নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
অ্যাশট্রের মুখ দিয়ে ধোঁয়া উঠছে সদ্য নেভানো দেশলাইয়ের কাঠির উৎস থেকে, ধোঁয়া বের হচ্ছে সদ্য জ্বালানো দু-আঙুলের ফাঁকের সিগারেট থেকে, ধোঁয়া বের হলো কালো দুটি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। সিগারেটে আরেকটি টান দিয়ে খুক খুক করে কেশে ফরহাদ হোসেন হাত বাড়ালেন টেবিলের গ্লাসের দিকে। ঢক ঢক করে দুটো ঢোক গিলে গ্লাসটা টেবিলে রেখে আবার দেয়ালের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন। বাম হাত দিয়ে মাথা চুলকালেন, মাথায় তিপ্পান্ন বছর বয়সী কাঁচা-পাকা চুল রুক্ষ ঘাসের মতো। মুখেও কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ।
সিদ্ধান্তটা গতকাল মাঝরাতের। শুরুতে ভেবেছিলেন বাসাতেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। কংক্রিটের জঙ্গল ঢাকা শহরে নয়, তিনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চান নিরিবিলি নির্জনে। কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির খুব কাছে। তাই খুব সকালেই বাসে চেপে প্রথমে চট্টগ্রাম এসেছেন। তারপর বাস বদলে বান্দরবান। উঠেছেন বান্দরবান শহর থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে উংক্ষ্যংছড়ি যাবার পথের পাশের একটা নির্জন কটেজে। জানালা খুললেই সাঙ্গু নদী দেখা যায়, সাঙ্গুর ওপারে অজস্র পাহাড়; পাহাড়ের পর পাহাড়, আর পাহাড়ের খাজে খাজে জমা সাদা মেঘ যেন পাহাড়ের গোপনাঙ্গ আবৃত করে রেখেছে লোকদৃষ্টি থেকে! কটেজটা রাস্তার ঢালে। কটেজের পরেই পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে সাঙ্গু নদীতে। সাঙ্গু খুব কাছে মনে হলেও পাহাড়ী ঢাল আর কাঁটা-লতা, ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে কাছে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। আগে একবার বন্ধুদের সঙ্গে নেমেছিলেন তিনি। এর আগেও বার তিনেক এই কটেজে থেকে গেছেন। একবার অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে, আরেকবার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। আর সব শেষবার পরিবারের সঙ্গে। জায়গাটা দারুণ নিরিবিলি। রাস্তার উল্টোদিকে উঁচু-নিচু পাহাড়ী ভূমিতে শালবন। আশপাশে আর কোনো কটেজ নেই। মাইল খানেক দূরে বমদের একটি গ্রাম। অত্যাধিক নির্জনতার কারণেই বান্দরবান এলে তিনি এখানে এসে ওঠেন। পরে যান অন্য কোথাও। আরো গহীনে।
এখন বর্ষাকাল। কোনো ছুটিছাটা নেই। তাই কটেজে ভিড় নেই বললেই চলে। তিনি ছাড়া আর অন্য এক দম্পতি আছেন এখানে। তাই পর্যটকদের হইহল্লাও নেই। একেবারেই সুনসান। কেবল নৈঃশব্দের যতোটা শব্দ!
সন্ধ্যার পরপরই বিদেশী হুইস্কির বোতল খুলেছেন ফরহাদ হোসেন। এমনিতে দেশি হুইস্কি, ভদ্কা যখন যা জোটে তাই খান। বিদেশী খাবেন অতো টাকা কোথায়! যা বেতন, তাতে তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। অবশ্য মাসে একটা বিদেশী বোতল জুটে যায়। নিজের টাকায় কেনা নয়, উপহার। মাসের শেষ দিকে হামিদ চৌধরী তার অভিসারালয় ‘তাম্রলিপি’তে যেতে বলেন তাকে। এই তাম্রলিপিকে হামিদ চৌধুরী সবার কাছে পরিচয় করান তার ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে। বলেন, এখানে তিনি লেখালেখি করেন, অধ্যয়ন করেন। কিন্তু হামিদ চৌধুরীর অতি ঘনিষ্ঠজনেরা জানে তাম্রলিপি তার অফিস নয়, অভিসারালয়!
মাসের শেষ দিকে ফরহাদ হোসেনের দিকে একটি বিদেশী হুইস্কির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে হামিদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাণ ভরে হুইস্কি খাও, আর হাত খুলে লেখ।’
বিদেশী বোতলটি কয়েক দিনেই শেষ হয়ে যায়। তারপর সংসারের খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা ছেকে রেখে মাঝে মাঝে কিনে আনেন একটা-দুটো দেশি পাঁইট।
দরজায় শব্দ হলো। উঠে গিয়ে দরজা খুললেন ফরহাদ হোসেন। সামনে দাঁড়িয়ে অলসেন, অলসেন ত্রিপুরা, কটেজের বেয়ারা, বাইশ-তেইশ বছরের যুবক, ফর্সা গোলগাল চেহারা, একটু বেটে। দারুণ ব্যবহার আর কাজেও খুব পটু। যখন যা দরকার অলসেনকে বললেই হলো, উড়ে গিয়ে এনে দেবে!
‘কিছু বলবে অলসেন?’
‘স্যার ককন কাবেন?’
‘আমি আর নিচে গিয়ে খাব না অলসেন। ভাত লাগবে না, তুমি শুধু গরুর ভূনাটা দিয়ে যাও।’
‘আচ্চা।’
মৃদু হেসে চলে গেল অলসেন। দরজা লাগিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলেন ফরহাদ হোসেন। এতোক্ষণ বেশ স্থির ছিলেন। হঠাৎ তাকে অস্থির লাগছে। উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন, সাড়ে আটটা বাজে। জানালাটা খুলে দিতেই শীতল বাতাসের ঝাপটা লাগলো মুখে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এখানে বর্ষাকালেও কিছুটা শীতল আভাস। আর কেওক্রাডাং, বগা লেকের দিকে কম্বল গায়ে দিতে হয়। আবার থানচির দিকে পড়ে ভীষণ গরম। হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকতে লাগলো মেঘ। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের পাহাড়টা ঋষির মতো ধ্যানে বসে আছে যেন সাদা মেঘের কৌপিন পরে!
