নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:৩৫

মশাই, বললে বলবেন, আমি মানুষ ভাল না। ভাববেন, আমি একটা অমানুষ। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, একটা মানুষ কখন তার স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করতে পারে, তাও আবার সেই মানুষটার বয়স যদি হয় সত্তর, যখন স্ত্রীকে কাছে পাওয়া খুবই দরকার! হ্যাঁ, আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছি। কিন্তু ঐ একবারই!
তার আগে সারাটা জীবন নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছিঁড়েছি। ভাইরে, পুলিশের মেয়ে বিয়ে করেছিলাম। তা বলে আমি বলছি না, সব পুলিশ-ই খারাপ বা বদরাগী। কিন্তু আমার শ্বশুর ভদ্রলোক ছিলেন অতি উচ্চাঙ্গের বদরাগী। অবশ্য অমন বদরাগী লোকদের ভদ্রলোক বলতে আমার বাধে। কিন্তু কী আর করা! নামের আগে একটা কিছু সংযোজন না করলে আপনারা আবার আমাকে বলবেন, লোকটা ভদ্রতা শেখেনি।

যাইহোক, আমার শ্বশুর ভদ্রলোকের ছাঁচে গড়া ছিল আমার স্ত্রী! একদম বাপকা বেটি। আমি পুলিশের মেয়ে বিয়ে করবো, এমন ইচ্ছে আমার ছিল না। জানেনই তো, আমাদের সময়ে পুলিশের সাথে সহজে কেউ আত্মীয়তা করতে চাইতো না। একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, পুলিশ মানেই ঘুষখোর! দু-নম্বর লোক! এখন অবশ্য গণেশ উল্টে গেছে। জামাই হিসেবে পুলিশ-নিলামের বেশ উপরের দিকে উঠে এসেছে। তা যা বলছিলাম, আমার বাবা ছিলেন অর্থ এবং ক্ষমতালোভী একজন মানুষ। কিছু লোক আছে না-যোগ্যতা থাক বা না থাক সব ব্যাপারেই নিজে মধ্যমণি হয়ে থাকতে ভালবাসে, নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সুখ পায়, সকলের ওপর কর্তৃত্ব ফলায়। বন্ধু নয়, স্বামী নয়, বাবা নয়, ভাই নয়, সন্তান নয়, পড়শি নয়, সমাজের কর্তা হয়ে থাকাই তার লক্ষ্য এবং তাতেই তার সুখ। আমার বাবাও তেমনি! পাড়া-পড়শিদের ক্ষমতার গরম দেখাবার জন্য পুলিশের মেয়ের সঙ্গে তিনি আমার বিয়ে ঠিক করলেন। যতো শিক্ষিত-ই হোক আমাদের সময়ে বাপের মুখের ওপর কথা বলতে পারতো কয়টা ছেলে? আমিও পারিনি। তাই আমাকে পুলিশের মেয়ের গলাতেই মালা পড়াতে হলো। কিন্তু তখনো তো বুঝিনি আমার কপালে কী অপেক্ষা করছে। বুঝলাম বাসর রাতে! বন্ধু-বান্ধবদের বিদায় দিয়ে সবে মা গোঁসাই ধরনের কাঁঠাল কাঠের ভারী দরজার খিলটা আটকেছি। অমনি আমার নতুন বউ গম্ভীর গলায় বললো, ‘এতো দেরি হলো কেন?’
আমি বললাম, ‘বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এলাম। তাই একটু দেরি হলো।’
‘এতো বন্ধু-বান্ধব কেন তোমার?’
‘বা! বন্ধু-বান্ধব থাকবে না!’
‘এতো বন্ধু-বান্ধবের দরকার নেই। বন্ধু-বান্ধবরা শুধু স্বার্থের জন্য পিছন পিছন ঘুরঘুর করে। স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে।’
‘ছি, ছি! এসব তুমি কী বলছো! ওরা আমার পিছে স্বার্থের জন্য ঘুরবে কেন! আমরা সবাই খুব ভাল বন্ধু। কেন তোমার কোনো বন্ধু নেই?’
‘না। মেয়েদের আবার বন্ধু কিসের! দু-একজন বান্ধবী থাকতে পারে। কিন্তু সে ঐ বিয়ের আগ পর্যন্ত। বিয়ের পর মেয়েদের কাজ স্বামী-সংসার আর বাচ্চা-কাচ্চার দেখভাল করা। যাক, অতো কথার কাজ নেই। আলোটা বন্ধ কর। তোমাদের বাড়িতে যা মানুষের হল্লা, একটু শান্তিতে নিশ্বাস ফেলবার জো নেই। আমার খুব মাথা ধরেছে। মাথাটা একটু টিপে দাও।’

মশাই, মাথা টিপতে আমার আপত্তি নেই। মনের মতো মানুষ পেলে সারাজীবন শুধু তার মাথা টিপতে টিপতে আমি পরকালে যেতে পারি। কিন্তু কথাগুলো বলার সময় আমার বউয়ের কণ্ঠে ভোররাতের উনুনের ছাইয়ের তলার আগুনের উত্তাপ ছিল। যা আমাকে করলো অপমানিত-লজ্জিত। হ্যাঁ, শঙ্কিতও করলো।

সে রাতে বিয়ে বাড়ির কোলাহল থেমে গিয়ে নীরবতার নিবিড় পর্দা নামলো। প্রহরে প্রহরে পাখি ডাকলো-ডানা ঝাঁপটালো। পাজি ইঁদুর একটা কচি ডাবের বোঁটা কেটে দিলে মাটিতে আছড়ে পড়লো ডাবটি, বাড়ির কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে করতে সেদিকে ছুটে গেল। কুকুরের সাড়া পেয়ে দুটো চিকা চিঁ চিঁ করতে করতে খড়ের গাদায় লুকোলো। আমার জানালা থেকে জোছনার শেষ ফালিটুকুও চুপি চুপি সরে গেল। শুকতারা ডুবে গেল। কেতুর মায়ের ভোরগোস্টের সুর ভেসে এলো কানে, আবার মিলিয়েও গেল। আমার বউ পাশ ফিরে শুলো। মশাই, বাসররাতে আমি কেবল তার মাথাই টিপেছিলাম!

বুঝতেই পারছেন আমার বাকি জীবনটা কেমন কেটেছে! বউ-শ্বশুর মিলে আমার জীবনটা আর আমার থাকতে দেয়নি। মনে হতো আমার খোলসের মধ্যে কোনো আগন্তুক ঢুকে পড়েছে। যেন অচেনা জীবনের বোঝা বইতেই জন্মেছি আমি। এজন্য আজকালকার ছেলে-ছোকরাদেরকে বলি, বাপু প্রেম করেই হোক কিংবা সম্বন্ধ দেখেই হোক, মন বুঝে বিয়ে কোরো। বউতো আর শো-পিস নয়, যে যখন ইচ্ছে বদলে ফেলবে! অবশ্য আজকাল জামাই-বউ দুজনেই শো-পিস হয়ে যাচ্ছে। যার যখন খুশি, যতোবার খুশি বদলে ফেলছে। তারপরও আমি বলি, শুধু বহিরঙ্গ, অর্থ, ক্ষমতা দেখে বিয়ে কোরো না। ঘরের মানুষ মনের মানুষ না হলে, জীবনটা বাজে খরচের খাতায় জমা হয়ে যায়।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। স্ত্রীর মৃত্যু আমি কামনা করেছিলাম। কী করবো বলুন! ধৈর্য্যে আর কুলোলো না। মশাই, সারাজীবন আমি ব্যয় করেছি স্ত্রী আর তিন ছেলে-মেয়ের জন্যে। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেবার পর, কোথায় একটু শান্তিতে ঘুরে-ফিরে, হেসে-খেলে জীবন পার করবো। তা না সারাক্ষণ বাসায় থাকার কারণে অশান্তি যেন আরও জেঁকে বসলো। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে দুটো আমেরিকায়। আর মেয়েটা কানাডায় সেট্ল হয়েছে। তারা আর দেশে স্থায়ী হবে না। দেশের প্রতি তারা মহাবিরক্ত! তাই মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠিয়েই বাপ-মায়ের প্রতি তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতো। তাদের মায়ের সাথে তাদের সম্পর্র্ক খুব একটা মধুর ছিল না। থাকবে কী করে! তারাও যে তাদের মায়ের ছাঁচেই গড়া!

