নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নৌকাগুলোকে রাঙিয়ে দিলে কেমন হয়? লাল,নীল,হলুদ, সবুজ, বেগুনি, গোলাপি, কমলা, আসমানী রঙ; তবে কালো রঙ করা যাবে না।তুরাগের পানি এমনেই কালো, এতে কালো রঙ ফোটার কথা না।
এই নদী নোংরা, আগের সৌন্দর্য নেই। তাতে জনপদে কোন সমস্যা হচ্ছে না।মানুষ দলে দলে নদী পাড় হয়ে টঙ্গী বাজার যাচ্ছে, পুলাপানের দল সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতনে পড়তে যাচ্ছে, হুটহাট অসুস্থ মানুষকে নিয়ে আইচি হাসপাতালে আসছে,কেউ কেউ কাঁদতে বেড়িয়ে যাচ্ছে, কপোত-কপোতী সিমেন্টের রেলিঙে বসে আছে, স্বাগতম ফুচকার দোকানে বেশ ভীড়, Bamboo tea-stall'এ অনেক ভীড়, ছেলের দল চা খেতে খেতে গল্প করছে, হেসে একে আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে!বেশ আনন্দময় পরিবেশ। যে মানুষটা রোগী নিয়ে এসেছিল, মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ ছিল।কিছুক্ষণ পর সেও এই আনন্দময় পরিবেশের সাথে মিশে যায়, হাসি হাসি মুখে Bamboo চা বা স্বাগতম ফুচকা খেতে থাকে!
এই জনপদে অনেকে আসে, আবার ফিরে যায়।আমি একেবারে মাঝখানে বসে আছি, দুপাশে দুইটা ব্রিজ। একটা রেলের, আরেকটা বাসের। পোপো সাইরেন বাজিয়ে ট্রেন চলে যায়, বাসের হর্ন আমি শুনতে পাই না। তবে অনেক বাস যায়, নদীতে সাই সাই করে ডিঙি, ট্রলার যায়। আমার যাওয়ার জায়গা নেই। গত দুইদিনে আমি খুজে পাইনি!
গত কাল বিকেল থেকে আমি এখানেই বসে আছি। আইচি হাসপাতালের সামনে যেখানে মাটির জিনিস বিক্রি হয়, তার ঠিক উল্টো দিকের নদীতে নামার সিড়িতে। এখানে মোট ত্রিশটা সিড়ি, আমি বসে আছি উপর থেকে চৌদ্দ নম্বর সিড়িতে। দুইদিন ধরে এখানেই বসে আছি, আমাকে কেউ খুজতে আসেনি! কেন আসছে না?
আমি অনেক ভেবেছি, কোন কিনারা করতে পারিনি!
আমার পরনে কালো জিন্স, গায়ে ইজি'র নীল শার্ট, হাতে টাইটানের রূপালী চেইনের ঘড়ি, চোখে বড় কাচের ক্যারেরা ব্র্যান্ডের চশমা, পায়ের জুতা চকচকে কালো কালি করা। বোঝা যাচ্ছে আমার সামাজিক বা ব্যক্তিগত অবস্থা ভালো। কিন্তু আমার কাছে কোন মোবাইল নেই!এমন একটা লোকের কাছে নিশ্চয়ই মোবাইল থাকা উচিত। আমি সেলুনে নিজের চেহারা দেখেছি, কালো কিন্তু লছমি আছে। ঠিক অভিজাত না, আবার গরীব না। আমার পকেটে ১০ হাজার টাকা।একজন গরীব মানুষ নিশ্চয়ই পকেটে এত টাকা নিয়ে ঘুরবে না!
তবে আমার পকেটে কোন মানিব্যাগ নেই। একটা চিরকুট আছে, তাতে গোটা অক্ষরে লিখা
বাবা,
আজ অবশ্যই ভাইয়ের মোবাইল কিনে আনবে।ভাই কিন্তু তিনদিন ধরে ভাত খাচ্ছে না। আজকে মোবাইল না আনলে সে নাকি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। আমার জন্য একটা পারফিউম আনবে, রয়্যাল মিরাস। মনে রেখো বাবা। যা ভুলো মন তোমার!
