নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১...
সকাল আটটায় ছেলেটা যায়।ঠিক যায় বলা যায় না, কচ্ছপ গতিতে এগোয়। বাচ্চারা যেমন চারপাশে তাকিয়ে থেমে থেমে চলে, তা কিন্তু না। সে চলে ইটের রাস্তার দিকে তাকিয়ে। যেখানে যাচ্ছে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ নেই হয়তো। সে ১১ টার দিকে একই ভাবে বাসায় ফিরে।
আবার সেদিন দেখলাম ও তিনটার দিকে ওদিকে যাচ্ছে, একইভাবে যাচ্ছে।পাশে মজা পুকুরে কচুরিপানা ছেয়ে আছে, মাঠে ওরই বয়সী ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলছে, ওর পিছনে ছুটছে কুকুরের বাচ্চার দল, পুকুরপাড়ে ফুটে আছে জংলী ফুল। ওর সেদিকে খেয়াল নেই, অথচ আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিল গাদা, রজনীগন্ধার চেয়ে নাকি জংলী ফুল অনেক বেশি সুন্দর। আমি যেদিন জলজ উদ্ভিদ পড়াচ্ছিলাম, ও বললো, ও কোনদিন পানা, কলমি, হেলেঞ্চা দেখেনি। ও চাইলেই এখন দেখতে পারে, দেখছে না কেন? আগ্রহটা কোথায় গেল?
আমি খেয়াল করা শুরু করলাম। আমার কোন কাজও নেই, একটা পেলাম আরকি!
সন্ধ্যা ৬টার পর আন্টিকে দেখলাম ওকে নিয়ে ফিরছে। গত পাচ দিনে এই রুটিন পরিবর্তন হয়নি। আমি ছেলেটাকে ভালোভাবেই চিনি, ও আমার ছাত্র। ওর বাবা এলাকার সবচেয়ে বড় ফার্মেসির মালিক, উনি শুরুতে ঢাকায় এসে ভ্যান চালিয়েছেন। আন্টির কথা উনারা শুরুতে কষ্ট করেছেন, ছেলেরাও কষ্ট করবে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে এত সম্পদ করছেন কেন?এদের আরামের জন্য না? তিনি উত্তর দেননি।
খেয়াল করুন, ছেলেটা মোট ছয় ঘন্টা কোচিং-এ যাচ্ছে। দিনের অর্ধেক, অথচ কিছুদিন আগেই ও পিএসসি পরিক্ষা দিয়েছে। কি একটা পরিশ্রমের কাজ, পরিক্ষা দিয়ে এসে স্বস্তি নেই। আবার পরের দিনের জন্য ফাইট শুরু!ছেলেটার মুখে সে কয়দিন হাসি ছিল না।
আমি বলেছি, পরিক্ষার দশদিন আগে পড়লেই চান্স পাবে। আর কিছু লাগবে না। শোভন কিছুদিন ছুটি পাক।না, তারা রাজি নন। তারা ওকে কোচিং-এ দিয়ে দিলেন। কারণ যেভাবেই হোক, সরকারি স্কুলে চান্স পেতে হবে।কোচিংটাও অসময়ে, খেলার সময় আর একটু বেশি ঘুমের সময়ে!
আমাকে কাল থেকে ওকে পড়াতে যেতে হয়।ও বারবার হাই তোলে, ওর মলিন মুখ দেখে আমার মন খারাপ হয়।আমি ওর সাথে গল্প করি, ক্লাসে কি হল?দুনিয়ায় আশ্চর্য কি কি আছে? আরও কত কি! ও বেশ হাসে, অবাক হয়।
আমি সময় কাটিয়ে চলে আসি।
শোভন ছাত্র হিসেবে দারুণ, দ্রুত বুঝতে পারে, প্রশ্ন করে, ভালো রেসপন্স করে!কিন্তু কোন অজানা কারণে পরিক্ষায় ফুল উত্তর করে আসে না!
২...
যেদিন শ্রাবণকে প্রথম পড়াতে যাই, ও মাত্র এইটে উঠেছে। আন্টি আগেই বলেছেন, ও অংক ইংরেজিতে শুধু ফেল করে। আর প্রতি ক্লাসে টাকা দিয়ে পরের ক্লাসে উঠে, মাইলস্টোনে এই নিয়ম।
যাইহোক ও আমাকে দেখেই টয়লেটে চলে গেল।
ফিরলে আমি একটু পড়াতে শুরু করলাম, ও আবার টয়লেটে চলে গেল। সহজেই অনুমেয়, আগের স্যার ওকে মারতেন। আর ও পড়াশোনায় আনন্দ পাচ্ছে না।
শুধু কি তাই? আমি হয়তো কিছু একটা বোঝাচ্ছি, ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও ঘুমোচ্ছে।
ও ঘুমিয়ে পরে, টয়লেটে বসে থাকে। আন্টি বাসায় না থাকলে কল দিয়ে বলে, আজ পড়বে না। আমি বিরাট যন্ত্রণায় পরে গেলাম। যে টিউশনি এনে দিলেন, প্রতিনিয়ত বলেন, যাইহোক ওকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। আর টাকাটাও আমার খুব দরকার!
