নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

A learning Advocate!

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

An Ordinary God

১৬ ই আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৩:২৮



১..
কাক বাসা-বাড়িতে বা নিচু গাছে বাসা বাধে না। অথচ জাম্বুরা গাছে কাকের বাসা, কাক বাচ্চা ফুটিয়েছে। বাচ্চা ২ টা সারাদিন ক্যা ক্যা করে। বাচ্চা তিনটাও হতে পারে। আজকে সকাল থেকে কাকের দল বাড়ির উপরে উড়াউড়ি করছে, একটা দুইটা না; এক ঝাক কাক!
যে বাড়ির উপরে কাক উড়ে সে বাড়িতে কেউ না কেউ মারা যায়। এই বাড়িতে মোহর উদ্দিন বয়স্ক, আর কেউ অসুস্থও নেই। তবে মারা যাবেটা কে? উনার মা-বাবা আগেই ওপারে চলে গেছেন।স্ত্রী মারা গেছেন তাও বছর খানেক আগে। মরে যাবার সিরিয়ালে তিনিই এগিয়ে। তিনি বিরক্ত হলেন।
তিনি দুই তিনবার কাক তাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
"হুস হুস, যা যাহ। দূরে গিয়ে মর।"
ছররা বন্দুকটা থাকলেও হত, একবার গুলি ফোটালেই কাকের খেলখতম। তিনি আশেপাশে তাকালেন। সামনে বিশাল ধানের খেত; কামলারা ধান কাটছে , পাশে মজা পুকুরে হাসের দল ডোবা ডুবি করছে, আরেক পাশে মেহগনি বন। কেউ-ই নেই, তিনি কাকে ডাকবেন?

বাড়ির দখলে(বাড়ির পেছনে লাগোয়া খালি জায়গা) তেপায়া-আরাম কেদারা বসিয়ে মোহর উদ্দিন বই পড়ছেন। টেবিলে তিনটা পিরিচে কলা, পাটিসাপটা আর পোয়া পিঠা। তিনি পিঠা ছুয়েও দেখেননি, মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন। বইয়ের নাম "বোবা কাহিনী"। মাথার উপরে জাম্বুরা-নিমগাছের মিশেল ছায়া। এই বয়সে নিমের ছায়া উপকারী, অসুখ-বিসুখ দূর করে। তিনি অবশ্য আরাম পাচ্ছেন না। পুকুরে হাসের প্যাক প্যাক, জাম্বুরা গাছে কাকের কা কা! বিরক্ত হয়ে তিনি বই থেকে মাথা তুললেন!
সামনে দাঁড়িয়ে তার বড় মেয়ে মিনি।
:আব্বা, চাও খাও।
:দে, তুই আজ কলেজে যাসনি?

:আব্বা, আমার কলেজ শেষ! আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার আজকে রেজাল্ট দিয়েছে!
মিনি খুশিতে ঝলমল করছে।
মোহর উদ্দিন কিছুই জিজ্ঞের করলেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে বইয়ে মনোযোগ দিলেন।
:আব্বা, আমি চান্স পেয়েছি।
মোহর উদ্দিন 'ও আচ্ছা' বলে আবার বইয়ে ডুব দিলেন।

মিনি একটি দূরে চলে গেল। দূর থেকে আব্বাকে ভালো দেখা যায়! আব্বা যখন গাছের নিচে বসে বই পড়ে, দুর থেকে দেখলে মনে হয় গহীন বনে কোন সাদা-চুলো সুফি প্রার্থনা করছে। মিনির বড় ভালো লাগে।
পুকুর পাড় দিয়ে অরুণ, বরুণ দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
:আব্বা আমরা ফুটবল খেলায় জিতছি। অরুণ একটা গোল দিছে। আমি দিতে পারি নাই।
মোহর উদ্দিন অরুণকে কোলে নিয়ে আকাশে ছুড়ে দিয়ে আবার লুফে নিলেন।
বরুণের গালে চুমু খেয়ে বললেন,'তুমি মন খারাপ কইরো না, আব্বা। পরের ম্যাচে তুমিও গোল করবা।'
:আব্বা, নতুন বলডা তো ফুইট্টা গেল।
:তাইলে লও হাটে গিয়া নতুন বল কিইন্না আনি।
মোহর উদ্দিন দুই পুত্রকে নিয়ে হাটে চলে গেলেন।