টুকটুক
আশ্চর্য! আর একটা পরিবার আছে, মেয়ে আছে, ছেলে আছে। এদের নাম, এরা কোথায় থাকে, আমার মনে নেই।আমি দিন মনে করতে পারছি না!
কেবল মনে আছে, আমার স্ত্রীর নাম ইরা।সে মারা গিয়েছে, আমাকে বলে গিয়েছে যাতে কখনো ছেলেমেয়েদের কখনো কষ্ট না দিই। আমি কে?কোথায় থাকি? আমি আর কিছুই মনে করতে পারছি না।
আমি অনুমান করার চেষ্টা করছি। আমার মেয়ের নাম টুকটুক!এটা নাম নাও হতে পারে, অনেকে সন্তানকে আদর করে এসব নামে ডাকে।
আমার মেয়েটা বড়, বড় বোন ভাইদের আদর করে ভাই ডাকে।আমার ছেলেটা হয়তো সদ্য জেএসসি দিয়েছে বা নাইনে পড়ে। এই বয়সী ছেলেরাই মোবাইলের জন্য মাথা কুটে। আমি তাকে মোবাইল কিনে দিচ্ছি না কেন?
আমি তুরাগের পাড়ে বসে আছি,এরমানে আমার বাসা এদিকেই!
আমি নদীর পাড় দিয়ে হেটেছি, যতদুর লোকজন বসবাস করে। যদি কেউ ডাকে,"বাবা, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি চিন্তায় শেষ!" অথবা কেউ বলে," আরে **** ভাই, হাটাহাটি করছেন কেন বাসায় যান, ছেলেমেয়ে আপনাকে খুজছে।"
না কেউই ডাকেনি!
কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, টুকটুক নামে কাউকে চিনে কিনা? ইরা নামে কাউকে চিনে কিনা?
কেউ চিনতে পারে না। বুড়ো ধরনের একলোক বলেছেন,"নটি পাড়ায় যান, ঐখানে টুকটুকি ইরা দুইজনরে পাইবেন। যা অইতে কইবেন, ওরা তাই অইব।"
এদের বলাই বাহুল্য, এরা আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে।আমি হারিয়ে গিয়েছি।
আমার পাশের সিড়িতে একলোক কানে ইয়ারফোন গুজে, মোবাইলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তাও প্রায় দুই ঘন্টা ধরে। মোবাইলের স্ক্রিনে উনার আঙুল দারুণ বেগে ছুটছে।
উনার পরনে চেক শার্ট, এর গলা সুন্দর করে কাটা তবে কলার নেই।এই ধরনের জামা ড. ইউনুস সাহেব পড়েন। এগুলো নাকি গ্রামের গরীব লোকজন হাতে তৈরি করেন।
লোকটি তুরাগে পা ডুবিয়ে বসে আছেন। আমি কালও দেখেছি, লোকটা পা পানিতে ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলেন।
নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকলে মাথা থেকে দুশ্চিন্তা পানিতে চলে যায়। আমিও পা ডুনিয়ে রাখলাম, দুশ্চিন্তা গেল কিনা বুঝতে পারছি না। তবে নোংরা পানিতে পা চুলকাতে লাগলো।
আমি লোকটির পাশে দাড়াতেই উনি কথা বললেন,"কি ব্যাপার বলুনতো? আপনাকে কালও দেখেছি, এভাবে একাএকা বসে ছিলেন।কোন সমস্যা?"
যারা উপযাচক হয়ে আপনার সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করবে, তারা নিঃসন্দেহে ভালো লোক। আমি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম। মানুষকে চট করে বিশ্বাস করা অনুচিত।
"আপনি কি করছেন? কালও দেখেছি, আপনি এখানেই বসে ছিলেন। কানে ইয়ারফোন গোজা।"
"লিখছিলাম, আমি এখানে বসে বসে লিখি। অবশ্য দুদিন ধরে আপনি আমার জায়গায় বসে আছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা নদী দেখছেন।আমি ভাবতাম, এই তুরাগ কেবল আমারই ভালো লাগে!"
"কি লিখছিলেন?"
"গল্প লিখছিলাম, মিথ্যা গল্প।"
"আপনি সারাক্ষণ কানে ইয়ারফোন গুজে রাখেন?"