তার আত্মহত্যার সংবাদ কখন জানতে পারবে সবাই? সকালে না দুপুরে? সকালে তাকে চা দিতে আসবে অলসেন। দরজায় শব্দ করবে। ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সে ভয় পেয়ে ম্যানেজারকে ডাকবে। ম্যানেজার এসে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর সাড়া না পেয়ে খবর দেবে কটেজের মালিককে, তারপর থানায়। থানা থেকে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখতে পাবে তার নিথর দেহ! তারপর পুলিশ ফোন করবে তার অফিসে। অফিসে কে আগে ফোন ধরবে, রোকেয়া না সুব্রত? যেই ধরুক সংবাদটা শোনার পর তার মুখটা কালো হয়ে যাবে। গম্ভীর মুখে সে সম্পাদককে ফোনের লাইনটা দেবে। এরপর অন্যদের জানাবে। সবাই শুনে আহা, উহু করবে। ‘মানুষটা বড় ভাল ছিল।’ ‘কিভাবে মৃত্যু হলো হার্ট অ্যাটাক? শরীর খারাপের কথা তো কখনও বলেননি!’ ‘ইস্! ছেলেটা সবে পাশ করে বের হলো। সবে সুখের দিনের শুরু অথচ সুখটা ঠিকমতো উপভাগও করে যেতে পারলেন না।’ ‘আত্মহত্যা নয় তো?’ ‘না, না, তা কেন করবেন?’ ‘বলা যায় না হতেও পারে।’ ‘কিংবা খুন?’ ‘দেখা যাক পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কী বলে।’ এমনি আরো কতো প্রশ্ন, কতো কথা!
শুরু হবে তার লাশ কাঁটা-ছেঁড়া। এরপর অফিসের সামনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হবে কিছুক্ষণ। জানাজা পড়া হবে। প্রেসকাবে তার লাশ নেওয়া হবে না। কারণ তিনি কোনো খ্যাতিমান সাংবাদিক নন। আবার রাজনৈতিক দলের ধ্বজা ধরা সাংবাদিক নেতাও নন। অফিসের সামনে থেকেই তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে গ্রামের বাড়িতে।
কিন্তু শুধুমাত্র অফিসের সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নয়, গোটা জাতির শ্রদ্ধা পেতে পারতেন তিনি। শহীদ মিনারে তার লাশ রাখা হতো। সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ছুটে আসতো। ফুলে ফুলে ঢেকে যেতো তার কফিন। ফটোসাংবাদিক, রিপোর্টারদের কাল ঘাম বেরিয়ে যেতো। কিছু চ্যানেল মৃত্যু বাণিজ্য করে নিতো। পরদিন দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ফুলেল কফিনের ছবি ছাপা হতো। শোক প্রকাশ করতেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। অথচ এসবের কিছুই হবে না তার মৃত্যুর পর!
স্ত্রী-সন্তানেরা কয়েকদিন কাঁদবে। ব্যাস, তারপর সব শেষ। শেষ হয়ে যাবেন ফরহাদ হোসেন। অফিসের সহকর্মীরা নতুন কর্মীর ভিড়ে, বন্ধুবান্ধব-ঘনিষ্টজনেরা নতুন ঘনিষ্টজনের আনাগোনায় ভুলে যাবে একজন ফরহাদ হোসেনের কথা।
স্ত্রী-সন্তানদের স্মৃতিতেও আস্তে আস্তে ধুলো পড়ে যাবে। তবু স্ত্রী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন হয়তো তার কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন থাকবে। স্ত্রী মারা যাবার পর সেগুলোও হারিয়ে যাবে। তার চশমা, শখের পাঞ্জাবি, লেখার খাতা, দামী কয়েকটি কলম, সব একে একে হারিয়ে যাবে। অথচ এসব না হারিয়ে অনায়াসে কালের গায়ে ঠেস দিয়ে টিকে থাকতে পারতো তার নামে কোন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত হয়ে অনন্তকাল ধরে।
আজ তার দাদার কথা মনে পড়ছে খুব। দাদা ছিলেন খ্যাতিমান কবিরাজ। কিন্তু যতো না বড় কবিরাজ ছিলেন তার চেয়ে বড় গল্পকার ছিলেন তিনি। অন্তত ফরহাদ হোসেন তাই মনে করেন। দাদার দাড়ি-গোঁফ কামানো থাকতো সব সময়। ব্যাকব্রাশ করা কাঁচা-পাকা চুল। সন্ধ্যেবেলা চার-পাঁচটি নাতি-নাতনি নিয়ে উঠোনে কিংবা বারান্দায় বসতেন তিনি। অনর্গল গল্প বলে যেতেন। অসংখ্য রূপকথার গল্প, লোকগাঁথা জানতেন। এছাড়া মুখে মুখে বানিয়ে গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। মুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনতো সবাই!
কবিরাজি পেশার কারণে দাদাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো রোগী দেখার জন্য। বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি বিচিত্র পেশার, বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখেছেন। তাদের জীবন-যাপনের ধরণ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ, কাছ থেকে দেখেছেন। সেইসব মানুষদের বিচিত্র জীবন-যাপনের গল্পই তিনি তার নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব রঙে, নিজের মতো করে বলতেন নাতি-নাতনিদের কাছে। সন্ধ্যা হলেই নাতি-নাতনিরা তাকে ছেকে ধরতো গল্প বলার জন্য। ছেলেবেলায় দাদার মুখে সেইসব গল্প শুনে শুনেই নিজের ভেতরে কথার বুনন তৈরি হয়েছে ফরহাদ হোসেনের। জীবনে তিনি যা কিছু লিখেছেন তার প্রায় সবটুকু অবদান তিনি দাদাকে দেন। দাদা তার শিশু মনে গল্পের শক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন। বড় হয়ে তিনি শুধু শব্দের দেয়াল গেঁথেছেন। এতো বড় গল্পকার হয়েও দাদা প্রায় হারিয়ে গেছেন! শুধু ফরহাদ হোসেন ছাড়া আর কেউই হয়তো দাদাকে সেভাবে মনে রাখেনি। দাদা কোনো গল্প লিখে যাননি। তাই হয়তো তিনি হারিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি? তিনি তো অসংখ্য ছোটগল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তারপরও তো তিনি হারিয়ে যাবেন দাদার মতোই। কোথাও ফরহাদ হোসেন নামটি জ্বলজ্বল করবে না। কোনো বইয়ের দোকানের তাকে না, কোনো বাড়ির সাজানো বুক সেল্ফেও না। তার দাদা আকমল কবিরাজ যেমনি হারিয়ে গেছেন, তেমনি তিনিও হারিয়ে যাবেন পৃথিবীর বুক থেকে।
মাথায় এলোমেলো ভাবনাগুলোর অস্থির পায়চারী, দুরন্ত ছুটোছুটি। মেঘ আর বাতাসের ছোঁয়ায় শরীর শীতল হয়ে গেছে। কতোক্ষণ এভাবে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন মনে নেই। ভাবনায় ছেদ পড়লো অলসেনের ডাকে-
‘স্যার..।’
‘দাঁড়াও খুলছি।’
দরজা খুলতেই অলসেন মাংসের বাটি হাতে ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখলো বাটিটা। ঘরের শীতলতা অনুভব করে অলসেন বললো, ‘স্যার, জানালা বন্ধ করে দেব?’