মোহর উদ্দিন আর ছকিনা বেগমের তিন পুত্র, দুই কন্যা। বড় ছেলে সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারপর মিনি। মিনির পর নিলুফা, নিলুফার পরে জমজ পুত্রদ্বয় অরুণ-বরুণ। অরুণ, বরুণ এর জন্মের সময় ছকিনা বেগম মারা গেলেন। তাও ১২ বছর আগের কথা! তারা দুইজন ৭ম শ্রেনীতে পড়ে। নিলুফা এবছর এসএসসি পাস করেছে, ও কলেজে ভর্তি হবে।
ছকিনা বেগমই ছেলেপেলেদের পড়াশোনার খোঁজ নিতেন।তিনি মারা যাবার পর মোহর উদ্দিন খেয়ালি হয়ে পরলেন। বিশেষ করে মিনির দিকে।
বলাই বাহুল্য, মিনি ছাড়া মোহর উদ্দিনের চার সন্তান দেখতে ভালো। মিনিই কেবল একটু চাঁপা রঙের। ছকিনা বেগম যদ্দিন বেচে ছিলেন তদ্দিন এই নিয়ে উনার চিন্তার শেষ ছিল না! তবে সিরাজ বোনের রূপের সহজ বর্ণনা দেয়,'কালী কালো, কৃষ্ণ কালো,,,, '
ভাইয়ের কাছে এহেন অপমানে মিনি সবসময়ই কান্নাকাটি করতো। এখন আরও যোগ হয়েছে দুই ভাই!

যাইহোক, অলক্ষুণে কাকের ডাক বা অসাবধানতা; যে কারণেই হোক মোহর উদ্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন।
অতি সাধারণ দূর্ঘটনা!নারায়ণখোলা বাজারে রাস্তায় ভীড়ও নেই। তিনি দুই পুত্রের হাত ধরে রাস্তা পাড় হচ্ছিলেন। একটা টেম্পু এসে ধাক্কা দিল, তিনি ড্রাইভারের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আবার হাঁটা দিলেন। ৮/১০ কদম হেঁটে ভাঙাপুল পর্যন্ত গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পুলের পাশে মুরগির দোকানে মুরগিগুলো হুটোপুটি করল, রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে, হর্ণ বাজিয়ে টেম্পু, সিএনজি, নসিমন চলে গেল; কিন্তু তিনি চোখ খুললেন না। কোন গুরুতর আঘাত না, রক্তপাত না; অথচ তিনি মারা গেলেন।

সেদিন থেকে ৭ দিনপরই, অভিভাবকহীন পরিবারটি সিদ্ধান্ত নিল তারা সবাই ঢাকা চলে যাবে। নিলু হলিক্রস কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অরুণ-বরুণও ফার্মগেটে কোন স্কুলে ভর্তি হবে। যেহেতু, সিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে; নিলু কলেজে পড়বে আর অরুণ, বরুণ ছোট; তাই তাদের দেখাশোনা করার জন্য মিনি আপাতত বাসায়ই থাকবে। যাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত তাকেই কেবল কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। কেউ জানতেও চাইল না, মিনি চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চায় কিনা!
বাসা থেকে কাছে এইজন্য মিনি তেজগাঁও কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলো।