তারা তো দূরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু আমি? আমি তখন না পারি ফেলতে, না পারি গিলতে। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তেরোটি বছর গিন্নীর ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে আমার জীবন কয়লা হয়ে গেছে। শরীরে নানান রোগের বাসা বাঁধিয়েছিলেন তিনি। তা একটা ধারালো চকচকে তরবারিও যদি আপনি দিনের পর দিন কাজ না করে ফেলে রাখেন, সেটাতেও তো জং ধরবে নাকি! সারাটা জীবন তো নড়ে চড়ে দেখলো না। কাজের লোক আর আমি অধম ছিলাম তার হুকুম পালন করার জন্য। শরীরে রোগ বাসা বাঁধবে না তো কী পেশিতে বিদ্যুৎ খেলা করবে!

কাজের লোকদের সাথে সারাক্ষণ খিট-মিট করতো। আরে বাবা, ওরা গরিব মানুষ। পেটের জন্য পরের বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু ওরাও তো মানুষ। ওদেরও তো সহ্য শক্তির একটা সীমা আছে নাকি? ক’দিনেই ওরা হাঁপিয়ে ওঠতো। তারপর পালাতো। তিন মাসের বেশি কোনো কাজের লোক থাকার জো ছিল না। ঠ্যালা সামলাও। রাত-দুপুরে তার গরম জল দাও, কোমরে ছ্যাঁক দাও, মেরুদদণ্ডে মলম মালিশ কর। তাও যদি একটু ভাল মুখ দিতো! কী জীবন আমার! মশাই, সত্তর বছর বয়স আমার। আমারও তো একটু আরাম-আয়েশের দরকার আছে নাকি?

সেদিন সকালবেলায় আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। যাবে না কেন? আমিও তো মানুষ। কাজের মেয়েটা ভেগেছে। আমি সারারাত ত্যানা গরম করে ছ্যাঁক দিয়েছি তার কোমরে। ভোরের দিকে কেবল একটু চোখ বুজেছি। অমনি অনুভব করলাম পিঠে ধাক্কা। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। বললাম, ‘কী হলো?’

যেন হাত ফসকে পড়া কাঁসার থালা ঝনঝনিয়ে উঠলো, ‘সারারাত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ। আর পিঠের কাছে যে একটা মানুষ না ঘুমিয়ে সারারাত ব্যথায় কাতরাচ্ছে, সেই হুশ যদি থাকতো! যাও চা বানিয়ে আনো।’

সাতসকালে উঠে তার আবার আদা-লবঙ্গের চা চাই। চিনি এক চামচের সামান্য কম। কিঞ্চিৎ এদিক-ওদিক হলেই মুশকিল। এই মিষ্টি চিনি-ই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দু-দুটো কাজের মেয়ে ভাগিয়েছে! তো ঘুম জড়ানো চোখে গেলাম চা বানাতে। মনে হলো আমার পৃথিবীটা দুলছে, মাথা ঘুরে পড়ে যাব। ঐ অবস্থায় গরম চা কাপে ঢালতে গিয়ে পাত্রটা আমার হাত ফসকে পড়ে গেল। অমনি ও ঘর থেকে তার চিৎকার, ‘ভাঙলো কী? একটা কাজ যদি তোমাকে দিয়ে হয়! একটা কাজ করতে বললেই অকাজ করবে। পা পুড়েছে তো না কী! আমার আর শান্তি নেই!’

মশাই বলুন তো, এর পর কে আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে! নির্ঘুম রাত কাটায় এমনিতেই মাথাটা কাজ করছিল না। আমি আর পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে। সামনে গিয়ে বললাম, ‘তুমি মরতে পারো না! তবে তো তুমিও শান্তি পাও, আমিও শান্তি পাই!’

সে পাথুরে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটি কথাও বললো না। হয়তো এমনটা সে ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি।
কিছুক্ষণ পরই আমার ভেতরে অপরাধ বোধ হলো। সারাটা জীবন যখন চুপ করে সব সয়ে এসেছি, এই শেষ বেলাতে মুখ না খুললেই পারতাম। আমি তার কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম। সে কোনো কথা বললো না। আমার দিকে তাকালোও না। ভাবলাম পরে ঠিক হয়ে যাবে। পরদিনও সে আমার সাথে কথা বললো না। তার পরদিনও না। আর কোনদিন-ই না। নয় দিন পর সে সত্যি সত্যি পৃথিবী ছেড়ে শান্তির দেশে চলে গেল!

আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। অপরাধবোধ কেবলই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, আমার জন্যেই বোধ হয় ও মরে গেল, আমি কেন সেদিন অমন কথা বলতে গেলাম?

দুই ছেলে দেশে এলো। মেয়ে আসতে পারলো না। শ্রাদ্ধ-শান্তি শেষ হলে তারা তাদের যাবার দিন নির্ধারণ করে ফেললো। একদিন রাতে সবাইকে ডেকে আমি বললাম, ‘আমি এখন কী করবো?’
ছোটছেলে বললো, ‘তোমার দেখাশোনার জন্য দুটো কাজের লোক রেখে নাও। টাকা-পয়সার জন্য চিন্তা কোরো না। ওসব আমরা দেখবো।’

আমি বড় ছেলের মুখের দিকে তাকালাম। সে হয়তো আমার মনের ইচ্ছে পড়তে পেরেই উপদেশ দিলো, ‘আমাদের ওখানে গিয়ে তো তুমি থাকতে পারবে না। ওখানকার জীবন-যাত্রা অনেক কঠিন। আবেগের কোনো দাম নেই, আবেগ প্রকাশের সময়ও নেই। ওখানে গেলে আমরা তোমাকে সময় দিতে পারবো না। তোমারও ভাল লাগবে না। তার চেয়ে বরং তুমি এখানেই থাকো। পরিচিত পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন আছে এখানে। ওখানে গেলে তুমি হাঁফিয়ে উঠবে।’

খানিকটা দম নিয়ে সে আবার বললো, ‘কী করবে বল। প্রতিটা মানুষই একসময় নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। তখন নিয়তিকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমরা কেউ-ই নিয়তির ঊর্ধ্বে নই।’

আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না, আমার সন্তান আমেরিকায় থেকেও এমন মহামানবের মতো বাণী শিখেছে সেই আনন্দে!
সত্যি বলতে কী, আমার মনে মনে আশা ছিল, ওরা আমাকে যাওয়ার কথা বলবে। শেষ জীবনটা নাতি-নাতনিদের সাথে হেসে-খেলে কাটাবো। এর আগেও তো আমি গিন্নীকে নিয়ে একবার তিনমাস কাটিয়ে এসেছি আমেরিকায়। আমার মন্দ লাগেনি। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনিদেরকে কাছে পেয়ে আমি মন্দ লাগার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। কিন্তু ওদের কথা শুনে আমি চুপসে গেলাম। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইলো। অজানা আশঙ্কায় ভারী হয়ে উঠলো বুকটা। আশঙ্কা এজন্যই যে, বাকি জীবনটা আপনজন ছেড়ে নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে আমাকে! কোনোদিন তো আপনজন ছাড়া থাকিনি। পুলিশের বেটি যতো চড়া-ই হোক, দুটো কথা তো বলা যেতো। আমি মনে মনে বললাম, ‘আমি চাই তোরা সুখে থাক। কিন্তু কেউ-ই যখন নিয়তির ঊর্ধ্বে নয়, তোরাও নিশ্চয় নিয়তির ঊর্ধ্বে নয়। তোদেরও তো ছেলে-মেয়ে আছে।’

