নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

A learning Advocate!

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ত্রিনয়না

১২ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:০৭


১....
সবার মাঝে আশ্চর্য তাড়া। সবাই কাজাইকাটা বড় বাড়ি যাবে। কেবল বাড়ির বৌ মিনির তাড়া নেই। সে অস্থির হয়ে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।হুদাই!
উনার বড় ছেলে সোহাগ এক পাটি জুতা খুজে পাচ্ছে না। সোহাগের ইচ্ছে চিৎকার করে বলে,"ও আম্মা, ও দাদী! আমার জুতা তো পাই না।" ও চিৎকার করছে না। আব্বা ভীষণ রাগী, নিশ্চয়ই মারবে। আবার রেখেও চলে যেতে পারে। কাল ওকে ফেলে সবাই কাজাইকাটা গেছেগা!

মিনি গত ইদের নতুন শাড়িটা পরেছে। সে একবার স্বামী, আরেকবার দেবর সারোয়ার, আবার শ্বাশুড়ি ছফিনা বেগমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কোন কারনে কেউই তাকে দেখছে না। কেউ বলছে না," এই তুমিও চল। সবাই একলগে হাসিনূররে দেখবার যাই।"
সবাই তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে যায়।

মিনি মন খারাপ করে না। সময় কই? কত কাজ পরে আছে।
ছটকু ছেলেটা খড়ের গাদায় ঘুমিয়ে কাঁদা। মেঝ ছেলে চুলার পাড়ে বসে ঝিমুচ্ছে।ঝাকে ঝাকে মশা দুই ছেলেকে ঘিরে আছে।
উনি ধাক্কা দিয়ে বলেন,"সজীব, এই সজীব! ঘুমাইয়ো না।সালুন অইয়া গেছে। যাও মেহরাবরে ঘরে রাইখা আসো। আমি ভাত বাড়ি।"
সজীব এলোমেলো পায়ে ভাইকে কোলে নিয়ে ঘরের দিকে যায়।
নারকেল গাছটায় বাতাসে ঝড় ওঠে। মিনিও ভয়ে কেঁপে ওঠে। বাড়ির পশ্চিম দিকটায় এখনো বেড়া দেয়া হয় নাই। ঘনকালো জঙ্গল দেখা। ভালো করে তাকালে মনে হয়, কোন অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে! মিনি তাড়াতাড়ি বাসনকোসন নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।

সজীবকে খেতে দেয়া হয়েছে। গরম ভাত থেকে এঁকেবেঁকে ধোয়া উঠছে। সজীব প্লেট ছুড়ে ফেলল। মিনি বললো," এই পুলা, তুই ভাত ফালাইলি কেন? খাইতি না?"
সজীব বিছানায় গড়িয়ে বিরবির করে," তুই তো রানলি মুরগির সালুন। আমারে দিলি মাছ ভাজা।আমি ভাত খাইতাম না।"

ঠিক একই সময় কাজাইকাটা বড় বাড়ি একই ঘটনা ঘটলো। মুরগির ঝোলের বাটি ছুড়ে দিলো হাসিনূর। ঝোলে মাখামাখি হল ওর মায়ের পা, আর বড় মামার শার্ট। সোহাগ বললো," আফা, সালুন ফালাইয়া দিলা কেন? মুরগী ত আম্মায় রানছে।"
সাত্তার খান সাথে যোগ দিলেন," হ রে মা, তরকারি তোমার মামীই রানছে। না খাইয়া, ফালাইয়া দিলা কেন?"

হাসিনূর পাশ ফিরে শুয়ে রাগে বলতে থাকলো," আমিতো কিছুই খেতে পারি না। সবই মুখে তিতা লাগে। আমি মামানির রান্না খাইতে চাইলাম, যাতে মামানি রান্না করে আমাকে দেখতে আসে। মামানি আসলো না!এক বছর হল, আমি অসুস্থ। মামানি আমারে দেখতে আসলো না!"

