নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ষাঁড়

১২ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:০৮

বংশ পরম্পরায় সঙ্গীত শিল্পী ইতিহাসে অনেক আছেন। আর আমাদের চিরায়ত মৃৎ শিল্পী, তাঁতশিল্পী, কারুশিল্পী এরা তো আছেনই-ই। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত নিন্মশ্রেণির কোন কোন গোত্র, বংশ পরম্পরায় পাঁঠা পালন করে। গ্রামগঞ্জে এটা বিরল নয়। কিন্তু উচ্চ গোত্রীয় কায়েস্থ পরিবারের বংশ পরম্পরায় ষাঁড় পালন করাটা কেবল বিরল নয়, আশ্চর্যজনকও বটে। সেই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি-ই তিন পুরুষ ধরে ঘটিয়ে চলেছে পাট্টলীর দত্ত বাড়ি। ভদ্রলোকের নাম সুভাষ চন্দ্র দত্ত। পেশায় একজন স্কুল শিক। সুভাষ চন্দ্রের বাবার নাম ছিল সতীশচন্দ্র, সতীশ চন্দ্রের বাবা ছিলেন সুবোধ চন্দ্র। ঘটনার জনক এই সুবোধ চন্দ্র। সুবোধ চন্দ্র নিজ বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পনের টাকা আট আনা পণের সঙ্গে বালিকা কনে, আর কনের সঙ্গে একটা বকনা পেয়েছিলেন। সেই বকনা বড় হয়ে পাড়া পড়শীর নজর কাড়লো। জাতটা উন্নত। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। উচ্চতা প্রায় গলা সমান। সুবোধ চন্দ্রের স্ত্রী গোপী আদর করে বকনাটার একটা নামও রেখেছিলেন। ধবলা।

ধবলা গাভীন হলো। সুবোধ চন্দ্র আর তার স্ত্রীর আদিখ্যেতার শেষ নেই। ধবলাকে খাওয়ানো-নাওয়ানো, ধবলার গায়ের আঠালু বেছে ভাঙা চাড়ার উপর ফেলে পটাস পটাস করে মারা, সন্ধ্যেবেলা ধবলার ঘরে সাঁজাল দেওয়া। আবার রাতের প্রহরে প্রহরে উঠে ধবলার খোঁজখবর নেওয়া। চোর-ডাকাতের কথা বলা তো যায় না! পাড়া-পড়শী কেউ কেউ! গোপীকে বলে, ‘ধবলা আগের জন্মে তোমার মেয়ে ছিল।’

একদিন ভোররাতে ধবলা একটা বাচ্চা প্রসব করলো। এঁড়ে বাছুর হলো। সুবোধ চন্দ্র আর গোপীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তারা আশা করেছিলেন বকনা বাছুর হবে। বকনা হলে দ্রুত পাল বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি।

এঁড়ে বাছুরটা সুবোধ চন্দ্র আর গোপীর চোখের সামনে ছুটোছুটি-লাফালাফি করে লেপা উঠোনের মাটি তুলে বড় হতে থাকলো। তাগড়া শরীর। দুধ পায় প্রচুর। এঁড়ে বাছুরটার লম্ফ-ঝম্ফ দেখে বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন সুবোধ চন্দ্রের মাথায় এক নতুন বুদ্ধির উদয় হলো। আশপাশে কোন ষাঁড় নেই। গাভী ডাকলে সবাইকে পায়ে হেঁটে সেই পারুলিয়া যেতে হয়ে। আসতে যেতে দিন কাবার। এঁড়ে বাছুরটাকে বলদ না বানিয়ে ষাঁড় করলে মন্দ হয় না। ভাল রোজগার হবে। সুবোধ চন্দ্র গোপীর সাথে পরামর্শ করলেন। গোপী প্রথমে একটু দ্বিমত করলেও শেষপর্যন্ত দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে- এঁড়ে বাছরটাকে বলদ করা হবে না, ষাঁড় করা হবে।

ঘটনার সেই শুরু। দত্তবাড়িতে তিনপুরুষ ধরে টিকে আছে ষাঁড় ব্যবসা। ধবলা কবেই মরে গেছে। কিন্তু টিকে আছে ধবলার বংশধরেরা। একটা করে ষাঁড় অক্ষম হবার আগেই নতুন করে আরেকটি ষাঁড়কে উপযুক্ত করে তোলা হয়। আর অক্ষম ষাঁড়টিকে তোলা হয় কোরবানীর হাটে। এই ব্যবস্থাই চলে আসছে তিনপুরুষ ধরে।

