নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।
বইমেলার বই পড়ার মত আনন্দ পাবেন এই গল্পটিতে
গল্পটি ক্লোজআপ ভালোবাসার গল্প হিসেবে পাঠিয়েছিলাম । কিন্তু কিঞ্চিত ভুল হয়েছিল ওয়ার্ড থেকে পিডিএফ করার সময় । পিডিএফ ছবি ফরম্যাটে হয়ে গিয়েছিল তাই কপি করা যাচ্ছিল না । তাই হয়তো লেখাটা সিলেক্টেড হয়নি । তাছাড়া অন্য কোন কারণ দেখি না । বিশ্বাস হয় না ? তাহলে সম্পূর্ণটা একবার পড়ে দেখুন ।
----------------------------------------------------------------------------------------
- হুমমমম, হ্যা__লো
- ঐ শালা, এখনও ঘুমাচ্ছিস ?
- হুম, কি হইছে ?
- মরছে
শরীফের মুখ থেকে "মরছে" শব্দটা শুনে খাটে শোয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে উঠে বসলো আদনান । তার বুকও ধুকধুক করা শুরু হয়েছে ।
- মরছে মানে কে মরছে ? কখনও মরলো ?
- আরে মরে নাই, তবে মরবো
এতক্ষণে একটু বুকের ধুকধুকানি কমলো আদনানের । ওহ, শরীফ তাইলে কথায় কথায় "মরছে" শব্দটা ব্যবহার করেছে ।
- কি মরবে ?
- বলতিছি, আগে গেট খোল ।
- গেট খুলবো মানে ?
- আবে শালা, বলদ নাকি তুই !! তোর বাড়ির নিচে দাড়িয়ে আছি । গেটে তালা মারা, নিচে এসে খোল ।
আদনানদের বাড়ি তিনতলা । এই তিনতলা বাড়িটি আদনানদের নিজস্ব । আদনানের বাবার রেস্টুরেন্ট ব্যবসা । পুরো ঢাকা শহরে মোটের উপর তাদের তিনটি রেস্টুরেন্ট আছে । প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্টের নাম অবশ্য একই । "আয়েশা এন্ড নজরুল রেস্টুরেন্ট" । আয়েশা খাতুন ছিল আদনানের দাদীর নাম আর নজরুল হক আদনানের দাদার নাম । বাবা-মায়ের স্মৃতিকে সবসময় বাঁচিয়ে রাখতেই ওর বাবা আসিফ হক রেস্টুরেন্টের এই নাম দিয়েছেন । সকাল কয়টা বাজে দেখতে মোবাইল অন করলো আদনান । সাড়ে এগারোটা । ধুর, এত সকালে কেউ ঘুম ভাঙ্গায় !! বাড়ির সকলের উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এই সময়ে যেন কেউ আদনানকে বিরক্ত না করে । বন্ধু-বান্ধবও কেউ এই সময় আদনানকে বিরক্ত করে না । তবে আজকে শরীফ কেন যে আসলো !! বাধ্য হয়েই আদনান একটা ট্রাউজার পড়ে নিচে নামলো । শরীফ অনেকদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল । মানে ঢাকায় ছিল না । এলাকার বিল্লাল ভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করলে তো এমনটা হওয়ারই কথা । গেট খুলে শরীফকে নিয়ে আদনান আবার রুমে চলে এলো ।
- কি হইছে, এবার বল
- ঐ বিল্লালরে আমি খাইয়া ছেড়ে দিমু
- কি বলিস যা তা !!
- তোর কাছে কি এটা মশকরা মনে হইলো ?
- চেইতা আছস কেন এত ? কি হইছে খুলে বল
- ঐ হারামি, আমার ভাইয়ার দোকানে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসছে !! কত বড় সাহস ওর, একবার চিন্তা কর তো
- ভুল কই করছে সে !! তুই না পালাইলে তো যাইতো না ওখানে
- তুই এখন ঐ হারামিটার সাপোর্ট নিচ্ছিস ?
- না, মানে, সাপোর্ট নিচ্ছি না কিন্তু তুই খামোখা ওর চামচারে চড় মারতে গেলি কেন ?
- খামোখা !! তুই জানোস না, ঐ হারামিটা গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে রোজ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে
- সে না হয় করলো কিন্তু তোর কি তাতে ?
- তুই তো দেখছি নির্ঘাত মাল !! এটা কি বললি ? ওরে শুধু একটা চড় না, বেঁধে পেটানো দরকার ছিল
- হইছে হইছে থাম । এবার বোঝ কত ধানে কত চাল
- আরে সেইজন্যই তো তোর কাছে আসছি । তুই একটা বুদ্ধি দে কি করা যায় !!
- এই গেঁজানোর জন্য তুই সকাল সকাল এসে জ্বালাতন শুরু করলি !!
- তোর কাছে এটা গেঁজানো মনে হচ্ছে !! নাহ, দুনিয়াতে বন্ধুত্ব বলে আসলেই কিছু নেই
- থাক, থাক, আর সেন্টি হওয়ার দরকার নেই । আচ্ছা, আগে দুই কাপ চায়ের কথা বলে আসি, এরপর তোর ব্যাপারটা দেখতেছি । সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এককাপ চা না খেলে আমার পুরো দিনটাই কেমন জানি পানসে যায় !!
- এইটা কোন জনমের সকাল তোর কাছে !! ঘড়িতে তো প্রায় দুপুর এখন
- আমার কাছে এইটাই সকাল । বীণা, ঐ বীণা, এক কাপ চা দিয়ে যা তো
বীণা এই বাড়ির কাজের লোকের নাম । কিন্তু আদনানের কথা আজ বীণা শুনতে পাবে না কারণ বীণা কাজে আসেনি আজকে । এই ব্যাপারটা আদনান জানে না । যে ব্যক্তি ভোরের কাকের ডাক শুনে ঘুমাতে যায়, আর ঘুম থেকে ওঠে ভরদুপুরে তার এই বাড়িতে কে আছে, কে নেই, এটা খুব ভালো জানার কথা না । প্রায় দশ-পনেরো মিনিটেও কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আদনান এবার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো কিন্তু রান্নাঘর পুরা ফাঁকা । এতক্ষণে আদনান বুঝলো বীণা আজ কাজে আসেনি । আদনানের মা নিলুফার হক একজন শিক্ষিকা । বাড়ির কাছের একটি হাই স্কুলের সমাজের শিক্ষিকা তিনি । স্বভাবতই তিনি খুব সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান । বাবা তো বেরিয়ে যান সকালে আর ফেরেন রাত করে । বাকী থাকে একমাত্র ছোট বোন, আদিবা । নিশ্চয় সেও ঘুমাচ্ছে !! এটা ভেবেই আদিবার রুমের দরজা নক করলো আদনান । যদি ঘুমিয়ে থাকে তাইলে সাড়া দেওয়ার কথা না আর না ঘুমিয়ে থাকলে দরজা খুলবে । ভিতর থেকে কথার আওয়াজ আসছে । তার মানে আদিবা ঘুমায়নি আর ঘরে অন্য কেউ একজন আছে । মোবাইলে কথা বলার তেমন অভ্যাস নেই মেয়েটার । একটু পর দরজা খুললো আদিবা । দরজা পুরোটা না খুলে অর্ধেক ভিড়িয়ে থাকলো । আদনান হাত দিয়ে পুরো দরজাটা খুলে দিলো । তার দেখার দরকার ভিতরে কে আছে । হাজার হলেও বড় ভাই বলে কথা ।
ভিতরে একটি মেয়ে বসে আছে, নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে । মেয়েটিকে আগে কোনদিন দেখিনি আদনান । আদিবা ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে । মেয়েটার হাতে গুনা কয়েকটা ফ্রেন্ড । প্রায় সবাইকেই চেনে আদনান । নতুন কারও সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে হলে আগে বাড়িতে এনে পরিচয় করায় আদিবা । এইদিক থেকে আদনান সম্পূর্ণ উল্টা । ওর সব ফ্রেন্ডগুলোকে ওর বাড়ির লোক চেনা তো দূরের কথা, কয়েকজনকে তো আদনান কখনই বাড়ির ঠিকানাও বলেনি । আদনানের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়েছে মেয়েটির উপর । সময়টা যেন থেমে গেছে, আশেপাশের সবকিছু নিথর । মেয়েটি ফর্সা, গোল চেহারা, গালের মাঝের তিল, টানা চোখের চাহনি, স্লিম শরীর কাঠামো - মেয়েটার দিকে যে কারও চোখে আটকানো তো খুবই স্বাভাবিক । আদনানের দৃষ্টি এড়ালো না আদিবার । ভাইয়ার একনাগাড়ে চাহনি তাকেই অস্বস্তিতে ফেলছে । আদিবা ছোট একটা কাশি দিতেই আদনানের যেন হুশ ফিরে এলো ।
- কিছু লাগবে ভাইয়া ?