অলসেনের কথা শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ফরহাদ হোসেন। প্রকৃতির মাঝে মরবেন বলেই তো এতো দূরে এসেছেন, জানালা বন্ধ করে আর কি হবে! যদিও শীত লাগছে বেশ। তাতে কী! আর কয়েক ঘণ্টা পর তো তার শরীরটা এমনিতেই বরফ শীতল হয়ে যাবে।
বললেন, ‘জানালা খোলাই থাক।’
অলসেন তাকিয়ে আছে ফরহাদ হোসেনের দিকে।
‘বোসো, অলসেন। তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
অলসেন সোফায় বসলো।
‘বালো স্যার। বোনটাকে গেলো মাসে বিয়ে দিয়ে দিলাম। একন মা-বাবা আর ছোটবাইটাকে নিয়ে বালোই আচি।’
‘তুমি বিয়ে করবে কবে?’
‘এই তো সামনেই করবো।’
‘তোমার পছন্দের কেউ আছে?’
একটু যেন লজ্জা পেল অলসেন। মৃদু হাসলো।
‘লজ্জা পাচ্ছো কেন?’
‘আছে স্যার।’
‘বাহ্! ভাল, খুব ভাল। মনের মানুষকে বিয়ে করতে পারা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবাই মনের মানুষকে পায় না। তুমি খুব সৌভাগ্যবান।’
অলসেন হেসে মাথা নিচু করলো। ফরহাদ হোসেন উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগ খুলে অনেকগুলো পাঁচশো টাকার বের করলেন। নগদ দশ হাজার টাকা নিয়ে তিনি বেরিয়েছেন। পাঁচ হাজার টাকা খরচের জন্য রেখেছিলেন মানিব্যাগে, ওখান থেকে বাস ভাড়া দিয়েছেন, কটেজের এক রুমের এক রাতের ভাড়াও দিয়েছেন। এখন হাতের পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলেন অলসেনের দিকে, ‘নাও তোমার বিয়েতে আমার উপহার। বউকে কিছু কিনে দিও আর নিজে কিছু কিনে নিও।’
‘এতো টাকা স্যার!’ অলসেনের চোখে বিস্ময়।
‘এতো কোথায়! সামান্যই। আমি খুশি হয়ে দিলাম। নাও।’
‘স্যার এতো টাকা লাগবে না। আপনি দিতে চাইলে অল্প কিছু দ্যান।’
‘ধুর বোকা! বিয়ে বলে কথা। এর চেয়ে কম দেওয়া যায় নাকি! ধরো।’
প্রায় জোর করেই অলসেনের হাতে টাকাগুলো দিলেন ফরহাদ হোসেন। অলসেন বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
‘মনের মানুষকে বেশিদিন অপেক্ষায় রাখতে নেই। যতো তাড়াতাড়ি পারো বিয়েটা সেরে ফেলবে।’ অলসেনের পিঠ চাপড়ে বললেন ফরহাদ হোসেন।
অলসেন ঘাড় নাড়লো। তার চোখ ছলছল করছে। হয়তো জীবনে সে এতো বড় উপহার আর এতো ভাল ব্যবহার কোনোদিন পায়নি। সেই আনন্দেই হয়তো চোখ ছলছল করে উঠলো।
‘আপনার আর কিছু লাগবে স্যার?’
‘না। আর কিছু লাগবে না। তুমি যাও, শুয়ে পড়।’
চলে গেল অলসেন। যাবার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেঘের মতো কোমল দৃষ্টি বুলিয়ে গেল ফরহাদ হোসেনের দিকে। ফরহাদ হোসেন দরজা বন্ধ করে আবার সোফায় এসে বসলেন। বোতল থেকে আরেক পেগ গ্লাসে ঢেলে জল মিশিয়ে চুমুক দিলেন।
অলসেনকে যখন মনের মানুষকে বিয়ে করার কথা বলছিলেন, তখনই অনেক বছর আগের তার মনের মানুষ এসে উঁকি দিচ্ছিল স্মৃতির দরজায়। এখন সোফায় বসে গ্লাসে চুমুক দিতেই দরজা পেরিয়ে ভেতরে এলো শায়লা। শায়লা রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের জুনিয়র ছিল। লেখালেখির সুবাদেই শায়লার সাথে পরিচয় হয়েছিল। পরে সম্পর্ক। শায়লা তার লেখা খুব পছন্দ করতো। প্রত্যেকটা লেখা মন দিয়ে পড়তো। উৎসাহ দিত। আবার সমালোচনাও করতো। লেখাপড়া শেষ করার পর ফরহাদ হোসেন অনেকদিন বেকার ছিলেন। চরম হতাশায় দিন পার হতো তার। নিন্মবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। বাড়িতে বিধবা মা, অবিবাহিত দুটো বোন। তখন যেন অন্ধকারে আছাড়ি-পিছাড়ি করে পথ খুঁজছিলেন তিনি। রোজগারের পথ। সেই সময় একমাত্র শায়লা-ই তার পাশে ছিল। শায়লা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বাড়ি থেকে টাকা আসতো। আবার নিজেও টিউশনি করতো। শায়লা টিউশনির টাকা থেকে তাকে প্রায়ই টাকা দিতো। টাকার অভাবে কতো দুপুর না খেয়ে রুমে বসে থেকেছেন ফরহাদ হোসেন। সেই ক্ষুধালগ্নেই কোথা থেকে এসে হাজির হতো শায়লা। মুখ দেখেই বুঝতে পারতো পেটে কিছু পড়েনি। হাত ধরে তাকে নিয়ে গেছে নীলক্ষেতের কোনো হোটেলে। পেট পুরে ভাত খাইয়েছে। তারপর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘একদিন মেঘ কেটে যাবে। হতাশায় তুমি লেখালেখি ছেড়ো না। নতুন উপন্যাসটা শেষ করো।’
ফরহাদ হোসেন তখন একটি উপন্যাস লিখছিলেন, দেশভাগের সময়কার একটি পরিবারের দুর্দশার গল্প নিয়ে। লেখা তখন শেষের পথে। উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে, চরিত্র নিয়ে, চরিত্রের পরিণতি নিয়ে শায়লার সাথে দিনের পর দিন তার কথা হতো। শায়লা বলতো, ‘দেখো, তোমার উপন্যাসটা খুব হিট হবে। তোমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না।’
শায়লার উৎসাহে খাতা-কলম নিয়ে বসেছেন ফরহাদ হোসেন। লিখেছেন পাতার পর পাতা। কাটাকুটি করেছেন, পছন্দ হতো না বলে পাতা ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে লিখেছেন। কী যে নিবিড় তপস্যায় গেছে সেই দিনগুলো! ঠিক তখনই দুটো পত্রিকায় পর পর তার দুটো ছোটগল্প ছাপা হলো। তারপর আরেকদিন পত্রিকা অফিসে গল্প দিতে গিয়েই পরিচয় হয়েছিলো হামিদ চৌধুরী’র সাথে। হামিদ চৌধুরী তখন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। তিনিও অল্পস্বল্প লিখেন। সেদিন হামিদ চৌধুরীর সাথে ফরহাদ হোসেনের অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছিল। তারপরই তিনি তার পত্রিকায় চাকরি দিলেন ফরহাদ হোসেনকে।
ফরহাদ হোসেনের চাকরি পাওয়ার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিল শায়লা। তাকে নিয়ে শায়লার সে কী পাগলামো! কিন্তু যখনই শায়লা তার লেখার কথা তুলতো, তখনই তার মুখ গম্ভীর হয়ে যেতো। সে কৌশলে প্রসঙ্গ বদলাতো।
কিছুদিন পর এক বিকেলে শায়লার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ফরহাদ হোসেন। শায়লা কখনও দেরি করে আসে না। কিন্তু এদিন সে প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে এলো। ফরহাদ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে রাগ ঝাড়লেন শায়লার ওপর। কিন্তু শায়লা কেমন যেন নির্লিপ্ত! তারপর তিনি নিজে নিজেই শান্ত হয়ে বসে পড়লেন ফুটপাতে। শায়লা এসে বসলো তার পাশে খানিকটা দূরত্ব রেখে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে শায়লা বললো, ‘তোমার লেখার কী খবর, উপন্যাসটা শেষ করলে?’
