নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।
- কি ব্যাপার উঠছো না কেন ? সকাল কত হয়েছে খবর আছে ?
- ধুর, বুঝো না কেন, মাথাটা ধরেছে খুব......
- দুইদিন ধরে তো একই বাহানা বানাচ্ছো । তার মানে আজকেও বাইরে খেতে হবে, তাই না ?
- ওহ, সামির, কি শুরু করলে সকাল সকাল ? মানুষ কি অসুস্থও হতে পারবে না নাকি ? আজব তো...
- নাহ, আমি কি সেটা বলেছি নাকি !! তুমি তো দুইদিন ধরেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মাথা ধরে বসে থাকো, বলি ঔষুধ খাও না কেন ?
- তোমার কি মনে হয়, আমি ঔষুধ খাচ্ছি না ? ডাক্তার আমাকে যে পরিমাণ হাই পাওয়ারের ঔষুধ দিয়েছে, তুমি খেলে তো বিছানা থেকে উঠতেই পারতে না । সে তো খালি আমি বলে এই সংসার টেনে চলছি কষ্ট করে ।
- কি বলতে চাও ? কষ্ট তুমি একা করো ? আমি করি না ? আমাকে কে ননীর পুতুল ভাবো নাকি তুমি ?
- ওহ, সকাল সকাল কি শুরু করলে তুমি, তোমার যন্ত্রণায় তো মাথা ব্যাথাটা কমার বদলে আরও বাড়ছে...... এই তুমি যাও তো, ফ্রেশ হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নাও । আমি দেখি, একটা ডিম অমলেট করে দিতে পারি কিনা, ফ্রিজে ব্রেড আছে, খেয়ে যেতে পারবা......
আবার ঐ ডিম অমলেট - মনে মনে বলতে থাকে সামির । বিয়ের এই পাঁচ বছরে ম্যাডাম দুইটা জিনিসের উপর বেশ পিএইচডি করেছেন । এক, বাহানা তৈরি করা আর দুই, ডিম অমলেট । যখনই কিছু দ্রুত তৈরি করে দিতে বলবো, ম্যাডাম দেখা যাবে ডিম অমলেটের অন্য কোন রেসিপি নিয়ে হাজির । ধুর, ডিম অমলেট খেতে খেতে মুখটাই মুরগীর মত হয়ে গেছে । এভাবেই বিড়বিড় করতে করতেই টয়লেটে ঢোকে সামির ।
বন্যার সাথে সামিরের বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে কয়েকদিন আগেই । প্রেমের বিয়ে, তারপর আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে । এমন না যে বন্যা বিয়ের আগে বলেনি যে ও রান্না করতে পারে না কিন্তু বিয়ের এত বছর পর সবকিছুতেই প্রব্লেম । হ্যাঁ, এমনটা হয়ই । এই বিয়েটা পারফেক্ট ছিল না সত্যি, কিন্তু ভালোবাসাটা ঠিকই ছিল, এত বছর পর সেই ভালোবাসাটাই কেমন জানি ফিকে হয়ে যাচ্ছে । এই পাঁচ বছরে সংসার তাদের দুই বছরের একটি মেয়েও আছে, নাম তিথি । মেয়েটা অত্যন্ত চুপচাপ, বাবা-মায়ের ঝগড়ার সময় তো আরও চুপচাপ । আলাদা রুমে ঘুমালেও বাবা-মায়ের ঝগড়ার ব্যাপারটা কানে গেলে বিছানার মাঝেই জড়সড় হয়ে যায় ও । অথচ এক বছর আগেও এত ঝগড়া হতো না সামির আর বন্যার মাঝে । এখন সময়টাই বোধ হয় খারাপ ।
বন্যা একটা ছোট কিন্টারগার্ডেন স্কুলের টিচার, আজ প্রায় তিন বছর ধরে । সামির একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে চার বছর ধরে, এর আগে ছোটখাট একটা ব্যবসা ছিল ওর । সাইবার ক্যাফের । সেই সাইবার ক্যাফেতেই প্রথম পরিচয়, এরপর প্রেম আর সবশেষে পরিণয় । বাবা-মায়ের অমত ছিল দুই পরিবারেই কিন্তু ওরা নিজেদের ছোট্ট সংসারে সবকিছুই মানিয়ে নিয়েছিল কিন্তু এখন কেন জানি সবকিছুই অন্য রকম......