- এ্যা... কি লাগবে !!
- সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি, কিছু লাগবে ?
- ওহ, হ্যাঁ, চা
- চা মানে ? বীণাকে বলছো ? ও বানিয়ে দেয়নি ?
- কে...ওহ, বীণা... ও তো মনে হয় আসেনি আজকে
- তাইলে নিজে বানিয়ে খাও ।
- ধুর, বানিয়ে দে না একটু !! আমার আর শরীফের দুই কাপ
- ওহ, ঐ বদ শরীফ ভাই এসেছে ? না, আমি পারবো না, তোমাদের চা তোমরাই বানিয়ে খাও
এই বলেই যখন আদিবা আদনানের মুখের উপর দরজা লাগানোর উপক্রম হলো, তখন আদনান একটু জোর খাটিয়ে দরজা আবারও খুলে দিলো । আদিবা একটু অবাক হলো আদনানের ব্যবহারে । আদনান আদিবাকে আরেকটু অবাক করে দিতেই যেন ওর হাত ধরে বাইরে একটু সাইডে নিয়ে এলো ।
- এই ভাইয়া, ছাড়ো, কি করছো ? বললাম না, আমি চা বানাতে পারবো না ।
- আচ্ছা, তুই চা না হয় না বানাস, আগে বল, তোর রুমের ঐ মেয়েটা কে ?
- কেন ক্রাশ খেয়েছো ?
- ইয়ার্কি বাদ দে । প্লিজ, বোন আমার, কে একটু বল না ?
- আচ্ছা, বাবা, বলছি । কিন্তু চুপিচুপি কেন, ওর সামনে গিয়েই না হয় তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই । কি বলিস ?
- মানে কি ? কি বলিস এসব ?
আদনানের নিষেধ বুঝেও আদনানের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে খাটে বসে থাকা মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড় করালো আদিবা । আদিবার এমন আকস্মিক আচরণে আদনানের বুখের ধুকধুকানি আবারও বেড়ে গেলো । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সামনের মেয়েটির দৃষ্টি এখনও নিচের দিকে । মনে হচ্ছে ভাই বোনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখার একেবারে ইচ্ছা নেই মেয়েটির । সবার আগে আদিবাই বলে উঠলো,
- ভাইয়া পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি হচ্ছেন সুমনা । তুমি হয়তো জানো না, আমি একটি পথশিশুদের স্কুলে জয়েন করেছি । প্রতি মঙ্গলবার আর বুধবার বিকেল থেকে সন্ধ্যায় সেখানে সময় দেই । সেখানেই সুমনা আপুর সাথে পরিচয় আমার । আপু অনার্স পাশ করেছেন সদ্যই, এখন মাস্টার্সের ভর্তি হবেন ।
আদিবা এতক্ষণ কথা বলে গেলেও আদনানের দৃষ্টি সুমনা নামের মেয়েটির দিকে । মেয়েটি এখনও নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে । একটু খটকা মনে হলো আদনানের কাছে । তবে আদনানকে অবাক করে দিয়ে সুমনা প্রথম কথা বলে উঠলো,
- হ্যাঁ, আদিবা মেয়েটা অনেক মিষ্টি । আমি ঐ স্কুলে আছি প্রায় তিন বছরের মত । অন্ধ বাচ্চাগুলোকে ব্রেইল সিস্টেমে আমি পড়াই ।
"ব্রেইল" শব্দটা শুনে কেমন জানি একটু ধাক্কামত খেলো আদনান । একটু পর আদিবার দিকে তাকাতেই আদিবা বুঝে গেলো ব্যাপারটা ।
- আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে কলেজে যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করে আপু তার দুইটা চোখ হারান । অন্ধ জীবনটাকে বোঝা মনে করে আপু এর পরের এক বছর বাড়ি থেকে বের হননি । এক বছর পর মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আপু আবারও কলেজে ভর্তি হন । ব্রেইল সিস্টেমেই পড়াশুনা করা আপু আজ এতদূর এসেছেন । আপুর মত এমন মানসিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি !!
এতক্ষণ আদিবার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে সুমনা যেন লজ্জা পেয়ে গেলো ।
- আরে না, না, তুমি মনে হচ্ছে আমার সম্পর্কে একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলছো । আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে । তা এত কথা কাকে বলা হচ্ছে শুনি ।
সুমনার কথা শুনে আদিবার এতক্ষণ পরে মনে পড়লো ভাইয়ার পরিচয় তো দেওয়াই হয়নি আপুকে । ওদিকে আদনান অনেক আগে থেকেই নীরব দর্শক । এবার আদিবা বলে উঠলো,
- আদনান ভাইয়া । আমার বড় ভাই । নাহিয়ান হক আদনান । নর্থ সাউথে এমবিএ শেষের পথে ভাইয়ার । জানেন আপু, ভাইয়া ছোটবেলা থেকেই খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র । ক্লাশে কখনও সেকেন্ড হননি । আর জেদও অনেক । সরকারী ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েও জেদ করে নর্থ সাউথে ভর্তি হন । এখানেও রেজাল্ট ফাস্ট ক্লাশ ফাস্ট ।
আদিবা যখন কারও সম্পর্কে বলতে থাকে, তখন ওর মুখে খালি ভালো দিক ছাড়া কখনও খারাপ দিক আসে না । বোনের মুখে নিজের এরকম কথাগুলো শুনে আদনানও লজ্জা পেয়ে গেলো । অথচ আদনান ভেবেছিল আদিবা মনে হয় আদনানের পিঠ পিছনে তাকে নিয়ে উল্টো কথাগুলোই বলে । আজ তার ভুল ভাঙ্গলো । আদনান আদিবার হাত চেপে ধরলো যাতে আদিবা থেমে যায় । হাত চাপাটা হয়তো একটু জোরেই হয়ে গেলো, আদিবা "উহ" করে উঠলো । সুমনা বুঝতে পেরে হেসে উঠলো । বাহ, মেয়েটার হাসিও তো অনেক সুন্দর । আচ্ছা, দুনিয়ার সব সুন্দর ব্যাপারগুলোর কোন একটা খুত কেন থাকে ? খুত ছাড়া হলে কি সমস্যা ? অথচ এই মেয়েটা অন্ধ না হলে আর সাত-পাঁচ না ভেবে এর পিছনে লেগে পড়া যেতো অনায়াসে কিন্তু এখন তো বিশাল কনফিউশন !! সুমনার সাথে কিছু বলবে কি বলবে না, এই কনফিউশনে রুম থেকেই বেরিয়ে গেলো আদনান । তার চলে যাওয়ার ব্যাপারটাও বুঝলো সুমনা । অন্ধ মানুষের বাকী ইন্দ্রিয়গুলো খুব প্রখর হয় । সুমনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয় ।
আদনান রুমে ঢুকতেই দেখলো শরীফ বিছানায় শুয়ে আছে । আদনানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে শুয়ে পড়েছে । অবশ্য এটা বুঝা গেলো কারণ আদনান ঘরে ঢুকতেই তড়াক করে উঠে বসলো শরীফ ।
- কি রে, এতক্ষণ লাগালি অথচ চা কই ? একা একা খেয়ে আসলি নাকি রান্নাঘর থেকে ?