‘শেষ আর করলাম কোথায়, অফিসে কাজের যা চাপ।’
‘তাই!’ শায়লার শান্ত উত্তর।
‘উপন্যাসটা তাড়াতাড়ি শেষ করো। আমার পরিচিত এক প্রকাশক আছে। চলো, একদিন গিয়ে কথা বলি।’
‘আরে ধুর! এখনও শেষই হলো না। কবে শেষ করতে পারবো তারও ঠিক নেই। আগে শেষ করি তারপর প্রকাশকের খোঁজ করা যাবে।’
‘তাহলে শেষ করো তাড়াতাড়ি।’
‘শোনো, সামনে খাবার পেলে গপগপ করে খেয়ে ফেলা যায়। কিন্তু কাগজ কলম পেলেই পটাপট লেখা যায় না। লেখার জন্য সাধনা করতে হয়। সব সময় লেখার মুডও আসে না। অফিসের ব্যস্ততা একটু কমে যাক, তারপর লিখে শেষ করবো।’
শায়লা হাসলো। সেই হাসিতে মেশানো কিছুটা অবজ্ঞা, কিছুটা করুণা। শায়লা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে তার সামনে তুলে ধরে বললো, ‘এই বইটি পড়েছ? বইটি খুব সাড়া ফেলেছে। লেখক এরই মধ্যে একটি পুরষ্কার পেয়েছে বইটির জন্য।’
উপন্যাসের নামের নিচে কালো রঙে লেখা লেখকের নাম জ্বল জ্বল করছে-হামিদ চৌধুরী। বইটির দিকে তাকিয়ে ফরহাদ হোসেনের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কপাল ঘামতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেল। মুখে ঝুলে রইলো লাউয়ের জাঙলার চুনমাখা হাঁড়ির মতো অভিব্যক্তি!
শায়লা কঠিন গলায় বললো, ‘আর কখনও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না। আমার কাছে মেরুদণ্ডহীন মানুষ আর একতাল মাটির পুতুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
তিনি শায়লার হাত ধরতে গেলেন। শায়লা এক ঝটকায় সরে গিয়ে বইটি তার গায়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। তখনই ওপর থেকে কাকের বিষ্ঠা পড়লো বইটির খোলা পাতায়! ফরহাদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন!
এতো বছর বাদে এখনও শায়লার মুখটা অবিকল মনে আছে ফরহাদ হোসেনের। মনে পড়ছে শায়লার সেই চলে যাওয়ার মুহূর্ত। তার চোখ থেকে দুটো জলের রেখা নামলো অধর বেয়ে।
বোতলে এখনও অর্ধেকের বেশি হুইস্কি আছে। এরই মধ্যে বেশ নেশা ধরে গেছে ফরহাদ হোসেনের। চোখ ছোট হয়ে আসছে। কাঁটা চামচে এক টুকরো মাংস গেঁথে মুখে পুরে গ্লাসটা হাতে নিয়ে সামান্য টলতে টলতে টেবিলের কাছে গেলেন তিনি। গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে চেয়ারে বসলেন। ব্যাগের পকেট থেকে স্লিপিং পিলের পাতা তিনটে আগেই বের করে রেখেছিলেন টেবিলে। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা একটা করে স্লিপিং পিল বের করে টেবিলের ওপর একটা কাগজে রাখতে লাগলেন। তখনই তার মাথায় এলো, আত্মহত্যা করলে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে কে?
শায়লা? না, না। শায়লা না। শায়লা বড় সত্য কথা বলে অনেকদিন আগেই তার জীবন থেকে চলে গেছে। সে নিজে? নাকি হামিদ চৌধুরী? নাকি বকুল? নাকি এই রাষ্ট্রব্যবস্থা?
কাল রাতে বকুল এসেছিল ঘুমের মাঝে, অনেক বছর পর! ভাঙা দেউড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বকুল তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। সব কথাই বলেছে রেগে, তীক্ষ্ণ কটাক্ষবাণ ছুঁড়ে, ঘৃনায় কপাল কুঁচকে। অথচ বকুল সহজে রাগে না। বকুল যদি কখনও রাগতো, তখন অন্যরা হাসতো। এমনকি যার সাথে সে রাগ করে কথা বলতো, সেও হেসে ফেলতো। কারণ বকুলের চেহারায় রাগ একেবারেই মানাতো না। অথচ সেই বকুল কাল মাঝরাতে কী ভীষণ মূর্তিতে তার সাথে কথা বলেছে! তিনি নিজেই চমকে গেছেন। এই বকুল তার একেবারেই অচেনা!
আচ্ছা, বকুল যখন সম্ভ্রম খুঁইয়ে ভারতে চলে গেল, তখন যেন তার বয়স কতো ছিল? তেইশ বছর...হ্যাঁ, তেইশ বছর। কাল রাতেও বকুলকে দেখে তেমনই মনে হয়েছে। তেমনি রোগা-পাতলা! বকুলের তবে বয়স বাড়েনি? অথচ তার এক মাথা কালো কুচকুচে চুলের বেশির ভাগই সাদা হয়ে গেছে! এমনই হয়। বকুলদের স্রষ্টার চুল পেকে যায়, চামড়া কুচকে যায়, তারপর একদিন মরেও যায়। কিন্তু বকুলরা তেমনি থাকে। চিরযৌবনা হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকে পাঠকের মনে।
না, তার মৃত্যুর জন্য বকুলকেও সে দায়ী করবে না। বকুল তো সত্য কথাই বলেছে। আগামীকাল হামিদ চৌধুরী দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পেতে যাচ্ছে। এটা বকুল সহ্য করতে পারছে না। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বলেই কাল রাতে অমন তেজস্বীরূপে বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছে তাকে ‘তুমি একটা কাপুরুষ, মেরুদণ্ডহীন, ছিঃ! দাঙ্গার সময় যারা আমার শরীরটা খুবলে খেয়েছিল, শাড়ী খুলে শরীরে পরিয়ে দিয়েছিল জমাট অন্ধকার! তাদের সাথে তোমার কোনো পার্থক্য নেই। সেই এক পুরুষরূপী লেখক পিশাচ তুমি! ছিঃ!’
