নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

A learning Advocate!

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরাভব

২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:২০


১...
দেয়ালে শেখ মুজিব আর ইন্দিরা গান্ধীর ছবি পাশাপাশি ঝুলছে। হুরমুছ খান বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আরে ছবিতো এমনেই হারাম। তাও আবার মালাউন বেটির সাথে ছবি! শেখ সাবে ভালো মানুষ, সন্দেহ কি? তবে তার পাশে মাওলানা ভাসানী সাবের ছবি থাকতে পারতো, তা নাই।এমন ভূলটা ইদানীং সব জায়গাতেই দেখা যায়। হুরমুছ খান উনার স্কুলেও একই বিষয় খেয়াল করেছেন, কাল স্কুল খোলা হলে অবশ্যই এটা নিয়ে কথা বলবেন।

আর্মির পোশাক পড়া এক লেংড়া লোক শেখ সাবের কথা বলছেন৷ কি এমন কথা যে দুই ঘন্টা লাগে? হুরমুছ খান উশখুশ করেন। তিনি কান পেতে কিছু আলাপ শুনতে পান।
:স্যার, দেশের সামরিক ব্যবস্থা নতুন করে সাজাতে হবে, সবাই যাতে দ্রুত অস্ত্র জমা দেয় দ্রুত সে ব্যবস্থা করেন।
:তুমি ঠিক বলেছ। সবখানেই সমস্যা! কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আমার খুব ইচ্ছে ৬৪ জেলা ঘুরে দেখবো, পাকিস্তানি হানাদার আমার দেশটারে কি বানাইয়া গেল!
শেখ মুজিবের চোখ ছলছল করে।তিনি আবার কথা বলেন।
:কর্নেল, তুমি এক কাজ কর। যা যা করতে চাও, আমাকে লিখে জানাও, আবার সময় করে এসো।অনেক আলাপ হবে।তোমার কাটা পা দেখে খারাপ লাগছে।
:নো স্যার, ডোন্ট গেট স্যাড। আই এম মোর স্ট্রং দ্যান আ টু লেগড ম্যান।

লেংড়া লোকটা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন। হুরমুছ খানের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার চোখে আনন্দ খেলে যায়।
:ছালাম চাচা, আমি কর্নেল তাহের। আমি আর আপনার ছেলে ছাত্তার খান একসাথে যুদ্ধ করেছি।কি সাহসী ছেলে আপনার!বয়স কম দেখে আমি গেরিলাগ্রুপে নিতে চাইনি, আপনার ছেলে নাছোড়বান্দা! ও কিছুতেই ফিরবে না। যুদ্ধ ও করবেই।সব সময় আগে আগে থাকতো, আর দেখুন ওর কিছুই হল না; পায়ে গুলি লাগলো আমার!আচ্ছা, ও বাড়ি ফিরেনি?
: ছাত্তার ফিরেছে। আমার মেয়ের জামাই আর্মি, ও ফেরেনি। শেখ সাবের কাছে আসছি কথা বলতে।

তাহের কি বলবেন ভেবে পান না। অনেকেই ফিরে আসেনি, আর ফিরবে কিনা আল্লাহ জানেন?

২...
এইতো অল্প কয়েক দিন আগের কথা। বরিশালে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে কত লোক মারা গেল! পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে যোগাযোগ আছে কিনা, জানা নাই। তবে সারা জামালপুর পানিতে তলিয়ে গেল, ফসল নষ্ট হয়ে গেল, শুরু হল খাবারের সংকট। মাঝেমধ্যেই নদে ভেসে আসতো মরা লাশ!
নান্দিনা প্রাইমারী স্কুল মাঠে হাজার হাজার মানুষ জমা হল, শেখ মুজিব আসবেন। দেশের মানুষ শেখ মুজিব বলতে পাগল।
কেন? হুরমুছ খান ভেবে পান না। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, অথচ এই লোক পাকিস্তান ভাঙতে চায়!
তিনি অবশ্য তাকে দেখতে আসেননি, তিনি এসেছেন ত্রাণের আসায়।