সামির ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দেখে বন্যা একটা ডিম অমলেট বানিয়ে আবার বিছানায় শুইতে গেছে । সামিরের দুই রকম অনুভূতি হচ্ছে একই সাথে । একটি হচ্ছে রাগ, কারণ সে আশা করেছিল বন্যা ডিম অমলেট বানিয়ে তার জন্য বসে থাকবে আরেকটি হচ্ছে কষ্ট, বন্যার এই অসুখটা তাকেও ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে । কিন্তু কেন জানি লজ্জায় বলতে পারছে না । তাদের সম্পর্কে কেন জানি আগের সেই ছোটখাট ভালোবাসার মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে । যা রয়ে গেছে সেটি হচ্ছে বাদনুবাদের মুহূর্তগুলো । যাই হোক, সামির ভাবছে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কারণ বন্যাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে । বন্যাকে সরাসরি জিজ্ঞেস না করলেও ও জানে বন্যার এই অসুখ একেবারেই খামখেয়ালী নয় বরং ও এই সমস্যার কারণে তিনদিন স্কুলেও যায়নি । বন্যা যখন ফোনে কথা বলছিল স্কুলের হেডম্যাডামের সাথে, তখন ও ওয়াশরুম থেকে শুনতে পেয়েছে । তাছাড়া তিথিও কেমন জানি আজকাল আরও চুপচাপ হয়ে গেছে, আগের মত প্রাণোচ্ছল নেই সে । এই কথা ভাবতে ভাবতেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো সামির ।
অফিসে পৌছতে না পৌছতেই হাসু ভাবীর ফোন । হাসু ভাবী সামির আর বন্যার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে । হাসু ভাবী কেন ফোন দিতে পারে !!! সামির বেশ অবাক হয়েই ফোন ধরলো ।
- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম ।
- (হাঁপাতে হাঁপাতে) ওয়ালাইকুম আসসালাম । সামির, বন্যা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, এখন অজ্ঞান । আমি ওকে সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি । তুমি এক কাজ করো, জলদি একবারেই হাসপাতালে চলে এসো । তিথি কে নিয়ে ভেবো না, ওকেও আমি নিয়ে এসেছি । তোমার বেলাল ভাইও হাসপাতালে আছে, ওই মূলত দৌড়াদৌড়ি করছে এদিক ওদিক । আমরা কোনরকমে একটা কেবিন ম্যানেজ করেছি । তুমি জলদিই চলে আসো ।
হাসু ভাবীর এই কথাটুকু কোনরকমে ধৈর্য্য সহকারে শুনলো সামির । হাসু ভাবী ফোন কাটতেই অফিসের সামনেই ধপাশ করেই বসে পড়লো সামির । তার মাথা ঘুরছে প্রচণ্ড রকম, মনে হচ্ছে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে । হয়তো শুয়েই পড়তো যদি না অফিসের দারোয়ান এসে তাকে ধরে না ফেলতো । এই খবর অফিসের মধ্যে ছরিয়ে যাওয়াতে বেশ কয়েকজন অফিস থেকে বেরিয়ে এসে সামিরকে অফিসের মধ্যে নিয়ে গেলো । বেশ অনেকক্ষণ মাথায় পানি দেওয়ার পর ঠিকমত হুশ ফিরলো তার । হুশ ফেরার পর সামিরের প্রথম কথা হলো, "বন্যার কি খবর এখন ?"