২...
রাত কয়টা বাজে? নিঃশব্দে ঘড়িটা চলছেই। মিনি সময় পড়তে জানে না, তবুও বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় আর চিন্তিত হয়। ওরা ফিরছে না কেন?
সজীব রেগে ঘুমিয়ে পরেছে।
আণ্ডাবাচ্চাটার দিকে তাকিয়েই মনে হল, আজ বিকালে ওকে কলা খাওয়ানো হয়নি। এখন খাইয়ে দিলেই হবে। ছটকু ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও খেতে পারে।
মিনি সবরি কলা খুজে পেল না। এখন কি হবে? সারারাত ওকে না খেয়ে থাকতে হবে। অবশ্য মেম্বর বাড়ি গেলে কলা পাওয়া যেতে পারে, বা সাঈদ মেম্বরকে বললেও কলা এনে দিবে।

বাইরে গাঢ় অন্ধকার। ভয়ে ওর গায়ে কাটা দিল। ও সজীবকে ডাকলো দু'একবার। কোন সাড়া নেই। অগত্যা নিজেই বেড়িয়ে গেল কূপি বাতি হাতে। বাতির লাল শিখা অন্ধকার দূর করবে কি, আরও বাড়িয়ে দিল কয়েক গুণ।

বাড়ির দেউরির কাছে পৌছাতেই চোখ পরলো গোরস্থানের দিকে। অন্ধকারের সাথে ভয়ও বেড়ে গেল। কয়েকবার অনুচ্চস্বরে ডাকলো,"চাচী আম্মা, ও চাচী আম্মা।"
মেম্বরনীর খবর নাই। ছোট দেবর-ননদদের ডেকে লাভ নেই।ও সন্ধ্যা না পেড়োতেই ঘুমিয়ে পরে। মিনি কি করবে ভেবে পায় না।
এ বাড়ির কঠিন নিয়ম, বাড়ির বৌ-ঝিরা বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না, উচ্চস্বরে কথা বলতে পারবে না। উনার শাশুড়ী ছফিনা বিবি খুব রাগ করেন।আবার ছোট ছেলে দুইটা ঘরে একা ঘুমিয়ে, ওদের রেখে অত দূর যেতেও অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে উঠে!

মিনি যেই ঘুরে ঘরে ফিরে যাবে অমনি ধাক্কা খেল কিছু একটার সাথে। বেশ জোরেই। হাতের কুপী বাতি ছিটকে চলে গেল বেশ দূরে।
মিটি মিটি আগুনে মিনি মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। ও বাতি তুলবে কি? এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে খিল দিল।

মেহরাবকে কোলে নিয়ে আবার ডাকলো,"সজীব, এই সজীব।"
ছেলে যে বয়সেরই হোক, ছেলে মানেই সাহস! কিসের কি? সজীব ঘুমিয়ে কাঁদা।
বাড়িতে ঢোকার গেটেই মিনি দাঁড়িয়ে ছিল, মহিলা এলো কোন দিক দিয়ে? অবশ্য পশ্চিম দিকটায় নারকেল গাছটার নিচে কোন বেড়া নাই, ওদিক দিয়ে আসতে পারে। তবে ঐদিকে তো পথ নাই, খালি জঙ্গল, ঘন গহীন জঙ্গল!মহিলা জঙ্গল থেকে আসবে কেন?
মিনি ভয়ে কুকড়ে যায়।

দরজার চৌকাঠের নিচে কিছুটা ফাঁকা। সেদিকে ঠিকরে আসছে লাল আলোর আভা। মিনি মেহরাবকে বুকে জড়িয়ে সজীবের হাত ধরে বিছানায় পা উঠিয়ে বসে থাকে।
দরজায় টোকা পড়ে, ঠক!ঠক!
একবার দুবার তিনবার।
মিনি শাশুড়ীর কড়া নিয়ম ভূলে বেশ চিৎকার দিয়ে বলে,"আপনে চইল্লা যান, নাইলে আমি সোহাগের বাপরে ডাকমু।"