"না, যখন লিখি তখন রাখি।লিখায় মনোযোগ দেয়া যায়।আপনি গান শুনবেন? নিন শুনুন।"
"ক্রমশ এ গল্পে আরও পাতা জুড়ে নিচ্ছি
দুমুঠো বিকেল যদি চাও, ছুড়ে দিচ্ছি
আরও কিছুক্ষণ যোগাযোগ ধরে রাখছি
আঙুলে আঙুল যেন ভূল করে ডাকছি...."
অনুপম রয়ের গান। এই ভদ্রলোক আসলে গান লিখেন না, লিখেন একেকটা কবিতা। এগুলাই গান হয়ে যায়। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ইয়ারফোন ফেরত দিয়ে চলে এলাম।
এমন লোকের সাথে গল্প করা যায় না, এরা আগ্রহ নিয়ে কথা শোনেন পরে মিথ্যা মিশিয়ে কিছু একটা লিখে দেন। অবশ্য গল্প করতে পারলে ভালো হত, দেখা যেত আমার সব মনে পড়ে গেছে। তা সম্ভব না, উনিও চলে গেলেন।
আমি নর্থ টাওয়ারের চার তলায়। মোবাইলের দোকানগুলোয় ঘুরছি, দেখা গেল মোবাইল কিনতে এসে সব মনে পরে গেল। ছেলে মেয়ের নাম, ঠিকানা সব!
আমার মত অনেকেই মোবাইল কিনতে এসেছে। সবার সাথেই মা বাবা রয়েছে, উনারা বিরক্ত মুখে সন্তানদের সাথে হাটছেন বা দাঁড়িয়ে আছেন। দু'একটা দোকান ঘুরেই কারণটা স্পষ্ট হল। মোবাইলগুলোর দাম নির্ভর করে ক্যামেরায় কত ভালো ছবি আসে, এর উপর। যত ভালো ছবি আসে, তত দাম। মায়েরা বিরক্ত হবে না তো কি হবে?
আমার কোন মোবাইল পছন্দ হল না, কোনটাতেই ঠিক আমার মত ছবি আসে না। ছবিতে আমি আমাকেই চিনতে পারি না, আমাকে ফরশা করে ফেলে। মোবাইল কিনা হল না, কিছুই মনে পড়লো না।তবে মন খারাপ হয়ে গেল।
খুব বেশি হলে স্কুল পড়ুয়া হবে এক ছেলে বাবাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,"একটা মোবাইল কিনে দিতে পার না, তো জন্ম দিয়েছে কেন? এত বড় হলাম তুমি কখনো আমি যা চাই দিতে পারনি!"
ভদ্রলোক মাথা তুলে তাকাতে পারলেন না। আহারে! উনি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অক্ষম বাবা ভাবছেন। ছেলেটা Nokia X পছন্দ করেছিল!
আমি নিচতলায় কসমেটিকস'র দোকানে ঢুকে পড়লাম। টুকটুকের পারফিউম কিনে ফেলি। এখানে আরও ভীড়। মেয়েদের ভীড়ে কথা বলাই যাচ্ছে না।আবার কারও ধাক্কা লেগে যাওয়ার ভয়ে সামনেও যেতে পারছি না। কিছুদিন আগেই মেয়েরা "গা ঘেষে দাড়াবেন না" আন্দোলন করেছে। সচেতন থাকা আবশ্যক।
একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম, একটা গোল বাক্স কোথাও চাপ দিতেই ময়ূরের পেখমের মত মেলে গেল।ওখানে নানা রঙ, কি রঙ নেই?আর সাথে আয়নাও আছে।আরেকটা শোকেসের মত, বিভিন্ন ড্রয়ারে নানা রঙ।দারুণ সব মেকাপ বক্স, অথচ মেয়েটা একটাও না কিনে চলে গেল!