- না, চা খাইনি
- তো কই ছিলি এতক্ষণ ?
- আদিবা একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে, ওখানেই ছিলাম এতক্ষণ । কথা হচ্ছিল ।
- কে ? তোর ছোট বোনের কোন বান্ধবী নাকি ? সুন্দরী দোস্ত ?
- হ্যাঁ, মেয়েটা অনেক সুন্দর
- কি বলিস !! সত্যি ?
- কিন্তু অন্ধ
- এ্যা, কানা !!
- কি বলছিস এসব ? কানা মানে কি ?
- কানা মানে যার চোখের লাইট ফিউজ !! কেন, মনে হচ্ছে তুই জানোস না ?
- এভাবে বলিস না । অন্ধত্ব একটা অভিশাপ । যার কষ্ট সেই জানে ।
- আহা, তোর এত দরদ আসতেছে কেন ? কি !! মামা !! কুপোকাত নাকি ?
- শরীফ তুই এখন যা তো । আমার মাথাটা হঠাৎ ধরেছে । আমি একটু শুবো এখন । কথা বলতে খারাপ লাগছে ।
- মাথা ব্যাথা !! হঠাৎ ? আচ্ছা যাচ্ছি । তুই একটু শুয়ে থাক, ভালো লাগবে ।
আসলে আদনানের পুরো চিন্তা জুড়ে এখন শুধু সুমনা । মেয়েটি অন্ধ না হলে কি হতো এমন !! ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো আদনান । ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যার দিকে । আদনান প্রতিদিন ভার্সিটি যায় না । রেগুলার ক্লাশ করতে ভালো লাগে না তার । আর পড়াশুনা, সে তো পরীক্ষার আগের সপ্তাহ । তাও যে কি করে এমন রেজাল্ট হয় !! ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিলো সে । এরপর রান্নাঘরে যেয়ে দেখলো তার মা তরকারী কাটাকুটি করছে । কাজের মেয়ে না আসলে নিজেদেরই কষ্ট করতে হয় ।
- মা, এক কাপ চা দাও তো
- কি ব্যাপার !! তুই এত বেলা করে ঘুমিয়ে ছিলি !! শরীর খারাপ করেছে নাকি ?
- না, ঘুম থেকে উঠেছিলাম একবার । কাজ-কাম নেই, তাই ভাবলাম আরেক দফা...
- বাহ, নবাবজাদা আমার !! সারা দুনিয়ার মানুষ কাজ কাম করতে করতে জান শেষ আর উনার সারাসময় শুধু অবসর !!
- কি যে বলো না মা !! আমারও অনেক কাজ আছে
- থাক বাবা, আর হাসাস না, যা এখান থেকে, কাজ করতে দে
- আচ্ছা, মা, আদিবার ঘরের ঐ মেয়েটা চলে গেছে ?
- কে ঐ অন্ধ মেয়েটা ?
- অন্ধ বলছো কেন, ওর নাম নেই বুঝি ?
আদনানের মুখ থেকে এমন সহানুভূতিশীল উক্তি শুনে মিসেস নিলুফার হক যেন একটু অবাক হয়ে আদনানের মুখের দিকে তাকালেন, পরক্ষণেই বলে উঠলেন,
- কি যেন নাম মেয়েটার, মনে করতে পারছি না
- সুমনা
আদনানের ঝটপট উত্তরে ওর মায়ের আরেকবার অবাক হওয়ার পালা । আদনান নিজেও অবাক নিজের আচরণ দেখে । মায়ের দৃষ্টির সামনে আর থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে সে চলে গেলো নিজ ঘরে ।
পরদিন নিজেকে নিজেই অবাক করে দিয়ে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো আদনান । খুব সকাল মানে সকাল ৮টায় । সকলের জন্য এই ৮টায় পুরো সকাল হয়ে গেলেও আদনানের জন্য ভোরবেলা । খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলো সে । বেশ সময় নিয়েই রেডি হলো । এরপর চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । বাড়ির লোকেরা যেন জানতে না পারে সেজন্যই এত চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া । বাড়ি থেকে বের হয়েই সোজা মিরপুর ১৪ তে সেই স্কুলে গিয়ে হাজির হলো আদনান । এই স্কুলেই বিকেলের দিকে পথশিশুদের আসর বসে । আগের রাতেই ইন্টারনেট থেকে স্কুলের নাম দিয়ে সার্চ দিয়ে লোকেশন বের করেছিল সে । তার এখানে আসার উদ্দেশ্য সুমনার সাথে কথা বলা । কাল থেকেই একটা অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছে আদনানের মেয়েটার প্রতি । কেমন জানি একটিবার কথা বলা, দেখা করবার তাড়না কাজ করছে ।
খোঁজ নিতেই জানা গেলো সুমনা সকালের দিকে এখানে আসে না । প্রতিদিন বিকেলের দিকে আসে সে । স্কুল থেকে চালাকি করে সুমনার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করলো আদনান । আসলে নিজে একজন অন্ধ পথশিশুর কথা বলে টিচার সুমনার নাম্বার নিয়েছে সে । নাম্বার না হয় নেওয়া গেছে কিন্তু এবার !! অনেকবার মোবাইল হাতে নিয়ে নাম্বার টাইপ করেও সাহসের অভাবে কেটে দিলো আদনান । ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো সে । বাড়ির কেউই টের পায়নি । এই ব্যাপারটা সে বুঝলো যখন দুপুর পর্যন্ত তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি ।
দুপুরের দিকে একবার সাহস করে ফোন দিলো আদনান । দুইবার রিং হতেই ফোন ধরল সুমনা ।
- হ্যালো কে ?
- ভালো আছেন ?
- জী আলহামদুলিল্লাহ্, কে বলছিলেন ?
- গলা শুনে কি চেনা যায় ?