বাইরের জন কিছু বলে না। চৌকাঠের নিচ দিয়ে বাতির লালচে আভা আসতেই থাকে। আস্তে আস্তে চৌকাঠের নিচ দিয়ে আসে দুইটা কলা, পাকা সবরিকলা!
বাইরের জন মিহি মায়াময় গলায় বলতে থাকে,"ও মিনি, মিছা কতা কস কেন? তর মানুষটা তো বাইতে নাই। তুই হুদাই ডরাস! ছুডু গেন্দারে কলাডা খাওয়া, আহারে! পোলাডা দুফর থেইকা কিছুই খায় নাই। দোর খোল, বাতি নে। দুই পুলা নিয়া আইন্ধারে কতক্ষণ বইসা থাকবি!"

লালচে কুপি বাতির আলোয়, পাকা কলা দুইটাকে একটু বেশিই হলুদ দেখাচ্ছে। মিনি কলা দুইটা হাতে নেয়, ঠিকই তো আছে।

৩...
মিনি কুপি বাতিটা নেয়। বলে,"আপনে ঘরে আইসা বসেন।"
"আমি ঘরে আসমু না। আমার সারা শইলে ময়লা। আমারে একটা শাড়ি দিবি, লাল শাড়ি! তর তো তিনডা আছে, একট দিলে কিছুই অইত না। গোসল দিয়া পরতাম।"
মিনি একটা লাল নতুন শাড়ি বের করে দেয়,এখনো ওটার ভাজ খোলা হয়নি। পেছনে আসতে থাকে, কল থেকে পানি তুলে দিবে।
বুড়ি খিস্তি কাটে," ও মা, তুই বাইর হইছস কেন? রাইত বিরাতে সোন্দর বৌ-বেটির ঘর থেইকা বাইর হওন মানা। জানস না,বাড়ির কাছেই গোরস্থান। আর ঐহানে কব্বর দিছে তর চাচী শাশুড়ীরে। বেডি না খাইয়া মইরা গেছে!আহারে!"
মিনি দাঁড়িয়ে পরে।
"তুই ঘরে যা, পুলারে দুধ কলা খাওয়া।"

মিনির মেলে দেয়া পায়ে ঘুমিয়ে আছে মেহরাব। ওর মুখে রূপোর চামচে তুলে দেয়া হচ্ছে দুধ-কলা। ও ঘুমিয়ে পড়লেই খাইয়ে আরাম, জেগে থাকলে মুখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে।
মিনি একটু ঝুকে এসেছে ছেলে দিকে, ওর লম্বা চুল খুলে ছড়িয়ে গিয়েছে। তৈরি করছে একটা দেয়াল, বুড়িটা মিনি বা ছেলের মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

মহিলা কতক্ষণ আগে গোসল করে এসে ঘরের চৌকাঠে বসেছে, মিনি টের পায়নি। মিনি উনার দিকে তাকিয়ে বললো," আম্মা, আমিতো এরে খাওয়াই। আপনে নিজেই ভাত বাইরা খান।"
বুড়ি কিছু বললেন না।

বুড়ির ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। উনার মুখ অত কালো না, আবার ফরশাও না। কপালে লাল বড় টিপ, লাল শাড়ি আর লাল টিপে তাকে মানিয়েছে। সরুসরু পা- হাতের আঙুল, চিকন নাক আর লম্বা চুল দেখে যে কেউই আচ করতে পারবে, ইনি বেশ সুন্দরী ছিলেন। মিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
"কি রে নজর লাগাইয়া দিবি নাকি! আমি ত তর নখের যোগ্যও না, তুই কত সোন্দর!" বলেই মহিলা হাসতে লাগলেন।
মিনি লজ্জা পেল।

মিনি মহিলাকে ভাত বেড়ে দিয়েছে। মেঝেতে বসার পিড়ি দিয়েছে, উনি ভেতরে বসলেন না।
প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাত, আর ভাজা মাছের চাক।
ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে মহিলা বললেন,"আমি মাছের চাক খাইতাম না, আমারে কাতলার মাতাডা দে।"
"আম্মা, আমিতো ঐডা ভাজি নাই। হলুদ দিয়া মজাইয়া রাখছি।"
"হ, জানি। ঐডাই দে।"

