নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১....
বাহ! সুন্দর ছবি। ময়লা তুরাগে টলটলে পানি, সারি সারি নৌকা ভাসছে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নদের পানি নোংরা হয়ে যায়, গন্ধ ছড়ায়।তখনও এই সৌন্দর্য থাকে। তবে নৌকাগুলোকে বেনিআসহকলা অনুযায়ী রঙ করলে আরও দারুণ লাগতো। ডা. নাফি প্রতিদিন এই সৌন্দর্য দেখেন। তার ঘোর কাটে না,তিনি প্রতিদিন নতুন করে আশ্চর্য হন।
প্রতিটি জিনিসই নদীর মত। আসল সৌন্দর্য দূর থেকে, টলটলে কালো জল, বাহারী রূপ! আর কাছে গেলেই খুতগুলো চোখে পরে, গন্ধ পাওয়া যায়।
আইচি হাসপাতাল, ১৪৩ নম্বর রুম। ডা. নাফি গত চার বছর ধরে এই রুমে বসেন। জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়! উনার দারুণ লাগে।
উনার মনে হয় সবচেয়ে উত্তেজনাকর কাজ হল নৌকা বা রিকশা চালানো। প্রতিবার নতুন নতুন যাত্রী। ডাক্তারি পেশার উত্তেজনা নেই, একই রুগী বারবার আসে। প্রতিদিন এতএত রোগ-শোকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। শেষে সবাই অভাবের কথা বলে, ফি দেবার টাকা নেই। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ নিয়েও অনেকে নিঃসংকোচে টাকার অভাবের কথা শুনিয়ে যায়। উনার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
নাফি বিষণ্ন মনে তুরাগ নদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
দুপুরে লাঞ্চের আগে শেষ রোগী বসে আছেন, পাশে আগাগোড়া কালো বোরকা ঢাকা মহিলা। লোকটার ফরশা মুখ, মাথায় ঝাকড়া চুল, গালে ঘন কালো দাড়ি, গায়ে সাধা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি। পায়ের জুতো দেখা যাচ্ছে না, জুতোও সাদাই হবে। যারা এমন পোশাক পড়ে সব মিলিয়েই পড়ে। অনেকটা সন্যাসীদের মত। উনার চোখে ধূর্ত একটা ভাব আছে। সাধারণত দেখা যায়, যাদের মাথায় ঝাকড়া চুল তাদের দাড়ি থাকে না। যাদের মাথায় টাক তাদের ঘন দাড়ি। এই লোকটি ব্যতিক্রম। উনার ঝাকড়া চুল, ঘন দাড়ি দুটাই রয়েছে!
উনি রুমের কোণে মানিপ্ল্যান্ট, আর ক্যাকটাসের দিকে তাকিয়ে আছেন।
"ডাক্তার সাব, এই গাছ এত যত্ন কইরা লাগাইয়া রাকছেন? আমরার বাড়িত্তে এই গাছ দূর করবার পাড়ি না। আমগাছ, পেয়ারা গাছ, বরইগাছ সব গাছে এই লতাইন্না গাছ জড়াইয়া রাকছে। গাছে ফল নাই। ফল ছাড়া গাছের দাম কি? বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলেন পরিচয়েত। আমি কই নাই, খনার বচন!"
উনি আরও কিছু বলতেন, মেয়েটি হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে কিছু বললেন।
উনি বিরক্ত হলেন।
"আসছি যখন আসল কথাতো বলবোই, এত তাড়াহুড়ো নাই। এই তাড়াহুড়ার জইন্যই আমরা এই দুনিয়ায় আইছি, নউলে বেহেশতে হুর,গেলমান নিয়া মাতামাতি করতাম।হে হে..."
মেয়েটি লোকটার হাত শক্ত করে ধরলেন। লোকটা মিউয়ে গেলেন, মুখের ভাব পালটে গেল। তিনি চুপ করে গেলেন।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই নীরব রইলেন।
ডা. নাফি নীরবতা ভাঙলেন।
"আপনাদের কি সমস্যা, বলুন তো।"
"আমরার সমস্যা কিছুই নাই। কুন ডাক্তার সমস্যা ধরবার পারে না, হের লেইগা সমাধানও নাই।"
"সমস্যাটা বলুন, আগে শুনি।"
"আমাদের পুলাপান হয় না।"
ভদ্রলোক অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললেন। বোঝা যাচ্ছে এই কথা তিনি অনেকবার বলেছেন, তার জড়তা কেটে গেছে। তবে মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেললো।
"রিপোর্ট এনেছেন সব? দিনতো দেখি।"
"ডাক্তার সাব, রিপোর্ট দেহার কাম নাই। আমরা চিকিৎসা নিবার আসি নাই। অন্য কামে আসছি।অহন আপনে রাজি অইলেই সই। মনে রাইখেন, টেকা পয়সা আমার কাছে আতের ময়লা!যত টেকা লাগে দিমু।"
নাফির কৌতুহল হবার পরিবর্তে রাগ হল। বেশ জোরেই বললেন,"আপনি কি চাচ্ছেন বলেন তো?"