বাড়ির সামনের পতিত জমিটুকুতে বাঁশ পুঁতে, বাঁশ বেঁধে খোঁয়াড় বানানো। সারাক্ষণ ষাঁড়টিকে সেখানেই বেঁধে রাখা হয়। দূর-দূরান্ত থেতে গৃহস্থ-গৃহস্থের রাখালেরা গাভী নিয়ে আসে। এই ষাঁড়ের সাধনকর্মটি পরিচালনার গুরুদায়িত্ব সুভাষচন্দ্রের ছোট ভাই সুহাস চন্দ্রের কাঁধে। সুহাস চন্দ্র লেখাপড়া করেনি। জমিজমা দেখাশোনা আর ষাঁড় ব্যবসায়ের হাল ধরে আছে সে। কদাচিৎ সুভাষ চন্দ্রকেও ষাঁড়ের সাধনকর্ম পরিচালনা করতে হয়। যখন সুহাস চন্দ্র কোথাও বেড়াতে যায়।

সুভাষ চন্দ্রের চৌদ্দ বছরের ছেলে সজল কুমার সবার অগোচরে প্রায়ই ষাঁড়টিকে লম্বা লাঠি দিয়ে পেটায়। পেটানোর সময় জিভ মুখের বাইরে এনে দাঁতে চেপে ধরে সজল। চোখগুলো থাকে বড় বড়। এটা সজলের রাগের বহিঃপ্রকাশ। ষাঁড়কে এমন বেধরক পেটানোর কারণ, স্কুলের সহপাঠীরা তাকে প্রায়ই ষাঁড়ের পো বলে ডাকে। বাপ-বেটা দুজনই একই স্কুলে-একজন পড়ে, আরেকজন পড়ায়। সুভাষ চন্দ্র মানুষটা ভীষণ বদরাগী। বিশাল দেহ। গায়ের রঙ কালো, একমাথা কোঁকড়া চুল। দেখতে অনেকটা কুস্তিগীরের মতো। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বেত্রাঘাত করাটা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বেত্রাঘাত করার সময় তাকে ভীষন ভয়ঙ্কর দেখায়। চেহারা দেখেই ছাত্র-ছাত্রীরা ভয়ে সিটিয়ে থাকে। আর আড়ালে বলে, ‘অসুর’। সুভাষ চন্দ্র যখন কাসে আসেন, তাকে দেখা মাত্রই কেউ কেউ বলে, ‘সাবধান! হুশিয়ার! ঐ যে আসছেন যাঁড় সুভাষ চন্দ্র, দুলিয়ে তার দন্ড।’ দন্ড হলো বেত। বেত ছাড়া সুভাষ চন্দ্র কখনও কাসে যান না।

তাই সহপাঠীরা রেগে গিয়ে প্রায়ই সজলকে বলে, ‘ষাঁড়ের পো।’ এজন্যই সজল ষাঁড়টিকে পিটিয়ে গায়ের জ্বালা মেটায়। আবার মাঝে মাঝে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ষাঁড়টির দিকে তাকিয়েও থাকে। যখন স্কুলে যাবার সময় প্রায়ই সুহাস চন্দ্রের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয় সে। সেই টাকা তো এই ষাঁড়ের রোজগারের টাকাই।

সুভাষ চন্দ্রকেও আড়ালে গ্রামের অনেকে ষাঁড়ওয়ালা বলে। কোন অচেনা লোক গাভী নিয়ে এসে লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদা, ষাঁড়ওয়ালার বাড়িটা কোনদিকে?’ অবশ্য এসব কথা সুভাষ চন্দ্র গায়ে মাখেন না। এত কিছু গায়ে মাখলে চলে না। তিনি করেন অন্য হিসাব। আশপাশের ত্রিশটা গ্রামে ষাঁড় নেই। ধরা যাক প্রতিটা গ্রামে গড়ে দেড়শো করে পরিবার বাস করে। এর মধ্যে অন্তত একশো বাড়িতেই গাভী আছে। সেই হিসাবে ত্রিশটা গ্রামে গাভীর পরিমাণ তিন হাজার। প্রতিটা গাভী যদি তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে না হোক চারশো দিনেও ডাকে তো দিনে সাড়ে সাতটা হয়। সুভাষ চন্দ্রের বাড়িতে সাত-আটটা গাভী তো দিনে আসেই। গাভী প্রতি পঞ্চাশ টাকা। দিনে সাতটাও যদি ধরি সাড়ে তিনশো টাকা হয়। অর্থাৎ মাসে সাড়ে দশ হাজার টাকা। সুভাষ চন্দ্রের এক মাসের বেতনের সমান। সুতরাং লোকের কথায় কান দিলে চলবে কেন!