‘বকুল....’
‘চুপ, একদম চুপ। আমার নাম ধরে ডাকবে না তুমি! আজ আমি তোমার কোনো কথাই শুনবো না। তোমার কথা শোনার জন্য আমি সীমান্তের ওপার থেকে কষ্ট করে আসিনি। আজ আমি বলবো, তুমি শুনবে। তুমি অনেক কথা বলেছ, আমি শুনেছি। তুমি আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করেছ। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য দাওনি। আমি সব মেনে নিয়েছি। তুমি আমায় যে মনটা দিলে, সে মনটা বাঁধা পড়লো নিখিলদার কাছে। আমার মনের ঘরে নিখিলদার অবাধ যাতায়াত। যখন তখন আসে, পিঁড়ি পেতে বসে। মায়ের হাতের পিঠা খেয়ে, হাত ধুয়ে ভেজা হাত আমার আঁচলে মোছে। আমি কপট রাগ দেখালে বেণী ধরে টানে। সেই টানের তান গিয়ে লাগে আমার হৃদয়ে! শরীরের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে কতো না রাগ-রাগিনী! কতো যে স্বপ্ন খেলা করতো দুটি চোখে! সেই স্বপ্ন আমার গলিত বরফ জলের মতো দু-চোখ থেকে ঝরে পড়লো। তুমি ঝরালে। কী যে খেয়াল তোমার! ভাঙো, গড়ো, আবার ভাঙো! অবিরাম ভাঙা-গড়ার আনন্দে তুমি উদোরে গড়িয়ে দাও আগুনের লাভা। সেই লাভার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে মগজে। তখন কথার ঝুড়ি খুলে বসো তুমি। গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে শুনতে হয়েছে তোমার সেসব কথা।
তুমি আমার ওপর রেগে গেছো। আবার ভালও বেসেছো। মধূত্থ আবেগে আমার খোঁপার বেলি ফুলের গন্ধ শুকতে। তুমি তখন তুমি নও। তুমি তখন নিখিলদা। নিখিলদা হয়ে আমার শিরা-উপশিরার রাগ-রাগিনী শুনতে। সেই রাগিনীতে বুদ হয়ে উদ্দাম তুমি দ্রুত লয়ে তবলার ঝঙ্কার তুলতে আমার শরীরে।
কিন্তু তোমার ছোঁয়ায় আমি অপবিত্র হইনি কখনও। যতোবার তুমি আমায় ছুঁয়েছো, ততোবারই আমি নতুন করে জন্মেছি! তোমার অগোচরেও নিখিলদার সাথে আমার সব কথা হতো। ও শুনে হাসতো। বলতো, লোকটা সত্যিই পাগল!
আমি তোমার সব পাগলামী-ই মেনে নিয়েছি। তুমি যখন দেখলে আমি খুবই সহনশীল একটি মেয়ে, তখন তুমি নিখিলদা আর আমার মাঝে দেয়াল তুলে দিলে। আমি ধিঙ্গি মেয়ে, বেণী দুলিয়ে কলেজে যাই, ছেলে বন্ধুদের সাথে হেসে কথা বলি, আবার গানও গাই। কোথাও কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ে। তাই নিখিলতার বাবার চোখে আমাকে করে তুললে ‘পাজি নচ্ছার মেয়েছেলে’! নিখিলদাকেও তার বাবার তুলে দেওয়া দেয়াল ভেদ করে আমার কাছে আসতে দিলে না। আমার শুকনো আঁচল অপেক্ষায় রইলো নিখিলদার ভেজা হাতের। কিন্তু নিখিলদা আর এলোই না। বেণীতেও আর টান পড়লো না কখনও।
তুমি নিখিলদার বিয়ে দিয়ে দিলে তথাকথিত লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের সাথে। তুমি আমাকেও বিয়ে দিলে আমার অনিচ্ছায়। দিলে তো দিলে আমার দ্বিগুণ বয়সের এক কালো মানিকের সঙ্গে। কালো মানিকের রেলের সরকারী চাকুরী মেদিনীপুরে, কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করেছে। তাই একটু লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মেয়ে চায়। মেদিনীপুর থেকে তুমি তাকে বিয়ে করার জন্য টেনে আনলে খুলনার গ্রামের বাড়িতে। ফরিদপুর থেকে সে আমায় বিয়ে করে নিয়ে গেল খুলনায়। আমার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি সব মেনে নিলাম। তাহলে পাঠিয়ে দাও আমাকে স্বামীর সাথে মেদিনীপুর, দিলে না। আমায় রেখে দিলে দজ্জাল শাশুড়ির সেবাযত্নের জন্য, আর কালো মানিককে পাঠিয়ে দিলে মেদিনীরপুর। কী স্বামী রে বাবা! কালো মানিক তো কালো মানিকই! নামেই কলকাতায় পড়েছে। কিন্তু মগজের গাঁথুনি খুলনার অঁজো গ্রামের কাদা-মাটি দিয়ে। দজ্জাল মায়ের সামনে পুতু পুতু করে। মেদিনীপুরে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খায়। অথচ মাকে মুখ ফুঁটে বলতে পারে না বউকে নিয়ে যাব ওখানে। আর তেমনই শাশুড়ি তুমি আমায় দিলে। নতুন বউ যাতে ছেলের কানে মন্ত্র দিয়ে ছেলেকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে না নিতে পারে, তাই ছেলের বউকে বেঁধে রাখলো নিজের সাদা থানের আঁচলে! শাশুড়ির সাদা থানে দিনের পর দিন বাঁধা থাকতে থাকতে আমার ভেতরের সব রঙ বিবর্ণ হতে লাগলো। পুকুরের জলে, রাতের অন্ধকারে মিশে যেতে লাগলো আমার যতো রঙ। ঠিক তখনই....’