২..
টঙ দোকানে অরুণ বিড়িটা মাত্র জ্বালিয়েছে। বরুণ তাড়া দিচ্ছে,"ভাই, তাড়াতাড়ি চল। দুধ নিয়ে গেলে বুবু পায়েস রান্না করবে। তারপর বুবু একটু সাজবে। চল ভাই, তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।"
"অত চিন্তা করিস নাতো। নে তুই এক টান দে। এক টানে মেজাজ ফুরফুরা, সব চিন্তা শেষ।দে এক টান, দিবি!"
অরুণ বরুণের দিকে বিড়ি এগিয়ে দেয়। বরুণ দূরে সরে যায়।
পেছনে এক লোকের সাথে ধাক্কা খায়।
"ভাই, মোহর নিবাস কোথায় বলতে পারেন?"
অরুণ চট করে বিড়ি ফেলে দেয়।
"জ্বী, আমাদের বাসা। কাকে চাই বলুন তো?"
"জ্বী, আমরা পাত্রী দেখতে এসেছিলাম।"
অরুণ, বরুণ তাদের সালাম দেয়। বাসায় নিয়ে আসে।

বাড়ির নাম মোহর নিবাস। তেজগাও কলেজের পাশে ডানদিকের গলিতে এগিয়ে গেলে ৫ নম্বর একতলা বাসা; গেটে ঝেকে আছে বাগান বিলাস, লাল বাগান বিলাস। পশ্চিমের কোণায় পাশাপাশি একটা জাম্বুরা একটা নিমগাছ লাগানো; নিচে সিমেন্টের টেবিল আর প্লাস্টিকের দুইটা চেয়ার ফেলে রাখা। অপরিষ্কার, অনেক দিন কেউ বসে না! কাগজি লেবুর গাছ লতিয়ে গেছে, লেবু নিচে পরে পঁচে গেছে। উঠোনে চড়ছে চারটি তিতির, তিনটা রাজহাঁস। মর্দা রাজহাঁসটি অপরিচিত লোক দেখে তেড়ে এলো!


পাত্রী দেখা উপলক্ষে ঘর পরিষ্কার করা হয়েছে, ঘর বলতে বসার ঘর আরকি! বসার ঘরে অরুণ, বরুণ থাকে। এই বাসায় তিনটা লিভিং রুম। একটাতে বড় ভাই সিরাজ, অন্যটাতে নিলু, আরেকটাতে মিনি থাকে।
সোফায় নতুন কুশন লাগানো হয়েছে, একটা নতুন ফুল দানি কেনা হয়েছে। ফুলদানিতে তাজা ফুল, রজনীগন্ধা।
মিনির বিয়ে হয়ে গেলেই তার রুম অরুণ পাবে, সে পাক্কা ২ মিনিটের বড়। সিরাজ বলেছে বসার ঘরে বরুণকেও আলাদা রুম করে দিবে।

বরুণ রুমে ঢুকেই রেগে গেল। নিলু যে শাড়িটা পড়ে আছে, সেটা বুবুর পড়ার কথা ছিল। বুবুকে এই শাড়িতে ফর্শা দেখা যায়।
"নিলু আফা, তুই এ শাড়িটাই পরলি কেন? বিয়ে কি তর, নাকি বুবুর? তর কি জিবনেও বুদ্ধি হবে না। আর তুই এমনিতেই সুন্দরী।"
অরুণও একমত, "তুই বুবুর শাড়ি পড়লি কেন, আফা?"
নিলুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মেকাপ করছে।

দুধ আনতে দেরি হয়েছে, পায়েস রান্না হয়নি। মিনি গোসল করতে পারেনি। সে চুলার পাশে দুধ নাড়ছে। আজকে আনন্দের দিনে, আনন্দের দিনে মিষ্টিমুখ করা লাগে!

সিরাজ পাত্রী দেখতে আসা লোকদের সাথে কথা বলছে। অরুণ, বরুণ খাবার এগিয়ে দিচ্ছিল। তাদের হাত থেকে খাবারের পাত্র নিয়ে নিলু এগিয়ে গেল।

মিনি বেগুনি শাড়িটা পড়েছে। ওর চুল ভেজা, মুখে একটু পাউডার দেয়ারও সময় নেই!লোকগুলো কখন এসেছে! কতক্ষণ বসে থাকবে?
বরুণ রাগল করলো,"বুবু একটু মেকাপ দে। তোকে সুন্দর লাগবে।"
"এমনে সুন্দর লাগছে না বুঝি!"
"তা লাগে, তবে পাউডার দিলে আরও সুন্দরী লাগবে!"