"আপনি রাইগেন না। আমি আপনেরে টেকা দিব,আপনে আমারে একটা বাচ্চা দিবেন। পুলা অইলে ভালা, পুলা হইল গিয়া বংশের বাত্তি। তয় আমার সংসারের মাইয়া পছন্দ।"
ডা. নাফি ভয়ানক রেগে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলেন। উনার শরীর কাঁপছে।
"আপনারা এক্ষুনি বেড়িয়ে যান। এত বড় সাহস?
এই মুহুর্তে বেড়িয়ে যান, নইলে আপনাদের পুলিশে দিব।"
লোকটা ধূর্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,"আরেকবার বিবেচনা করলে হইত না। আপনেরে টেকা দিমু। আমি চাইলে গেরাম থেইকা নিতে পারতাম, কিন্তু আমরার গেরামে কোন ভালা বংশ নাই, সব কামলা। আর কেউ জাইনা ফালাইলে আমার ইজ্জত থাকে না।আপনে খালি ভালা বংশের একটা পুলা দেন, আপনে যা চান আমি তাই দিমু।"
লোকটা আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল। মেয়েটি লোকটার হাত ধরে টেনে তাকে বাইরে নিয়ে গেলেন।
ডাক্তার নাফি আবার জানালার কাছে গিয়ে নদের দিকে তাকালেন। তিনি খেয়াল করেছেন, তুরাগের দিকে তাকালেও তার রাগ ঝরঝর করে পরে যায়। সে যখন সানিয়াকে কল দিতে থাকে, ও কল ধরে না। নাফির খুব রাগ হয়।তাকে রাগও দেখানো যায় না, কল কেটে মোবাইল অফ করে দেয়। তখন হয় আরেক যন্ত্রণা, কিছুই ভালো লাগে না। নদের দিকে তাকিয়ে থাকলে রাগ পরে যায়, মন ভালো হয় না।
"এই যে শুনছেন?"
নাফি ঘুরে তাকালেন। বোরকা পড়া মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।
"আপনি উনার কথা রাগ করবেন না। উনি এমনই, মনে করেন টাকা দিয়ে সব করে ফেলবেন!"
"তা আপনি কি দিয়ে সব করে ফেলতে চান?" নাফি উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন টিপাটিপি শুরু করলেন।
"আপনি রেগে আছেন!আমি আপনার বোনের মত। যদি অভয় দেন, তবে একটা কথা বলতে পারি। আগে শুনুন, যদি ভালো না লাগে বলবেন। আমি চলে যাবো। এই বোনকে ক্ষমা করবেন।"
নাফি কিছুই বললেন না।
"আমাদের সন্তান নেই। কেন হয় না জানিও না। দেশে যত চিকিৎসা আছে করিয়েছি। দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছি না।ঊনাকে বলেছি আরেকটা বিয়ে করতে, উনি করবেন না। আপনি চাইলে আমাকে এই লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারেন।"
"কিভাবে? অন্যের বাচ্চা চুরি করে আপনাকে বেঁচে দিব।"
মেয়েটি কিছু বললো না।
মেয়েটি বোরকার মুখ খুললো। ফরশা গোলগাল মুখে বড়সড় কালো চোখ, চোখ থেকে পানি পরছে। ঠোঁট কাঁপছে।
"আপনি শুধু শুধু আমাকে অপমান করছেন। আমি তা বলতে আসিনি।"
"আচ্ছা, বলুন।"
"দেখুন, আমি শুনেছি ঢাকায় হাসপাতালে অনেকে বাচ্চা ফেলে দেয়। আপনারা বাচ্চাটাকে কেটে কেটে পেট থেকে বাইরে আনেন, মেরে ফেলেন। যদি একটা বাচ্চাকে না মেরে আমাকে দিয়ে দেন, তাতে ক্ষতি কি?"