কী আর করা, সন্তানদের দেওয়া ঐ নিয়তিকেই মেনে নিলাম আমি। একা একা থাকি ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে। কাজের মেয়েটা আজ আসে তো কাল আসে না। রান্না-বান্না প্রায়ই নিজেকে করতে হয়। আমি তো আর গিন্নীর উপর নির্ভরশীল ছিলাম না। আমার কাজ-কর্ম যতোটুকু আমি নিজেই করতাম আর কাজের মেয়ে কিছুটা করতো। তো সেই দিক থেকে আমার কোনো অভাববোধ নেই। তবে একটা ব্যাপার কী জানেন, দীর্ঘদিন কোনো কিছুতে আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেলে, হঠাৎ-ই সেটার অভাব আপনার জীবনে ছন্দপতন ঘটাবেই। আপনার ভেতরে শূন্যতা তৈরি করবেই। আমার ভেতরেও শূন্যতা তৈরি করেছে যেটা, সেটা হলো গিন্নীর বকবকানি আর ধমকানি। হাসবেন না মশাই, সত্যি বলছি, সে তো যতোক্ষণ জেগে থাকতো বকবক করেই চলতো। পান থেকে চুন খসলেই ধমকাতো। এটারই তীব্র অভাব বোধ হলো আমার! যেটা আমাকে সারা জীবন জ্বালিয়েছে। আমার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। সেটার অভাবেই আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করতে শুরু করলো! কাজের মেয়েটা চলে যাবার পর শ্মশানের নীরবতা নামতো ফ্ল্যাটে। প্রাণ বলতে বারান্দার কয়েকটা টবের গাছ, গোটা চারেক টিকটিকি, কিছু পিঁপড়া আর আমি। নীরবতায় আমি হাঁফিয়ে উঠতে লাাগলাম। আর হাঁফিয়ে উঠলেই টিকটিকিগুলোর সাথে কথা বলা শুরু করতাম। তিনটা আমার কথা শুনতো না ঠিকমতো। ওরা পোকা ধরার জন্য ব্যস্ত থাকতো। তবে লেজ কাটা যে টিকটিকিটার, সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতো। ড্যাবড্যাব করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বোধ হয় ওর লেজকাটা বলে অন্যরা ওকে এড়িয়ে চলতো। তাই বুঝি চিনেছিল-রতনে রতন! টবের গাছগুলোর সাথেও কথা বলতাম। সে-সব কথা এক তরফা। কী বলবো, এক সন্ধ্যায় ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো পুলিশের বেটির জন্য! হায়রে! তবু তো একটা মানুষ আমাকে বকাবকি করার জন্য পৃথিবীতে ছিল। এখন তো আমাকে বকবার মানুষটিও নেই, এমনই একা আমি! অথচ পৃথিবীতে কতো মানুষ! মশাই, সত্তর বছর বয়সে সেই সন্ধ্যায় পুলিশের বেটির জন্য প্রথম আমার চোখের জল ঝরলো!

এরপর থেকে আর সন্ধ্যাবেলায় বাসায় থাকতাম না। ধানমন্ডি লেকে, ফুটপাতে হেঁটে, চায়ের দোকানে বসে সময় কাটিয়ে রাত দশটায় বাসায় ফিরতাম। তো তেমনি এক সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকে এক তরুণের সাথে আমার পরিচয় হলো। তরুণের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ছেলেটির সাথে কথা বলে ভাল লাগলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে পারলাম ছেলেটির মা-বাবা নেই। আপন বলতে তেমন কেউ নেই। একটা এন, জি, ও’তে চাকরি করছে। পৈত্রিক কিছু জমিজমা পেয়েছিল। সেগুলো বিক্রি করে একটা বৃদ্ধাশ্রম করেছে। নিজে বিয়ে-থা করেনি। করবার আগ্রহও নেই। বুড়ো-বুড়িদের সেবা করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়। ছেলেটির কথা শুনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই যুগেও এমন ছেলে হয়! এই ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার নিজের ছেলেদের মুখ মনে করার চেষ্টা করলাম। মুখগুলো বড় বিকৃত লাগলো। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো!

ছেলেটির নাম বাঁধন। আমি বাঁধনের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে এলাম। দিন কয়েক নিজের সাথে নিজে আলাপ-আলোচনা করলাম। টিকটিকি আর টবের গাছগুলোর সঙ্গেও! তারপর একদিন ফোন করলাম বাঁধনকে। আমার ফোন পেয়ে ও খুব খুশি হলো। আলাপের এক পর্যায়ে বললাম, ‘বাবা, আমি তোমার অতিথি হতে চাই। তোমার বৃদ্ধাশ্রমে এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের জন্য কি একটু জায়গা হবে?’
ছেলেটির কী বিনয়! বললো, ‘আমাকে লজ্জা দেবেন না আংকেল। আপনি কবে যেতে চান বলুন। আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।’
বাঁধনকে আমার ঠিকানা দিলাম। দু’দিন পরেই ও আমার বাসায় এলো। আমি আমার একলা সংসার ছেড়ে পা বাড়ালাম বাঁধনের বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশে।

আসবার সময় আমার ভেতরটা হাহাকার করছিল। বুঝতেই পারছেন কেন এই হাহাকার। আশঙ্কা ছিল, বৃদ্ধাশ্রমে আমি মানিয়ে নিতে পারবো তো? কিন্তু বাঁধন যখন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, সবার ব্যবহার দেখে আমার আশঙ্কা কিছুটা দূর হলো।

‘গোধূলিবাড়ি’। বৃদ্ধাশ্রমের নাম। নামটি বেশ মনে ধরলো। আমি উঠলাম একলা একটা ঘরে। এখানকার ঘরগুলো বেশ বড়। প্রত্যেক ঘরে দুজন করে থাকেন। দুটো আলাদা বিছানা। আগে থেকেই এখানে চৌদ্দ জন ভদ্রলোক আছেন সাতটি ঘরে। তাই আমাকে খালি পড়ে থাকা একটি ঘরে উঠতে হলো। চৌদ্দজন ভদ্রলোক ছাড়াও এখানে আটজন ভদ্রমহিলা আছেন। তারাও এক ঘরে দু’জন করে থাকেন। সবাইকে দেখাশোনা করার জন্য আছে চারজন কর্মী। ব্যবস্থা খুবই ভাল। আমার পছন্দ হলো।

দেখা গেল বয়সের দিক থেকে এখানে আমার উপরে আছেন দু’জন। একজন ভদ্রমহিলা। সবাই তাকে বেনুদি বলে ডাকেন। বেনুদির বয়স পঁচাত্তর। কিন্তু এখনও তার গানের গলা দারুণ। রোজ সকালে হারমনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজ করেন। এখানকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন বেনুদি। প্রতি সোমবার আর শুক্রবার সন্ধ্যায় গানের আসর বসে। ‘গোধূলিবাড়ি’ নামটি বেনুদির দেওয়া।