এরপর রাতের পর রাত পোহালো। দিন গিয়ে দিন এলো। মাথার অর্ধেক চুল পাকিয়ে সুভাষ চন্দ্র চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আগেই। আরেক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অবসর নেবার পর। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে সুভাষ চন্দ্রের অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে। বিশেষ করে ছোট মেয়েটা বিয়ে দেবার সময় তিনি কোমরের জোড় খুইয়েছেন। মেয়েটার গায়ের রঙ কালো। লেখাপড়ায়ও ততটা ভাল ছিল না। টেনেটুনে বি, এ পাস করেছে। মেয়েটাকে কত করে বলেছেন, একটু ভাল করে লেখাপড়া কর। পাজি মেয়েটা কথা শোনেনি। ঐ তো গায়ের রঙ তাও নাকি তিনটে প্রেমিক ছিল। এসব কথা হাওয়ায় ভেসে তার কানে এসেছে। তিনটে প্রেমিক ছিল ভাল কথা। ঐ তিনটা থেকেই একটাকে পাকড়াও কর। তা তো পারলি না। বিয়ের কথা বলতেই প্রেমিকবৃন্দ ভেগেছে। কোন খবরই অজানা নয় সুভাষ চন্দ্রের।

অবশেষে সুভাষ চন্দ্র এক স্কুল মাস্টারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তবে পেনশনের টাকার বেশির ভাগই বেড়িয়ে গেছে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে হাত টানাটানি। সেই শোকে বারান্দার চেয়ারে বসে সুভাষ চন্দ্র নিজের কাঁচা-পাকা গোঁফে তা দেন আর মনে মনে মেয়েটিকে গালি দেন-হারামজাদী, লেখাপড়াও ঠিক মতো করলি না, আবার একটা প্রেমিকও পাকড়াও করতে পারলি না। আর এর ধকল গেল আমার ট্যাঁকের উপর দিয়ে।

ষাঁড়টাও এখন বুড়ো হয়ে গেছে। লোকেরা আর আগের মতো গাভী নিয়ে আসে না। তাদের চাই টাটকা ষাঁড়। আশ-পাশের কয়েকটা গ্রামে এখন অনেকেই ষাঁড় পুষছে। তাই লোকেরা এখন সেখানে গাভী নিয়ে যায়। তাছাড়া এখন আবার নতুন বাতিক উঠেছে ইনজেকশনের। উন্নত জাতের বাছুর জন্মাতে অনেকেই হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছে। রাগে গা জ্বলে যায় সুভাষ চন্দ্রের, আরে বাবা ইনজেকশনেই যদি সব হয়, তো যা না নিজের বউটাকেও ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে আয়। বউয়ের সঙ্গে শোয়া কেন!

আগে দিনে সাত-আটটা গাভী আসতো। এখন মাসে আসে সাত-আটটা। হারামজাদী গাভী দুটো পর পর অনেকগুলো বকনা বিয়োলো। যাও বা দুটো এঁড়ে হয়েছিল। দুটোই নিউমোনিয়া হয়ে মারা গেল। নতুন করে আর ষাঁড় না হওয়ায় এখন তিন পুরুষের ব্যবসাটাই বন্ধ হতে চলেছে। একটা তেজী ষাঁড় থাকলে এই দুঃসময়ে কতো কাজে লাগতো!