ডা. নাফি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। এমনও হয় নাকি? উনার তন্দ্রার মত হল। সেদিন আর রোগী দেখলেন না।
২....
ডা. নাফি'র জ্বরজ্বর লাগছে, নাক বন্ধ হয়ে গেছে,মাথাব্যথা করছে।তার কিছুই করার নেই,বাইরে এখনো ৫ জন রোগী বসে আছে। কিন্তু তার রোগী দেখতে ইচ্ছে করছে না। তিনি ৫ কাপ ক্যাপাচিনো খেয়ে ফেলেছেন। কফি এসপ্রেসোর চেয়েও তিতা লাগছে।
গরু আকাশে উড়ে, এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু ডাক্তার অসুস্থ, এটা কেউ স্বাভাবিকভাবে নিবে না। ডাক্তারের পসার কমে যাবে।
বাসায় ভিডিও কল দেয়া যায়, তার অবশ্যই ভালো লাগবে। শিশুকন্যা এলছাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। এতটুকু মেয়ে, ফরশা মুখে বড় বড় চোখ! পিটপিট করে চেয়ে থাকে, টু শব্দও করে না,কেবল হাত-পা নাড়ায়; নাফির গলা ধরে আসে। মনে হয়, তার কলিজাটা নড়ছে।
সানিয়া তাকে মেয়ের কাছে বসতে দেয় না, বলে "এই! তুমি আমার মেয়েকে নজর লাগিয়ে দিবে।যাও এখান থেকে।"
অন্যসময় হলে তিনি সানিয়ার সাথে লম্বা সময় ঝগড়া করতেন, কিন্তু এখন করেন না। উনার মা নাজমা বেগমও একই কথা বলেন,"এই সাগর, মাইয়ার দিকে অমনে চায়া থাহিস না, নজর লাইগা যাইবো।বাবা-মার নজর বড় খারাপ নজর গো!"
ডা. নাফি বাসায় ভিডিও কল দিলেন।কল ধরলো নিহান।
: নাফি ভাইয়া, এখন কল দিয়ে লাভ নাই। এলছা হবার পর সাইনা আপু বাঘিনী স্বভাবের হয়ে গেছে। তার একমাত্র চিন্তা কিভাবে শাবককে নিরাপদ রাখবে।এলছা ঘুমিয়ে পড়েছে, আপা ওকে মশারীর ভিতরে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আপনি চাইলেও এখন মেয়েকে দেখতে পাবেন না!আমি এসেও দেখতে পাইনি। আপা হুমকি দিয়েছে,"খবরদার মশারি তুলবি না, মশা ঢুকবে।"
: তুমি কখন এসেছ, নিহান?
: নাফি ভাইয়া, তোমার গলা কেমন যেন শোনা যাচ্ছে!তোমার শরীর খারাপ নাকি?
: গলা কেমন লাগছে?
: ভূতের মত!
বলেই নিহান হাসতে লাগলো। নিহান অনেকটা নাফি'র হাসান ভাইয়ার মত কথা বলে। ভাইয়াও গলা শুনেই বলে দিতেন। তিনি বলতেন, "বাবু, তোমার কি শরীর খারাপ?কি হয়েছে?"
ভাইয়া ডা. নাফিকে আদর করে বাবু ডাকতেন।পরিবারে ছোটদের এমন নাম থাকেই, সাধারণত বড় হয়ে গেলে এই নামে কেউ ডাকে না। ভাইয়া নাফিকে বাবু, সানিয়াকে গেন্দা, নিহানকে বেবিই ডাকতেন।তবে রেগে গেলে আপনি করে বলতেন!
মেডিকেল কলেছে পড়ার সময় বন্ধুদের সামনে একবার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন,"বাবু, আমি যাই। তুমি ভালো থেকো।"
নাফির লজ্জার শেষ নেই!
নিহানও অমন, ছোটবেলা থেকেই নাফিকে ভূত আর সানিয়াকে সাইনা আপু ডাকে। বড় হয়েও পাল্টায়নি।
ছোটবেলায় নাফি আর ভাইয়া নিহানকে জিজ্ঞেস করতো,"বেবি, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?"
নিহানের হাসিমুখ হুট করে অন্ধকার হয়ে যেত, ও কথা বলতে পারতো না।
এখন অবশ্য অমন করে না। ভাইয়া আর নেই, ভাইয়া চলে গিয়ে সহজ করে গেছে। তবে ডা. নাফির খারাপ লাগে।হাসান ভাইয়া ওকে খুব আদর করতেন! এখন আর কেউ হুটহাট বাইরে বেড়াতে, খেতে নিয়ে যায় না, শুধুশুধু নতুন জামাকাপড় কিনে আনে না, দারুণ সব জুতো কিনে আনে না।খাবার, ঘুম অনিয়ম হলে কেউ আর চিল্লাচিল্লি করে না।নিহান, সানিয়াও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে!