আরেকজন আমার চেয়ে বড়। তিনি হারুন ভাই। হারুন ভাইকে সবাই ক্যাপ্টেন বলে ডাকেন। আমি ভেবেছিলাম সত্যি সত্যিই বুঝি তিনি জাহাজ কিংবা বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন। চেহারা-স্বাস্থ্য তেমনই পোক্ত। পরে জানলাম তিনি ট্রেন চালাতেন। আবার এখানে ফুটবল খেলায় নেতৃত্বও দেন তিনি। তাই সবাই তাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকেন। হারুন ভাই দুঃখ করে বলেন, ‘সারাটা জীবন এই দুই হাতে ট্রেন চালিয়েছি। কোটি কোটি মানুষকে পৌঁছে দিয়েছি তাদের গন্তব্যে। কিন্তু কবে যে নিজের জীবনের ট্রেনটা বে-লাইনে চলে গেছে খেয়াল করি নাই। যখন খেয়াল করলাম, তখন জায়গা হলো এই গোধূলিবাড়ি’তে।’

আসলে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম, এখানে আমরা যারা আছি তারা প্রত্যেকেই একটা সময় পরিবারের কর্তা বা কত্রী ছিলাম; কেউ উচ্চ মধ্যবিত্ত, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ নিন্ম মধ্যবিত্ত, আবার কেউবা নিন্মবিত্ত পরিবারের। কিন্তু প্রত্যেকেই এসেছি ভেতরে একটা হাহাকার নিয়ে। হারানোর হাহাকার। তাই আসবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের অহংবোধ ফেলে এসেছি। কে উচ্চ মধ্যবিত্ত, কে নিন্ম মধ্যবিত্ত আর কে কেরানি, কে পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, সে-সব ভুলে এখানে একসূত্রে এসে মিলেছি। আমরা সবাই মানুষ। তাইতো শান্তি নিকেতন থেকে পড়াশোনা করে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বেনুদি একই ঘরে থাকছেন একজন সরকারী হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত আয়ার সঙ্গে। একজন অসুস্থ হলে আরেকজন সেবা করছেন। আসলে আমরা সারা জীবন নাই-নাই, চাই-চাই করে নিজেকে নিঙড়ে রক্ত জল করেছি সংসারের জন্য। তারপর সেই সংসারের কাছ থেকে পোড় খেয়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে এখানে এসেছি সবাই। তাই এখানে কোনো নাই-নাই, চাই-চাই নেই। এখানে বিলিয়ে দিতে পারাতেই যেন সবার আনন্দ, একজন আরেকজনের জন্য কিছু করতে পারাতেই যেন সুখ!
আমি যেদিন গোধূলিবাড়ি’তে উঠলাম তার পরদিন বিকেলবেলা ক্যাপ্টেন আমার ঘরে এসে হাজির। হাতে ফুটবল, পরনে কালো হাফপ্যান্ট, গায়ে সাদা টি শার্ট।
‘আপনি রেডি হয়ে নিন।’

আমি ক্যাপ্টেনের হাতের ফুটবলের দিকে তাকালাম। ক্যাপ্টেন সেটা খেয়াল করেই বললেন, ‘ফুটবল খেলতে হবে। চলুন।’
আমাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখে ক্যাপ্টেন আবার বললেন, ‘কী, ভয় করছে?’
‘না, ভয় ঠিক না। তবে ভাবছি বুড়ো হাড়ে সইবে কিনা!’
‘আরে আপনি তো এখনও যথেষ্ট ফিট আছেন। চলুন। সামনে আমাদের দু-দলের ম্যাচ আছে। এখন জোরসে প্রাকটিস চলছে।’

ক্যাপ্টেনের তাড়ায় আমাকে যেতেই হলো। গোধূলিবাড়ি’র সামনে বাগান মতো খানিকটা জায়গা। নানান রকম ফুলের গাছ-গাছালি বাগানে। তার পরই খেলার মাঠ। মাঠে গিয়ে দেখি অনেকেই এসে গেছেন। দু-দলে ভাগ হয়ে প্রাকটিস শুরু হলো। আমরা গোধূলিবাড়ি’র পনেরজন বাদেও স্থানীয় কয়েকজন ভদ্রলোক আছেন। আমাদেরই কাছাকাছি বয়সী তারা। শুরুতে আমার বেশ হাসি পাচ্ছিল। দু-দলের খেলোয়াড়দের গড় বয়স পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি তো হবেই। আমি একটু লজ্জাও পাচ্ছিলাম। গোধূলিবাড়ি’র বারান্দা আর পুবের পুকুরঘাটে বসে এখানকার ভদ্রমহিলারাও যে বুড়োদের খেলা দেখছেন!

ফুটবলে আমি যে একবারে নতুন তা নয়। ছাত্রাবস্থায় যথেষ্ট ফুটবল খেলেছি। খ্যাতিও ছিল বেশ। কিন্তু সে অনেককাল আগের কথা। কর্মযজ্ঞে ঢুকে স্বেচ্ছা অবসর নিতে হয়েছে ফুটবল থেকে। আবার এতো বছর বাদে বুড়ো বয়েসে অবসর ভেঙে খেলায় ফিরলাম। একটুতেই হাঁফিয়ে উঠছিলাম আমি। তবে ভয়-লজ্জা কাটিয়ে অল্পক্ষণেই আমি যেন ফিরে গেলাম সেই হারানো দিনে!

অবশেষে এলো ম্যাচের দিন। সেদিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। বেলা উঠতে না উঠতেই মাইক বাজতে শুরু করলো। একটু পর পর মাইকে ঘোষণা করা হলো খেলার সময়। বাঁধন আগের দিন বিকেলেই চলে এলো।

দুপুর গড়াতেই দেখি আশ-পাশের ছেলে-ছোকরা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত খেলা দেখতে আসতে শুরু করেছে। আমার ভেতরে তখন চরম উত্তেজনা। দেখলাম, আমার মতো সব খেলোয়াড়দের একই অবস্থা। ক্যাপ্টেন যেন টগবগে তরুণ বনে গেছেন। ক্যাপ্টেন আমাদের দলেরও ক্যাপ্টেন। আরেকদলের ক্যাপ্টেন মাস্টারদা তপন রায়। জয়ের সম্ভাবনা দু-দলেরই সমান।

রেফারির বাঁশি বাজলো। শুরু হলো খেলা। আমাদের বয়সের কারণেই নব্বই মিনিটের বদলে সময় নির্ধারণ হয়েছে পঞ্চাশ মিনিট। বাইরে থেকে ছেলে-ছোকরাদের সে কী উৎসাহ!
‘মারুন কাকা....’
‘দাদু জোরসে...’
‘মামা ডানে পাস দ্যান’
‘গোল...ওহ্ হো হলো না! ওকে দাদু আবার হবে, চালিয়ে যান।’

মাঠের বাইরে থেকে অবিরাম ভেসে আসতে লাগলো এসব উৎসাহব্যঞ্জক কথা। ক’দিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের কয়েকটা জায়গায় জল জমে কাদা হয়েছিল। দু-দলের খেলোয়াড়রাই জল-কাদায় মেখে একেবারে ভূত হয়ে গেলাম।

রেফারির শেষ বাঁশি বাজলো। কিন্তু ফলাফল ড্র। উভয় দলই তিনটা করে গোল দিয়েছি। আমাদের বয়সের কথা ভেবে অতিরিক্ত সময় বাড়ানো হলো না। একবারে টাইব্রেকার। টাইব্রেকার তো নয়, যেন বুড়োদের হার্টের চরম পরীক্ষা! একটা একটা করে শর্ট শেষ হয় আর আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমাদের দলের হয়ে সর্বশেষ শর্ট নিতে এগোলাম আমি। কিন্তু আমার তখন পা কাঁপছে! আমি গোল করতে পারলেই আমরা জিতে যাব। নয় তো আবার ড্র হবে। আবার একটা একটা করে শর্ট নিতে হবে। আমি শর্ট নেবার আগে মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলাম। কলেজ জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। অমনি আমার শরীর-মনে যেন জোর ফিরে এলো। পায়ের কম্পন বন্ধ হলো। যেন সত্তর বছরের বৃদ্ধ নয়, শর্ট নিতে যাচ্ছি আমি আঠার বছরের যুবক। শর্ট নিয়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। ক্যাপ্টেনদা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। সাথে সাথে অন্য বুড়োরাও। গোল!