বিক্রেতা আমার কথা, শুনলো না। আমি দুবার বললাম,"রয়্যাল মিরাস পারফিউম হবে?" শেষবার জোরেই বললাম। তবুও শুনলো না।
একবার ভাবলাম টুকটুকের জন্য একটা মেকাপ বক্স কিনে ফেলি।নিশ্চয়ই সে খুব খুশি হবে।
আবার ফিরে গেলাম, আরেকদল মেয়ে ভীড় করেছে।
আমি আইচি হাসপালালের ঠিক সামনের হোটেলে খেতে বসেছি।বেশি দূরে যাইনি, আমার ছেলে মেয়ে খুজতে আসতেও পারে।
একটা ছোট চটপটে ছেলে এগিয়ে এল।
"স্যার কি খাবেন বলেন? মাছ,মুরগী, গরু, খাসি সব আছে। তয় আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনেরে দিবো চিংড়ি দিয়ে বরবটি ভাজি, কই ভাজা আর মুগের ডাল দিয়ে খাসির মাথার তরকারি। খেয়ে দেখেন,বিরাট স্বাদ পাবেন।"
ছেলেটা শুদ্ধ উচ্চারণে বলে গেল।
"তুইতো দারুণ কথা বলিস, স্কুলে যাস না?"
"না, যাই না।তবে আমার ছোট দুইজন যায়, আমি আর মায় কাজ করি।তারা পড়ে, সবাই স্কুলে গেলে টাকা আসবে কোথা থেকে? আমার মাকে চিনবেন, মা আটিপাড়া মোড়ে পিঠা বেঁচে, ভাপা, চিতই আর পুলি পিঠা। একবার খেয়ে দেখবেন।"
"তুই এমন শুদ্ধ ভাষা শিখলি কিভাবে?"
"আগে কাজ করছি এক মাস্টারের বাসায়। সে খুব ভালো মানুষ, তবে উনার স্ত্রী খুব মারতেন। তাই চলে আসছি। উনি শিখিয়েন।
স্যার, দোয়া করবেন। আমি পড়বো না, আমার ছোট দুজনকে পড়াশোনা করাবো,একজন হবে ডাক্তার আরেকজন জজ।"
ছেলেটার প্রত্যয় যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
কি সুন্দর একটা মুখ!ছোট করে কাটা চুল, টিকালো নাক, পাতলা ঠোটের ছেলেটাকে দেখে মায়া লাগলো। আবার ভালো লাগলো, এতটুকু ছেলে কত দায়িত্ব কাধে নিয়ে বসে আছে! আর আমি দুদিনে কিছুই মনে করতে পারছি না, আমার ছেলেটা দেখতে কেমন? সে কি শুদ্ধভাষায় কথা বলে?সে কি আজ ভাত খেয়েছে? মেয়েটাই বা কেমন? তারা কোথায়, কিছুই না!
"ও স্যার, আপনি কাঁদছেন?"
"না রে।"
"স্যার, কাল থেকে দেখছি আপনি এদিকেই হাটাহাটি করছে, নদীর পাড়ে সিড়িতে বসে আছেন। মাঝরাতে প্রস্রাব করতে বেড়িয়েও দেখি আপনে জেগে আছেন। হাসপাতালে আপনার কেউ নাই, আপনাকে একবারও ঐদিকে যেতে দেখিনি।স্যার, কি হয়েছে আমাকে বললেন? আপনি কি ঘুমাবেন?আমার ঘরে একটু ঘুমান,ভালো লাগবে।"
একটা ছোট ঘর, একটা ওয়াশরুমের চেয়েও ছোট। কোন খাট বা চৌকি নেই। মেঝেতে একটা কাথা বিছানো, একটা তেল চিটচিটে বালিশ, পাশেই একটা মাটির ব্যাংক।এক কোণে একটা নকশা আকা মাটির টবে মানি প্ল্যান্ট, দেয়ালে তিনটা প্রজাপতি মাটির প্রজাপতি। ঘরে আর কিছু নেই, তবু ভালো লাগছে।কঠোর দুনিয়া ছেলেটাকে ভেতরে মেরে ফেলতে পারেনি।
এই ছেলেটির একটা ঘর আছে, আমার ঘর আছ কিনা আমি তাও জানি না।
আমি ছেলেটার হাত ধরে কেঁদে ফেললাম,"বাবারে আমি হারিয়ে গিয়েছি।আমি কে?কোথায় থাকি?কোথায় যাবো? আমার কিছুই মনে নাই!"
