নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।
প্রতিদিন বাড়ির সামনে অলসভাবে শুয়ে থাকা কুকুরটার ভয়তেই বাড়ির ভিতরে যাওয়া হয় না সৌহার্দ্যের । অথচ কিভাবে কিভাবে যেন প্রতিদিন রাফিয়াদের বাড়ির সামনে হাজির থাকার জন্য এক তোড়া করে গোলাপ ম্যানেজ করে সে । এভাবে ঠিক কতদিন ধরে চলছে বলাটা স্রেফ কঠিন । তবে এটার শুরু হয়েছিল একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় রাফিয়াকে প্রথম দেখার পর থেকে । সেখানে অনেক চেষ্ঠা করেও রাফিয়ার সাথে কথা বলতে পারিনি সৌহার্দ্য । এরপর তো রাফিয়াকে হারিয়ে ফেলা । এর পরের ঘটনাগুলো বেশ মজার । রাফিয়াকে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়ার অক্লান্ত চেষ্ঠা দৃষ্টি কাড়ে সৌহার্দ্যেরই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাকিরের । জাকির আগে থেকেই চিনতো রাফিয়াকে । বিষয়টা অনেকটাই কাকতালীয় । রাফিয়া হচ্ছে জাকিরের কাজিন বোনের বান্ধবী ।
বন্ধুর কাছ থেকে রাফিয়ার খোঁজ পেয়ে সৌহার্দ্যের বৃহস্পতির অবস্থা পুরাই তুঙ্গে, যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে সে । এরপর ধীরে ধীরে মোবাইল নাম্বার ম্যানেজ, বাড়ির ঠিকানা ম্যানেজ আরও কতকিছু করেছে সৌহার্দ্য কিন্তু রাফিয়ার মনমত কিছুই হয়নি । মোবাইল থেকে ব্লক প্রথম কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরই, ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোর পরেও শুধুমাত্র ফলোয়ার হিসেবে ঝুলে থাকা, বাড়ির সামনে প্রথম প্রথম আসা শুরু করার পর থেকে পিছনে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, বাবার কাছে অভিযোগ, অতঃপর সৌহার্দ্যের বাড়িতে অভিযোগ চলে যাওয়া ইত্যাদি আরও অনেককিছুই হয়েছে । কিন্তু হ্যাঁ, সৌহার্দ্য দমে যায়নি কোন বাধাতেই ।
প্রায় আধা ঘণ্টাখানেক দাড়িয়ে থাকার পর আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে থেকে অবশেষে আজকের মত ফিরতি পথ ধরলো সৌহার্দ্য । অথচ ছেলেটা জানতেই পারলো না যে রাফিয়া ঠিকই জানালার পাশে দাড়িয়ে পর্দার ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখছিল । সৌহার্দ্য ফিরে যেতেই রাফিয়া জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় গিয়ে বসলো । সৌহার্দ্যের জানার কথা না কিন্তু রাফিয়া দ্বিতীয় দিন থেকেই এভাবে সৌহার্দ্যকে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে আসছে । হ্যাঁ আজকে ধরে ৪৮ দিন হলো । ছেলেটার মধ্যে এক ধরনের সরলতা আছে, অন্য অনেক বখাটে ছেলের মত রাফিয়ার জানামতে সৌহার্দ্যের কোন বাজে অভ্যাস নেই । রাফিয়া অনেকের কাছে খোঁজ নিয়েছে অন্য কোন মেয়ের দিকেও সৌহার্দ্যের নজর নেই মোটেও । ছেলেটার স্রেফ পরীক্ষা নিচ্ছে সে । প্রতিদিন ঠিকই সাহস করে সবকিছু উপেক্ষা করে বাড়ির সামনে দাঁড়াতে পারে অথচ সাহস করে মুখ ফুটে ভালোলাগার, ভালোবাসার কথাটা বলতে পারে না । বুদ্ধু একটা !!
- এভাবে আর কতদিন চলবে ?