: নাফি ভাইয়া, তুমি কথা বলবে না? চেম্বার ছেড়ে বাসায় চলে এসো। একদিন রোগী কম দেখলে কিছুই হয় না। আর আমি বুঝতে পারছি, তোমার শরীর ভালো নেই।
: আচ্ছা, আমি চলে আসছি।
৩....
ডা. নাফি বাসায় যেতে পারলেন না। বাজেভাবে ফেঁসে গেলেন।
অত্যন্ত ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে তার বৌকে নিয়ে এসেছে, বেবি এবরশন করাবে। যেহেতু তারা সম্মানিত পরিবার, তারা চায় না ঘটনাটা জানাজানি হোক। বড় পরিবারের প্রথম সন্তান নিয়ে অবশ্যই হইচই হবে, সকল পত্রিকা এটা নিয়ে খবর ছাপতে চাইবে। তাই তার কাছেই করাবে, যাতে কেউ না জানে।
বাচ্চাটা নষ্ট করে দেয়ার একমাত্র কারণ সে মেয়ে শিশু। তার পরিবার চায় না, তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হোক। এখন নাফিকে এই বাচ্চা নষ্ট করে দিতে হবে, যাতে মা বুঝতেও না পারে!
নাফি রাজি হচ্ছেন না।
কিন্তু উপায় নেই, নানা জায়গা থেকে কল আসতে লাগলো। স্বাচিস'র(স্বাধীন চিকিৎসক সমিতি) সভাপতিও কল দিয়ে প্রথমে অনুরোধ করলেন। পরে হুমকি দিলেন, সনদ বাতিল করে দেয়ার!
ভাইয়া থাকলে একটা ব্যবস্থা করে ফেলতেন। হাসান ভাইয়া আইনজীবী ছিলেন, যেকোনো সমস্যা সমাধানের অসাধারণ ক্ষমতা তার ছিল।
অগত্যা তিনি অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভাইয়া চলে হুট করে চলে গিয়ে তাকে একা করে দিয়েছেন।
আকাশী-নীল গাউন গায়ে, চশমাপরা মেয়েটি টেবিলের মানিপ্ল্যান্টের দিকে তাকিয়ে আছে। নাফির সামনে সে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। সে ডাক্তারের সাথে একা কথা বলতে চায়। অথচ একবারও নাফির দিকে তাকাননি।
উনার দিকে না তাকিয়েই কথা বললো।
"বাহ! আমি আগে অনেক নামী ডাক্তার দেখেছি। কারও রুমে গাছ দেখিনি।"
"আমি লাগাইনি, আমি যত্নও নিই না। আমার বোন নিহান দিয়েছে। সে-ই এসে যত্ন নিয়ে যায়।"
"হ্যা, বোঝা যাচ্ছে। যে গাছ ভালোবাসে, প্রকৃতি ভালোবাসে সে কিছুতেই কোন শিশুকে মেরে ফেলতে পারে না।"
"কি আশ্চর্য! আমি কাকে মারছি?"
"এমনভাবে কথা বলছেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।আপনি এখানে সবচেয়ে ভালো এবরশন করান। করান না?"
"আগে করাতাম, এখন করাই না। আর আপনার এবরশন করানো হবে না। আপনার কিছু সমস্যা আছে সেটা চেক করা হবে।"
"কেন মিথ্যে বলছেন? আমি সব জানি, আমার সন্তান কেবল মেয়ে বলে তাকে মেরে ফেলা হবে, এটা আমি জানি।"
"কিভাবে?"
"কেউ আমাকে এসে সব বলে যায়। আপনাকে বললে বিশ্বাস করবেন না।"
"আচ্ছা,শুনতে চাচ্ছি না। এই সময়ে সবাই এমন আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। আপনিও হয়তো......"
"আপনি ভেবেছেন, ও আমাকে আপনার এখানে নিয়ে এসেছে? আমি নিজেই এসেছি। ওরা কোন না কোনভাবে আমার সন্তানকে মেরেই ফেলবে।আপনি বাঁচাবেন, কেবল আপনিই পারবেন। ওরা আমাকে বলেছে।"
"ওরা কারা? কি বলেছে?"