হুরমুছ খানের সিরিয়াল আসতেই ত্রাণের বস্তা শেষ হয়ে গেল। উনার সামনে বিরক্তমুখে একলোক বসে আছেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুল বামদিকে সিথি করা, মোটামুটি বিশাল শরীরের মানুষ, তবে চোখে বুদ্ধিদীপ্তির একটা ব্যাপার আছে!
তিনি আর যেই হন, শেখ মুজিব নন। শেখ সাবের পুরু গোফ আছে আর উনি চুলে সিথি করেন না, ব্যাক ব্রাশ করেন। হুরমুছ খান পত্রিকায় দেখেছেন। বলাই বাহুল্য, তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

তাজউদ্দীন আহমদ ঘামছেন। কোন ত্রাণ অবশিষ্ট নাই। অথচ সামনে অগণিত মানুষের সারি! শেখ মুজিব ৫০০০ টাকা পাঠিয়েছেন, তাও শেষ!
এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনী প্রচারনার টাকা কম পরে যাবে। তিনি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে এক লোক এগিয়ে আসেন, তার পিছনে গুটি কয়েক লোক, বলেন,"আমরা শ্যাখ মুজিবরে ভুট দিমু। শ্যাখের লাইগা আমগো মন কান্দে।"
সবাই চোখ মুছতে থাকে!

হুরমুছ খান খুবই বিরক্ত হন! একটা মানুষ প্রায় একাই পাকিস্তান ভেঙে ফেলছে, মাওলানা ভাসানী সাবও চান পাকিস্তান অক্ষত থাকুক; সবচেয়ে বড় কথা তুমি তারে দেখ নাই, চিনও না; তার জন্য এত দরদ কিসের?

৩...
৭ই ডিসেম্বর। পুরো পাকিস্তানে উৎসবের মত ভোট চলছে। হুরমুছ খান ফজরের নামাজ পড়ে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য দোয়া করলেন।
ভোট দেয়াটাও জরুরি, তবে তিনি কাকে ভোট দিবেন ঠিক করেন নাই। মাওলানা সাব শেষ পর্যন্ত ভোট ত্যাগ করেছেন। যে দেশে মানুষের ভাত নাই, সেখানে আবার নির্বাচন কিসের?
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভোট দিবেন তলোয়ার বা হারিকেন মার্কায়। সাদা পাঞ্জাবি পরে বাইরে আসতেই ছাত্তার বাবা দিকে এগিয়ে এল।
:আব্বা, লও আমিও যাই।আব্বা, তুমি কিন্তু শেখেরে ভুটটা দিবা। শেখেরে ভুট না দিলে দেশ স্বাধীন অইত না।
হুরমুছ খান পুত্রের হাত ধরে স্কুলের দিকে এগিয়ে যান। ছাত্তারের কতই বা বয়স ১৫-১৬, স্বাধীনতার সে কি বোঝে!তবুও শেখের প্রতি তার কি অকৃত্রিম টান। কিছু মানুষই জন্মায় সবার ভালোবাসা পাবার বিরল গুণ নিয়ে!

স্কুলে পৌঁছে তিনি আশ্চর্য হন। সারা মাঠ মানুষে গিজগিজ করছে। তবে স্কুলে পতাকা টানানো হয় নাই। নীল আকাশে চাঁদ-তারার পতাকা উড়ছে না। স্কুলের হেড মাস্টার রইস উদ্দিন নৌকার লোক। শেখ মুজিব যা বলেন তাই অনুকরণ করেন। তাই বলে দেশের পতাকা টানানো যাবে না?
উনি অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বাধ সাধে ছাত্তার।
:আব্বা, আমারে নৌকা মার্কার ব্যাজ আইন্না দেও। দেখছ সবাই কেমুন নৌকার ব্যাজ পইড়া ঘুরতাছে!