- অন্ধ মানুষ যদিও গলা দিয়েই মানুষকে মনে রাখে কিন্তু আপনার গলাটা আমার কাছে তেমন পরিচিত মনে হচ্ছে না । আপনার পরিচয়টা একটু দেন তো কষ্ট করে
- আমি আদনান
- কোন আদনান ?
- আদিবার বড় ভাই ?
- ওহ, ফাস্ট ক্লাশ ফাস্ট হওয়া সেলেব্রিটি !!!
সুমনার সম্বোধনে একটু ধাক্কামত খেলো আদনান । আদিবা না হয় নিজ ভাইয়ের প্রশংসায় সত্য কথাটা সুমনার সামনে বলে ফেলেছে কিন্তু "সেলেব্রিটি" শব্দটা তো বড্ড বেমানান এখানে । মেয়েটা মশকরা করছে না তো !!?? সেটাই শিউর হওয়ার জন্য আদনান জিজ্ঞেস করে,
- সেলেব্রিটি মানে ?
- ও মা, আপনি ঠিকঠাক পড়াশুনা না করেও ঠিকই রেজাল্ট ফাস্ট ক্লাশ ফাস্ট । আপনি সেলেব্রিটি না হলে সেটা কি করে সম্ভব ?
- জী না, আমি কোন সেলেব্রিটি না । যদিও আমি বুঝতে পারছি আপনি আমাকে নিয়ে মজা নিচ্ছেন কিন্তু তবু আমি কোনভাবেই সেলেব্রিটি না । এখন ক্লাশের বাকী ছেলেমেয়েরা একেবারেই না পড়াশুনা করলে আমার দোষ নাকি ?
- না, একেবারেই না, আপনার দোষ হবে কেন । আপনিই তো একা পড়াশুনা করেন !!
- হুম, করি না কে বলেছে !!
- না, কেউ বলেনি
- তাহলে ?
- তাহলে কি ?
- আপনি এভাবে বলছেন কেন ?
- আচ্ছা, বাবা, আমার ভুল হয়েছে । ক্ষমা চাইছি, করবেন তো ক্ষমা ?
- ওকে, যান, আপনি একজন দয়াশীল ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইলেন । ক্ষমা না করে থাকি কিভাবে !! হা হা হা
- হা হা হা । তা আমার মত একজনের কাছে হঠাৎ ফোন !!?
- না, গতকাল আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই আপনার ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।
- কোন ব্যাপারটা ?
- এই যে আপনি নিজের শরীরের প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে, চোখের অন্ধকারকে পাশ কাটিয়ে পুরো সমাজ, দেশকে আলোকিত করছেন ছোট ছোট এই অসহায় বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর মাধ্যমে
- দেখুন, এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার জীবন থেকে বেশকিছু মূল্যবান সময় কেড়ে নিয়েছে । আমি আমার বাকী জীবনের সময়টাকেও তো কেড়ে নিতে দিতে পারি না, তাই না ?
- হুম তা তো বটেই । আমাদের এই সমাজে সাহসী মেয়ে হয়তো অনেক আছে কিন্তু আপনার মত খুব কমই দেখেছি
- মানে ?
- এই যে নিজের সাহসকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিভা সবার থাকে না
- আপনি যেভাবে বলছেন, আমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি
- হা হা হা । না, আমি এই কারণে কথাটা বলিনি । কাল রাত থেকে আরও একটা কথা আমার মাথা ব্যাথার কারণ হয়েছে
- কি সেটা ?
- আচ্ছা, থাক সেটা, আপনার বাসায় কে কে আছে ?
- আমি, আম্মু, আর ছোট একটা ভাই ।
- আপনার আব্বু ?
- আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আব্বু একটা রোড এক্সিডেন্টে এই দুনিয়া ছেড়েছেন
- আমি দুঃখিত
- আরে না, না, আপনি দুঃখিত হচ্ছেন কেন ? সে তো অনেক আগের কথা । আমরা সেই শোক কাটিয়ে উঠেছি অনেক আগেই ।
- এটাই উচিৎ
- আপনি কি জানি বলছিলেন তখন
- কখন ?
- ঐ যে কাল রাতে কোন ব্যাপারটা জানি আপনার মাথা ব্যাথার কারণ হয়েছিল
- কই, এমন কিছু বলেছিলাম নাকি ?
- দেখুন কথা ঘুরাবেন না একদম । তাইলে কিন্তু আমি রাখবো
- না, না, দাঁড়ান । বলছি । মানে ইয়ে... মানে
- মানে, মানে করছেন কেন ?
- আসলে আপনার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা এসেছে আমার
আদনান এতটুকু বলেই থেমে গেলো । আর কিছুই বলতে পারছে না সে । তার গলা কাঁপছে । হাত-পাও কাপা শুরু হয়েছে । ভয়তে গলা শুকিয়ে যাবার উপক্রম । ওদিকে ফোনের অপ্রান্তও একেবারে নীরব । প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেলেও কেউ কিছুই বললো না । একবার আদনানের এটাও মনে হলো হয়তো ফোন কেটে গেছে কিন্তু না, ফোনের লাইন ঠিকই আছে । বেশ খানিকক্ষণ পর আদনানই প্রথম জিজ্ঞেস করলো,
- কোন উত্তর দিবেন না ?
- দেখুন আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার জন্য শুধুই একটা সীমাবদ্ধতা । আপনার আগেও অনেক ছেলেই আমাকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছে । কিন্তু সেটা আমাকে নিয়ে তাদের নিছক ভালো লাগা । দায়িত্বর ব্যাপার আসলেই কাউকেই খুঁজে পাবো না, সেটা আমি জানি । আপনিও হয়তো তাদের মধ্যেই একজন
- না, মানে আমি...
- হুম, আর বলতে হবে না । আমার জায়গায় না আসলে কখনও আপনার কাছে আমার অবস্থান পরিষ্কার হবে না । আর কখনও যদি পরিষ্কার হয় তাহলে আমাকে নিয়ে আপনার এই চিন্তাই হয়তো পুরো ঘুরে যাবে । আজ তাহলে রাখি । খুশি হবো যদি এরপরে আপনি কখনও ফোন করেন, সেইবার আপনি আপনার অবস্থান পরিষ্কার করবেন । খোশগল্প করতে নিশ্চয়ই ফোন দেবেন না ।
- আমি দুঃখিত, আমার এই উদ্দেশ্য ছিল না, বিশ্বাস করুন
- আল্লাহ্ হাফেজ ।
- মানে !! ওকে, আল্লাহ্ হাফেজ
আদনানের মধ্যে ভীষণ পাপবোধ হচ্ছে । নিজের ভালো লাগার কথা বলতে গিয়ে মেয়েটার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার প্রতি একটা সূক্ষ্ম খোঁচা লেগে গেছে । মেয়েটা ভীষণ আত্ব-নির্ভরশীল । সুমনার সাথে কথা বলার আগে ওর প্রতি আদনানের যে ভালো লাগা ছিল, কথা বলার পর সেই ভালো লাগা যেন আরও বেড়ে গেছে । আচ্ছা, মেয়েটা কি বললো যেন !! "আমার জায়গায় না আসলে কখনও আপনার কাছে আমার অবস্থান পরিষ্কার হবে না । আর কখনও যদি পরিষ্কার হয় তাহলে আমাকে নিয়ে আপনার এই চিন্তাই হয়তো পুরো ঘুরে যাবে ।" ওর জায়গায় আসা বলতে কি বুঝালো মেয়েটা ? মানে ওর মত অন্ধত্ব !! না, আদনানের মাথা আর কাজ করছে না । সারাদিন খাওয়া হয়নি কিছুই তবু বিছানায় মাথাটা এলিয়ে দিতেই ঘুমে তলিয়ে গেলো সে ।
ঘুম ভেঙে গেলো বেশ রাতে । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত নয়টা । ক্ষুধায় পেট ডাকছে আদনানের । জলদি করে কোনোরকম মুখ ধুয়েই রান্নাঘরে গিয়ে খাবার খুঁজতে লাগলো সে । রান্নাঘরের দিকে এখন কেউই নেই । তবে সে যে সারাদিন কিছুই খায়নি এই ব্যাপারটা মা জানলে কষ্ট পেতো, না জানতে পেরেই ভালো হয়েছে । রান্নাঘরে তেমন কিছুই নেই । ফ্রিজ খুললো আদনান । ফ্রিজে দুই প্যাকেট মিষ্টি আছে । সেখান থেকেই গপগপ করে ৩-৪টা মিষ্টি পেটে চালান করে দিলো সে । এরপর একটা আপেল হাতে নিয়ে ফ্রিজ বন্ধ করতেই দেখলো আদিবা দাড়িয়ে । আদিবাকে দেখেই বুক ধক করে উঠলো আদনানের । তবে কি সুমনা ওকে বলে দিয়েছে !!??