"ওরা বলেছে, আপনি বাঁচাবেন।আমি আর কিছুই চাই না।আমার মেয়েটাকে বাঁচান।"
"আপনি আবোলতাবোল বকছেন।"
"আমি ঠিকই আছি। এখন আরও নিশ্চিন্ত লাগছে। আমার আর চিন্তা নেই।আমার মেয়েটা বেঁচে যাবে, আমার আনন্দ লাগছে।"
৪....
ডা. নাফি রাতে বাড়ি ফিরলেন না। হাসপাতালের যে রুমে ইনকিউবিটরে অপরিপক্ক শিশুদের রাখা হয়, সেখানে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিলেন। আয়া ১৪৩ নং রুম থেকে খাবারের ট্রে নিতে এসে দেখেন সানিয়া, নিহান বসে আছে। সে ডা. নাফিকে খবর দিল।
নাফি রুমে ঢুকতেই সানিয়া ওর হাত ধরে বললো,"একটু কি মেয়েকে দেখতে দেইনি ডা. বাড়িই ফিরলেন না। এখন দেখুন, আপনার মেয়ে বাবার বিরহ সইতে না পেরে নিজেই চলে এসেছে।"
নিহান একটু হেসেই গাছের পরিচর্যায় মন দিল।
নাফি মেয়েকে নিয়ে পরলেন। এলছা বাবাকে একদিন পর পেয়ে হাত-পা নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করলো।
নাফি, সানিয়া, নিহান তখন বাড়ি ফিরে এল।
এই ক'দিনে ডা. নাফির আচরণে হাসপাতালের সবাই একটু আশ্চর্য।অবশ্য তিনি আগে থেকেই অন্যরকম, তাই সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।
তিনি প্রতিদিন ইনকিউবেটর রুমে সময় কাটাতেন। কাচঘেরা ইনকিউবেটরের পাশে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা একা কথা বলেন,"এইযে বেবি, আজকে কেমন আছ? নিশ্চয়ই ভালো আছ? তোমার তো কোন চিন্তা নেই। আমার চিন্তায় ঘুম আসে না, বই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারি না। সময় যাচ্ছে আর তোমাকে কি করবো, তা নিয়ে ভেবে কিছুই পাচ্ছি না।তুমি চিন্তা কর না, আমি একটা পথ বের করে ফেলবো।......"
আরও কত কথা!
নার্সেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারা এখনো জানে না, ঐ ইনকিউবেটরে শিশুটা কোন পেশেন্টের।
অবশ্য এই ডাক্তার আগে থেকেই একটু কেমন যেন, ঘন্টার পর ঘন্টা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ময়লা তুরাগে দেখার কি আছে কে জানে?
মাঝেমধ্যে বইয়ে এমনভাবে ডুবে যান যে, আশেপাশে কে আছেন চিনতে পারেন না। তবে তিনি ডা. নাফি লোক ভালো, অন্য ডাক্তারদের চেয়ে আলাদা। তিনি কখনো কাউকে বকেছেন বলে মনে পড়ে না!
৩ মাস চলে গেল। হাসপাতালের এপয়েন্টমেন্ট বুক থেকে নাফি অনেকদিন আগের সেই বোরকাপরা মেয়ে আর ধূর্ত লোকটার ঠিকানা জোগাড় করে তাদের খবর পাঠালেন।
রাত ৯ টা। নাফি ভিডিওকলে সানিয়ার সাথে কথা বলছেন। এলছা একটু আধটু শব্দ করতে পারে। আজকে শব্দ করেছে "বা...বা...বা..বা...."
এলছা বাবা ডাকছে কিনা, কে জানে? অথচ ডা. নাফি গলা ধরে আসছিল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সানিয়া এটা নিয়েও ফোড়ন কাটলো।
"অমন করে কাঁদছ কেন, ডাক্তার? তোমার কেমন ছিঁচকাদুনে স্বভাব। মেয়ে বাবা ডেকেছে, এই খুশিতে না নেচে তুমি ফুঁপিয়ে কাঁদছ!