কেন্দ্র জুড়ে নৌকার জয়জয়কার! লোকজন হাসিমুখে ভোট দিয়ে বেড়িয়ে আসছে।
এজেন্টদের কাছে নৌকার কোন ব্যাজ নাই। একগাদা তলোয়ারের ব্যাজ, আর কয়েকটি হারিকেনের ব্যাজ পড়ে আছে। হুরমুছ খান সাত্তারের শার্টে হারিকেনের একটা ব্যাজ পড়িয়ে দিতে যান, ছাত্তার রাজি হয় না। সে শেখ মুজিবের লোক, সে হারিকেনের ব্যাজ পরবে না।
হুরুমুছ খান ভোট দিয়ে বেড়িয়ে আসেন। উনার পাঞ্জাবিতে হারিকেন মার্কার ব্যাজ!
ছাত্তার প্রশ্ন করতে থাকে,"আব্বা, ভূটটা দিলা কারে? নৌকায় দেও নাই।"
হুরমুছ খান কথা বলেন না।
ছাত্তার প্রশ্ন করা থামায় না,বলতে থাকে,"আব্বা, আমি হারিকেনের ব্যাজ দেইখখাই বুঝছি তুমি নৌকায় ভূট দেও নাই। তুমি এইডা কি করলা? মাইনশে ঠিকই কয়, তুমি স্বাধীনতা চাও না।"
ছাত্তার ছলছল চোখে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

হুরমুছ খান ছেলের চলে যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির দিকে হাটা দেন। উনার ছেলেটা মায়ের পেট পুছা সন্তান, পাঁচ বোনের পর এক ভাই। একটু বেশিই অভিমানী, জেদি!

৪...
দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া খানের মতে 'কালে কালে ছোটা ছোটা মাছলি খানেওয়ালা বাঙাল ওয়ার ক্যায়া কারেগা!' এ ধারণা ভূল প্রমাণ করে বাঙালী বেশ প্রতিরোধ তৈরি করেছে। আগে পথেঘাটে কেবল বাঙালির লাশ দেখা যেত এখন সমহারে পাক বাহিনীর লাশও দেখা যায়।
প্রাইমারি স্কুলে পাক বাহিনীর ক্যাম্প, হুরমুছ খান প্রতিদিন নিয়ম করে ক্যাম্পে যান। তাদের সুবিধা অসুবিধা দেখেন।

পাকিদের কর্মকাণ্ডে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্ত, কিন্তু প্রকাশ করেন না। এরা প্রতিদিন নিরীহ মানুষের ঘর পুড়িয়ে দেয়, তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন এরা মুক্তিযুদ্ধ বুঝে না, এরা পাকিস্তানের পক্ষে; পাকি মেজর কথা শুনেন না।
সেদিন ১৫ জন যুবক ছেলেকে মসজিদের সামনেই গুলি করা হয়েছে। দেশের ৭ কোটি জনসংখ্যার মাত্র কয়েক লাখ হিন্দু। বিবিসি বাংলা ফলাও করে প্রচার করে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সব হিন্দু লোকজন অবশ্যই ভারতে চলে গেছে, ওদের সাথে দল বেধে চলে গেছে কিছু অতিউৎসাহী মুসলমানের দল।
আরে হস্তীমূর্খ! এই দেশ মুসলমানের দেশ, তুই মুসলমান তোর ভয় কি! হুরমুছ খান রেগে যান।

পাক বাহিনী প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে মানুষ ধরে ধরে আনে। সব নাকি হিন্দু, এদের শিক্ষা দিতে হবে যে এই দেশ তাদের না, তারা ভারতে চলে যাক।
সব হিন্দু তো ভারতেই চলে গেছে, এরা এত হিন্দু মেয়ে পায় কই?
হুরমুছ খানের বুঝতে বাকি থাকে না।
মাওলানা সাব ঠিকই বলেছেন, পাক বাহিনী নিরীহ মানুষ, মেয়েছেলের উপর অত্যাচার করছে। এই অন্যায়, অত্যাচার আল্লাহ সহ্য করবেন না। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত! মাওলানা ভাসানী কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরদের নিয়ে বাহিনী ঘটন করলেন। সাদা পাঞ্জাবী, মাথায় লোকজন মাওলানা সাবের বাহিনী যোগ দেয়। হুরমুছ খান ইচ্ছে সত্যেও যোগ দিতে পারেন না, তার বড় মেয়ে বকুল বেড়াতে এসেছে। মেয়েটা পোয়াতি, মেয়েরা কেবল পোয়াতি হলেই বাবার বাড়ির প্রতি টান বেড়ে যায়। এ মেয়েটা ব্যতিক্রম, তার সবসময় বাবার বাড়ির প্রতি অসম্ভব টান।