অফিসের বেশ কয়েকজনের সাহায্য এবং একজনের প্রত্যক্ষ সাহায্য মানে গাড়িতে করে যখন হাসপাতালে পৌঁছলো, তখন আরেকবার মাথা ঘুরান দিলো সামিরের । দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর, তবুও কোনরকমে হাসপাতালের ভিতর ঢুকলো ও । সামিরের সাথে অবশ্য অফিসের আরও দুইজন আছে । সামিরের সাথে তারা দুইজনও ছুটি নিয়ে এসেছে । একজন সামিরের এসিসট্যান্ট শিউলি আর একজন কলিগ জামিল সাহেব । জামিল সাহেবই মূলত সামিরকে ধরে রেখেছেন, যদি আবার মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে, এই ভয়তেই । সামির কোনরকমে কেবিন পর্যন্ত পৌঁছলো । বন্যা শুয়ে আছে বিছানাতে । তাকে ঘিরে অনেক মানুষ আছে কেবিনটাতে । বন্যার বেশ কয়েকজন কলিগ, হাসু ভাবী, বেলাল ভাই, আরও তাদের বিল্ডিং এর বেশ কয়েকজন । সামির আসাতে সবাই সামিরের জন্য বন্যার পাশে জায়গা করে দিলো । তিথিকে হাসু ভাবী কোলে নিয়ে রেখেছে । এমনিতেই মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ, হাসপাতালের এই অবস্থা তার মধ্যে ভীতিও দারুন বাড়িয়ে দিয়েছে । বোঝা যাচ্ছে কারণ মেয়েটার চোখ বেশ বড় বড় হয়ে আছে । সামির বন্যার পাশে এসেই ধপাশ করে বসে পড়লো বন্যার পাশে । বন্যার অবশ্য জ্ঞান ফিরে এসেছে আরও ঘণ্টা-খানেক আগেই । সামিরকে দেখে বন্যা মুখ ঘুরালো । তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আর চিবুক বেয়ে পানি পড়ছে । বন্যা চায় সামির যেন এই কান্না না দেখে । সামির চক্ষুলজ্জা ভুলে বন্যার হাত ধরে ফেললো সবার সামনেই । ঘটনার আকস্মিকতায় বন্যা কান্নারত অবস্থাতেও সামিরের দিকে চোখ ঘুরালো । মানুষটাকে বেশ বিধ্বস্ত লাগছে । আসলে কে যে রোগী, সেটাই এখন বুঝা মুশকিল । রুমের নিরবতা ভেঙে প্রথম প্রশ্ন অবশ্য বন্যাই করলো সামিরকে ।
- কি হয়েছে তোমার ?
- কই, কিছু না তো ।
- চোখ ফুলা কেন ? আবার চোখ-মুখ এরকম লাগছে কেন ? কি হয়েছে খুলে বলো তো......
- আমার কি হবে, হাসপাতালের বিছানায় কি আমি শুয়ে আছি ? আজব ।
সামিরের কথা বলার ধরন এখনও আগের মতই আছে, বন্যার তাই ভেবে হাসি এসে গেলো । তাই হঠাৎ-ই সে ফিক করে হেসে দিলো । শুধু সামির না, রুমের কারোরই বন্যার সেই হাসি চোখ এড়ালো না । তবে সামির একটু অবাক হলো বেশি ।
- কি ব্যাপার হাসছ যে !!
- না, এমনি, তোমাকে আমার চেয়েও বেশি অসুস্থ দেখাচ্ছে । ভাবতেই হাসি চলে আসলো ।
- আচ্ছা, তিথির কথা একবারও ভাবলে না ?
- ও মা, আমি কি এই সমস্যা ইচ্ছা করে বাধিয়েছি ? আর তাছাড়া তিথির দুষ্টু আব্বু আছে কি করতে, তিথির আবার চিন্তা কিসের ?
- আমি দুষ্টু না ? আর ম্যাডাম খুব ভালো ?
- ও মা, তুমি কি এখানে ঝগড়া করতে এসেছো নাকি ?
