে, হাত ধুয়ে টেবিল থেকে ভাতের থালাটা নিয়ে ভাত মেখে ওর মুখের সামনে তুলে ধরলাম এক লোকমা। কয়েক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভাত মুখে নিলো ও। আমি অপরিচিত, কিন্তু ও আমার হাতে খেতে দ্বিধা করলো না। অনেকদিন পর আমার হাতে কেউ ভাত খেলো। সোহাগ-শুভ্রা আট-নয় বছর বয়সেই আমার হাতে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন খাইয়ে দিতে গেলে ওরা বলতো, ‘আমরা এখন বড় হয়েছি না’!
সত্যিই ওরা বড় হয়ে গেল। একটু একটু করে ওদের নিজস্ব একটা জগত তৈরি হয়ে গেল। সে জগতের দেয়ালের প্রাচীর এমন উঁচু আমার আর উঁকি দিয়ে দেখবারও উপায় রইলো না। কেমন দূরের মানুষ হয়ে গেল ওরা। শুভ্রাকে যদিওবা একটু চেনা যায়, সোহাগ একবারেই ঝাপসা। অথচ আমি কতো চেষ্টা করেছি ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে।
এজন্য দায়ী ওদের বাবা আর কোয়ার্টারের বর্তমান পরিবেশ। ছোট থেকে ওরা দেখেছে ওদের বাবা পরিবারের স্বৈরশাসক। যে কোনো কিছুতে তার কথাই শেষ কথা, হোক সেটা ভুল কিংবা সঠিক। কোনো ভুলের জন্য অনুতাপ নেই, নেই কোনো স্যরি ফিলিংস। জীবনভর শুধু টাকার নেশা। ব্যাগভর্তি কাড়ি কাড়ি টাকা এনে আলু-পটলের মতো রেখেছে খাটের নিচে। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাংকে গছিয়েছে। সোহাগ-শুভ্রা এসব দেখে দেখেই বড় হয়েছে। ছোট থেকেই ওরা জেনেছে ওদের বাবা অসৎ উপার্জন করে। ওদের টাকার কোনো অভাব নেই। তাই ওরা বাহুল্য খরচ শিখেছে আর ওদের ভেতরে তৈরি হয়েছে বেপরোয়া মানসিকতা। প্রগল্ভ আচরণ, কাউকে কেয়ার করে না। ওদের বাবাকে ওরা শ্রদ্ধা করে না, ভয় পায়। আর আমাকে তো ভয় পাওয়ার বালাইটুকুও নেই!
কোয়ার্টারের পরিবেশটাও সুস্থ মানসিকতা বিকাশের পরিপন্থী। মাদকের অবাধ বিচরণ এখানে। পানির পাম্পের পিছনের বাতাস কখনও বিশুদ্ধ হয় না। ছেলেদের শরীরের পৌরুষের গন্ধ প্রলীন হয়ে গেছে মাদকের গন্ধে! সোহাগও ভিড়েছে সেই দলে। কিছুতেই আমি আটকাতে পারি নি। মাঝে মাঝে বাপ ছেলের ওপর চড়াও হয়। তাতে সুফল মেলে না, সংসারের শান্তিকপোত উড়ে যায়। আমি কতো বলেছি, ‘চলো, আমরা কোয়ার্টার ছেড়ে ফ্যাটে উঠে যাই।’
ধানমন্ডিতে ফ্যাট কেনা আছে। ভাড়া দেওয়া। কে শোনে কার কথা!
আমার স্বামী কোয়ার্টারের কাবের সহ-সভাপতি। কাবের আগামী নির্বাচনে সভাপতি হবে নিশ্চিত। তার জনসংযোগ ক্ষমতা অত্যন্ত প্রখর। শুধু মাথায় হাত বুলিয়েই মানুষকে দাস বানিয়ে রাখতে পারে!
অর্থ আর ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। আমার স্বামী এমনই অন্ধ যে নিজের ছেলের ভবিষ্যতটাও দেখতে পায় না। ছেলের শরীরে প্রায়ই উৎকট গন্ধ পাই। সে গন্ধে আমার মাতৃহৃদয় জ্বলে যায়, হাহাকার করে। ছোট্ট সোহাগের কচি মুখের দুধের গন্ধ ফিরে আসে আমার অনুভূতিতে!
অনেকদিন পর আমার থিতিয়ে আসা মাতৃত্ববোধটা যেন আবার চাগাড় দিয়ে উঠলো। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমার চোখে জোর কাটালের জোয়ার এলো। বহু কষ্টে আমি সংযমের বাঁধ দিয়ে রাখলাম। খাওয়ানো শেষ হলে আমি হাত ধুয়ে এসে আবার নাদিয়ার পাশে বসলাম। ওর ডান হাতটি আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে তুমি উত্তেজিত হতে পারবে না।’
ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর মাথা নেড়ে বললো, ‘ঠিক আছে, বলুন।’
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে পারলাম না। আমার হাতের মুঠোয় ধরা ওর কোমল হাতখানির দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো বললাম, ‘যে তিন পাষণ্ড তোমার সর্বনাশ করেছে, আমি তাদের একজনের মা।’
ও নীরব। আমিও কয়েক মুহূর্ত পর ওর দিকে তাকালাম, ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখার জন্য। ওর চোখে-মুখে ঘৃণা আর বিস্ময়! কুঞ্চিত মুখম-ল, যেন পারলে আমার হাতে খাওয়া ভাতগুলো এখনই বমি করে বের করে দেয় উদর থেকে! কিন্তু ও আমাকে কথা দিয়েছে তাই উত্তেজিত হলো না, তবে আমার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘কেন এসেছেন আপনি?’