এতক্ষণ নিজের জগতেই ডুবে ছিল রাফিয়া । হঠাৎ করে যে মা রুমে ঢুকেছে তা খেয়ালই করেনি সে । তবে মায়ের কথা শুনেই সেই চিন্তার জগত থেকে ফিরে আসলো সে, মায়ের করা প্রশ্নটা সে ধরতে পেরেছে । তবু সে চুপ করে থাকলো । মিসেস স্বপ্না অর্থাৎ রাফিয়ার মা মনে করলেন রাফিয়া হয়তো তার প্রশ্ন বুঝতেই পারেনি । তাই তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
- কি হলো, বললে না !! এভাবে আর কতদিন চলবে ?
- জানি না ।
- জানি না বললেই হলো ? বিষয়টা তো যত দিন গড়াচ্ছে ততই দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে । নিশ্চয় তুমি কোনকিছুর ইঙ্গিত করেই যাচ্ছ যার কারণে ছেলেটা প্রতিদিন বাড়ির সামনে আসার সাহস পায় !!
- মা !! উদ্ভট কথা বলো না তো । আমি আবার কিসের ইঙ্গিত দিতে যাবো ? আমি কি শুরুতেই তোমাদের ঘটনাটা খুলে বলিনি ? বাবাকে দিয়ে ওকে ভয় দেখাইনি ? ওর বাবা-মা কে কি বাবা যথেষ্ট কথা শুনায়নি ? তাহলে তুমি এমন কিছু কিভাবে বলতে পারো ?
- হ্যাঁ, সবই তো বুঝলাম । কিন্তু সেগুলো তো আরও মাসখানেক আগের কথা, তুমি ছেলেটার সামনে দাড়িয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভালো করে বলো না কেন ?
- মা, ইতিমধ্যে আমি পরোক্ষভাবে ওকে অনেকবার বুঝিয়েছি এসব পাগলামি না করতে, এটা কি তুমি জানো ? এখন তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছ, এখন এই বিষয়টা সরাসরি ওকে বুঝাবো ?
- হ্যাঁ, আমি সেটাই বলতে চাচ্ছি ।
- কিন্তু আমার তো মনে হয় না এতে কোনরকম লাভ হবে ।
- তুমি একবার বলেই দেখো !! এরপর দেখা যাবে পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেওয়া যায় !!
- আচ্ছা মা, কালকেই বলবো তাহলে ।
- আচ্ছা, তোমার কোচিং আছে নাকি ? যাবা না আজকে ?
- না, আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না । একটু ঘুমবো ।
- আচ্ছা, ঘুমাও, আর কথাগুলো একটু ভেবে বলো কিন্তু...
- ওকে মা, তুমি এখন যাও, রুমটা একটু অন্ধকার করে ঘুমবো নয়তো ঘুম আসবে না আমার ।
- ওকে বাবা, তুমি ঘুমাও, আমি যাচ্ছি ।
মিসেস স্বপ্না চলে যেতেই রাফিয়ার মাথায় হঠাৎ ভাবনাগুলো এসে জড়ো হলো । সত্যি তো আগামীকাল ওকে আসলে কি কি বলা যায় !! ভাবতে ভাবতেই দুই চোখ লেগে আসলো রাফিয়ার । গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেও সময় লাগলো না তার ।
রাফিয়ার থেকে সৌহার্দ্য ২ বছরের মত বড় । রাফিয়া ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে আর সৌহার্দ্য অনার্স ফাস্ট ইয়ারে । পড়াশুনা সত্যি শিকেয় উঠেছে ছেলের । সেটাই স্বাভাবিক, সারাদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাফিয়ার বাড়ির সামনে এসে পড়ে থাকলে কারও ঠেকা পড়েনি যে ওর পরালেখার উন্নতি করাবে । সৌহার্দ্য বিষয়টা বুঝতে পারে, সে নিজেও চায় এমনটা না করতে । একটা মেয়ের কাছে কতদিন উপেক্ষিত থাকা যায়, বাবা-মায়ের রোজকার গালমন্দ খেয়েও ভালোবাসাটুকু মলিন রাখা যায় কিংবা বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে বেঁচে থাকা যায় ? সৌহার্দ্য তাই এগুলো সবই বোঝে কিন্তু কি এক আশ্চর্য মায়ার টানে সে স্থির থাকতে পারে না, তার ভাবনার জগতের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে পারে না কিংবা রাফিয়া নামের মেয়েতিকের চিরদিনের মত ভুলে থাকতেও পারে না । তার কি অধঃপতন আসন্ন !!