- ভাইয়া
- হ্যাঁ বল
- তুমি এমনটা কেন করলে ?
- না, মানে, আদিবা, আমি তো ইচ্ছা করে করিনি
- ও মা, নিজে সারাদিন মরার মত ঘুমিয়ে পার করলে, আবার বলছো ইচ্ছে করে করিনি
আদিবার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আদনান একটু আশ্বস্ত হলো, যাক আদিবাকে কিছুই বলেনি সুমনা ।
- কেন, কি হয়েছে ?
- তুমি সকাল সকাল ঘর থেকে বেরিয়েছিলে, তাই না ? বাবা অফিস যাওয়ার পথে তোমাকে দেখেছিল । পরে মা কে বলেছিল । এরপর বাসায় এসে তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়লে । মা ভেবেছে তুমি সারাদিন কিছু খাওনি, এইজন্য নিজেও কিছু খায়নি । তুমি তো বাইরে গিয়ে খেয়েছিলে, তাই না ?
- না, খাওয়া হয়নি ।
-ও মা, সে কি !! তাইলে তো মায়ের ধারণাই সত্যি । আচ্ছা ভাইয়া এত সকালে ঘুম থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিকে ? একটু বলো তো
- ঐ শরীফের কাজে একটু...
- ধুর, আবার সেই শরীফ ভাই !! ভাইয়া, তুমি এই ভোঁদড়ের বন্ধুত্ব ছেড়ে দাও তো
- কি যা তা বলছিস !!
- হ্যাঁ, আমি সত্যি বলছি । আচ্ছা, তুমি কি রান্নাঘরে খাবার খেতে এসেছিলে ?
- হ্যাঁ, কিছু নেই ?
- মা আজকে রান্নাও করেনি । বাবা বাইরে থেকে খাবার এনেছিল । আমি আর বাবা খেয়েছি । মা খায়নি কিছুই ।
- তাইলে মায়ের জন্য আনা সেই খাবার কই ?
- মা তার জন্য খাবার আনতে মানা করেছিল, তাই বাবা আনিনি
- ধুর !!! আচ্ছা তুই ঘরে যা
- এমন করো না কখনই আর, বুঝেছো ?
- এই, তুই আমার ছোট বোন নাকি আমি তোর ছোট ভাই ?
- তুমি যা করো মাঝে মাঝে তাতে তুমি যে বড় ভাই কিনা সন্দেহ হয়
- কি !! তাইলে বলিস না, যা ভাগ এখান থেকে ।
আদনানের কথামত আদিবা ঘরে চলে যায় । সামান্য কয়টা মিষ্টি আর আপেল খেয়ে ক্ষুধা রেখেই নিজের ঘরে চলে আসলো আদনান । মায়ের সাথে এখন কথা বলে লাভ নেই, শুধুশুধু অভিমান দেখাবে । এর থেকে সুমনাকে নিয়ে চিন্তা করবে সে । সুমনার বলা কথাটাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু । হঠাৎ আলনার নিচে একটা কালো কাপড়ের টুকরার দিকে নজর গেলো আদনানের । কোন এক কারণে এই কালো কাপড়ের টুকরা তার আলনায় ছিল । এই কালো কাপড়ের টুকরাটি দেখে আদনানের মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো । সুমনা তাকে বলেছে, ওর জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতে, আদনান এখন সেই কাজটাই করবে । এই কালো কাপড় চোখে বাধবে সে । এভাবে বেধেই কাটিয়ে দেবে সে। যতদিন না মেয়েটা বুঝতে পারে তার অন্ধত্বর এই সীমাবদ্ধটুকু নিয়ে আদনান মজা করছে না । যেই ভাবা সেই কাজ । সে রাতে আদনান ঘুমিয়ে গেলো এটা ভেবে যে কাল সকাল থেকেই শুরু হবে মিশন ।
পরদিনও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো আদনানের । আচ্ছা, শুধু শুধু কালো কাপড় পড়ে ঘুরলে সেই খবর তো কখনও সুমনা পর্যন্ত পৌছাতে নাও পারে !! তাহলে উপায় !!? একটু খানি ভেবে নিয়ে আদিবার ঘরের দরজায় গিয়ে নক করলো আদনান । আদিবা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল । এমন সময় মা কিংবা বাবাই তার দরজায় নক করতে পারে, এটা ভেবেই দরজা খুললো আদিবা । কিন্তু দরজায় আদনানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো সে।
- ভাইয়া তুমি ?
- হ্যাঁ আমি । মনে হচ্ছে ভূত দেখেছিস !!
- এই সময় তোমাকে দেখা আর ভূত দেখা একই কথা
- ধুর, ফালতু বকিস না তো
- আচ্ছা, ঠিক আছে । কি কাজে এসেছো আমার কাছে ?
- মানে কি ? তোর কাছে কি কাজ ছাড়া আসতে পারবো না ?
- না, তা তো পারবে কিন্তু আসো তো না । একমাত্র কাজ থাকলেই আমার কথা মনে পড়ে তোমার ।
- আহা, তুই আমার একটি মাত্র ছোট বোন, তোর কাছে আসতে আমার বাহানা দরকার !!
- নাটক বাদ দাও । এবার সাফ সাফ বলো কাহিনী কি নয়তো এখান থেকে গায়েব হও, ভার্সিটি যাবো, দেরী হয়ে যাচ্ছে
- আচ্ছা, ঠিক আছে বলছি । তুই সেদিন একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলি না তোর রুমে ?
- কে ? অপর্ণা ?
- অপর্ণা আবার কে ?
- ওকে তো তুমি চেনো । আমার বান্ধবী, গ্রিনরোডে বাড়ি
- ওহ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে । না, ওর কথা বলছি না
- তাহলে ?
- ঐ যে অন্ধ মেয়েটা
- ওহ, সুমনা আপুর কথা বলছো ?