আমাদের কষ্টটা ভাব, সারাদিন এলছার পিছনে লেগে থাকি, মা মা ডাকি। আম্মা সারাক্ষণ দিদা দিদা ডাকেন, অথচ সে প্রথমে ডাকলো কিনা বাবা!এই কষ্ট কোথায় রাখি! তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো তো।"
রাত ৯ঃ৩০। ডা. নাফির রুম তাজা ফুলের গন্ধে ভরে গেছে। চেয়ারে দুজন লোক বসে আছেন, তাদের ঠিক দেখা যাচ্ছে না। উনার চোখ ঝাপসা।
নাফি চোখ মুছে তাদের দিকে তাকালেন।
ধূর্ত লোকটা মেজের দিকে তাকিয়ে আছেন, মেয়েটি দেয়ালে ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
"আমার মেয়ে এলছা।"
"আপনার মতই হয়েছে। তবে নাকটা বেশি ছিপছিপে, টিকালো।"
"হ্যা, ভাইয়ার মত।"
নাফি উনাদের ইনকিউবেটর রুমে নিয়ে গেলেন।
মেয়েটি কাঁপা হাতে বেবিটা কোলে নিয়ে মেঝেতে বসে পরল। কিছুই বলতে পারছে না, নীরবে কাঁদছে। লোকটা স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাকে স্বান্তনা দিতে পারছে না।
"দেখছস বৌ, আমি আগই কইছিলাম, টেকার উপরে কুন ওষুধ নাই। দেখলি, শেষমেশ টেকা দিয়াই পুলাপান পাইলি না!"
মেয়েটি স্বামীর দিকে তাকালো। কোন বিশেষ কারণে লোকটা চুপসে গেলেন।
মেয়েটি কেঁদেই যাচ্ছে, তাকে স্বান্তনা দিয়ে দু'একটা কথা বলা উচিত। নাফি স্বান্তনা দিতে পারেন না। ভাইয়া যে দিন চলে গেলেন, সেদিন সবার বাইরে বিরিয়ানি খেতে যাবার কথা। নিহান, সানিয়া শাড়ি পড়ে রেডি। নাফি ছুটি নিয়েছিল। ভাইয়া সেই সন্ধ্যায় তো এলোই না, আর কোন দিনই আসবে না!
ওরা দুই বোন অনেক কাঁদলো। দুই বছর হল ওরা কেউ কোথাও বেড়াতে যেতে চায় না, কফি, বিরিয়ানি খেতেও না। ওদের ভাইয়াকে নিয়ে স্বান্তনা দিয়ে কিছু বলা উচিত, নাফি কিছুই বলতে পারেন না। অসহায় লাগে!তাকেই স্বান্তনা দিয়ে কেউ কিছু বলে না। সবাই এমন ভাব করে যেন, কিছুই হয়নি। অথচ অস্থির ভাবটা বোঝা যায়।
মেয়েটি চলে যাচ্ছে। লোকটা হয়তো অনেক লজ্জা পেয়েছে, নয়তো কষ্ট পেয়েছে। কথা বলছে না।
শেষে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললেন,"ডাক্তর সাব, আপনের লেইগা আনছি। হাসনাহেনা গাছ। সন্ধ্যায় বেজায় গন্ধ ছড়ায়। মাথা ঘুণ্টি দেয়। আপনের ভাবীর ইচ্ছা আপনেরে একটা গাছ দেই। হেইবার চইলা গিয়াই কইছে, আপনে আবার ডাকবাইন। যাতে একটা গাছ নিয়া আসতে পারি।আমি বিরাট চমক পাইছি।"
গাছ দেখে সানিয়া, নিহান মন খারাপ করে ফেললো। শিউলি, বকুল, হাসনাহেনা ভাইয়ার প্রিয় ফুল।
৫...
NASA Fertility Centre, Mymensingh শাখার প্রধান ডা. নাফি এবরশন স্পেশালিস্ট। ইনি ঠিক প্রচলিত পদ্ধতিতে এবরশন করান না, পেটে একটা কাটা দাগ থেকে যায়। তাই বলে উনার পসার কমে না। শহরে দিন দিন উনার সুনাম বেড়েই যাচ্ছে। কারণ এই ডাক্তার কোন প্রশ্ন করে না, এমনকি ভ্রুণ অনেক বড় হয়ে গেলেও আপত্তি করেন না।
সারি সারি ইনকিউবেটর, কোনটা খালি নেই। রুমে সুনসান নীরবতা। ডা. নাফি এই রুমে প্রায়ই একা দাঁড়িয়ে থাকেন। নীরব ইনকিউবেটর রুমটায় অপরিণত ভ্রুণগুলো ছাড়া বেশিরভাগ সময়টাই কেউ থাকে না। তিনি হেঁটে হেঁটে কার সাথে কথা বলেন, কে জানে?
Copyright protected by the writer.
০৭ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৫৯
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ!
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৮
রাজীব নুর বলেছেন: জাস্ট গ্রেট।