আমি আনন্দে কেঁদেই ফেলাম। অন্য খেলোয়াড়রাও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তখন। টাইব্রেকার বাদেও খেলায় তিন গোলের মধ্যে আমি দু-গোল দিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার হিসেবে পেলাম একটা ট্রফি। মশাই, সে যে কী অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না! স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম আমি। হাজারো স্মৃতি আমার ভেতরে ভিড় করতে লাগলো। সেই স্কুল-কলেজের দিনগুলো আবার যেন ফিরে পেলাম আমি, যা এতোদিন অনেক স্মৃতির নিচে চাপা পড়ে ছিল! একটি দিনের স্মৃতি বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিলো। যেদিন আমি কলেজের একটা ম্যাচে দু-গোল করে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলাম। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম একটি মেডেল। মেডেলটি এখনও বাসায় আছে।

মশাই, এ তো শুনলেন একটা ফুটবল ম্যাচের কথা। আমাদের গোধূলিবাড়ি’তে বারো মাসই খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। বাঁধনই এসবের আয়োজন করে। কেন করে তা আমরা বুঝতে পারি। যাতে পরিবার হারানো এই মানুষগুলো পরিবারের কথা ভুলে, কষ্ট ভুলে, হাসি-আনন্দে থাকতে পারে তার জন্যই এই আয়োজন।

একটা মজার ব্যাপার কি জানেন, গোধূলিবাড়ি’তে আমরা যারা আছি, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা আছে। এই যেমন ধরুন বেনুদির বিশেষ দক্ষতা সঙ্গীতে। ক্যাপ্টেন হারুন ভাইয়ের দক্ষতা ফুটবলে। বলা যায় তিনি একজন ফুটবল বিশেষজ্ঞ। মাস্টারদা তপন রায় শরীর চর্চায়। তিনি আমাদের ফিজিও। আয়েশা বেগম রান্নায়, রাবেয়া খাতুন কাঁথা সেলাইয়ে। ডলি আপা ফুলের বাগান সামলান। আমার আগ্রহ গাছপালা বিষয়ে। ছোট খাটো একজন উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞও বলতে পারেন। এরকম প্রত্যেকেই কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী।

এরই মধ্যে আমার ঘরে একজন সঙ্গী পেলাম। পরান বাউল। আমার চেয়ে বয়সে চার-পাঁচ বছরের ছোট হবে। একটা চোখ অন্ধ। দোতারা বাজিয়ে হাট-বাজারে গান করে বেড়াতো। বাঁধনের চোখে পড়েছে, ধরে নিয়ে এসেছে। খুব ভাল গান গায়। গলায় ভাব আর সুর মাখামাখি। পরানকে আমার পাশের ঘরে থাকতে দিচ্ছিল। আমি-ই পরানকে আমার ঘরে থাকতে বললাম। প্রথম দিন থেকেই তার সাথে আমার ভাব জমে গেল বেশ। আপনি’র ব্যবধান ঘুচিয়ে দু’জন দু’জনকে তুমি করে সম্বোধন করতে শুরু করলাম। পরানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। কিন্তু কী তার জীবন বোধ! কী গভীর তার দৃষ্টিভঙ্গি! আমি মুগ্ধ হয়ে পরানের কথা শুনতাম। বাউল তত্ত্ব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরানের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করতাম। পৃথিবীর পাঠশালা থেকে পরান যা শিখেছে তার কাছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তুচ্ছ মনে হলো আমার! নিজেকে পরানের কাছে অতি ক্ষুদ্র মানুষ মনে হলো। যদি সত্যিই জন্মান্তর বলে কিছু থেকে থাকে তবে প্রার্থনা করি আবার যদি জন্ম হয়, তাহলে মিথ্যে সংসারের কর্তা না হয়ে যেন বাউল হতে পারি।

পরান আবার সাঙ্ঘাতিক রসিকও। ও আসার পর গোধূলিবাড়ি যেন আলাদা মাত্রা পেলো। গানের আসরে যখন বেনুদি আর পরান গান গাইতো, তখন অদ্ভুত এক সুরের মায়া তৈরি হতো। কোন এক অচেনা জগতে যেন হারিয়ে যেতাম। মনে হতো আরও আগে কেন এই জীবনের স্বাদ পেলাম না!

একদিন বিকেলবেলা পুকুরপাড়ে হাঁটছি। পুকুরপাড়ের সুপারি গাছের তৈরি বেঞ্চে বসে গুনগুন করে গান গাইছেন আর উলের সোয়েটার বুনছেন একজন ভদ্রমহিলা। নতুন এসেছেন। বাঁধন ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের সবার সঙ্গে। কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপ হয়নি আমার সাথে। ভদ্রমহিলা এক মনে গুনগুন করছেন আর সোয়েটার বুনছেন। খেয়াল করেননি উলের সুতার হলুদ বলটি গড়িয়ে পড়েছে বেঞ্চ থেকে। আমি সুতার বলটা মাটি থেকে তুলে একটা শুষ্ক কাশি দিয়ে বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন।

‘এটা পড়ে গিয়েছিল।’ ভদ্রমহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলাম সুতার বলটা।
‘ধন্যবাদ।’ মৃদু হেসে বললেন তিনি।

ভদ্রমহিলা এখনও বেশ সুন্দরী। বয়স ষাটের এপাশ-ওপাশ। ডান কানের কাছে কয়েক গোছা চুলে পাক ধরেছে।
আমি ধন্যবাদের জবাব দিয়ে বললাম, ‘আপনার গানের গলাটা কিন্তু বেশ মিষ্টি।’
ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিকে এক মুহূর্ত তাকালেন। তারপর হেসে বললেন, ‘না না আমি গাইতে পারি না। ঐ একটু গুনগুন করছিলাম আর কী! আপনি বসুন না।’

ভদ্রমহিলা আমাকে জায়গা করে দিতে সরে বসলেন। আমি বসতে বসতে বললাম, ‘আমি গান গাইতে পারি না। তবে আমি সঙ্গীতের একজন ভাল শ্রোতা মনে করি নিজেকে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, চর্চা ছাড়া এমন সুরে গাওয়া সম্ভব নয়।’

ভদ্রমহিলা এবার আমার চোখের দিকে তাকালেন। বুঝিবা আমার ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করলেন। তারপর দূরে পুকুরের ঐ পাড় কিংবা আরো দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘অনেককাল আগে আলপনা নামের একটি মেয়ে গান শিখতো প্রমথ মাস্টারের কাছে। প্রমথ মাস্টার ছিলেন সঙ্গীতের সাধক। লম্বা-চওড়া মানুষ। চোখে কালো চশমা পরতেন। গায়ের রঙ কালো ছিল বলে সব সময় সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরতেন। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে ধুলো-কাদা ভেঙে আলপনাদের তিন ভাই-বোনকে গান শেখাতে আসতেন তিনি। মাস্টার মশাই আলপনাকে বলতেন, “তুই গান ছাড়িস না মা। তোর গলায় মা সরস্বতী আছে। তোর হবে।” তারপর আলপনার বিয়ে হয়েছে। সংসারের সঙ দেখে আলপনার কণ্ঠ থেকে মা সরস্বতী পালিয়েছেন ভয়ে। মাস্টার মশাইয়ের ভবিষ্যৎ বাণী বিফলে গেছে। আলপনার হয়নি।’