আমি ওর সাথে গল্প শুরু করলাম। নানা বিষয়ে গল্প, আমার ক্লাসে কি হয়, রাস্তায় কি দেখেছি, আমার ছেলেবেলার কাহিনি, ঈশপের গল্প ইত্যাদি নানা বিষয়। একটা অভ্যাস তৈরি করতে মানুষের ২১ দিন লাগে। আমি চেষ্টা শুরু করলাম।
কয়েক দিনেই ও ঘুমিয়ে পরা আর টয়লেটে বসে থাকা কমিয়ে দিল। আমি গল্পের ফাকে ফাকে পড়ানো শুরু করলাম।
আসলে ওর পড়ার আগ্রহ নেই, যার বাবা আব্দুল্লাহপুরের ক্যাডার, মামারাও নাকি চাদা তোলে, আব্দুল্লাহপুরের অর্ধেক নিজেদের দাবি করে; মায়ের বাড়ি আছে, ব্যাংকে টাকা, আমি নিজেও ওর পড়াশোনা করার কোন কারণ দেখিনা!
যাইহোক, আমি গল্প করি আর কিছু কিছু পড়াই। একদিন ওর বাবা আমাকে খুব করে ধরলেন।আমি নাকি শুধু গল্প করি, কিছুই পড়াই না। উনি অনেকদিন লক্ষ্য করেছেন।
আমি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, উনি বেকে বসলেন। আমার কাছে লিখিত নিলেন, শ্রাবণ ফেল করলে আমাকে টাকা দিবেন না। পাস করলে দ্বিগুণ টাকা দিবেন। আমি সাদা কাগজে লিখে দিলাম।
সে বার শ্রাবণ অংক, ইংরেজি দুটোতেই পাস করে গেল। গত কয়েক বছরে যা হয়নি, তাই হল। উনি কিন্তু আমাকে দ্বিগুণ টাকা দেননি।
আমরা সব খাই, সবচেয়ে বেশি খাই লজ্জাত মাথা।
বলাই বাহুল্য উনি কিন্তু শ্রাবণের বায়োলজিকাল পিতা নন, আন্টি ওর বাবাকে তালাক দিয়ে উনাকে বিয়ে করেছেন!
শ্রাবণ জেএসসিতে এ+, এসএসসিতে বাংলা আর কৃষিতে খারাপ করেছে তাই এ+ আসেনি। তবে আর কখনো অংক, ইংরেজিতে ফেল করেনি৷ উনাদের অনেক টাকা বেচে গেল।
আমি এখনো শ্রাবণের সাথে গল্প করি, এর ফাকে ফাকে পড়াই। ওর সামনে এইচএসসি পরিক্ষা। আগে যে ছেলের পাস নিয়ে আন্টি চিন্তিত থাকতেন, এখন তিনি এ+ এর জন্য হাসফাস করেন।
আমি ওকে এসব নিয়ে কিছু বলিনা, আমার অত মাথাব্যথা নেই।
৩...
একটা ভয়ানক এলাকায় থাকি!আমার বয়সী ছেলেগুলো চিপাচাপায় আড্ডা দেয় আর ধুমিয়ে গাজা খায়। একজন ছাড়া কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে না বা পড়েনি না। এর চেয়ে এক ব্যাচ ছোটরা আবার আমার বোনের বন্ধু, তাই তাদের সাথেও ঠিক মিশা হয় না। আর আমার ধারণা, আমাকে বন্ধু হিসেবে কেউ ঠিক নিতেও পারে না!
ক্রিকেট খেলতে খেলতে পরিচিত হয়ে গেলাম কলেজ পড়ুয়া কয়েক জন ছেলের সাথে। দারুণ সময় কাটছিল!আড্ডা দেই, ক্রিকেট খেলি বা ক্যারম খেলি,মাঝেমধ্যে বিলিয়ার্ড খেলতে যাই।
প্রায়ই এখানে সেখানে ঘুরতে যাই আর কাচ্চি খেতে যাই পুরান ঢাকা।
রাহাত সিগারেট খাওয়া শিখে নিল।আস্তে আস্তে গ্রুপের বাকি ছেলেগুলোও শুরু করলো। সিগারেটে আমার কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা শুরু হল, ওরা যখন গাজা শুরু করলো।
কথায় আছে শিক্ষক সবাইকে ছাত্র মনে করে উপদেশ দেয় বা ভালো ভালো কথা বলে। আমিও তাই শুরু করলাম। ওরা খাওয়া ছাড়লো না, তবে আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করলো।
কেউ ছাড়েনি তা না, সাব্বির সিগারেটও ছেড়ে দিল। বাবু সিগারেট ছাড়লো না, তবে গাজা ছেড়ে দিল!