ওর কণ্ঠে উত্তেজনা নেই, আছে সংযত ঘৃণার প্রকাশ। দৃষ্টিতেও ঘৃণার বিজবিজে শূককীট। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও বললো, ‘নিজের ছেলেকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে নাকি মামলা তুলে নেবার হুমকি দিতে এসেছেন আপনি?’
‘যা হয়েছে তার কোনো আপোস হয় না মা। আর হুমকি দেবার কথা বলছ? হুমকি দেবার মতো ক্ষমতাবান মানুষও আমি নই। আমি এসেছি এই দুঃসময়ে তোমার পাশে দাঁড়াতে। বিশ্বাস করো...’
‘আপনি চলে যান।’
‘আমার কথাগুলো একটু শোনো...’
‘দোহাই আপনার, আপনি চলে যান। আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।’
‘যে মায়ের গর্ভে মানুুষরূপী সাপের জন্ম হয়, যে মা গর্ভে পাপ ধারণ করে, তাকে কেউই সহ্য করতে পারে না; এটাই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি হলেও পারতাম না। তুমি আমাকে যা খুশি তাই বলো, যতো খুশি অপমান করো, ঘৃণা করো। শুধু আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও, আমি তোমার কাছে মিনতি করছি মা।’
আমি হাত জোড় করলাম।
আমার কথায় ও একটু শান্ত হলো। বললো, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘মাগো, আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি। ও আমাকে কষ্ট দেয়, অপমান করে; তারপরও আমি ওকে আমার নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসি। কিন্তু আমি আমার সন্তানের জন্য তোমার কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে আসি নি। আমি ভেবেছিলাম আমার গর্ভাশয় পদ্মপুকুর, কোমল পাপড়ি মেলে সেখানে ফুটবে পদ্মফুল, অথচ পদ্মফুলের পরিবর্তে ফণা তুলেছে সাপ! গর্ভে সাপ ধরেছি আমি, ওর বিষদাঁত আমাকেই ভাঙতে হবে, নইলে ও আবারো অন্য কাউকে দংশন করবে। আমি চাই আমার সন্তান তার কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করে আত্মোপলব্ধি করুক, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নির্বিষ হয়ে ফিরে আসুক আমার আঁচল তলে।’
দু’হাতে মুখ ঢেকে পুনরায় কেঁদে উঠলো নাদিয়া। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘সোহাগ, মানে আমার ছেলে ওর বাবার সাথে কালরাতে দিনাজপুর গেছে আমার ননদের বাড়িতে। কাল-পরশুর মধ্যেই ওকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মুর্শিদাবাদে আমার এক চাচা-শ্বশুর আছেন। তার ওখানেই পাঠানো হচ্ছে ওকে।’
ও মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি আমার পার্স থেকে ঠিকানা লেখা একখানা কাগজ বের করে ওর হাতে দিলাম, ‘এখানে দিনাজপুরের আমার ননদের বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে। উল্টোপিঠে আমার ফোন নম্বরটাও আছে। আমার যা করার আমি করলাম। এখন তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই কোরো। ভালো থেকো মা।’
আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। কান্নায় আমার গলা বুজে আসছিল। চোখের পানি বাঁধ ভাঙছিল। আমি দ্রুত কেবিন থেকে বের হলাম উদ্ভ্রান্তের মতো। একবারও পিছে ফিরে তাকালাম না। আমার নাড়িছেঁড়া ধনের করুণ নিকট ভবিষ্যৎ আমি নিজ হাতে লিখে এলাম। আমার মনোছবিতে ভেসে উঠলো- জেলখানার গরাদের ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সোহাগ। কী রোগা আর বিষন্ন!
হাসপাতালের গেট থেকে বের হতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃৃষ্টি শুরু হলো। আমি হাঁটতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে, হাঁটছি তো হাঁটছি-ই, হাঁটাই যেন আমার লক্ষ্য! কোথা দিয়ে কীভাবে যে আমি শুক্রাবাদ চলে এলাম তা নিজেও জানি না। আমার নজরে পড়লো একটা মানববন্ধন। মানববন্ধনকারীরা বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী, কিছু প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াও আছেন। তাদের হাতের বড় একটা ব্যানার আর কিছু ফেস্টুনে লেখা- ‘অবিলম্বে ধর্ষকদের গ্রেফতার করা হোক’, ‘ধর্ষণকারীদের ফাঁসি চাই’, ‘বন্ধ হোক নারী নিগ্রহ’, ‘ধর্ষক মানুষ নয়, বাবা নয়, সন্তান নয়, ভাই নয়, ধর্ষক কারো স্বজন নয় পশু’ ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারপর বিড়ালের পায়ে হেঁটে গিয়ে চুপি চুপি দাঁড়ালাম মানববন্ধনের লাইনে। কারো বক্তব্য, কারো কোনো কথাই আমার কানে এলো না। আমি নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির ফোঁটগুলো পুরু হলো, শুরু হলো ধূমল বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সবাই যার যার মতো ছুটলো ছাদ কিংবা ছাইনির আশ্রয়ের উদ্দেশে। আমি তবু দাঁড়িয়েই রইলাম, আমার পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে ফুটপাতের কংক্রিট ভেদ করে প্রোথিত হয়েছে মাটির গভীরে! আমার চোখের নোনাপানি মিশে গেল বৃষ্টির স্বাদু পানিতে। বৃষ্টি...বৃষ্টি...বৃষ্টি....! এতো যে শীতল বৃষ্টি তবু কেন নেভে না আমার বুকের হোমাগ্নি!
ঢাকা।
জুলাই ২০১৪।
২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৪
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
স্বাগতম আমার ব্লগ আঙিনায়.....
ভাল থাকুন.......
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:১৫
বাড্ডা ঢাকা বলেছেন: সুন্দর ভালো লাগলো