সেদিন গল্পে গল্পে গোধূলিবাড়ি’তে গোধূলি নেমেছিল। পাখ-পাখালি ঘরে ফিরেছিল। ভদ্রমহিলার সাথে আলাপের সেই শুরু। তারপর আমাদের আলাপ পাখিটি চড়ে বেড়িয়েছে দু’জনের ফেলে আসা জীবনের বাঁকে বাঁকে।

এই ভদ্রমহিলাই সেই আলপনা। আলপনার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। এখনকার দিনের মতো বণিক কিংবা ভিলেজ পলিটিশিয়ান শিক্ষক নয়। সেই আমলের নিবেদিত প্রাণ সত্যিকারের শিক্ষক। জানেন তো, সেই আমলের অধিকাংশ শিক্ষকদের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। নিজের ঘরে চাল বাড়ন্ত কিন্তু গরীব ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষার ফিসের টাকা নিজের পকেট থেকে দিতে দ্বিধা করতেন না। সন্ধ্যার পর বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজ-খবর নিতেন, কে কী করছে, দেখতেন। কারো অংক বা ইংরেজির সমস্যা সমাধান করে দিয়ে বাড়িতে এসে গিন্নীর বকা খেতেন। মশাই, তেমন শিক্ষক এখন কোথায় পাবেন? তা বলে আমি বলছি না যে এখনকার সব শিক্ষক-ই বণিক কিংবা ভিলেজ পলিটিশিয়ান। তবে তেমন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের খোঁজ পেলে আমায় জানাবেন। আমি তাঁকে ভোর বেলার তাজা ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করবো।

যাক যা বলছিলাম, আলপনার বাবাও তেমনই একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই বাড়ির পরিবেশও ছিল একটা বিশেষ রুচিতে বাঁধা। বাড়িতে গান-বাজনার রেওয়াজ ছিল, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতা ছিল। আলপনার বেড়ে ওঠাও তেমনি শিক্ষা আর স্বাধীনতার স্বাদ নিতে নিতে। বি, এ পাস করে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছিল আলপনা। কিন্তু বিয়ের পর সে পড়েছিল উল্টো স্রোতের নদীতে। শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। বিয়ের আগে অবশ্য পাত্রপক্ষ যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর আলপনার স্বামী একটু একটু করে তার ডানা ছাটতে থাকে। আলপনার গান গাওয়া বন্ধ হয়। স্কুলের চাকরিটাও ছাড়তে হয়। ডানাবিহীন আলপনা বন্দী হয় রক্ষণশীল পরিবারের নিবিড়-কঠিন খাঁচায়। সে কখনও তার স্বামীর মনের নাগাল পায়নি। আর তার মন বোঝার মতো বোধ এবং পারিবারিক শিক্ষা আলপনার স্বামীর ছিল না। তাই স্বামী তার কাছে ছিল দূর আকাশের মেঘের মতো। কেবল নিজের প্রয়োজনে, নিজের ইচ্ছে মতো বৃষ্টি হয়ে ঝরতো আলপনার উঠোনে। তাতে হয়তো প্রকৃতির নিয়মে উঠোনের উত্তাপ কমতো। কিন্তু উঠোনের পেলবতা বুঝতে পারতো না সেই হতভাগা! স্বস্তি পেতো না আলপনাও।

এই উল্টো স্রোতে পনেরটি বছর জীবনের নৌকা বাইতে হয়েছে আলপনাকে। অবশ্য বলা ভাল সে নৌকা বায়নি। তীব্র স্রোতের বিপরীতে টিকতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। একাই স্রোতে ভেসেছে জীবনতরী। এরপর স্বামীর মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাকে। অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে আবার তাকে জীবনতরীর হাল ধরতে হয় তিন ছেলে আর এক মেয়ের জন্য।

আবার একটি স্কুলে চাকরি নেয় আলপনা। রক্ত জল করে ছেলে-মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। একসময় ছেলে-মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। তারপর চাকরি থেকে অবসর নেবার পর একটা সময় আলপনা বুঝতে পেরেছে ছেলেদের সংসারে সে অবাঞ্চিত অতিথি। বুদ্ধিমতি এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন আলপনা ছেলেদের সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এসেছে এই ‘গোধূলিবাড়ি’তে।

গোধূলিবাড়ি’র সকল বাসিন্দাদের জীবনের গল্পের প্লট প্রায় একই। গল্পের মাঝখানে আলাদা কিছু চড়াই-উৎড়াই আছে। কিন্তু শেষটা যেন একই শব্দগুচ্ছে গাঁথা একটি বাক্য।

মশাই, ভাবছেন আলপনা আমাকে এতো কথা কেন বলেছে? ঐ যে বললাম, আলাপ পাখিটি চড়ে বেড়িয়েছে আমাদের বিগত জীবনের বাঁকে বাঁকে। তারপর বিরান বালুচর, ধু-ধু মাঠ, বিজন বন-জঙ্গল চড়তে চড়তে কখন যেন আমাদের মনের একান্ত গলি-ঘুপচিতে ঢুকে পড়েছে। আমরা টেরও পাইনি। টের পেলাম যখন, তখন বিকেল হলেই সুপারি গাছের বেঞ্চটি আমাকে প্রবলভাবে টানতো। আলপনাকেও টানতো ঠিক একইভাবে।

আমরা উভয়েই অনুভব করলাম, একে অপরের প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে, বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ, ভালবাসাও জন্মেছে! তীব্র ভাবেই জন্মেছে!

সেদিন কার্তিক মাসের এক বিকেল। বিকেল থেকেই হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করে। দূরের গ্রামগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। সন্ধ্যার পর শীতও পড়ে বেশ। দু’জনে বসে আছি বেঞ্চে। দু’জনের পিঠে পড়েছে কার্তিকের শেষ বিকেলের মায়ারোদ। আলপনা যখন ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল, তখন ওর ডান গালে খেলা করছিল রোদ। কানের কাছের এক গোছা সাদা চুল তখন চকচক করে উঠছিল। আলপনার সোয়েটার বোনা শেষ হলে কাঁচি দিয়ে সুতা কেটে সোয়েটারটা নিজের মুখের সামনে মেলে ধরলো। হলুদের ওপর রোদ পড়ে দারুণ দেখাচ্ছিল সোয়েটারটা!

‘কেমন হয়েছে?’ আমার দিকে তাকালো আলপনা।
আমি তো বলার জন্য তৈরিই ছিলাম। বললাম, ‘দারুণ!’
‘পরুন।’ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সোয়েটারটা।
‘আমি!’
‘আর তো কেউ নেই এখানে। আপনার গায়ে লাগলে আমার মেজো ছেলের গায়েও লাগবে। দেখি মাপটা ঠিক হলো কিনা।’
‘মায়ের চোখ বলে কথা। আপনার ছেলের গায়ে ঠিক লেগে যাবে। গায়ে দিতে হবে না।’
‘তবুও একটু দিন না গায়ে। ছোট-বড় হলে আমি এখনই ঠিক করে দেব। একবার পাঠিয়ে দিলে তো আর ঠিক করতে পারবো না।’
অগত্যা আমাকে পরতেই হলো। আমার গায়ে একদম ফিট। দেখি আলপনা আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে।
‘বললাম না, মায়ের চোখ বলে কথা! একদম ফিট।’
আমি সোয়েটারটা কেবল খুলতে যাব। অমনি আলপনা যেন আঁৎকে উঠে বললো, ‘খুলবেন না!’