৪...
কাজাইকাটা হাসমত পুলিশের বাড়ি। এ বাড়িতে গত এক বছর বাতি নিভে না। আজও জ্বলছে, তবে আজকের আলো অন্যরকম! বাতির লাল শিখা যেন কেন্দ্র আর চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা ছফিনা বিবি, ছাত্তার খান, দৌলতুন্নেছা বকুল,শিউলি বেগম, হাসমত পুলিশ, সারোয়ার জাহান, বদরুল আলম আর সোহাগ যেন পরিধির একেকটা বিন্দু। এরা সবাই অস্থির। কারণ হাসিনূর বৃত্তের বাইরে। অথচ সবাই এই মেয়েটাকে সারা জীবন স্নেহের বৃত্তে বন্দি করে রাখতে চান।

হাসিনূর ঘোষণা দিয়েছে আজকে সে কিছুই খাবে না। এমনকি ওষুধও না!
হাসিনূরের কঠিন একটা রোগ হয়েছে। ওষুধ কিছুতেই বাদ দেয়া যাবে না।এখানে উপস্থিত কেউ কিছুই করতে পারছে না।ও কারও কথা শুনছে না।

৫...
খাওয়া শেষ করে বুড়ি বললো,"মিনি কাজাইকাটা যাইবি? হাসিনূর রাগ করছে। ভাত খাওন, অষুদ খাওন বন্ধ। তুই গেলেই খাইবো!"
"না, আমি যাইতাম না। কত রাইত অইছে। আর আমার শাশুড়ী, সোহাগের বাপে খুব রাগ করবো।"
"হেগর রাগের খেতা পুড়ি! তুই যাইবি কিনা ক?"
"না, আমি যাইতাম না।"

বুড়ি চলে গেল।মিনিও দুই ছেলে নিয়ে শুয়ে পরলো। ওর ঘুম আসছে না কিছুতেই।চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে, হাসিনূর খিলখিল করে হাসছে। আর একটু পরপর বলছে, মামী খাবার কি আছে দেন। পেটের নাড়িভুঁড়ি খিদায় হজম হয়ে গেল।
মেয়েটা একটু পরপর খায়। সারাদিন মুখের এক মূহুর্ত অবসর নেই।
মাঝেমধ্যেই ঘোষণা দিত,"নানী, আজকে মামির ছুটি। আজকে মামী কোন কাজ করবে না।"
ছফিনা বিবি বলতেন,"তাইলে এত রান্ধন, ঘর-দোর ঝাট কেডায় দিবো, গরুর পানি,খইল কেডায় দিবো!"
হাসিনূর চোখমুখ শক্ত করে বলতো,"সব আমি করবো। নানী তুমিই কও আমার রান্ধা খাইতে পারবা নি? আর আমারে দিয়া এত কাম করাইছ, তোমার মেয়ে শুনলে তোমারে কি করবে!"
ছফিনা বিবি আর কথা বাড়াতেন না। ঐ একদিন মিনি সারাদিন ছুটি পেত। গত এক বছর মেয়েটা অসুস্থ। মিনির ঐ ছুটিও আর পাওয়া হয় না!

মিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, যা হবার হবে। ও সজীবকে ঘুম থেকে তুলে। মেহরাবকে কোলে নেয়। ঘরে তালা দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকে,"আম্মা, ও আম্মা আপনে আছেন?"
কোথাও মহিলার সাড়া পাওয়া যায় না। মিনি কিছুটা ভয় পেলেও হতাশ হয় না। আজ ও একাই কাজাইকাটা যাবে।
রাত কয়টা বাজে, কে জানে?
মেম্বর বাড়ি থেকে কোন দেবরকে ডেকে নেয়া যায়, তাও করা যাবে না। বাড়ির বৌ এত রাতে বাইরে যাচ্ছে, কেউ মেনে নিবে না। অগত্যা মিনি দুই ছেলেকে নিয়ে একাই হাটা শুরু করে।