তবে এত সব হতাশার অন্ধকারের মাঝে সুভাষ চন্দ্রের একমাত্র আশার আলো তার ছেলে সজল। ছেলেটা অত্যন্ত মেধাবী। আর অল্প কিছুদিন বাদেই লেখাপড়া শেষ করবে সজল। তারপর একটা ভাল চাকরি সে পাবেই। এজন্য সুভাষ চন্দ্রের অহংকারের শেষ নেই। তবে অহংকারের গরমটা এখনই সবার সামনে প্রকাশ করতে পারছেন না। আগে ছেলেটা চাকরি পাক। তারপর দেখাবেন। এখন একটু হাত টানাটানি যাচ্ছে। পেনশনের টাকা থেকে ছেলেকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হয়। বারো মাস বউয়ের অসুখ লেগেই থাকে। ওষুধের ধকলও কম নয়। তাই গোঁফে তা দিতে দিতে সুভাষ চন্দ্র অপো করেন ছেলে ফাইনাল পরীক্ষার।

কথায় বলে, হাতি নদে পড়লে চামচিকায়ও কান মলে। কথাটার সত্যতা এখন হাড়ে হাড়ে টের পান আর বারে বারে স্মরণ করেন সুভাষ চন্দ্র। পাড়া-পড়শীও এখন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারো কাছে কিচ্ছুটি ধার চেয়ে পাওয়া যায় না। সবাই ভাবে সুভাষ চন্দ্রের আর্থিক অবস্থা এখন পড়তির দিকে। ধার দিলে তো সময় মতো শোধ করবে না। সুভাষ চন্দ্রও বারান্দায় বসে গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবেন, ‘আর কটা দিন যাক না। ছেলেটা পাস করে বের হোক। বড় চাকরি করুক। তখন আমিও দেখিয়ে দেব সবাইকে।’

সুভাষ চন্দ্রের রাগটা বেশি তার ছোট ভাই সুহাস চন্দ্রের উপর। নিজের জমি-জমা বুঝে নিয়ে সুহাসটা আলাদা হয়ে গেল। ষাঁড়টাও ওর ভাগে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র দেননি। অবশ্য না দিয়ে তেমন লাভ হয়নি।

সুহাস দেয়াল তুলে ঘর দিয়েছে। চালে দশ ফুটে টিন। সেই দেমাগে সুহাসের বউয়ের পা মাটিতে পড়ে না। সুভাষ চন্দ্র মনে মনে ভাবেন, দেয়ালের উপরে দিয়েছিস তো টিন, তায় আবার অত দেমাগ কিসের! সজলটা পাস করে বের হোক না, আমি দেয়ালের উপরে ছাদ ঢালাই দেব। তখন তো তোরা চোখ টাটিয়ে মরবি!

সজল পাস করে বের হলো। অল্প কিছুদিন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরিও করলো। তারপরই বি,সি, এস দিয়ে টিকে গেল। এখন সে প্রশাসনের ক্যাডার।

সুভাষ চন্দ্রের চুল-দাঁড়ির আশি শতাংশ পেকে গেছে। পাকা চুলে হাত বুলিয়ে, গোঁফে তা দিয়ে এখন তিনি নানান রকম ভাবনা ভাবেন আগামী দিনগুলো নিয়ে। ভাবনার পুরোটাই ছেলেকে ঘিরে। ইতিমধ্যে নানান জায়গা থেকে সজলের বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত তেরোখানা প্রস্তাব পেয়েছেন। এর মধ্যে একটা মেয়েকে তার পছন্দ হয়েছে। তিনি যেমন চান মেয়ে তেমনি সুন্দরী। পরিবারও ভাল। কিন্তু মেয়ের বাপ ট্যাঁক খুলতে চাইছে না। দেনা-পাওনা নিয়ে সুরাহা না হওয়ায় দু-পক্ষই এখন নীরবতা পালন করছে। ঘটকের কাছে শুনেছেন সুভাস চন্দ্র, মেয়েপ নাকি বলেছে, ছেলের বাপের দাবী বড় বেশি। সুভাষ চন্দ্র বলেছে ঘটককে, ছেলে আমার যদু-মধু নয়। বি, সি, এস ক্যাডার। আমার আরো বেশি চাওয়া উচিত ছিল। নেহাত মেয়ে পছন্দ হয়েছে তাই কম করে চেয়েছি।