রাফিয়া পড়াশুনায় বেশ ভালো । একেবারেই কলেজের সেলেব্রিটি টাইপের একজন । বেশিরভাগ কলেজের স্যাররা তো রাফিয়া বলতে একরকম অজ্ঞান । কোনরকম একাডেমিক ফাংশনের আয়োজন করতে হলে রাফিয়া, কালচারাল প্রোগ্রাম হলে রাফিয়া, স্পোর্টস আয়োজন করতে হলে রাফিয়া - এক কথায় কলেজের যে কোন আয়োজনেই রাফিয়ার নাম সবার প্রথমেই উচ্চারিত হয় । সেই সুবাদেই তো তার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কলেজের প্রতিনিধিত্ব করা আর সেখান থেকেই তো সৌহার্দ্যের নজরে পড়া । ঐ প্রথম দিনই যে ছেলেটা কথা বলার চেষ্ঠা করছে সেটা রাফিয়ার দৃষ্টি এড়ায়নি কিন্তু রাফিয়া নিজে থেকেই কথা বলার সুযোগ তৈরি হতে দেয়নি । তখন অবশ্য হঠাৎ দুর্বলতা থেকে নয়, নিজের নিরাপত্তার খাতিরেই কাজটা করেছিল রাফিয়া কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সৌহার্দ্য ছেলেটার সাথে রাফিয়াকে কথা বলতেই হবে ।
আচ্ছা, কথা বলতে তো হবে কিন্তু জায়গা নিয়েই তো কনফিউশন । ঠিক কোন জায়গায় দাড়িয়ে কিংবা বসে কথা বলা যায় !!? রাফিয়া এই বিষয়টা নিয়ে বেশ টেনশনেই পড়ে গেলো । অনেকক্ষণ ভেবে কোন উপায় না পেয়ে ফোন করলো জারা কে । জারা রাফিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড । এমন কোন কথা নেই যেটা রাফিয়া জারার সাথে শেয়ার করে না । সৌহার্দ্যের এই বিষয়টাও জারার সাথে শেয়ার করেছে সে । এখন জারাই ভরসা, একটা ভালো সাজেশন পেলেই চিন্তামুক্ত হতে পারবে রাফিয়া । অনেকক্ষণ ধরে রিং হওয়ার পর ফোন কেটে গেলো । জারা মেয়েটাই এমন, কখনও একবারে ফোন ধরে না ও । ভাগ্য বেশ ভালো হলেই কেবল ওকে দ্বিতীয়বার ফোন করে পাওয়া যায় । অনেকসময় তৃতীয় কিংবা চতুর্থবারে গিয়ে ধরে সে । অবশ্য কেন প্রথমবার ফোন করলে ফোন ধরে না, এটা অনেকবার ওর কাছে জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পায়নি রাফিয়া । আজকে রাফিয়ার ভাগ্য মনে হয় ভালো, দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই ফোন ধরলো জারা,
- হ্যালো, রাফিয়া, কি রে, খবর কি তোর ?
- ভালো আবার ভালো না ।
- (মুচকি হেসে) পাগল হলি নাকি রে ?
- ঠিক পাগল না, তবে কনফিউজড ।
- তা ম্যাডামের কনফিউশন কি নিয়ে, একটু শুনি তো
- তোকে সৌহার্দ্য নামে একটা ছেলের কথা বলেছিলাম, মনে আছে ?
- হুম, খুব আছে, থাকবে না কেন, ঐ যে রোমিও-টা না যে লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে তোর বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকে ?
- হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস, ওর একটা ব্যাপার নিয়ে কনফিউশন
- দাড়া, দাড়া, ঐ বজ্জাতটা কি শেষমেশ তোকে প্রপোজ করে দিয়েছে ?
- আজব তো !! প্রপোজ করেছে সেটা আমি কখন বললাম ?