তিনি মাগরিবের নামাজে সালাম ফিরিয়ে দেখেন ছাত্তার দাঁড়িয়ে আছে।
:আব্বা, আমি যুদ্ধে যামুগা। আইজকা চইলা যামু, আমি খবর নিছি নালিতাবাড়ী পানিহাটা পার অইলে কাছেই মুক্তির ক্যাম্প।
ছাত্তার কথা শেষ করে বাবার উত্তরের অপেক্ষা করে না, দৌড়ে বেড়িয়ে পরে। হুরমুছ খান দ্রুত মোনাজাত শেষ করেও ছেলের দেখা পান না।
হুরমুছ খান নিজের প্রতি বিরক্ত হন। ছাত্তারকে তিনি একদম শাসন করেননি দেখেই ছেলে এমন বেয়াদব। বাবাকে মান্যগণ্য করে না। প্রতিদিন সকাল বিকাল দুইবেলা থাপ্পড় দিলে যদি সে মানুষ হয়।শেষ বয়সে সন্তান হলে এই এক সমস্যা, শাসন করা যায় না।

যুদ্ধ শেষ হয়, ছাত্তার ফিরে আসে। শেখ মুজিব অস্ত্র জমা দেবার ডাক দেন, সে রাজি না। সে একরোখা সে অস্ত্র জমা দিবে না, সে তো দেশের মিলিশিয়া হয়ে ব্যারাকে বসে ঝিমাতে যুদ্ধ করে নাই।সে যোগ দিবে সর্বহারা পার্টিতে, দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে, দেশকে ভারতের হাতের পুতুল হতে দিবে না।

৫....
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হুরমুছ খান শেখ মুজিবের দেখা পান না।
বিকালের দিকে একদল লোক আসে। সবাই স্লোগান দেয়,"বাঘা কাদের! বাঘা কাদের!,,,জয় বাংলা!জয় বাংলা!"
হাস্যমুখে অত্যন্ত বলশালী এক লোক শেখের সামনে এসেই পায়ে লুটিয়ে পড়ে। আবার শুরু হয় স্লোগান।
স্লোগান দিতে দিতে দলের সবাই শেখের কাছে অস্ত্র জমা দেয়। শেখ মুজিব লোকটাকে জড়িয়ে রাখেন। লোকটা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী! হুরমুছ খান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এই হাস্যমুখের লোকটার ভয়ে পাকিদের ভাত পেটের মধ্যেই গু হয়ে যেত!

হুরমুছ খান মুজিবের দেখা পান না। আসলে তখন অনেক আপন লোকই মুজিবের দেখা পেতেন না। যেমনঃ তাজউদ্দীন আহমদ। মুজিবকে ঘিরে একদল লোক সারাক্ষণই থাকতো। অথচ তাজউদ্দীন কাছেই যেতে পারতেন না, উনার কত ইচ্ছে মুজিবের সাথে যুদ্ধের গল্প করেন। উনার চেয়ে হুরমুছ খানের কষ্ট কিছুটা কম!

মুজিব তখন নানা চিন্তায় ব্যস্ত। মাওলানা ভাসানী বীরদর্পে তার সমালোচনা করে যাচ্ছে, মৃদু আন্দোলন দানা বেধেছে সিপাহীদের মধ্যেও, ওরা এত বছর ট্রেনিং করে আর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেই হয়ে যাচ্ছে সিপাহী! মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রও জমা দিচ্ছে না, ভারতীয় সৈন্যরা নাকি লুটপাট করে ফিরে গেছে, এজন্য ওদের কোর্ট মার্শালও নাকি হচ্ছে, আমেরিকা সাহায্য পাঠাবে বলে পাঠাচ্ছে না, চীন স্বীকৃতি দিচ্ছে না, অথচ বড় বড় দেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক খুব দরকার। বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ লোকজন চায়নি দেশ স্বাধীন হোক; রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের তালিকা করার সময় এদের নামও ঢুকে গেছে। এরা আবার মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামিলীগের নেতাকর্মীদের পরিবার, আত্মীয়। তারা নানাভাবে এদের বাঁচাতে মরিয়া।
বাড়ির সামনে দলবেঁধে বসে থাকে মেয়েদের দল, পরিবার এদের ফেরত নিচ্ছে না।
তিনি কি করবেন ভেবে পান না!