মেহরাব মিনির কাধেই বেঘোর ঘুমে। সজীবের ঘুম এখনো ভাঙে নাই। এলোমেলো পায়ে কিছুক্ষণ হাটতেই ঘুম কেটে গেল। ও প্রশ্ন করতে শুরু করলো এত এত!
"আম্মা, এত রাইতে কই নিয়া যাও। নানীগর বাড়ি নি?"
"আমরা কাজাইকাটা যাই।তোমার হাসিনূর আফারে দেখতে।"
"তয় সকালে গেলে কি অইত! আব্বারে কইলে একটা রিশকা আইন্না দিত।আর আমিতো পুরান পেন পিইন্দা আছি।একটা নতুন পেন পিনলে কি অইত!"
সজীব একটা কিছুর সাথে উষ্টা খেল।
মিনির এক হাতে হারিকেন, আরেক হাতে সে শক্ত করে ধরে আছে কোলের ছোট ছেলেকে, সজীব মায়ের আঁচল ধরে হাটছে। হারিকেনের আলোয় অন্ধকার ঠিক কাটছে না। মাঝখানে আবার ছেলের এমন কথার উৎপাত।
"আম্মা, তোমার মনে আছেনি! আমিতো ভাতও খাইনাই। আমার তো খিদা লাগছে। আম্মা, ও আম্মা কতা কও না কেন?লও বাইতে যাই, খাইয়া আবার রওনা দিমুনে। চিন্তা নাই, মাছ ভাজা দিয়াই ভাত খামু। তুমি একটু নুন দিয়া মাখাইয়া দিয়ো। আম্মা, ও আম্মা, তুমি কথা কও না কেন?"

মিনির রাগ হচ্ছে খুব। ছেলের গালে এক চড় দিলে ওর কথা থামতো।কোন অজানা কারণে মিনি সন্তানদের মারে না। মিনি ছেলের হাতে হারিকেন দিল, ওকে ব্যস্ত রাখলে যদি কথা বলা কিছু কমে!

৬...
সমস্যা হল কোটেরচর মাদ্রাসা পাড় হয়ে মোড়ের দিকে আসতেই। ওখানে একটা ঘন বাশ ঝার। জায়গাটা একটুও ভালো না। মানুষ নানা কথা বলে, এখানে নাকি কি দেখেছে!
মিনির ছোট ছেলেদের নিয়ে এগিয়ে যাবার সাহস হয় না। আবার ফিরেও যেতে চায় না।
মোড়ের ঝাপ ফেলা দোকান থেকে হাসাহাসির আওয়াজ আসে। তাস পিটাচ্ছে হয়তো।
আচ্ছা, ওদের বললে কি মিনিকে বাশ ঝার পাড় করে দিবে? মিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
তবে সে বাশ ঝার এড়িয়ে ধানের ক্ষেত দিয়ে হেটে যেতে পারে।
সেই ভালো! এই ভেবে মিনি ক্ষেতের আইল দিয়ে হাটা শুরু করে।

ও হাটতে পারলেও সজীব পারে না। দু'বার পড়ে গেল। ধানের ক্ষেতে পানি দেয়া হয়েছে।
ধান ক্ষেত সবুজ হবার কথা, সাদা আকাশে মৃদু আলো আছে।তাতে কি? নিচের দিকে তাকালে আবার অন্ধকার!
সজীব পড়ে গিয়ে হারিকেন ভিজিয়ে ফেললো। ও কাদায় মাখামাখি আর হারিকেন নিভে গেল।
"আম্মা, ও আম্মা কিছুইতো দেহি না। আম্মা, আম্মা আমারে ধর।"
মিনি ছেলেকে ধরে তুললেন। সজীবের চেচামেচিতে মেহরাবও মাথা তুলছে, জেগে গেছে হয়তো।

মিনি সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ, কে জানে?
সজীবও চুপ, ও বুঝতে পেরেছে পড়ে গিয়ে বিরাট অপরাধ করেছে! হারিকেন নিভিয়ে ফেলেছে।