- না, তুই অবশ্য বলিসনি, আমি অনুমান করলাম ।
- উদ্ভট কথা রাখ তো । কাজের কথা শোন আগে
- হ্যাঁ বল শুনি
- মা দুপুরের দিকে রুমে এসে বলছিল ছেলেটার সামনাসামনি দাড়িয়ে যেন ওকে বলি যে ও যেই কাজগুলো করছে তার জন্য সামাজিকভাবে আমরা দৃষ্টিকটু বিষয়ে পরিণত হচ্ছি, ছেলেটা যেন এসব বন্ধ করে ।
- হ্যাঁ, অ্যান্টি তো ভালো কথাই বলেছে, বল তাইলে
- কিন্তু ঝামেলা আছে তো
- ওহ আমার সোনা, গুলুগুলু বাবু, রোমিও আর বাড়ির সামনে আসবে না, এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে এখন থেকেই ?
- ঐ ইয়ার্কি রাখ তো, ইয়ার্কি ভালো লাগছে না এখন । আমি কনফিউশনে আছি ওর সাথে কোথায় দাড়িয়ে কিংবা বসে কথা বলবো ? বাড়ির সামনে দাড়িয়ে তো কথা বলা যায় না, তাই না ?
- তাইলে কি রেস্টুরেন্টে বসার চিন্তা করছিস ? আমাকেও বলিস রে । তোরা কথা বলবি আর আমি খাবো
- নাহ, তোর সবকিছুতেই ইয়ার্কি, ধুর !! এই আমি রাখছি বাই ।
- নাহ, এই শোন, শোন...
জারার কথা উপেক্ষা করেও রাফিয়া ফোন রেখে দিলো । রেস্টুরেন্টের বিষয়টা একেবারে মন্দ না । কাউকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে সৌহার্দ্যকে জায়গাটা বলে দিতে হবে, ও আসলে একজায়গায় বসে ঠাণ্ডা মাথায় ওকে বুঝিয়ে বলা যাবে । ও ভালো ছেলে, নিশ্চয় শুনবে । কিন্তু জারা কিন্তু একেবারে মিথ্যা বলেনি । সৌহার্দ্য আর ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবে না, এটা ভাবতেই কেমন কেমন জানি একটু কষ্ট হচ্ছে রাফিয়ার । তবু এই অনুভূতিটুকু কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না । এই অনুভূতিটুকু রাফিয়ার একার ব্যাপার, এর ভাগ সে কাউকে দেবে না, কাউকে না ।
এখানে এসির বাতাসটা খুব তীব্র । যেখানে সাধারণত যে কোন পাবলিক রেস্টুরেন্টে এসির তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম দেওয়া থাকে না, সেখানে এখানকার এসির তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেওয়া । সৌহার্দ্যের কেমন যেন শীত শীত লাগছে । সেই ৩টা থেকে এসে বসে আছে, এক ঘণ্টার মত হতে চললো অথচ রাফিয়ার কোন খোঁজ নেই । অবশ্য সৌহার্দ্যের বিরক্তি লাগছে না বরং কেমন যেন একটু নার্ভাস নার্ভাস লাগছে । মেয়েটা এখনও আসেনি একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, কি বলবে সৌহার্দ্য ওর সামনে ? সকল বীরত্ব তো ওর থেকে দূরে থেকেই হয়েছে, কাছে থেকে কিছু বলার সাহস কি করতে পারবে সৌহার্দ্য !! দুইদিন আগে রাতের দিকে হঠাৎ জাকিরের ফোন । জাকিরের সাথে প্রায়ই টুকটাক কথা হয় সৌহার্দ্যের, তাই বিষয়টা এতটা অবাক হওয়ার মত কিছু না । কিন্তু কথার এক পর্যায়ে জাকির যখন জানালো রাফিয়া সৌহার্দ্যের সাথে দেখা করে কিছু কথা বলতে চায়, সেই মুহূর্তেই সৌহার্দ্য যেন স্থির হয়ে যায় । রাফিয়া !! তার সাথে দেখা করবে !! সত্যি ? সে কি স্বপ্ন দেখছে না তো ?