ভাবনার মধ্যে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল ফরহাদ হোসেনের। আবার জেগে উঠলেন। জেগে উঠতেই চোখের মনি অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো টেবিলে রাখা স্লিপিং পিলগুলোর ওপর। কিন্তু অর্ন্তদৃষ্টি মামা বাড়ির পাশের বাড়ির বীণা বৌদির মুখে। মামাদের পাড়াতে সব গিয়ে থুয়ে শেষ অবধি একটি হিন্দু পরিবারই অবশিষ্ট ছিল। ছেলেবেলায় মা আর বড় ভাই-বোনদের সঙ্গে প্রায়ই মামা বাড়িতে যেতেন ফরহাদ হোসেন। শীত গ্রীষ্মে দুবার তো যাওয়া হতোই। তাছাড়াও নানার অসুখ, নানী যায় যায় অবস্থা, ছোট মামা সাইকেল অ্যাকসিডেন্টে হাত ভেঙেছে, এসব কারণে মায়ের আরো যাওয়া পড়তো। আর প্রত্যেকবারই মায়ের ন্যাওটা হয়ে যেতেন ফরহাদ হোসেন। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় এই সৌভাগ্যের শিকেটা তার কপালেই ছিঁড়তো।
মামা বাড়িতে গেলেই যমের বউয়ের দর্শন লাভ হতো! অর্থাৎ পাশের বাড়ির এক জাঁদরেল হিন্দু মহিলা। আড়ালে সবাই যাকে যমের বউ বলে ডাকতো। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি মতো লম্বা। মোটা আর কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল সারাক্ষণ ছড়ানো থাকতো পিঠের সীমানা ছাড়িয়ে কোমর অব্দি। চওড়া কপালে বড় একটা সিঁদুরের ফোঁটা পড়তেন। সিঁথিতেও পুরু সিদূররেখা। দেখে ভাবা স্বাভাবিক এ নারীর স্বামী ভক্তি অতি দূর্লভ! অথচ ঠিক উল্টো। যমের বউ খেতাব পাওয়া মহিলার স্বামী যমরাজ দূরে থাক নিদেন পক্ষে স্বর্গের ক্ষৌরকারও নয়! গোবেচারা স্বামী মরমে মরে থাকতেন ঘরে। স্ত্রীর থেকে বছর পঁচিশের বড় তো হবেনই। যমের বউয়ের বয়স তখন পঞ্চাশের সামান্য উপরে। স্বামী বেচারা ঘরের কোনে পড়ে থাকতেন। গ্রীষ্মে যদিওবা মাঝে মাঝে পাড়ার লোক তার দর্শন পেতো, শীত-বর্ষায় কখনও নয়। হাঁপানীর রোগী। বুকের মধ্যে অবিরাম শ্বাসযন্ত্রের ঘরঘরানী। তিনবেলা স্বশব্দে গরম ভাতের থালা পড়তো তার সামনে। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে টাইপ মেশিনের খট খট শব্দের মতো ধাক্কা লাগতো স্ত্রীর মুখ নিশ্রিত তপ্তবাক্য। স্ত্রী চোখের সামনে থেকে চলে গেলে শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় নিচু স্বরে বলতেন, ‘মাগী’!
যমের বউ ততোক্ষণে পাড়ার কোনো ডানপিটে কিশোরকে লাঠি হাতে তাড়া করেছে। অনেক বড় বাড়ি। পুকুর বাগানসহ আট বিঘার মতো। অথচ বাড়িতে মাত্র তিনজন মানুষ। তাই পাড়ার ডানপিটেগুলো সুযোগ পেলেই বাগানে ঢুকে পড়তো। ধরা পড়লে তাদের বংশলতিকা ধরে টান দিতো যমের বউ। এই ডানপিটেদের দলে কখনও কখনও ফরহাদ হোসেনও থাকতেন।
বাড়ির তিন প্রাণের দুটির কথা তো বলা হলো। আরেক প্রাণ ঐ বাড়িতে যমের বউয়ের দাপটে বড় আঁকুপাঁকু করতো, সে যমের বউয়ের একমাত্র ছেলের বউ বীণা বৌদি। বীণা বৌদির স্বামী চাকরি করতো। থাকতো দূরের কোনো শহরে। আর বাড়িতে শাশুড়ির ফরমাশ খাটতে খাটতে বীণা বৌদির জান বেড়িয়ে যাবার উপক্রম হতো। পান থেকে চুন খসলেই মা-বাপের নামে গালাগালি।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় যমের বউয়ের গলা শোনা যেতো অনেক দূর থেকেও; কখনও স্বামীকে, কখন বীণা বৌদিকে, আবার কখনও পাড়া-পড়শিকে বাকঠ্যাঙানি দিতো! যমের বউ প্রায়ই মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতো, কখনও বোনের বাড়িতে। সেই সুযোগে বীণা বৌদি পাড়া-পড়শিদের বাড়িতে যেতো। সবার সঙ্গে ভাব জমাতো। নিজের সুখ-দুখের কথাও বলতো। ফরহাদ হোসেনের মায়ের সঙ্গে বীণা বৌদির দারুণ ভাব জমে উঠেছিল। দুজনে কতো গল্প করেছে। সে সব গল্পের কিছু কিছু ফরহাদও শুনেছেন। বীণা বৌদির সেসব কথা শুনে ছোট্ট ফরহাদের মন বিষিয়ে উঠেছিল যমের বউয়ের প্রতি। ইচ্ছে করতো মহররমের রাতের তরবারী দিয়ে যমের বৌকে বধ করতে!