কেউ সামনে থেকে কথা বললো,"তহন আমি কইলাম, তুই না করলি যাইতি না। অহন এলকাই রওনা দিছস। তর বিরাট সাবাস! রাইত বিরাইতে সোন্দর বৌ-ঝিয়ের বারিত্তে বাইর হওন লাগে না।নিয়ম নাই।এগুলা তরা কবে বুঝতি!"
মিনি চিনতে পেরে আর কথা বলে না।
মহিলা খিস্তি করতে থাকেন,"আমারে ধর, পুইল্লাডারে আমার কুলে দে। আর ফরফরাইন্না বান্দররে তুই ধর। অর সারা শইল্লে প্যাক। আমি আমার শাড়ি নষ্ট করমু নি!"
সজীব আবার কথা বলে,"আম্মা, ফরফরাইন্না বান্দর কেডা? বুড়ি আমারে বান্দর কয় নি? আম্মা, আমি বান্দর নি?"
বুড়ি আর মিনি দুজনেই হাসেন।

৭...
কাজাইকাটা হাসমত পুলিশের বাড়ি রাস্তার পাশেই, কাজাইকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো দিকে। মিনি, সজীব, মহিলাটি বাড়ির গেটেই দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা মিনির কোলে মেহরাবকে দিয়ে বললেন,"তুই বাইতে ঢুক।আমি খাড়াইছি।"
মহিলা সজীবের হাতে দিলেন একটা চটের ব্যাগ। তাতে সাদা বকফুল, বুবি(লটকন) আর আধা কাঁচা বড়ই।

ঘরের পিছনে মিনি সজীবের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে যাবার সাহস হচ্ছে না। তার শাশুড়ী আর সোহাগের বাপ নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে।

হটাৎ কি হল, কে জানে? হাসিনূর তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এল। খালি পায়ে নিঃশব্দে ঘরের পিছনে এসে মামির পিছনে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার দিল। মিনিও ভয়ে চিৎকার দিল।
দুজনে গায়ে পরে হাসতে লাগলো।
সজীব আপার জামা ধরে টানছে আর বলছে,"আফা, চাইয়া দেহ, ঐ বুড়ি আমারে কইছে ফরফরাইন্না বান্দর। আফা দেহ, দেহ না। ও আল্লা, বুড়ি জংলায় যায় কেন?"
মা আর আপা এত আনন্দিত! সজীবের কথা শোনার সময় কই?

মিনি জিজ্ঞেস করলো,"আম্মা, আপনে কি খাইবেন?"
হাসিনূর হাসতে হাসতে বললো,"যা খাবো তাই এনে দিবেন? বলেন, মামী বলেন।"
"হ্যা, দিবো।"
মিনির কথায় এত জোর নাই। ওর গলা ধরে আসে। এই সুন্দরী মেয়েটার ভীষণ অসুখ! তাতে মেয়েটার সৌন্দর্য একটুও কমেনি। আরও বেড়েছে, গাল হয়তো একটু ভেঙেছে, চুল এলেমেলো, চোখের নিচে কালো দাগ; দেখতে আরও ভালো লাগে। মিনি গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়!
"তাইলে পাকনা বুবি(লটকন), কইষ্টা বড়ই আইনা দেন। লবণ দিয়া খাই। আচ্ছা মামী, বক ফুলের বড়া আর গরম ভাত খাইতে মন চায়। পারবেন?"

দৌলতুন্নেছা বকুল, শিউলি, ছাত্তার, সারোয়ার, হাসমত পুলিশ সকলে একটা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন।
হাসিনূরের হাতে বুবি, আর আধাপাকা বড়ই। ও উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে লবণ মিশিয়ে চুকচুক শব্দ করে খাচ্ছে৷
চালুনে ছড়ানো সাদা বকফুল। চুলায় আগুন জ্বলছে, বক ফুলের বড়া ভাজা হবে। মিনি, হাসিনূর কি কারণে হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠছে। চুলোর লাল আগুনের আভা এদের দুজনের মুখে পরেছে, দুজনকেই কি সুন্দর লাগছে। কে বলবে, হাসিনূরের এক বছর ধরে অসুখ!