জাকিরকে ফোন করে এই কথা জানিয়েছে জাকিরের কাজিন সুস্মিতা । সুস্মিতা আর রাফিয়া একই কলেজে একই ক্লাসে পড়ে । জাকিরের মুখ থেকে এই কথা শুনে সৌহার্দ্যের বিশ্বাস করতে সত্যি অনেক কষ্ট হয়েছে । প্রথমে তো সৌহার্দ্য ভেবেছিল জাকির ওর সাথে মজা করছে কিন্তু পরবর্তীতে জাকির কসম কেটে বললে এরপর সৌহার্দ্য বিশ্বাস করে । এরপর জায়গার নাম, কবে দেখা করতে হবে আর কয়টার দিকে দেখা করতে হবে সবকিছু জানিয়ে জাকির ফোন রেখে দেয় । অবশ্য সবশেষে কংগ্রাচুলেশন জানাতে ভোলেনি সে । এই দুইটা দিন সৌহার্দ্যের কেটেছে অনেকটা স্বপ্নরাজ্যের রাজকুমারের মত । একেকবার একেক অদ্ভুত স্বপ্ন এসে ভর করছে তার উপর । সে আর রাফিয়া হাত ধরে রেললাইনের দুই ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নয়তো একটি ডিঙ্গি নৌকায় সে আর রাফিয়া চড়েছে - সেখানে সৌহার্দ্য বৈঠা দিয়ে নৌকা চালাচ্ছে আর রাফিয়া একটু নিচু হয়ে হাত পানিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে নয়তো একটা ছোট প্রাইভেটকারে লং ড্রাইভে ঘুরতে বেরিয়েছে তারা দুইজন ইত্যাদি আরও অনেক স্বপ্ন ।
রেস্টুরেন্টটা রাফিয়াদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে । প্রতিদিন তো রাফিয়াদের বাড়ির সামনে এসেই বসে থাকে সে, সেই হিসেবে এই রেস্টুরেন্টে সময়মত আসতে কষ্ট হয়নি সৌহার্দ্যের । আজকে তার পোশাক পুরোপুরি ফরমাল, সহসা যে কেউ দেখলে মনে করবে হয়তো চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে বেরিয়েছে সে । হাতে স্বভাবজাত সেই গোলাপের তোড়া । আজকে সে গুণে গুণে ত্রিশটা গোলাপ এনেছে । না, ত্রিশ সংখ্যাটা স্পেশাল কিছু না, এমনিতে মনে হয়েছে তাই এনেছে । ঘড়িতে চারটা বেজে পনেরো মিনিটের মাথায় রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো রাফিয়া । চাইনিজ রেস্টুরেন্টটা দুপুর-বিকেলের মধ্যাহ্ন এই সময়টাতে একপ্রকার খালিই থাকে । আশেপাশে ৪-৫টা টেবিলে হাতেগোনা ৫-৬ জন বসে আছে । ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃদু সুরে ইংলিশ গান বাজছে, একটা ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি হয়েছে পুরো রেস্টুরেন্টের ভিতরে । রাফিয়া একাই এসেছে, জারা অবশ্য সাথে আসার জন্য দুইবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু রাফিয়া ওকে সাথে আনেনি । আজকে সৌহার্দ্যের সাথে তার একারই কথা বলা দরকার । রাফিয়া ঢুকে সোজা হেঁটে গিয়ে সৌহার্দ্য যে টেবিলটাতে বসে ছিল সেই টেবিলে সৌহার্দ্যের সামনাসামনি চেয়ারটাতে গিয়ে বসলো ।
এতক্ষণ যে এসির বাতাসটাই খুব তীব্র বলে মনে হচ্ছিল, সেই এসির বাতাসটাকেই এখন বেশ অপ্রতুল বলে মনে হচ্ছে সৌহার্দ্যের কাছে । তার গরম লাগা শুরু হয়েছে । একটু একটু করে ঘামাও শুরু করেছে সে । রাফিয়া খেয়াল করলো সৌহার্দ্য পকেট থেকে একটা রুমেল বের করে মুখ মুছতে লাগলো । পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাফিয়া মুচকি হাসলো কিন্তু তার এই হাসিটা সৌহার্দ্যের নজরে পড়লো না । পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা দরকার, রাফিয়া মনে মনে ভাবতে লাগলো । তাই সে-ই প্রথমে কথা বলা শুরু করলো,
- কখন এসেছেন ?