- হুম, সুমনার কথাই বলছি
- বাব্বা, সুমনা !! কি ব্যাপার ভাইয়া ? একেবারে পড়ে গেছো নাকি ? আপুর প্রেমে অবশ্য হাজার হাজার ছেলে পড়ে আছে । চোখে দেখতে পারে না তাই এই অবস্থা । চোখে দেখতে পারলে না জানি কি অবস্থা হতো !! লাভ নেই বুঝছো ভাইয়া, একেবারেই লাভ নেই । তুমি পাত্তাই পাবা না ।
- আদিবা তোকে একটা কথা বলার দরকার
- হ্যাঁ, বলো
- আমি সুমনাকে প্রপোজ করেছি
আদনানের কথা শুনে আদিবা পুরো হতভম্ব হয়ে গেলো । একটু আগে সে কি শুনেছে, সেটা কি আদৌ সত্য !! সুমনাকে নিয়ে একটু আগে সে যা বলছিল সেটা একরকম মজা করে কিন্তু তার ভাইয়া যে সত্য সত্য একটি অন্ধ মেয়েকে প্রপোজ করতে পারে, সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না ।
- কিন্তু ভাইয়া ? সুমনা আপুই কেন ?
- দেখ, ও শুধু চোখে দেখতে পারে না । সেটা তো আমার সাথেও হতে পারতো । এই একটা বিষয় নিয়ে তাকে ভালো না লাগার পিছনে কোন লজিক নেই । ও যে এই অবস্থাতেও সমাজকে আলোকিত করছে, ওর মত প্রতিবন্ধকতা বিশিষ্ট মানুষদের আলোর দিশারি হচ্ছে, এই বিষয়টাই আমাকে মুগ্ধ করেছে । আমার মনে হয় সত্যি সত্যি ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি
- সুমনা আপু হ্যাঁ বলেছে ?
- এখানেই তো সমস্যা । ও ভাবছে আমি হয়তো ওর এই সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছি
- কিন্তু ভাইয়া...
- দেখ, ও গতকাল আমাকে একটা কথা বলেছে যে আমি নাকি ওর জায়গায় গিয়ে ওর অবস্থান না বুঝে এতকিছু করছি । ওর জায়গায় থাকলে নাকি আমি নিজেও অন্যরকম ভাবতাম । আমি ওর পর্যন্ত একটা মেসেজ পৌছাতে চাই যে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা । আমি ওকে সত্যি ওর মত করে পেতে চাই ।
- আচ্ছা, বুঝলাম । তা আমি কি এখন যেয়ে সুমনা আপুকে বুঝাবো ? তুমি কি এটাই চাও ?
- না, আমি সেরকম কিছু চাইছি না । আমি এই অন্ধত্বর জীবন যাপন করবো যতদিন সুমনার কঠিন মন না গলে । এই মেসেজটাই তুই ওকে গিয়ে দিবি ।
- এতকিছু যখন তুমিই করছো, তুমিই তাহলে জানাও । শুধু শুধু এর মধ্যে আমাকে জড়াচ্ছ কেন ? তুমি কি একবার বাবা-মায়ের কথা ভেবেছ ? তারা কি একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে একটা অন্ধ মেয়েকে মেনে নেবে ?
- গাধার মত কথা বলিস না । তোর মত একটা মডার্ন মেয়ে যদি এখনও আদিম চিন্তা ভাবনা করে তাহলে চলবে ? তাছাড়া ও তো জন্মান্ধ না । চিকিৎসা করলে নির্ঘাত ভালো হবে ।
- তোমার যা ইচ্ছা করো
- তুই ওকে জানাস, প্লিজ
- আচ্ছা, আমি সুমনা আপুকে জানিয়ে দিবো নে । আপুকে যতটুকু চিনি, তোমার এই সস্তা চালবাজিতে আপুর মন গলবে না । আর বাবা-মা রেগে গেলে তোমার কিন্তু খবরই আছে
- পরেরটা পরে দেখা যাবে । এখন যেটা ভাবছি সেটাই করবো
এই বলে আদনান ঘরে চলে এলো । এখন থেকেই ওর মিশন শুরু হবে । আদিবা ঠিকই সুমনাকে জানিয়ে দেবে । একটু পর আদনান কালো কাপড়ের টুকরাটি চোখে বেঁধে নিলো । চোখ থাকতেও অন্ধ, এক ধরনের ব্যাপার আছে । আদনানের এই ব্যাপারটা চোখ ভালো থাকতেও অন্ধ । এইভাবেই থাকবে সে । এতক্ষণ সে খাটে বসে ছিল । একটু পর তার টয়লেটে যাবার প্রয়োজন পড়লো । সে সেই অবস্থাতেই টয়লেটে যাওয়ার সময় টি-টেবিলে ধাক্কা খেলো । একটু পর চেয়ারের সাথে, আর টয়লেটে ঢুকতেই টয়লেটের দরজায় বাড়ি খেলো । প্রাথমিক অভিজ্ঞতাই যদি এত ভয়ংকর হয় তাহলে না জানি এরপর কপালে কি লেখা আছে !!
আদিবা ঠিকই সুমনাকে জানালো আদনানের প্ল্যান সম্পর্কে । সেই কথা শুনে সুমনা আর আদিবা হাসতে হাসতে শেষ । প্রথম দিন আদনানদের বাসায় আদনানের আচরণ দেখেই আদিবা সন্দেহ করেছিল এমন কিছু একটা হতে পারে । তাই আদিবা সেই সময়ই সুমনাকে বুঝিয়ে বলেছিল । তাই আদনানের সুমনাকে প্রপোজ করার বিষয়টা সুমনা কিংবা আদিবা কারও কাছে অবাক করার মত কিছু ছিল না যদিও তারা দুইজনেই ভান করেছিল ।
- তোমার ভাইয়া কি পাগল নাকি ?