তাদের কথা বলার মধ্যবর্তী সময়েই হাসু ভাবী বুদ্ধি করে সবাইকেই একে একে রুম থেকে বের করে দিয়ে নিজেও তাদের দুইজনকে একা রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো । অবশ্য তিথিকে রেখে গেলো বাবা-মায়ের কাছে ।
- তিথি মামনি, তুমি কি কান্না করেছো নাকি ? তোমাকে এরকম লাগছে কেন ?
মামনির এরকম প্রশ্ন শুনে তিথি কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো । তিথি ইদানিং তার বাবা-মা দুইজনকেই অনেক ভয় পায় । আবার তার ভয় লাগে, এই বুঝি বাবা-মা ঝগড়া শুরু করে দিলো । তাই সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো । সে মনে মনে আশা করছে, পাশের বাসার হাসু অ্যান্টি তাকে নিয়ে যাবে বাইরে । তার ভাগ্য হয়তো ভালোই, একটু পর হাসু ভাবী নিজে এসেই তিথিকে কোলে নিয়ে আবার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো । হাসু ভাবী যাওয়ার পর আবার বন্যাই প্রথম কথা বললো......
- শোন সামির, লুকোচুরির কিছু নেই । আমার ব্রেইন ক্যান্সার । ডাক্তার দুইবার টেস্ট করে কনফার্ম করেছে । আমার হাতে আর বড়জোর ছয় মাস সময় আছে ।
কথা বলার মাঝেই বন্যার মুখ চেপে ধরলো সামির । ও আর শুনতে পারছে না । এগুলো কি বলছে বন্যা ? ও কি পাগল হয়ে গেছে নাকি ? কতটা স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলছে ও !! অথচ সামিরের মনে হচ্ছে কেউ একজন তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে দিয়েছে । বন্যা না থাকলে ও কিভাবে বাঁচবে, ও জানে না । আর তিথি !! বন্যা যদি না থাকে, সামির কোনদিন দ্বিতীয় বিয়ে করবে না, তাহলে তিথির কি হবে ? ওকে কে দেখবে ? আর মা ছাড়া বড় হওয়া কি অতটুকু ছোট মেয়ে সহ্য করতে পারবে ? না, সব চিন্তা-ভাবনা উলটপালট হয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে এই সবই একটি বড় দুঃস্বপ্ন । ঘুম ভাংলেই শেষ । কিন্তু না...... এইগুলা সবই সত্যি । বন্যা আসলেই সত্যি কথা বলছে !! কিন্তু ও কিভাবে জানলো ? ওর তো জানার কথা না !! তাহলে কি হাসু ভাবীই ওকে সব বলে দিলো, নাকি ও ডাক্তারকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল ? সামিরের মাথায় কিছুই ঢুকছে না ।
- শোন, সামির, এখন এমনভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না । আমি চাই তুমি আমার বাবা-মা আর তোমার বাবা-মাকে খবরটা দাও দ্রুত । তারা আমাদের যতই ঘৃণা কিংবা অপছন্দ করুক, আমার মৃত্যুর খবর শুনলে না এসে পারবে না । আর আমি যাওয়ার পর তোমার তিথিকে একা মানুষ করতে হবে না, ওর দাদা-দাদি এবং নানা-নানীও তোমার সাথে সাথে ওকে দেখাশুনা করবে । আর একটা কথা, এই ছয়মাস কিন্তু তোমার এই মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটাকে সহ্য করতে হবে, আবদার মেটাতে হবে । তুমি কিন্তু না করতে পারবা না !!
বন্যার কথা শেষ না হতেই সামির কান্নায় ভেঙে পড়লো । এই একটা মানুষকেই নিয়ে যেখানে ও নতুন সুখের জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্ন আজ ধূলায় মেশানোর পথে । সামিরের কান্না দেখে বন্যা মুখ ঘুরিয়ে ফেললো । সামিরের কান্না দেখতে তার কষ্ট হচ্ছে, তার চোখও আবার ছলছল করছে । তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো যেখানে সে আর কান্না করে কাটাবে না ভাবছে কিন্তু মনে হয় তার এই ইচ্ছা পুরন হবে না ।
©somewhere in net ltd.