মিনি সোফায় গিয়ে বসতেই, নিলু ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ল।
লোকগুলো প্রশ্ন করতে শুরু করলো।
:আপনার নাম কি?
:জ্বী, মমতাজ খান মিনি।

:আপনি কদ্দুর পড়েছেন?
: তেজগাঁও কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে, ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছি।

:বাহ অনেক পড়েছেন। চাকরি করেছেন/করছেন?
:জ্বী, একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছি কিছু দিন। তারপর পরিবারের প্রয়োজনে.....

বয়স্ক লোকটি একটু নড়েচড়ে বসলেন।
:আচ্ছা, আপনার মেয়ে কথা বলতে পারে না? আপনার মেয়েতো পিছনে দাড়িয়েই আছে, তাকে উত্তর দিতে দিন।
সিরাজ, মিনি হকচকিয়ে গেল। ঘটনা বুঝতে পেরে মিনি লজ্জায় মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সিরাজ কথা বললো।
:জ্বী মানে, মিনিই পাত্রী। যে দাঁড়িয়ে আছে সে নিলু, আমাদের ছোট বোন।
: দু:খিত! আমরা নিলুকে কনে ভেবেছি!

মাঝখানে বোধহয় পাত্র বসেছিল। সে দাঁড়িয়ে গেল।
:তবে আমার নিলুকেই পছন্দ। আমি নিলুকেই বিয়ে করতে চাই।

মোহর নিবাসে সেদিনই বিয়ে হলো। পাত্রপক্ষ পুরো বাড়ি লাল মরিচ বাতিতে সাজিয়ে দিল। তাদের পক্ষের কয়েকজন লোক এল, গয়না নিয়ে। সারা শরীরে গয়না পড়ে নিলু খুশিতে ঝলমল করছে।
মিনি তাকে দেখতেও পেল না, তার কত কাজ!বাড়িতে প্রথম বিয়ে; আয়োজনের কমতি হওয়া যাবে না। সে মন দিয়ে রান্না করলো। আত্মীয়স্বজন তার রান্নার প্রশংসা করলো। সবাই পায়েস পছন্দ করলো! শেষে কিনা পায়েসই কম পরলো!
রান্না শেষ করে, মিনি সবাইকে খাইয়ে এসে দেখে নিলু গাড়িতে বসে গেছে, গাড়ি এক্ষুনি ছেড়ে দিবে। সে বারান্দা থেকে নিলুর মুখটা একটু দেখল, বাহ! কি সুন্দর লাগছে নিলুকে।আর দুজনকে কি দারুণ মানিয়েছে!

নিলু চলে গেছে, সে গোলাপি শাড়িটা রেখে গেছে। যেটা পড়লে মিনিকে ফর্শা দেখায়। পাখি উড়ে যায়, রয়ে যায় পাখির পালক!

মোহর নিবাস শান্ত!আচ্ছা, মোহর উদ্দিন জীবিত থাকলে আজকেও কি মিনিকে এড়িয়ে যেতেন? যেভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে অরুণ, বরুণ, সিরাজ! সিরাজ ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে।
অরুণ বারান্দায় সিগারেট টানছে! বরুণ কোথায়?
মিনি শাড়িটা ছড়িয়ে দিতে বারান্দায় গেল!
অরুণ সিগারেট ফেলে দিল?
:বুবু, তোর খারাপ লাগছে?
:খারাপ লাগবে কেন? বিয়ে-শাদি আল্লাহর ইচ্ছেতে হয়।আর খারাপ লাগার সময় কই, কত কাজ! সারা বাড়ি নোংরা হয়ে আছে।

মিনি নিলুর ঘরে উঁকি দিল। বরুণ শুয়ে আছে।
:অরুণ কবে থেকে সিগারেট খায়রে? জানিস তুই?
:জানি না, বুবু। তুই যা তো, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

:তুইয়ো খাস নাকি? কিরে বরুণ তুই কাঁদছিস! তোর তো খুশি হবার কথা তোরা আলাদা ঘর পেলি।
বরুণ মিনিকে জড়িয়ে ধরলো,"তোর জন্য খারাপ লাগছে, বুবু।তুই মন খারাপ করিস না, আমি তোর জন্য ভালো পাত্র নিয়ে আসবো।"
"আমি কই মন খারাপ করছিরে, পাগল। মন খারাপ করছিস তোরা। আমার ভালোই লাগছে, নিলুর বিয়ে হয়ে গেল। এখন ভাইয়ার বিয়ে, তারপর তোদের!"