- পুরোপুরি না, কিন্তু মনে হয় দুই একটা স্ক্রু ঢিলা আছে
আদিবা এই কথা বলা মাত্রই সুমনা আর আদিবা একসাথে হেসে উঠলো । আদনানের এই অন্ধ হওয়ার ভূত খুব দ্রুতই মাথা থেকে নেমে যাবে এই কামনা করেই আদিবা সুমনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে এলো । আজকে আর তার ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি । বাড়ি এসে দেখে হুলস্থূল ব্যাপার । আদনান চোখে কালো কাপড় পড়ে আছে । মা আজকে স্কুলে যায়নি । ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি ভাবছেন ছেলের মাথা আউলিয়ে গেছে । ছেলে আগে, চাকরী না । মা ফোন দিয়ে বাবাকে ডেকেছেন । সেও পথে । ওদিকে আদনানের কয়েকটা বন্ধুকেও ফোন করে ডেকে আনা হয়েছে । শরীফ, বাঁধন, রতন, আশিক এরা সবাই আদনানকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে । এদের মধ্যে আদিবার মনে হলো শরীফ মিটমিট করে হাসছে আর মজা নিচ্ছে । নাহ, ভাইয়া যে কেন এই ছেলের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে গেলো !! মা বলেই যাচ্ছেন । কিন্তু আদনান কিছুতেই কারও কথা শুনার পাত্র না । সকালে টয়লেটে পরে যাওয়া থেকে শুরু, এরপর রান্নাঘরে আছাড় খাওয়া, ব্যালকনিতে গাছের টবের সাথে ধাক্কা লেগে পায়ের নখ প্রায় উঠিয়ে ফেলার উপক্রম করা ইত্যাদি অনেক অঘটনই ইতিমধ্যে ঘটিয়ে ফেলেছে আদনান । আদিবা এগুলো দেখে একটু ফিক করে হেসে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো । সুমনা মেয়েটার মন যে এত সহজে গলবে না এটা আদিবা ভালো করেই জানে ।
এভাবে প্রায় তিনদিন কেটে গেলো । ছেলের জন্য মা মিসেস নিলুফার হক প্রায় অঘোষিত ছুটি নিয়ে নিয়েছে চাকরী থেকে । আদিবা ভার্সিটি যেতে পারলেও আদনান-আদিবার বাবাও বেশ বেকায়দায় পড়েছেন । ছেলের পাগলামি তো আছেই, ছেলের এই পাগলামির জন্য ছেলের মাও প্রায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । এটা নিয়ে আসিফ হক সাহেব বেশ মাইনকা চিপা অবস্থানে পড়ে গেছেন । অনেক ভেবেচিন্তা করে তিনি ছেলের সাথে নিবিড়ভাবে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন, যদিও বাপ-ছেলে কালে ভদ্রে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে । যেই ভাবনা সেই কাজ । তিনি আদনানের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলেন । কারণ আদনানের মা যাতে তাদের কথোপকথন শুনতে না পারে । তিনি সন্দেহ করছেন মেয়েঘটিত কোন কারণে ছেলে এই পাগলামি করছে । তাই তিনি মূলত এসেছেন ছেলেকে বুঝাতে । আদনান বুঝতে পেরেছে কেউ একজন এসেছে তার রুমে । প্রায় ৪ দিন চোখে কাপড় দিয়ে রাখার তার ইন্দ্রিয় এখন বেশ প্রখর । সে এখন টয়লেটে পা গুণে যেতে পারে । এমনকি বাড়ির যে কোন প্রান্তেই সে পা গুণে যেতে পারে । আগের থেকে কোথাও ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেক কম । ঘরে কে ঢুকেছে সেটি বুঝতেই আদনানই প্রথম কথা বলে উঠলো,
- কে ? কে ওখানে ?
- কেন, দেখে বুঝো না ?
- ও বাবা । আমি তো দেখতে পাচ্ছি না
- ওহ, আদনান, স্টপ দিস ননসেন্স । এনাফ ইজ এনাফ !!
- বাবা, আসলে এই দুনিয়ায় যারা অন্ধ তারা কিন্তু চাইলেই এনাফ কিছু করতে পারবে না । ধরে যাও, তোমার ছেলেও তাদের দলে
- তুমি যদি সতি সত্যি অন্ধ হতে, তখন না হয় একটা ব্যাপার ছিল । এখন তো ব্যাপারটা ভিন্ন ।
- আমি তাদের ব্যাথাটা ফিল করতে চাচ্ছি ।
- তুমি কিন্তু আসলে তাদের নিয়ে মজা নিচ্ছ
- ছিঃ বাবা, মোটেও না । কমপক্ষে বাবা হয়ে তোমার এটা বুঝা উচিৎ ছিল
- তুমি বুঝিয়ে দাও তাইলে । আমার কাছে এটা তোমার ঢং মনে হচ্ছে । তুমি যদি ছোট হতে এতক্ষণে মেরে তোমার পিঠের চামড়া তুলতাম ।
- হুম, সেটা তুমি করতেই, আমি জানি ।
- তাইলে তুমি এখন কি চাও ?
- আমি তো কিছু চাচ্ছি না । খালি তোমরা আমার এই মহৎ উদ্যোগটাতে কোন বাধা দিও না ।
- আচ্ছা, আদনান, ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেলে নাকি তারা বাবা-মায়ের বন্ধু হয়ে যায় । তো আমাকে বন্ধু ভেবে একটা কথা বলো তো
- বাবা, এটা তুমিও জানো, আমিও জানি, তুমি আর আমি কখনই বন্ধু হতে পারিনি । তুমি সেই সুযোগটাই আমাদের কখনই দাওনি । তবুও তুমি কি জানতে চাও, বলো ?
- তুমি কি এটা কোন মেয়ের জন্য করছো ? আল্লাহ্র কসম করে বলতে পারবে যে, না, তুমি তা করছো না ?
- আসলে বাবা, তোমার কাছে লুকাবো না । হ্যাঁ, এটা একটা মেয়ের জন্যই ।
- আমি সেটাই সন্দেহ করেছিলাম । তো তুমি তো আমাকে আর তোমাকে মা কে খুলে বললেই পারতে সব । এর জন্য এসব নাটক করার দরকার কি ? নাকি তুমি সেই মেয়ের কাছে কোন পরীক্ষা দিচ্ছ ?
- পরীক্ষা ব্যাপারটা সত্যি কিন্তু আমি মেয়েটার কাছে পরীক্ষা দিচ্ছি না বরং মেয়েটার জন্য পরীক্ষা দিচ্ছি ।
- মানে ?
- ছোটবেলা থেকেই তোমাকে আর মা কে ফ্রেন্ডলি ভাবে পাইনি । এখন কিভাবে আশা করবো তোমরা আমার সিদ্ধান্তকে ফ্রেন্ডলি ভাবে নেবে ?!
- আচ্ছা, বাদ দাও এসব কথা, কে ঐ মেয়ে ? মেয়ের বাবা কি করে ? ভালো ফ্যামিলি নিশ্চয় ? তুমি বলো সব । আমি তোমার মায়ের সাথে আলোচনা করি যেয়ে ।
- মেয়ের নাম সুমনা । মেয়ের বাবা নেই । ভালো ফ্যামিলি অবশ্যই । মেয়ের মা তাদের সংসার চালায় আর মেয়েটাও টুকটাক শিক্ষকতা করে ।
- বাহ, তোমার মতই !! মা আর বউ দুইজনই শিক্ষিকা হবে তোমার ? হা হা হা
- বাবা, একটা কথা জানার দরকার তোমার, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
- ওহ, আরও আছে নাকি ? হুম বলো, কি সেটা ?
- মেয়েটা অন্ধ । চোখে দেখতে পায় না
- কি ?? একটা অন্ধ মেয়ের জন্যই তাহলে এতদিন ধরে এই নাটক করা হচ্ছে তোমার ?
- হ্যাঁ, আমি মেয়েটিকে ভালোবাসি
- তা কোথায় তোমার ভালোবাসার মানুষ ? একবারও তো তাকে দেখলাম না । নাকি একটি অন্ধ মেয়েকেও পটাতে পারোনি তুমি ?