রাফিয়ার মুখ থেকে হঠাৎ কথা শুনে সৌহার্দ্য আরও নার্ভাস হয়ে গেলো । সে রাফিয়াকে এক্সকিউজ মি বলে ওয়াশরুমে গেলো । সেখান থেকে মুখে একটু পানি দিয়ে এসে আবার জায়গায় এসে বসলো । সৌহার্দ্য যে বেশ নার্ভাস সেটা রাফিয়া বুঝতে পারছে, বিষয়টা বুঝতে পেরে রাফিয়ার বেশ মজাই লাগছে । সৌহার্দ্য চেয়ারে বসতেই রাফিয়া আবারও জিজ্ঞেস করলো,
- কখন এসেছেন ?
- (প্রথমদিকে সামান্য তোতলিয়ে সৌহার্দ্য জবাব দিলো) হ্যাঁ, এই তো, ৩টার দিকে, তুমি যখন আসতে বলেছিলে
- বাহ, রাইট অন টাইম !! আচ্ছা, ৩টার আগে এসেছিলেন নাকি পরে ?
- মানে ?
- মানে একজন মানুষ তো একেবারে রাইট অন টাইম হতে চাইলেও পারবে না । কমপক্ষে সেকেন্ডের ব্যবধান হলেও থাকবে, সেই হিসেবে ৩
টার আগে এসেছিলেন নাকি পরে ?
- সেভাবে খেয়াল করিনি
- ওহ আচ্ছা । আমি যে এত দেরী করে এসেছি, এতক্ষণ নিশ্চয় অনেক বিরক্ত হয়েছেন । আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয় অনেক কথা শুনাতেন, তাই না ?
- হয়তো
- তার মানে এখন আপনি আমাকে কথা শুনাবেন ?
- সেটা কেন ? না তো
- তার মানে আমি এরকম দেরী করে আসলে আপনার সমস্যা নেই ?
- না, ইয়ে মানে... কি বলবো
রাফিয়া আসলে সৌহার্দ্যের সাথে কথা পেচিয়ে তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল, এই মুহূর্তে ছেলেটা সেই পরীক্ষায় পাশ করেছে । তবে হ্যাঁ, রাফিয়ার সৌহার্দ্যের সাথে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছে । এই ভালোটা আসলেই অন্য রকম ভালো
- খাবারের অর্ডার করেছেন ?
- না মানে, তোমার কি পছন্দ, তা না জেনে কিভাবে...
- ওহ, তাইলে আপনি দেখছি আমার পছন্দ-অপছন্দের কিছুই জানেন না
- ইয়ে মানে...
- তাও তো দেখি ঠিক জানেন গোলাপ আমার প্রিয় ফুল !!
- মানে ?
- এত মানে মানে করবেন না তো !! বিরক্ত লাগে । তার চেয়ে বরং খাবার অর্ডার করেন, আগে খাওয়া, পরে কথা
রাফিয়া যেভাবে খাওয়ার কথা বলছে সৌহার্দ্যের মনে হচ্ছে মেয়েটা অনেকদিন ধরে না খেয়ে আছে । আচ্ছা আসলেই কি মেয়েটা এরকম খাই খাই করে ?! কি জানি, হয়তো করে, আবার হয়তো করে না । কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌহার্দ্য রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কি খাবে, বলো ?
- দাঁড়ান, আমি নিজেই অর্ডার দিচ্ছি । এই যে ওয়েটার ভাইয়া এদিকে একটু আসেন তো
রাফিয়ার ডাক শুনে ডেস্কের পাশে দাড়িয়ে থাকা একজন ইউনিফর্মধারী ওয়েটার কাগজ-কলম নিয়ে খাবারের অর্ডার নিতে আসলো । টেবিলে আগে থেকেই একটা মেন্যু কার্ড ছিল । সেখান থেকে পড়ে রাফিয়া রাইস, ভেজিটেবল, দুই পিস বিফ, দুই পিস রেজালা আর দুইটা কোল্ড ড্রিংকস্ অর্ডার করলো । ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই সৌহার্দ্য রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, বাহবা !! এ তো দেখছি মস্ত বড় খাদক !! সৌহার্দ্যের এই মনের কথা রাফিয়া শুনতে পারলে হয়তো সত্যি তুলকালাম বাঁধতো । খানিকক্ষণ নীরবতা ভেঙে রাফিয়াই প্রথম কথা বলে উঠলো,
- নিঃসন্দেহে আমাকে বাচাল আর খাদক বলে মনে হচ্ছে আপনার, তাই না ?