বাকিরা চাইলেও এদের সাথে সামিল হতে পারছে না। এদের ঘিরে একটা বৃত্ত, এ বৃত্ত স্নেহ-ভালোবাসায় টইটম্বুর। বাকিদের জায়গা কই?

মন্তব্য ২০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৪৫

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন:
সত্য ভালবাসা এই একই রকম । যা মৃত্যুর পরে শেষ হয় না .।

ভালবাসা হ'ল একমাত্র জিনিস যা আমাদের সমস্যা বহুল জীবনে কিছুটা হলেও শান্তির প্রলেপ দিতে পারে ।

১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪২

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: সমস্যা চিরন্তন, অসীম; ভালোবাসা ক্ষনিকের। তাই মানুষ অত গুরুত্ব দেয় না।

২| ১২ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৫২

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: অবশেষে লিখতে পেরেছেন দেখে খুব খুশি হলাম। পড়ি নাই এখনো । সময় নিয়ে পড়বো ইনশাআল্লাহ

১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: অনেক প্লট পরে আছে। ভুজংভাজাং দিয়ে শেষ করে দিছি!
হ্যা, আপনাদের দোয়া কাজে লাগছে।

৩| ১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৩৫

রাজীব নুর বলেছেন: মানুষ বুঝে না-
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অস্ত্রই হলো ভালোবাসা।

১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: হ্যা, ঠিক আছে। অস্ত্রের ক্ষত অবিনশ্বর হলেও ফলাফল ক্ষণস্থায়ী! চারপাশে এত সমস্যা, মানুষ একে আর অত গুরুত্ব দেয় না।

৪| ১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৪০

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অপরূপ ভাবনা। বস্তুনিষ্ঠ লেখা।

১২ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৩

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: আপনারা এত প্রশংসা করেন। উত্তরে কি বলতে হয়, আমার জানা নেই।
ভালো থাকুন।

৫| ১২ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:৪৭

মা.হাসান বলেছেন: সমস্যা আসলে ক্ষণিকের, ভালোবাসা চিরন্তন।
সুপার লেখা।

১২ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: এমনই হওয়া উচিত, আসলে কি তাই হয়?

৬| ১২ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৪

ইসিয়াক বলেছেন: ভালো লেগেছে খুব।

১২ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৭

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: রফিক ভাই ফিরে এসেছে! আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে....

৭| ১২ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১২

ইসিয়াক বলেছেন: প্রতি মন্তব্যে সত্যি সাত্য ভালো লাগা।
মিষ্টি আন্তরিকতা মাখানো।
ভালো থাকুন ভাইয়া।
শুভকামনা।

১২ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:০৪

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ, রফিক ভাই।

৮| ১৩ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: হ্যা, ঠিক আছে। অস্ত্রের ক্ষত অবিনশ্বর হলেও ফলাফল ক্ষণস্থায়ী! চারপাশে এত সমস্যা, মানুষ একে আর অত গুরুত্ব দেয় না।

জীবনের পথ মসৃন নয়।
জীবন মানেই সমস্যা। এইসব সমস্যা মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হবে। এটাই মানব জীবনের নিয়ম।

১৪ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:৩১

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: জীবন আমার অত লম্বা নয়, মাত্র ২৪ বছরের। তবুও মাঝেমধ্যে ক্লান্ত, বিরক্ত লাগে। মানুষ ৭০-৮০ বছর কিভাবে বেচে থাকে, কে জানে?

৯| ১৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:১৪

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: খুব সুন্দর হয়েছে

১৫ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৩৮

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: পড়েছেন! আমি ভাবলাম, ভুলে গেছেন হয়তো।

১০| ১৬ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:১৯

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: না আপনার লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করি। আপনি আমার প্রিয় লেখক না :)

১৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৪৮

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: হা হা....
আপনি লজ্জায় ফেলে দেন!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.