- বাবা, তুমি যাও, আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না । আমি একটু একা থাকবো ।
- হ্যাঁ, এই একাই থাকো । আজীবন । এইসব অন্ধ মেয়েকে কখনই আমরা এই ঘরের বউ বানাবো না । কখনই না ।
এই বলে আসিফ হক ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন । ছেলের মুখ থেকে শুনা কথাগুলো যেন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না । বাড়ির একমাত্র ছেলে, তাও আবার বাড়ির বড় ছেলে আর সে কিনা এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করলো, দেশে কি মেয়ের অভাব পড়ছে !! থাক সে এরকম অন্ধ হয়ে, দেখি এরকম নাটক কতদিন ধরে করতে পারে সে ।
অনেক ভেবে চিন্তা করে আদনান পরের দিন সিদ্ধান্ত নিলো এভাবে বাড়িতে বসে থাকার কোন মানে হয় না । আদিবা কি সুমনাকে বলেছে ? যদি বলে থাকে তাহলে সেই মেয়েটা কোন খোঁজ নিচ্ছে না কেন ? তাহলে কি... থাক উল্টাপাল্টা ভাবতে চায় না আদনান । আজকে বাইরে যাবে আদনান, এভাবেই চোখে কালো কাপড় বেধেই । রাস্তা ঘাটের লোকজন পাগল ভাবতে পারে, স্টান্টবাজি ভাবতে পারে, মজা ভাবতে পারে ইত্যাদি যাই ভাবুক আদনানের কিছু যায় আসে না । তার একমাত্র যায় আসে যে সুমনা কি ভাবছে !! আদনানের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে নিলুফার হক ইতিমধ্যেই শয্যাশায়ী হয়েছেন । আসিফ হক এখনও ছেলের উপর রেগে আছেন । ছেলের পাগলামিকে প্রশ্রয় দেবেন না ভেবেই আর বাড়িতে বসে না থেকে কাজে গেছেন তিনি । আদিবা ভার্সিটিতে গেছে । আদনান বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে । বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে থাকতে না হয় পা গুণে হাঁটতে শিখে গেছিল সে কিন্তু রাস্তা ঘাটে কিভাবে !!
প্রথম তাকে দেখে কয়েকজন ধরতে গিয়েছিল কিন্তু কালো কাপড় দেখে রাগে তারা সরে গেছে । আদনান হাঁটছে হাত দুইটি একটি সামনে উঁচু করে আর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে আশেপাশের মানুষ কটূক্তি করে যাচ্ছে পাশ থেকে । হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তার মাঝে চলে এসেছে আদনান সেটা টের পায়নি সে, হঠাৎ একটা গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো তবু রক্ষা হলো না । এরপর আর মনে করতে পারে না আদনান, চারপাশ থেকে মানুষ ছুটে এলো । আদনানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সে অজ্ঞান, ডাক্তাররা প্রথম যে কাজটা করলো সেটি হচ্ছে তার চোখ থেকে কালো কাপড়টি খুলে ফেললো । কেউ একজন সহৃদয়বান ব্যক্তি আদনানের মোবাইল থেকে ফোন করে আদনানের বাসায় জানালো ।
আদনানের জ্ঞান ফিরেছে । অপারেশন দরকার হয়নি, তবে দুইপায়েই ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে । ডাক্তাররা বলেছে দুই মাসের মত লাগবে পুরোপুরি সারতে । আদনানকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে আদনানের মা নিলুফার হক, আদিবা আর আদনানের বন্ধুরা শরীফ, আশিক, রতন, বাঁধন । আদনানের বাবাও আছেন হাসপাতালে কিন্তু তিনি দৌড়াদৌড়ি করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখছেন আর ঔষুধের ব্যবস্থা করছেন । নিলুফার হক খবর পেয়েই একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন । আদিবা ভার্সিটিতেই ব্যাগ রেখে এসে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে । রতনের একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ ছিল, শরীফের ডেটিং ছিল । সবাই সবকিছু ক্যান্সেল করে এখানে এসেছে । সবার আগে আদিবাই কথা বলে উঠলো,
- কি !! তোমার পাগলামি শেষ হয়েছে ?
- আমার চোখের কাপড় কে খুলেছে ?
- আবার তুমি কাপড় নিয়ে কথা বলো, তোমার লজ্জা করছে না ভাইয়া ?
- কিসের লজ্জা ? কাপড়টা কই ? নিয়ে আয় যা
- কিসের কাপড় !! মা পুড়িয়ে দিয়েছে ঐ কাপড় । এবার আর কালো কাপড় না, তোমার জন্য সাদা কাপড়ের ব্যবস্থা করা দরকার । আরেকটু হলেই সেটার প্রয়োজন হতো তোমার ।
- মানে ?
- মানে হচ্ছে কাফনের কাপড় । আরেকটু হলেই তো একেবারে উপরে পার্সেল হতে !!
- হলে তো ভালোই হতো তোর । বেঁচে যেতি
- হ্যাঁ, তা তো যেতামই
এই বলেই দুই ভাই বোন হেসে দিলো । ওদিকে আদনানের মা নীরব । তিনি ছেলের উপর অভিমান করেছেন, কথা বলবেন না সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । শরীফ অবশ্য এর মধ্যে একবার আদনানের কানে কানে এসে বলে গেলো, "শালা, তুই মরে গেলে, তিনদিনের খাওয়া, চল্লিশার খাওয়া কতকিছু পাইতাম !! মরলি না কেন !!" এই কথা আদিবার কানেও গেলো । সে একটু কপট রাগ দেখাল শরীফের দিকে চেয়ে । ছেলের পাশে বসে আছে মা অথচ কোন কথা নেই । আদনানই এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলা শুরু করলো,
- মা, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
- কই না তো । রাগ করলেই বা কি লাভ !! তোর তাতে কিছু যায় আসে ?
- কি বলো মা !! যায় আসবে না কেন ? অবশ্যই যায় আসে
- একটা অন্ধ মেয়ের সাথে এত অল্প দিনের পরিচয়ের গুরুত্ব তোর বাবা-মায়ের সাথে এত বছরের পরিচয়ের গুরুত্বর চেয়ে বেশি হয়ে গেলো তোর কাছে?
মায়ের এই প্রশ্ন শুনে আদনান চুপ করে গেলো । কি লাভ হলো তার এতদিনের করা কাজের । যার জন্য এতকিছু সেই তো আসলো না । আদনানের লম্বা দীর্ঘশ্বাসের অর্থ রুমের সকলেই বুঝলো । একটু পর আদিবা রুমের বাইরে থেকে নিয়ে এলো সুমনাকে ।
- দেখ তো ভাইয়া, চিনিস নাকি ইনাকে ?
সুমনাকে দেখে আদনান পুরো অবাক হয়ে গেলো । তাহলে কি সত্যি সুমনা তার জন্যই এসেছে এখানে ? আদনানের নীরবতা বুঝতে পেরে সুমনাই বলে উঠলো,
- কি !! অনেক তো কারসাজি করলেন । তা কেমন লাগলো অন্ধত্ব জীবন, অনেক মজার না ?
- ইয়ে মানে...
- আচ্ছা, আপনি কি ইয়ে মানে ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন না ?
সুমনা এই কথা বলা মাত্রই সবাই হাসা শুরু করলো । একটু পর আদিবা সবাইকে রুম থেকে বের করে নিলো । এই সময়টা শুধু এখন আদনান আর সুমনার ।
২| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৪৮
নূর-ই-হাফসা বলেছেন: অনেক বড় গল্প শর্টকাট এ পড়েছি ।
বেশ ভালো লাগলো ।
৩| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৭:০৩
সৈয়দ ইসলাম বলেছেন: ভালোলাগা আপনার এ দীর্ঘ লেখার প্রতি
৪| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:১৬
রাজীব নুর বলেছেন: লম্বা সংলাপ চালানো বেশ কঠিন।
৫| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:২৯
খাঁজা বাবা বলেছেন: ভাল ছিল
শেষ টা বেশী ই নাটকীয়
©somewhere in net ltd.
১| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৩৪
সালাহ উদ্দিন শুভ বলেছেন: ভাল ছিল, সুন্দর গল্প