যমের বউ যখন বাড়িতে থাকতো না তখন বীণা বৌদি মামা বাড়িতে বেড়াতে এলে ফরহাদকে বলতো, ‘ফরহাদ তুই আমাদের বাড়িতে যাস। গাছভর্তি কতো ফল। পচে যায়, পাখিতে খায়। তোরা তো গিয়ে খেতে পারিস।’
বীণা বৌদির কথায় খুশিতে ফরহাদের ভেতরটা নেচে উঠতো। মামাতো ভাই হাসান আর মিথুনকে নিয়ে বীণা বৌদিদের বাগানে কাটিয়ে দিতো সারাটা দুপুর। সেদিন দুপুরে আর ভাত খাবার কথা মনেই থাকতো না! বানরের মতো গাছে গাছে চড়ে বেড়াতো। আর বীণা বৌদির জন্য মমতায় উথলে উঠতো বুকের ভেতরটা। বীণা বৌদি কখনও কখনও আসতো বাগানে। সতর্ক করে বলতো, ‘সাবধান! পড়িস না যেন। আমায় দে তো ঐ পেয়ারাটা।’
বীণা বৌদিকে পেয়ারা পেরে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হতো। বীণা বৌদির তখন বয়স কতো? তেইশ-চব্বিশ। অথচ ঐ বয়সে কিনা তাকে স্বামীর থেকে দূরে থাকতে হয়! স্বামী নাকি বছরে দু-তিন বার আসে। বীণা বৌদির স্বামীকে কখনও দেখেনি ফরহাদ।
এর পরের বার ফরহাদ মামা বাড়িতে গিয়ে দেখলো যমের বউয়ের কপালে সিঁদূর নেই। পরনে সাদা থান। বুড়োটা তবে মরে বেঁচেছে! যমের বউয়ের চেহারা কেমন যেন হয়ে গেছে। মনে হলো এক ঝটকায় বয়স অনেক বেড়ে গেছে তার। শোকে? ধুর! বুড়োর জন্য তার আবার শোক! তবে বিধবা বেশে যমের বউকে দেখে ফরহাদ ভেবেছিল এবার বুঝি সে একটু শান্ত হবে। বড়দের মুখে সে শুনেছিল, মেয়েরা বিধবা হলে নাকি তাদের তেজ কমে যায়। মৃত্যুচিন্তা কিছুটা হলেও নাকি তাদের ভেতরটাকে নাড়া দেয়। কিন্তু কিসের কী! যে যমের বউ সেই যমের বউ-ই রইলো! দুদিন মামা-বাড়িতে থেকেই তা বুঝেছিল ফরহাদ। সাপ খোসা বদলায় কিন্তু বিষ বদলায় না। যমের বউও রঙিন শাড়ি ছেড়ে সাদা থান ধরেছে। কিন্তু ভেতরটা একটুও বদলায়নি। বরং যে সময়টুকু স্বামীর সাথে গজরাতো, সেই সময়টুকুও বরাদ্দ হলো বীণা বৌদির জন্য।
বীণা বৌদি কেঁদে-কেটে স্বামীর কাছে চিঠি লিখতো। স্বামীর চিঠি আসতো শাশুড়ির নামে আসা চিঠির সাথে একই খামে। বীণা বৌদি লেখাপড়া জানলেও তাকে দিয়ে চিঠি পড়াতো না যমের বউ। বউ যদি তার কাছে কিছু লুকোয়! তাই পাড়ার কলেজ পড়ুয়া ছেলে সুবলকে দিয়ে চিঠি পড়াতো। সুবলকে দিয়ে দুটো চিঠি-ই পড়িয়ে শুনতো। এরপর যমের বউয়ের ছাড়পত্র পেয়ে সেই চিঠি আসতো বীণা বৌদির হাতে। বলা বাহুল্য, সেই চিঠিতে গোপন গভীর প্রণয় বা আবেগী কিছু লেখা থাকতো না। কারণ বীণা বৌদি’র স্বামী জানতো এই চিঠি আগে তার মা কাউকে দিয়ে পড়িয়ে শুনবে, তারপর দেবে তার বউকে। তাই অতিসাধারণ কথাই লেখা থাকতো সেই চিঠিতে, ‘কেমন আছো? আমি ঠাকুরের কৃপায় মঙ্গলময় আছি। মায়ের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখিও। মা’র তো বয়স হইয়াছে। তাহার যত্নের যেন ত্রুটি না হয়। তুমিও ভাল থাকিও।’
ঘুরে ফিরে সব চিঠিতে এই একই কথা! বীণা বৌদি চিঠি হাতে নিয়ে খোলার আগেই স্বামীকে ব্যঙ্গ করে নাকি সুরে ঐ কথাগুলো বলতো। তারপর খুলে পড়ে দেখতো প্রায় একই ধরনের কথা। চিঠিখানা তখনই কুচি কুচি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিতো বীণা বৌদি।
এরপর প্রায় বছরখানেক বাদে মামাবাড়িতে যাওয়া হলো ফরহাদের। ছোট মামার বিয়েতে। তখন ফরহাদ মাথায় বেশ লম্বা হয়েছে। গোঁফ কালো হতে শুরু করেছে। গলার স্বর ভেঙেছে। বিকেলবেলা বীণা বৌদিদের বাড়িতে গিয়ে উঁকি-ঝুকি দিতেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন শুভ্র দাড়ি-গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক। মাথায় টুপি। ফরহাদ খানিকটা ভড়কে গেল, বীণা বৌদিদের ভেতর বাড়িতে মুসলমান! বীণা বৌদির শাশুড়ি কি তবে বাড়িতে নেই। নাকি মরে গেল! তাই এখন সব জাতের মানুষের অবাধ যাতায়াত এ বাড়িতে। বীণা বৌদির কোনো প্রকার সংস্কার নেই। এমন হতেই পারে। ও বেটি যমের বউ মারাই ভাল! মনে মনে ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে ভদ্রলোকের মুখোমুখি হতেই ভদ্রলোক তাকে বললেন, ‘তুমি কি ফাহিমের বন্ধু?
ফরহাদ বোকার মতো তাকালো ভদ্রলোকের মুখের দিকে। ভদ্রলোক আবার বললেন, ‘তুমি কি ফাহিমের কাছে এসেছো?’
ফরহাদ দু-দিকে মাথা নাড়লো।
‘তবে কার কাছে এসেছো?’
‘বীণা বৌদি।’
ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন, ‘ও, তাই বলো। আমি তো ভাবলাম তুমি আমার নাতি ফাহিমের কাছে এসেছো। তোমার বীণা বৌদিরা তো এখন এখানে থাকে না। তারা এই বাড়ি আমাদের কাছে বেচে দিয়ে ভারতে চলে গেছে।’
ধারালো ছুঁড়ি দিয়ে কেউ যেন ফরহাদের হৃদপিণ্ডে পোঁচ দিলো! সে ভেতর বাড়ির দিকে তাকালো। একটা বাচ্চা টাল খাওয়া পায়ে বল খেলার চেষ্টা করছে। এ পাশের বাগানে লিচু গাছ, আতা গাছ, জামরুল গাছগুলো তেমনি আছে। পেয়ারা গাছে অসময়ের পেয়ারা ধরেছে। সদর দরজার পাশের ডালিম গাছে কয়েকটা চড়ুই তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে। সবই আছে আগের মতো, শুধু বীণা বৌদি আর যমের বউ নেই। এই প্রথম যমের বউয়ের জন্য তার খারাপ লাগলো। দূর দেশে গিয়ে তার এই তেজ থাকবে তো! ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো বীণা বৌদির জন্য। ফেরার জন্য পা বাড়াতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার বৌদি নেই তাতে কী। এসেছো যখন, বসে যাও।’
ফরহাদের চোখে জোয়ার আসছে। আরেকটু দাঁড়ালেই আছড়ে পড়বে কপোলের সৈকতে। সে দুদিকে মাথা নেড়ে, ঘুরেই ছুটে একটা দৌড় লাগালো।
বকুলের শাশুড়ি সেই যমের বউয়ের ছায়া-কায়া দুই-ই। আর বকুল? বকুলের নিঃসঙ্গতা, উদারতা, অভিমান, বন্ধুবৎসলতা, চিকনাই হাসি- বীণা বৌদির। আর চঞ্চলতা, দুষ্টমী, মুখমণ্ডল, শরীরের চড়াই-উৎড়াই যাবতীয় আরেকজনের। তাকে একদিন মেলায় দেখেছিলেন ফরহাদ। জীবনে ঐ একবারই দেখা! কয়েকজন বন্ধুর সাথে মেলায় এসেছিল মেয়েটি। অল্প একটু সময়ের জন্য দেখা। তাতেই ফরহাদের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। দুষ্টুমী আর চঞ্চলতায় বন্ধুদেরকে মাতিয়ে রাখছিল। কী উচ্ছল, কী চঞ্চল অথচ কতো কী শালীন! বীণা বৌদি আর মেলায় দেখা ঐ মেয়েটিকে মিলিয়ে কুমোরের হাতের মাটির মতো শব্দের পেলবতা দিয়ে ফরহাদ হোসেন সৃষ্টি করেছিলেন উপন্যাসের চরিত্র-বকুলকে।
বিছানায় পড়ে থাকা সেল ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি...’। বিরক্ত হয়ে সেল ফোনের দিকে তাকালেন ফরহাদ হোসেন। এই যন্ত্রটা না আনলেই ভাল হতো। নির্জনতা ভেঙে তেতো বস্তুর মতো নষ্ট করছে একাকিত্বের স্বাদটুকু। সেল ফোনটা এখন বন্ধ করতে হবে। একটু আগেই স্ত্রী ফোন করেছিল। জানতে চেয়েছে রাতের খাবার খেয়েছে কিনা। তারপর শুরু করেছে উপদেশ, ‘বেশি ড্রিংক কোরো না। আড্ডায় বসলে তো তোমার হুশ থাকে না কতোটা পেটে পড়লো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পোড়ো ইত্যাদি।’ স্ত্রীকে বলে এসেছেন বন্ধুদের সাথে যাচ্ছেন। এজন্যই আড্ডার প্রসঙ্গ তুলে স্ত্রীর সতর্কবার্তা। আড্ডা অবশ্য ফরহাদ হোসেন দিচ্ছেন। নিজের সাথে নিজে, ছেলেবেলায় দেখা মানুষদের সাথে, তার সৃৃষ্ট চরিত্রগুলোর সাথে!