সেদিন দেখা করতে এসেছিলেন উনার কলেজের শিক্ষক। তিনি শিক্ষকের হাত ধরে বলেন,"স্যার, আমারে সৎ লোক চিনার উপায় বলে দেন। আমারে একশ সৎ লোক বাছাই কইরা দেন, আমি দেশটারে আবার নতুন কইরা শুরু করি।"
কোন উত্তর পাওয়া যায় না।

৬...
হুরমুছ খান হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে হাটা দেন। শেখ মুজিবকে বলা হয় না, রক্ষীবাহিনীর রাজাকারের তালিকায় তার নাম এসেছে। ঐ বাহিনীর নেতা তার পোয়াতি মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
তিনি স্বাধীনতা চান নাই, তিনি অখণ্ড ইসলামিক পাকিস্তান চেয়েছেন, এটা সত্য। মেয়েতো কোন দোষ করে নাই।মেয়েটার কষ্টের সীমা নাই!স্বামী যুদ্ধে গিয়ে ফিরে নাই, পোয়াতি মেয়েদের কত আবদার থাকে, কাউকে বলতে পারছে না।মেয়েটা সারাবেলা কাঁদে। ছাত্তার কই চলে গেছে, তিনি সত্যিই জানেন না! তার মেয়ে জানবে কিভাবে?

মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছেন, এদের কাজ অস্ত্র উদ্ধার করা। এরা নিশ্চয়ই মুজিবের কথা শুনবে। তিনি তো দেখাই করতে পারলেন না!
দেশে অদ্ভুত অবস্থা চলছে। রক্ষীবাহিনী, সর্বাহারা বাহিনী দু'দলের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। একদল রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধাদের খুজে খুজে মারছে, আরেকদল সাধারণ মানুষের বাড়িতে লুটপাট করছে। কোন অস্বাভাবিক কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দু'দল একে অপরকে সহ্য করতে পারে না।
দেশের মানুষের কাছেও এই দু'দল মূর্তিমান আতঙ্ক! আগে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলে মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, নিজের পরিবারের লোকের মত মনে করতো, তারাই এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকাত বলে পিটিয়ে মেরে ফেলে!

ঢাকা থেকে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। চন্দ্রকোনা বাজার পেড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আসতেই দেখতে পান মানুষের ভীড়। উনি পাস কাটিয়ে যান।উনার মন টানে, আবার ফিরে আসেন।একজনকে জিজ্ঞেস করেন,"এখানে কি অইছে, ভাই?"
"আর বইলেন না, হেরা দ্যাশটা স্বাধীন কইরা মনে কয় দ্যাশটা কিইন্না লইছে। ডাহাতি করে, মাইয়াগরে ধইরা নিয়া যায়।
আইজকা একটারে পাইছি, পিডাইয়া মাইরা ফালাইছি।"

হ্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলা হচ্ছে। আজকেও ডাকাতি করতে এসেছিল হয়তো। ধরা পরে, মার খেয়ে মরে গেছে।
হুরমুছ খান আরেকটু এগিয়ে যান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা দেখেছেন, ডাকাত মুক্তিযোদ্ধা দেখেন নাই। এই কৌতুহলে আরও এগিয়ে যান।

আশ্চর্য! ছাত্তার হাত-পা ছড়িয়ে পরে আছে। সারা শরীর কাদায় মাখামাখি, খোলা বুকে চারটা ফূটো, সরু রক্তের ধারা এখনো বইছে, কাধে রাইফেল তো আছেই!
ঠিকই আছে ডাকাতি করতে আসবে, আর মরবে না? চোরের দশদিন, গেরস্তের একদিন!
তিনি তবুও এগিয়ে যান, ছাত্তারের পাশেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা মেয়ের লাশ।চেহারা দেখা যাচ্ছে না, গায়ে গাঢ় সবুজ শাড়ি,কোনমতে কোমড়ে জড়িয়ে আছে, চুলগুলো এলোমেলো, পানিতে ভাসছে। ভাগ্যিস মেয়েটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, নয়তো মেয়েটার উন্মুক্ত বুক দেখা যেত।
আচ্ছা, লোকগুলো মেয়েটাকে মারলো কেন?মেয়েটাকে তো বাঁচাতে পারতো।