আমি খানিকটা চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম ও অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল।

পর মুহূর্তেই আলপনা যেন খানিকটা লজ্জা পেল। বললো, ‘স্যরি।..... আসলে সোয়েটারটা আপনার গায়ে দারুণ মানিয়েছে। এখন তো শীত পড়তে শুরু করেছে। এটা আপনিই পরবেন। ছেলেকে আমি আরেকটা সোয়েটার বানিয়ে দেব।

আমি থ হয়ে আলপনার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ ফেরাতে পারলাম না। বুঝলাম, ছেলের কথাটা অজুহাত। আলপনা আসলে আমার জন্যই বানিয়েছে সোয়েটারটা। এর আগে কৌশলে আমার গায়ের মাপও নিয়েছে দু-তিন দিন। বলেছে, ‘আমার মেজো ছেলের স্বাস্থ্য আপনার মতোই। আপনার মাপে বানালেই ওর হবে।’

আমি কতোক্ষণ আলপনার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম জানিনা। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। বাঁ-চোখ থেকে এক ফোঁটা জল নেমেও গেল গাল বেয়ে। কেন চোখ ভিজবে না, কেন জল ঝরবে না, বলুন? যে মানুষ সারাজীবন চৈত্রের দ্বিপ্রহরের খরতাপে পুড়েছে। আর এই বার্ধক্যে এসে সেই মানুষই কিনা কার্তিকের কুয়াশা মাখা বিকেলের মোলায়েম মায়ারোদে আপ্লুত হচ্ছে! কান্না না এসে কী পারে! জীবনে তো কোনোদিন এমন উপহার পাইনি।

দেখলাম, আমার চোখে জল দেখে আলপনার চোখও ভিজে গেছে। কিন্তু ও দ্রুত চোখের জল লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললো, ‘কী ছেলে মানুষি করছেন বলুন তো! প্লিজ, আমাকে অপরাধী করবেন না।’

আমি চোখের জল মুছে আলপনার ডান হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিলাম। আলপনা আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মুখে কিছু বললো না। আমি বললাম, ‘আমাদের জীবনে কী আবার হলুদ রাঙা বসন্তদিন আসতে পারে না?’

আলপনা মুখ তুলে এক দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমিও চোখ সরাতে পারলাম না। শেষ বিকেলের মায়ারোদটুকু তখন আর নেই। পুব আকাশের কপালে সাদা টিপ, কিন্তু পশ্চিম আকাশের গায়ে কাঁচা হলুদ!

ভীষণ লজ্জা লাগছিল। তবু কথাটা বাঁধনকে বললাম। বাঁধন আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘এতো লজ্জা পাবার কী আছে! আমার দুটো ছেলে-মেয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছে, আমার কাছে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে!’

আমি বাঁধনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললাম। বাঁধনের বুকে মাথা রেখে বহুদিন পর আমি যেন আমার বাবা নয়, মায়ের বুকের উষ্ণতা অনুভব করলাম। ও আমার মাথাটা তুলে ধরে বললো, ‘বোকা ছেলে, এই আনন্দের দিনে কাঁদতে হয়! চলো বাইরে গিয়ে সবাইকে খবরটা জানাই। আয়োজন করতে হবে তো!’

ও আমাকে প্রায় জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো। সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। আমি চলে যেতে চাইলে বাঁধন আমার হাত টেনে ধরলো। আমার হাত-পা কাঁপছিল। ও কথাটা বলতেই সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। হই-হুল্লোর শুরু হলো। কেউ কেউ মজা করে রসিকতা করতে থাকলো। আমি দেখলাম বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে লাজুক কিশোরী কনের মতো দাঁতে আঁচল কাটছে আলপনা।

বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। আয়োজন দেখে মনে হলো পঁচিশ বছরের যুবকের সাথে বিশ বছরের যুবতীর বিয়ে। বাঁধনকে বললাম, ‘এমন ঘটা করে আয়োজনের দরকারটা কী বাবা! আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।’

ও বললো, ‘এই প্রথম আমার দুই সন্তানের বিয়ে। আয়োজন না করলে লোকে যে আমার নিন্দা করবে!’
এরপর আমার আর কী বলার থাকে! জোর আয়োজন চলতে থাকলো। আমাদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হলো। বিয়ের কার্ড পর্যন্ত ছাপানো হলো। বিয়ের আর বাকি দুই সপ্তাহ!

সেদিনও প্রতিদিনের মতো একই সময়ে ঘুম ভাঙলো আমার। প্রাতঃভ্রমণ শেষে ঘরে এসে দেখি পরান তখনও ঘুমিয়ে। ও কখনও এতো বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে না। খুব ভোরে উঠে পুকুরপাড়ে গিয়ে গান গায়। শরীর খারাপ করলো কিনা তা দেখার জন্য পরানের কপালে হাত দিয়েই আমি চমকে গেলাম। বরফের মতো ঠান্ডা! শরীর শক্ত! শীতের সকাল, তবু আমি ঘামতে লাগলাম। পালস্ দেখলাম, পরানে পরান নেই! কখন চলে গেল ও! সারারাত পাশাপাশি দুটো বিছানায় দু’জন মানুষ ঘুমালাম। একজন মানুষ চিরতরে চলে গেল, অথচ আমি টেরই পেলাম না!

আমার কোনো ভাই ছিল না। তাই ভাতৃবিয়োগের শোক কী আমি জানি না। কিন্তু পরানকে হারিয়ে আমি সত্যি সত্যি ভাই হারানোর শোক পেলাম।

পরানের শেষকৃত্য হয়ে গেল। ‘গোধূলিবাড়ি’র সবাই শোকগ্রস্ত। স্তম্ভিত। এই প্রথম এখানে কারো চিরবিদায় ঘটলো। আমরা সবাই বুড়ো-বুড়ি। এভাবেই একজন একজন করে চলে যাব। তাই যাওয়ার শুরুটা চিরবৈরাগ্য পরান-ই করে দিয়ে গেল!

পরানের বিছানাটা শূন্য পড়ে থাকে। দেয়ালে ঝুলে থাকে নিঃসঙ্গ দোতারাটা। মাঝে মাঝে দোতারাটা হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করি। আমার ভেতরটা ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। কানে কেবলই বাজে পরানের কণ্ঠের সুর।

ক্রমশ গোধুলিবাড়িতে শোক কিছুটা থিতিয়ে এলো। আবার শুরু হলো বিয়ের তোড়-জোড়। যেহেতু কিছু কার্ড বিতরণ হয়ে গেছে তাই বিয়ে পিছাতে চাইলো না বাঁধন। কার্ড পাঠানো হয়েছে বাঁধনের বন্ধু-বান্ধবদের। আশ-পাশের গ্রামের দু-চারজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে। মানুষ যখন কোনো কিছু পায়, তখন সেই পাওয়ার আনন্দে প্রায়শ-ই যুক্ত হয় কিছু হারানোর বেদনা। আনন্দের ভেতরে মিশে থাকে যাতনা। তাকে বয়ে যেতে হয় আজীবন। আমার তেমনি হলো পরানকে হারিয়ে।

আমার ছেলে-মেয়েদেরকে আমি ফোনে জানিয়েছি। তাদের ভাষ্য নাইবা বললাম। কার্ড পাঠানো হলো আলপনার সন্তানদেরকেও।
গায়ে হলুদের আগের দিন, আমি আর আলপনা বসে আছি পুকুরপাড়ের বেঞ্চে। অগ্রহায়ণের শেষ ভাগ, তাই বেশ শীত পড়তে শুরু করেছে। বিকেল থেকেই কুয়াশা পড়লেও আকাশ পরিষ্কার। সূর্যটা হেলে পড়েছে রোজকার মতো পিঠের কাছে। রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি এলো। দেখতে দেখতে গাড়িটা ঢুকে পড়লো ‘গোধূলিবাড়ি’তে। আমরা কথা বলছিলাম। গাড়িটা দেখে আলপনা কেমন যেন হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকলো গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে দু’জন তরুণ এবং একজন তরুণী নামলো।

তারা গাড়ি থেকে নেমে উত্তরের ঘরখানার দিকে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্যাপ্টেন। হয়তো তারা ক্যাপ্টেনকে কিছু জিজ্ঞসা করলো। ক্যাপ্টেন হাত উঁচিয়ে আমাদেরকে দেখালো। ওদের দিক থেকে ঘাড় ফিরিয়ে আনলো আলপনা। তারা তিনজন এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। আলপনা কিছুটা বিব্রত। আমি এদের কাউকেই আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু অনুমান করতে পারলাম এরা কারা।

আলপনা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমার মেজো ছেলে আর ছোট ছেলে। আর, এ আমার মেয়ে।’
সত্যি বলতে কি আমিও বেশ বিব্রত। তবু বললাম, ‘ভাল আছো তোমরা?’