৩..
মেঘে মেঘে অনেক বেলা বয়ে গেছে! সিরাজ বিয়ে করেছে, বৌ ডাক্তার। সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সিরাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিশনাল ডিরেক্টর, বাসায় কেবল ঘুমাতে আসে! সারাদিন এত ব্যস্ত!
ওদের একটা ছেলে হয়েছে একদম মোহন উদ্দিনের মত দেখতে, গাঢ় কালো চোখ, তামাটে চুল, চিকন ঠোঁট, ধবধবে গায়ের রঙ! হাটেও মোহর উদ্দিনের মতো, অত কথা বলে না।
বাবা-মা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে, ছেলে মাহিরকে দেখবে কে? বংশের একমাত্র পুত্রকে তো আর হেলাফেলা করা যায় না। অগত্যা মিনি তেজগাঁও কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে ভাইয়ের ছেলেকে দেখাশোনা করে। তাও ৫ বছর চলে গেছে। আগামী বছর মাহির স্কুলে যাবে!

ব্যাংক কলোনীতে এত বড় বাসায় সবই আছে, তবে মিনির নিজের কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে এত একা লাগে! ফার্মগেটের বাসায় অরুণ, বরুণ একাই থাকে। মিনি মাঝেমধ্যে দেখতে যায়। মিনি খুব বিরক্ত হয়, ওরা ঘর এত নোংরা করে রাখে।
অরুণ বরুণ বুবুর জন্য পাত্র আনতে না পাড়লেও নিজেদের জন্য স্কলারশিপের বর ঠিকই এনেছে।
ওরা আগামী মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে, টাকা প্রয়োজন। তাই নিয়ে আজকে মিটিং!

পাঁচ ভাই-বোন খাবার টেবিলে বসেছে। নিলুর মেয়ে আলাইনা, সিরাজের ছেলে মাহির বারান্দায় খেলছে। সিরাজের স্ত্রী আসেনি, এইসব ঝামেলায় সে নেই।

নিলু কথা বললো, "বুবু, বাসা এত নোংরা করে রেখেছিস কেন? থাকিস তো দাদার বাসায়, কোন কাজ তো নেই। মাঝেমধ্যে এসে বাসা পরিষ্কার করতেও তো পারতি।"
কেউ কিছু বললো না।

সিরাজ: আমার ছোট চাকরি, তোদের ভাবী এত পরিশ্রম করে। বাড়ির জমি, ফার্মগেটের বাসা বিক্রি করে কিছু টাকা পেলে বনানীতে ফ্ল্যাট কিনতে পারি। মাহিরকে মানুষ করতে হবে তো, মিনি তো সারাজীবন আমাদের সাথে থাকতে পারবে না।এখন ছেলেপেলে মানুষ করা যে টাফ! মাহিরকে ভালো স্কুলে দিতে হবে।
নিলু: আলাইনার বাবার ব্যবশা ভালো যাচ্ছে না। আর আমার নিজের হাতেও কিছু টাকা পয়সা থাকা উচিত। চল গ্রামের বাড়ির জমি, ফার্মগেটের বাসা বেঁচে দিই। সবাই ভাগাভাগি করে টাকা নিই। আমি নিজেও একটা পার্লার দিতে চাই।
অরুণ: হ্যা, তাই হোক। আমাদের বিদেশে পড়াশোনা, সেটেল হতেও টাকা লাগবে।
বরুণ: ভাগাভাগি করে যে টাকা পাবো তাতে আমাদের হবে না। পড়াশোনা শেষ করতে পারবো, সেটেল হতে পারবো না।
মিনি: আমি ভেবেছিলাম কি; মাহির স্কুলে ভর্তি হবে;তোরা চলে গেলে আমি গ্রামে চলে যাবো। বাপের ভিটায় শেষ জীবন কাটিয়ে দিলাম আরকি।
কেউ কিছুই বলল না! মিনি সবার দিকে তাকাল, কারো সম্মতি আছে কিনা বোঝা গেল না!