হুরমুছ খান মেয়েটাকে উল্টে দেখেন। উনি একটুও চমকান না, মেয়েটা বকুল।উনার পোয়াতি বড় মেয়ে! যে মেয়ের বাবা রাজাকার, ভাই ডাকাত মুক্তিযোদ্ধা তার এমন পরিণতি অস্বাভাবিক না।
পাঁচ বোনের মধ্যে বড়বোন বকুল ছাত্তারকে অনেক পছন্দ করতো।প্রায়ই শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসতো, ভাইকে খাইয়ে গোসল করিয়ে আবার বিকালে ফিরে যেত। সারাটা দিন ছোট ছাত্তার বকুলের হাত ধরে থাকতো, পিছে ঘুরঘুর করতো। যুদ্ধ শুরু হতেই বকুল চলে এল, সে ছোট ভাইয়ের কাছে থাকবে। এটাই অভিশাপ হল,বাকি বোনদের মত যদি বকুলও না আসতো!
এখনো ছাত্তার শক্ত করে বকুলের হাত ধরে আছে।

হুরমুছ খান কন্যার গায়ে সবুজ শাড়ি জড়িয়ে দিলেন, পুত্রের লাশের বুকে হাত বুলাচ্ছিলেন। উনার চোখে একফোটা জল নেই।থাকবে কেন? এমনই হবার কথা ছিলো!
পেছন থেকে কেউ বলল,"তুই কি রাজাকার হুরমুছ খান?"
তিনি পেছনে তাকালেন। সকালের সূর্য লোকটার ঠিক পিছনে, চেহারা দেখা গেল না। তবে লোকটার হাতের কালো রাইফেল রোদে চিকচিক করছে।

লোকটা বেয়নেট উনার গলায় ঠেকিয়ে প্রশ্নটা আবার করলো। হুরমুছ খান মাথা ঝাকালেন। তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন!
মৃত্যু খারাপ না, সব কিছুর অবসান। সকল সমস্যা, দুঃখকষ্ট, অন্যায়, অপবাদ, অপমান থেকে মুক্তির মহৌষধ মৃত্যু।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: চমতকার গল্প। তবে সমস্যা আছে। সমস্যা টা কোথায় ধরতে পারছি না।
দেখি অন্য কেউ সমস্যাটা ধরতে পারে কিনা।

২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:৩৮

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: হ্যা, থাকতে পারে। আপনি বলেন না, ধারাবাহিকতা সমস্যা; সেটা আছে। টেনেটুনে শেষ করা। সাত্তার/ছাত্তার নিয়ে ঝামেলা তো আছেই।
৭০ এর ঘূর্ণিঝড়, নির্বাচন; মুক্তিযুদ্ধ, আর যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা মিশিয়ে জগাখিচুরি করে দিয়েছি।
তবুও শেষ করার একটা আনন্দ তো পাচ্ছি, এই কম কি?

২| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:০৩

ইসিয়াক বলেছেন: গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে তার পর মন্তব্য করবো ভাইয়া।
শুভকামনা।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:১৪

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: অপেক্ষা করছি।

৩| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:১৪

নেওয়াজ আলি বলেছেন: লেখা পড়ে বিমোহিত হলাম।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:১৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: এটা আপনার বিরল গুন। ইদানীং কেউ বিমোহিত হয় না, সবকিছুতে বিরক্ত হয়ে নাক কুচকায়।

৪| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:১৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: আমি সব মন্তব্যের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। একটু দেরি হয়, এই যা।

৫| ০২ রা মে, ২০২০ সকাল ১০:৩০

ইসিয়াক বলেছেন: গল্পটা একবার পড়েছি আবার পড়বো। তারপর মন্তব্য ।

০৩ রা মে, ২০২০ দুপুর ১:০৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: আপনার ধৈর্য্য আছে মশাই! :-P

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.