আমার প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করলো না ওরা। শুধু একটিবার আমার দিকে তাকালো। বোধহয় ওরাও আমাকে দেখেই কিছু অনুমান করেছে। এই ক’মাসে ওরা একবারও ওদের মাকে দেখতে আসেনি। ওরা যে বিয়ের খবর জেনেই এসেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার।

মেজো ছেলে আলপনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এসব কী শুরু করেছো তুমি?’
আলপনা নীরবে ছেলের মুখের দিকে তাকালো। এবার মেয়েটি বললো, ‘চুপ করে আছো কেন? এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলো কেন তোমার? এজন্যই কী তুমি সংসার ছেড়ে এসেছো?’
মেয়েটির গলা সৌজন্যতার মাত্রা ছাড়ানো। আলপনা বললো, ‘গলা নামিয়ে কথা বল। এটা তোমাদের বাসা নয়।’
এবার ছোট ছেলেটি কথা বললো,‘তুমি এক্ষণি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের সঙ্গে যাবে।’
‘কোথায়?’ আলপনার সরল প্রশ্ন।
‘কোথায় তুমি জানো না? ন্যাকা সাজছো?’ বললো মেয়েটি।
এবার আলপনার গলা কঠিন হলো, ‘সংযতভাবে কথা বলো। এখানে একজন ভদ্রলোক আছেন।’

একটু থেমে আলপনা বললো, ‘দ্যাখো, আমি তোমাদের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝলাম তোমাদের সংসারে আমি অতিরিক্ত আবর্জনা। তখন-ই আমি তোমাদের সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তোমাদের নিজস্ব জীবন-যাপনের স্রোতে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাইনি। তোমরা ভাল থাক এটাই আমি চাই।’

সন্তানেরা নিশ্চুপ হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলপনা আবার বলতে শুরু করলো, ‘একটা কথা কী জানো, আমার এই জীবনটা দীর্ঘ পনের বছর ছিল তোমাদের বাবা আর ঠাকুমা-ঠাকুরদার। তারা যেভাবে চালিয়েছে আমি সেভাবেই চলেছি। তারপর আমার জীবনটা হয়ে যায় তোমাদের চার ভাই-বোনের। আমার জীবনে আমি কোথাও ছিলাম না। তাই এখন আমি চাইছি যে ক’টা দিন বেঁচে আছি, আমার জীবনটা আমার-ই থাক।

‘তার মানে তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না?’ ঝাঁঝিয়ে মেয়েটি।

‘যাব না, সে কথা তো আমি একবারও বলিনি! এই ভদ্রলোকের সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে। হ্যাঁ, একটা বোঝাপড়াও হয়েছে। তোমাদের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এই ভদ্রলোক মাত্র কয়েকটা মাসেই আমাকে যতোটুকু বুঝতে পেরেছেন, তোমাদের বাবা পনের বছরে তার এক ভাগও আমাকে বুঝতে পারেননি। তোমরা আমাকে নিয়ে যেতে চাইলে, ওনার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেও আমি যেতে পারি। কিন্তু তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হবে? আমার মনে হয় তোমরা তোমাদের মতো থাক, আমি আমার মতো থাকি; সেটাই ভাল হবে।’

মশাই, কী বলবো! এই কথা শোনার পর আমার রীতিমতো কান্না পাচ্ছিল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। আমি কোনোমতে বাতাসের উল্টোদিকে তাকিয়ে রইলাম।

‘চলো, দাদা। আজ থেকে জানবো আমাদের মা মরে গেছে।’ বলেই গট গট করে হাঁটতে শুরু করলো মেয়েটি। দুই ভাইও তাকে অনুসরণ করলো। দেখলাম আলপনা সন্তানদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে যেমনি এসেছিল, তেমনি গোধূলিবাড়ি ছেড়ে উঠে পড়লো রাস্তায়। মুহূর্তেই চোখের আড়ালে চলে গেল।

আলপনা ভেজা চোখে তবু সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আমি একেবারে ওর কাছ ঘেঁষে বসে, ওর কাঁধে হাত রাখলাম। আলপনা আমার চোখে ভেজা দুটি চোখ রাখলো। শিশুর মতো লুটিয়ে পড়লো আমার বুকে, ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি ওকে একটুও সান্ত¡না দিলাম না। চোখের জলও মুছিয়ে দিলাম না। ও কাঁদুক, কেঁদে আমার বুক ভাসিয়ে দিক। বুকের ব্যথা উবে যাক চোখের জলে। সন্তানদের জন্য ওর বুকের ভেতরটা কেমন তোলপাড় করছে সে আমি জানি। আমি কেবল দু-হাতে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলাম ওকে।

সময় গড়াতে লাগলো, তবু আলপনা আমার বুকের মধ্যেই মুখ গুঁজে রইলো। গোধূলিবাড়ি’তে বকের ডানায় চড়ে গোধূলি নামলো। খুঁটে খেতে-মাঠে যাওয়া পাখিগুলো নীড়ে ফিরে এলো। আমি দেখলাম হালকা কুয়াশা মাখা পুকুরের জলে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসছে পঁচিশ বছরের এক যুবক, আর আলপনা নামের এক যুবতী। ওরা হাসছে, জলকেলি করছে। হঠাৎ বাতাস! এলো-মেলো বাতাস! কুয়াশা কোথায়? এ যে বসন্ত! বসন্ত বাতাসে আলপনার চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে! আঁচল সামলাতে টাল খেতে খেতে আলপনা পড়ে গেল যুবকের বুকের ওপর। যুবক বুকে আগলে রাখলো ওকে। বাতাসের সাধ্য কী চুল ওড়ায়! আঁচল ওড়ায়! দুটি যুবক-যুবতীকে সুখের দোলায় দুলিয়ে গোধূলির আলোয় জলের ওপর ভাসতে লাগলো নৌকা, কেবল ভাসতেই লাগলো.....!

পশ্চিম দিগন্তে শুকতারাটি দারুণ হেসে উঠলো!


এপ্রিল, ২০১৩
ঢাকা।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:১২

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: এত ভালো লেখা খুব কমই পড়েছি। এত সাবলীল, এত সুন্দর যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১৮

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১২

উড়োজাহাজ বলেছেন: আপনার লেখা প্রশংসার যোগ্য। সুন্দর লেখা। তবে বিশেষ করে আমি খেয়াল করি বাক্য গঠন এবং বানানের ক্ষেত্রে একজন লেখক কতটা সতর্ক। সেই হিসেবে আপনি খুব ভাল করেছেন। চালিয়ে যান। আপনার অন্য লেখাগুলো সময় করে পড়বো। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.