- না, না, কই না তো !! এরকম মনে হবে কেন, আজব তো !!
- মনে হলেও কিছু করার নেই । আমি এরকমই ভালো আছি । আচ্ছা ভালো কথা, আপনি প্রতিদিন আমার বাড়ির সামনে কেন দাড়িয়ে থাকেন, বলেন তো !!
- না, ইয়ে মানে
- আবার মানে মানে করছেন ? আসলে কি চান আপনি ? আমার সাথে কথা বলতে চান নাকি আমাদের বাড়িতে আসতে চান নাকি মায়ের হাতে এক কাপ চা খেতে চান, কোনটা ? একটু ঝেরে কাশুন তো
রাফিয়া উপমাযুক্ত বাক্য বললেও এই কথা শুনে সৌহার্দ্য সত্যি সত্যি কেশে উঠলো, আর সেটা দেখে রাফিয়া হেসে দিলো । রাফিয়ার হাসি দেখে সৌহার্দ্যের নার্ভাসনেস একটু হালকা হলো । এবার সৌহার্দ্য-ই নীরবতা ভাঙ্গলো আগে,
- সত্যি করে বলবো ?
- ও মা, তাহলে কি মিথ্যা বলবেন ?
- আসলে তোমাকে এক নজর দেখার জন্য যাই
- আমাকে রোজ রোজ দেখার কি আছে ? আমি পরী নাকি সেলেব্রিটি ?
- আমার জন্য তো সবকিছুই
সৌহার্দ্য নিজেই যে এরকম কিছু বলে ফেলবে তা বুঝতে পারেনি, হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে । তবে এই কথা বলামাত্রই রাফিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো । সৌহার্দ্য আর দেরী না করে খপ করে রাফিয়ার হাত দুটি ধরে বসলো । ঘটনার আকস্মিকতায় রাফিয়া চমকে উঠলো । আরও খানিকটা লজ্জা এসে যোগ হলো রাফিয়ার আগের অবস্থার সাথে...
- হাত ধরলেন যে... ধরে রাখতে পারবেন তো ?
সৌহার্দ্যের বেশ সাহস চলে এসেছে ইতিমধ্যেই । সেও জবাব দিলো,
- খুব পারবো, ছাড়ার জন্য তো হাত ধরিনি
- হুম, হয়েছে, ডায়ালগ বন্ধ, এবার খাওয়া, তারপর ঘুরাঘুরি । আস্তে আস্তে আবদার মেটাতে মেটাতেই না ক্লান্ত হয়ে যান !!
- তোমার সব আবদার আমার কাছে হুকুম, মেনে নিতে তো বাধ্য আমি
- বাহ, কি ডায়ালগ !! মেয়ে পটাতে তো দেখছি জনাব একেবারেই ওস্তাদ
- হ্যাঁ, সে কি বললেই হলো !! তাই তো তোমার সামনাসামনি এসে এভাবে কথা বলতেই দুই মাসের বেশি লেগে গেলো, তাই না ?
সৌহার্দ্য এমন কথা বলে উঠতেই রাফিয়া আর সৌহার্দ্য দুইজনে মিলেই হেসে উঠলো । ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে, রাফিয়া খাওয়া শুরু করে দিয়েছে কিন্তু সৌহার্দ্য খেতে পারছে না । তার কাছে মনে হচ্ছে সে স্বপ্নের জগতে আছে । মুগ্ধ, স্নিগ্ধ এবং অতি প্রসন্ন বাতায়নের মাঝে ডুবে আছে সে...
০২ রা অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৩
মোশারফ হোসেন ০০৭ বলেছেন: আগে পর্বভিত্তিক লেখা পোস্ট করেছিলাম । সেখান থেকে পড়তে পারেন ।
ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৪২
ওমেরা বলেছেন: এতবড় গল্প একসাথে পড়া যায় না ।