"স্যার, কাঁদবেন না।ঘুমান, একটু ঘুমান। দেখবেন, সব মনে পড়েছে।"
সেও চোখ মুছছে।ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি, আমি নিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি ঠিক নেই। আমাকে ডেকে তুললেন হোটেল মালিক।
একটা স্বপ্ন দেখেছি। ইরা মারা গেছে, আমি শুয়ে শুয়ে কাঁদছি, একটা বাচ্চা মেয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,"বাবা কেঁদো না, আল্লাহ পছন্দের মানুষকে নিজের কাছে নিয়ে নেন। তাই মাকে নিয়ে গেছেন। তুমি কেঁদো না।"
মেয়েটি নিশ্চয়ই টুকটুক, চুল দিয়ে ওর মুখ ঢাকা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটু দূরে একটা ছেলে খেলা করছিল,"হাতি ঘোড়া গেল তল, পিপড়ে বলে কত জল।"
ওর হাতে একটা মাটির হাতি একটা ঘোড়া। আমি ওর পিঠ দেখছিলাম, টুকটুক ওকে নাম ধরে ডাকলো। আমি শুনতে পেলাম না, এর আগেই আমাকে ডেকে তুলল!
আমি কারও চেহারা দেখতে পারলাম না!
সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে।তুরাগের কালো পানিতেও লালচে আভা পড়েছে, এত গোধুলীবেলার সৌন্দর্য এতটুকু কমেনি। আরও বেড়েছে।
হাত মুখ ধুয়ে হালুয়া দিয়ে দুটো পরোটা খেলাম।
বিল দিতে গিয়ে বিপত্তি হল। আমার পকেটে কোন টাকা নেই!
একটু দূরেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।
"কিরে ব্যাটা,টাকাটা তোর দরকার। তুই আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম।"
"কি কন, কাকা। আমি কিছুই বুঝতাছি না।"
হোটেলের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে আর কথা বলাই ঠিক হবে না।
এই অবস্থায় বাসায় ফিরে যাবার প্রশ্ন আসে না। ইরা অনেক রাগ করবে। একবার আমার চাকরি চলে গেল। ইরা আমাকে একটা চালের বস্তা আনতে বলেছে।আমার কাছে টাকা নেই, আনবো কি করে!আমি অফিসের সময় বাইরে বাইরে ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। সেদিন ফিরেছি মাত্র, দরজা খুলে দিল ইরা। কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
"তুমি নাকি অফিসে যাচ্ছো না, সারাদিন তুরাগের পাড়ে বসে থাকো?"
"হ্যা, আমি ইচ্ছে করেই তোমায় বলিনি।তুমি শুধুশুধু কষ্ট পাবে।"
"এখন আনন্দ পাচ্ছি, খুশতে নাচছি।আমাকে বললে কি হত?"
"তুমি শুধুশুধু হইচই করছো। আমি একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।"
"হ্যা, আমি শুধুশুধু হইচই করি।আমাকে বলবে কেন?তুমি অতিমানব, দি সুপারম্যান, তুমি একাই সব সমাধান করে ফেলবে।তুমি একাই থাকো আমি চললাম......"
আশ্চর্য! আমার সব মনে পড়ছে কিন্তু কারও চেহারা, জায়গা মনে পড়ছে না। ইরা কোথায় চলে যাবে সেটাও বলেছে, আমার মনে পড়ছে না!এমন কেন হচ্ছে?
আমি আগের মতই সিড়িতে বসে আছি। আমার আর কিইবা করার আছে?
আমার কাছেই একটা মেয়ে বসেছে।কানে মোবাইল ধরে আছে, হেসে হেসে কথা বলছে। মেয়েটার মোবাইলের লাইট জ্বলছে, ওখানে কেবল ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। কোন নাম্বারে কল দেয়নি, সে একা একাই কথা বলছে।হেসে ভেঙে পরছে!আশ্চর্য!মেয়েটা এমন করছে কেন?