প্রথমবার খেলাঘর বাঁধা শেষ হলে আবার খেলাঘর বাঁধা শুরু হলো। তারপর আবার...। নাছোড়বান্দা কিছু মানুষ আছে। একবার কল করে না পেলে বারবার, দশবারও কল করে। কোনো ক্লান্তি বা বিরক্তি নেই। তারপর ফোন রিসিভ করলে শোনায় অতি তুচ্ছ সাধারণ কথা। যার জন্য দশবার কল করার দরকার ছিল না। উঠে গিয়ে সেলফোনটা হাতে নিয়ে খানিকটা যেন অবাকই হলেন তিনি। স্ক্রিনে হামিদ চৌধুরীর নাম ভাসছে। এতো রাতে কেন ফোন করেছে হামিদ চৌধুরী? কোনো দরকারে? কালকের পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানের বক্তব্য লিখে দেবার জন্যে? হতে পারে। সব বক্তব্য হামিদ চৌধুরী তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল ফরহাদ হোসেনের। এখন যদি তাকে বক্তব্য লিখে দিতে বলে তাহলে ইচ্ছে মতোন গালিগালাজ করবেন হামিদ চৌধুরীকে। আবার মুহূর্তেই শান্ত হয়ে মত বদলালেন তিনি। এখন গালিগালাজ করা যাবে না। তাহলে কালকের সারপ্রাইজটা হালকা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং যা বলবে তার উত্তরে তিনি হ্যাঁ হ্যাঁ করবেন।
কলটা রিসিভ করলেন ফরহাদ হোসেন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো হামিদ চৌধুরীর কিছুটা জড়ানো কণ্ঠ, ‘আরে কোথায় তুমি ফরহাদ? শুনলাম আজ অফিসেও যাওনি? তোমাকে ফোন করেও পাচ্ছি না। শোন, কাল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একদিন। শ্রেষ্ঠ অর্জনের দিন। এই দিনে আমি সবার আগে তোমাকে চাই। কাল সময় মতো চলে এসো। আমি আজ রাতে অফিস করছি। কাল দিনে আর অফিসে যেতে পারবো না। তুমি চলে এসো কিন্তু।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
‘লেট কোরো না আবার।’
‘না, লেট হবে না। আমি সময়ের অনেক আগেই চলে আসবো।’
‘গুড। কী, খেয়েছ নাকি? গলা কেমন শোনাচ্ছে!’
‘একটু।’
‘গুড। না খেলে লিখবে কি করে! ও হ্যাঁ, কালকের অনুষ্ঠানের বক্তব্যটা লিখে আমাকে রাতেই মেইল করে দাও।’
‘ঠিক আছে।’
‘বিশেষ দিনের বক্তব্য, একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে লিখো।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। দেখবেন এই বক্তব্যটা হবে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তব্য।’
‘ভেরি গুড। ওকে রাখছি।’
সেল ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলেন ফরহাদ হোসেন। একটা গালিও দিলেন। আরেক পেগ বানিয়ে টলতে টলতে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। একটা সাদা কাগজ আর কলম টেনে নিলেন। মৃত্যুর আগে শেষ কিছু কথা লিখে যেতে চান। কী লিখবেন? কাউকে দায়ী করে কিছু লিখবেন? কিন্তু কাকে দায়ী করবেন? বকুলকে? নিজেকে? ফরহাদ হোসেনকে? নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে? আবার এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। তরুণ বয়সে অভাবের তাড়নায় হামিদ চৌুরীর জালে পা দিয়েছিলেন তিনি। বাকী জীবনে আর সেই জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেননি। মেরুদণ্ড সোজা করে হামিদ চৌধুরীর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেননি। বরং দিনে দিনে ক্রমশই তার মেরুদণ্ড সংকুচিত হয়ে গেছে। তিনি একজন ভীরু, কাপরুষ! ঠিকই বলেছে বকুল। নিজের স্ত্রীও তাকে তাই বলে। যখন-তখন মুরোদহীন মরদ বলে খোঁটা দেয়! সন্তানেরা বাবার দূর্বলতা বুঝে তাচ্ছিল্য করে। এই জীবন আর ভাল লাগে না। তার মরে যাওয়াই উচিত। ভাবতে ভাবতে কলম দিয়ে কাগজে আঁকি-বুকি করতে লাগলেন। কতোক্ষণ ধরে আঁকলেন তা তার মনে নেই। এক সময় দেখা গেল কাগজের পাতায় একজন মানুষের প্রতিকৃতি! মাথার সামনে-মাঝখানে টাক। পিছনের চুলগুলো ঘাড় অব্দি লম্বা। কাঁচা-পাকা, লম্বা-চওড়া জুলপি। ছবির মানুষটির চোখের দিকে ঢুলুঢুলু চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ফরহাদ হোসেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ছুরির মতো করে হাতের কলম দিয়ে আঘাত করলেন ছবির মানুষটির মুখে!
ঢাকা।
জুন, ২০১৩
©somewhere in net ltd.