টেবিলে খাবার সাজানো-মুরগির ঝোল, গরুর রেজালা, করলা ভাজি, পাতলা ডাল আর টক-মিষ্টি দই।ভাই-বোন সবাই এগুলো পছন্দ করে। কেউ খাবার খাচ্ছে না।

সিরাজ: কেন তোকে গ্রামে থাকতে হবে? তুই ঢাকায় থাকবি।
নিলু: আমরা সব জমি বিক্রি করতে চাই, বুবু। আর আমাদের গ্রামে থাকা বা যাবার ইচ্ছে নেই। গ্রামে জমি রেখে লাভ কি?
অরুণ: হ্যা, সব জমি বিক্রি করে ভাগাভাগি করলেও আমাদের আরও কিছু টাকা লাগবে। বুবু, তুই ঢাকায় থাক।একটা কাজ জুটিয়ে নে।পারবি না?
মিনি: এই বয়সে আমাকে কে চাকরি......
বরুণ: বুবু, চাইলেই তুই একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবি। আমি জানি, বুবু!
মিনি: আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আগে সবাই খেয়েনে।

মিনি অরুণ, বরুণকে এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে এসেছে। সব জমিজমা বিক্রি হয়ে গেছে!
নিলু টাকা নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চট্রগ্রাম চলে গেছে। সে আসেনি।
সিরাজ জমি দেখতে রূপায়ন সিটি, উত্তরাতে গেছে। খুবই ভালো জমি, হাত ছাড়া করা যাবে না।আজকে দেখে ফাইনাল করতে হবে। সে, মাহির, ভাবী জমি দেখতে গেছে। তারাও আসেনি।
মিনি তার ভাগের টাকা অরুণ, বরুণকে দিয়ে দিয়েছে। ওরা বিদেশে পড়াশোনা করুক, নিজের জায়গা তৈরি করুক। টাকাটা ওদেরই দরকার!
"বুবু, ভালো থাকিস। তোর কোন সমস্যা হলে জানাবি। আমরা তোকে দেখব, তোকে নিয়মিত টাকা পাঠাবো।দেখিস, তোর কোন সমস্যা হবে।"
"আমি ভালোই থাকবো। আমার কি ঝামেলা, আমি একা মানুষ। তোরা বিদেশে যাচ্ছিস, তোরা ভালো থাকিস!"
মিনি দুই ভাইয়ের কপালে চুমু খেলেন।

অরুণ, বরুণ চলে যাচ্ছে। ওরা একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। তাকালে দেখতে পেত, মিনি সেই শাড়িটা পড়েছে! মিনিকে কি সুন্দর লাগছে!
মিনি চেয়ারে বসে নিজের চোখ মুছল।
একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন।
"আপা, খারাপ লাগছে? ভাইয়েরা চলে গেছে, তাদের জন্য কাঁদছেন?"
"না আপা, আমার নিজের জন্য কাঁদছি!"

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:১২

করুণাধারা বলেছেন: গল্প ভালো হয়েছে, সাবলীল ভাবে এগিয়েছে তাই পড়তে ভালো লেগেছে। কিন্তু মুখচোরা, পরিবারের জন্য আত্মবিসর্জন দেয়া টাইপ মেয়েদের নিয়ে গল্পের থিম ভালো লাগে না।

০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৬

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: বাহ, আপনি মন্তব্য করেছেন।
আসলে সমাজে এমন প্রতিনিয়তই ঘটে।

অনেকদিন প্লট মাথায় ছিল, শেষ করতে পেরেছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.