সুভাষ চন্দ্র মাত্র দশ লক্ষ টাকা নগদ চেয়েছেন। আর নাক-কান, হাত-গলার গহনা ছয় ভরি স্বর্ণের। তারপর মেয়ের বাবাকে বলেছেন, ‘আমার দাবী এই। এছাড়া জামাই-মেয়ের নতুন সংসারে আর যা যা দেবার আপনার রুচি মতন দেবেন।’ আর যা যা বলতে-লেপ-তোষক, বালিশ-কাঁথাসহ সাংসারিক জিনিষপত্র।

অনেক কন্যার পিতাই সুভাষ চন্দ্রের দাবী শুনে আর প্রস্তাব নিয়ে আর অগ্রসর হননি। আবার অনেকে অগ্রসর হয়েছেনও। হবেন না কেন! আজকাল কন্যার পিতা-মাতাও কোমর পেঁচিয়ে নামেন জামাই খুঁজতে। অদৃশ্য নিলামে কে কত দর তুলে, কত যোগ্যতা সম্পন্ন জামাই বাগাতে পারেন। রীতিমত তার একটা প্রতিযোগিতা চলে। পাত্রের বাবা হিসেবে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করেন সুভাষ চন্দ্র। কিন্তু তার নাক উঁচু তারে বাঁধা। হয় পাত্রী পছন্দ হয় না। নয় তো পরিবার পছন্দ হয় না।

শেষ পর্যন্ত কোরবানী হাঁটে বুড়ো ষাঁড়টাকে বেচে দিলেন সুভাষ চন্দ্র। কিছুদিন আগেও মাসে সাত-আটটা গাভী আসতো। এখন একেবারেই আসে না। শুধু শুধু বুড়ো ষাঁড়কে রেখে কি হবে! অক্ষম ষাঁড় রাখা মানেই টাকার অপচয়। ষাঁড় বেঁচে বাড়িতে এসেই সুভাষ চন্দ্র বউকে বললেন, ‘এবার তোমার আফসোস ঘুচলো তো! এখন আর কেউ আমাকে ষাঁড়ওয়ালা বলতে পারবে না।’

সেদিন সন্ধ্যায় ঘটক আবার এলো। পূর্বের ঐ কন্যাপক্ষ আপোস প্রস্তাব পাঠিয়েছে। দশ লক্ষ টাকা নয়, আট লক্ষ টাকা দেবেন তারা। বাকী দাবী-দাওয়া সুভাষ চন্দ্রের চাওয়া মতোই দেবেন।

বউয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সুভাষ চন্দ্র এই অপোস প্রস্তাবে রাজী হলেন। কন্যাপক্ষকে আসতে বললেন।

বিয়ের দিন ধার্য হলো। মাঘ মাসের বারো তারিখ। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। রীতিমতো সাড়া পড়ে গেল। গোটা এলাকায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সুভাষ চন্দ্র আর তার ছেলে সজল। পাড়া-পড়শীর চোখ কপালে উঠলো। নিভাঁজ ধুতি পরিধান করে ভ্রু উঁচিয়ে এখন তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন সুভাষ চন্দ্র।

নিন্দুকেরা বলতে লাগলো, ‘সুভাষ চন্দ্র অক্ষম বুড়ো ষাঁড়টিকে বেচে দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন সেই অভাব পূরণ করছে এই সক্ষম জোয়ান ষাঁড়টিকে দিয়ে।’

‘বড্ড চড়া দরের ষাঁড়।’

‘তাতো হবেই। বি, সি, এস ষাঁড় বলে কথা।’

নানা জন নানা কথা বলে। তাতে বয়েই গেল সুভাষ চন্দ্রের! তিনি বলেন, ‘লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে খাইয়েছি-পড়িয়েছি। পেটে গামছা বেঁধে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছি। ছেলে বি, সি, এস ক্যাডার বানিয়েছি। এখন সে টাকা উসুল করবো না? পরের মেয়ে এসে আমার ছেলের ঘাড়ে বসে ভোগ-বিলাস করবে। আর আমরা বুড়ো-বুড়ি কি আঙুল চুষবো! অমন কলুর বলদ সুভাষ চন্দ্র না!’

তা সত্যিই, কলুর বলদ সুভাষ চন্দ্রকে কেউ বলে না। কিন্তু ঐ ষাঁড়ওয়ালা নামটি তার আর ঘুচলো না। ঘুচবে কেমন করে! সুভাষ চন্দ্রদের ঘর যে সারশূন্য হয়, কিন্তু ষাঁড়শূন্য হয় না কখনও!









মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.