ওরা এখন আমাকে আর আড্ডায় ডাকে না, ওদের আড্ডার বিষয়বস্তুও ভয়ানক! কে কয়টা প্রেম করলো আর কোন মেয়েটাকে কিভাবে পটিয়েছে বা **** করেছে! আমাকে আড্ডায় ডাকলেও আমি জয়েন করতে পারিনা। এখন আর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না।
মাঝেমধ্যে সাব্বিরের সাথে কথা, আড্ডা হয়, বাইরে খেতে যাওয়া হয়।
আস্তে আস্তে ওদের গ্রুপটা একটু বড় হয়ে গেল। গাজা খাওয়ায় বেশ ফাইন্যান্স করে বাবু। ওর ধারণা ওর বন্ধুরা ওকে দারুণ পছন্দ করে। ও আর যাইহোক এগুলা খাওয়া ছাড়বে না।
আমি বললাম, তুমি সবার গাজা কেনার টাকা দেয়া কিছুদিন বন্ধ করে দাও,দেখবে ওরা আর তোমাকে ডাকছে না।
বাবু আমার কথা মানলো না। তবে রাজি হল যে, যদি তাই হয় তবে ও গাজা খাওয়া ছেড়ে দিবে।
চারদিন পরেই বাবু বললো যে, সে আর গাজা খাবে না।
এই মাদকদ্রব্য আর টাকা বিরাট শক্তিশালী। আমি সিগারেট খাই না দেখে আমার অত বন্ধু নাই। বেশিরভাগ বন্ধুত্ব নাকি "ভাই, আগুন হবে?" দিয়ে শুরু হয়।
৪...
সৃজনশীল মানুষগুলো Atelophobia আর Autophobia দ্বারা আক্রান্ত।
Atelophobia আক্রান্ত লোকদের মনে হয়, তিনি কোন কাজ ঠিকভাবে করতে পারছেন না। তিনি একটা টপিক নিয়ে লিখবেন, ঐটা বারবার পড়বেন, এডিট করবেন, তারপরেও মনে হবে ঠিক হয়নি।এছাড়াওঃ দরজা বন্ধ করে বের হবার পর মনে হবে, উনি দরজা বন্ধ করেননি; কোন সংখ্যা লিখে বারবার চেক করবেন তবুও মনে করবেন, উনি ভূল করেছেন। কিছুতেই স্বস্তি পান না। ডেভিড ক্যামেরুন Avatar 2 মুভির শ্যুটিং করছেন, এডিট করছেন, তার নিজের কাছেই ভালো লাগছে না।আবার শ্যুটিং করছেন! ২০১৮ সালে মুভি মুক্তি দেবার কথা ছিল, কবে নাগাদ দেখা যাবে বলা যায় না!
আমি মোটেই গুল মারছি না, শরৎবাবু "দেবদাস" লিখে দু'বছর ট্রাঙ্ক বন্দি করে রেখেছেন। উনার ধারনা ছিল, এটা বাজে ধরনের একটা উপন্যাস হবে।জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করলেন, গাছের প্রাণ, রেডিও তরঙ্গ। কিন্তু তিনি কোন বিজ্ঞান সংস্থায় পরিক্ষার প্রমাণ-তত্ত্ব পাঠালেন না। উনি ভাবলেন, এই সস্তা আবিষ্কার কেউ গুরুত্ব দিবে না।
Autophobia আক্রান্ত লোকজন সবসময় এই ভয়ে থাকেন যে, তার পছন্দের মানুষটা তাকে ছেড়ে যাবে। এই ভয় থেকেই আশ্চর্য সব কাজ করেন। যেমনঃ তার পছন্দের কথা মানুষটাকে জানিয়ে দেন। তাকে কে বোঝাবে, কাউকে একটু পছন্দ করলেই দুনিয়ার সব এটিটিউড তার মাঝে জমা হয়!
অবশ্য নিঃসঙ্গ সৃজনশীল লোকগুলো দারুণ সব শিল্প সৃষ্টি করেন।
জ্যারেড লেটো'র কথা মনে আছে? ২০১৬ সালে Suicide Squad'এ জোকারের অভিনয় করেছিলেন। উনি এই চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য ১মাস একটা বন্ধ ঘরে কাটিয়েছেন,কারও সাথে কথা বলেননি, কেবল জোকারের মত নিঃসঙ্গতা উপভোগের জন্য। আমার কাছে তার অভিনয় দারুণ লেগেছিল!
Suicide Squad 2'তে তিনি আর অভিনয় করছেন না। ঐ ভয়ানক অবস্থার মধ্যে দিয়ে তিনি আর যেতে চান না।
একটা মজার ব্যাপার কি জানেন? প্রতিটি লেখক নিঃসঙ্গ। এই দারুণ দারুণ ঘটনা লিখেদেন, সবই তিনি ভাবেন, তার সাথে এমন ঘটতে পারতো। যেহেতু ঘটেনি, উনি কল্পনা করে বাকিটা লিখে দেন!
কবিরাও Autophobia'তে ভোগেন, তারা প্রতিক্ষণে প্রেমে পরেন।
১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৪৯
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ।
আপনি ব্লগ ডে'তে আসছেন?
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৯
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লাগলো পোষ্ট টি।
শরত বাবু যে দুই বছর দেবদাস ট্রাঙ্কে ফেলে রেখেছিলেন তাই ই জানতাম না।