মেয়েটা শাড়ি পড়েছে গাঢ় লাল শাড়ি, মুখে হয়তো একটু বেশিই মেকাপ দেয়া, মুখটা বেশিই সাদা, হাতের চুড়ি টুংটাং শব্দ করছে। হাসির শব্দ আর চুড়ির শব্দ আমাকে আচ্ছন্ন করছে। মেয়েটা এত হাসে কেন? মেয়েটাকি জানে না, বেশি হাসলে ক্বলব মরে যায়। একদিন হযরত (সাঃ) সাহাবিদের বললেন,"তোমরা বেশি হাসিও না।বেশি হাসা ক্বলবকে মেরে ফেলে।"*
আমি মেয়েটিকে ডাকলাম, মেয়েটি ফিরে তাকালো।মুখ থেকে কিশোরী ছাপ এখানো যায়নি,মেকাপ দিয়ে বড় ভাব আনার চেষ্টা করেছে, পারেনি।বাহ!কি সুন্দর ধূসর চোখ।অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে।চুলে সাদা কোন ফুল দেয়া, বেলি ফুল হবে। মিষ্টি গন্ধ আসছে।
"এই মেয়ে, তুমি শুধুশুধু একাএকা কথা বলছো কেন?আর এত রাতে বাইরে কি কর? বাসায় যাও।"
"আমার কাজ রাতেই শুরু হয়।আর কথা বলে আপনাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি।আপনার কিছু লাগব?হাহা...."
"আমার কিছু লাগবে না।আমার যা লাগবে তুমি দিতে পারবে না।যাও, বাসায় যাও।মেয়ে মানুষ রাতে বাইরে থাকা ঠিক না।যাও, বাসায় যাও।"
"আমাকে একটু সুযোগ দিন, আমি আপনাকে খুশি করবো। আমি অত টাকা নেই না।"
মেয়েটাকে এতক্ষণ ভালো লাগছিল, এখন আর ভালো লাগছে না। ওর বয়সও বেশি মনে হচ্ছে। ও আগের মতই হাসছে, এখন বিচ্ছিরি লাগছে।মনে হচ্ছে হাসিতে ওর দুপাটি দাঁত বেড়িয়ে আসছি।শাড়ির রঙ ক্যাটক্যাটে লাগছে, চুড়ির টুংটাং শব্দ মাথায় পিনের মত গেথে গেথে যাচ্ছে।
মেয়েটি নিশিকন্যা, এজন্য ঘেন্না লাগছে।সৌন্দর্য আপেক্ষিক।
মেয়েটিকে আমি ধমক দিলাম। ও চলে গেল না, আমার আশেপাশেই হাটাহাটি করতে লাগলো।
রাত অনেক হয়েছে। সবাই চলে গেছে, Bamboo Tea-Stall, স্বাগতম ফুচকা হাউজ বন্ধ হয়ে গেছে। তুরাগ পাড়ের ঘাট খালি। মাঝিরাও নৌকায় ঘুমানোর ব্যবস্থা করছে। হোটেলের ছোট ছেলেটাও উঁকি মেরে দেখছে। আল্লাহ মানুষকে সীমাহীন অভাব দিয়েছেন, পরিশ্রম করার ধৈর্য দেননি। আরও দিয়েছেন, লোভ। সীমাহীন লোভ। প্রতিনিয়ত লোভের কাছে ভালোবাসা হেরে যায়।
কোথাও যাচ্ছি না আমি, পিলারে বসা নিশিকন্যা, ক্ষনেক্ষনে চলা ট্রেন আর বাস।
আমি নিশিকন্যাকে ডেকে বললাম,"শোনো, আজ আমার দুঃখের দিন।আমি ছেলে মেয়েটাকে দেয়া কথা রাখতে পারবো না।একটা টাচ মোবাইল, একটা রয়্যাল মিরাস পারফিউম কিনে দেয়ার সামর্থ্য আমার আর নেই।আমি টাকা হারিয়ে ফেলেছি।আমি নিজেও হারিয়ে গেছি, আমি কে?কোথায় থাকি? আমার কিছুই মনে নেই!"
নিশিকন্যা আমার পাশে বসে আমার হাত ধরলো। মনে হচ্ছে আমি ইরার হাত ধরে বসে আছি।মেয়েটা আমার চুলে বিলি কাটছে।আশ্চর্য! এই মেয়ে ইরার স্বভাব কোথা থেকে পেল?
*ক্বলব মানে অন্তর। পৃষ্ঠা ১২৬, ক্বলব সংশোধন, লেখকের নাম মনে নেই। আগ্রহী পাঠকের জন্য সংগ্রহ করে দেয়া যাবে।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৩
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: আপু, ২০তম প্যারায় হযরত (সাঃ) এর একটা উক্তি ব্যবহার করেছি। ঐ পৃষ্ঠা থেকে নিয়েছি।ঐটার উৎস বলেছি।
গল্প আমি নিজেই লিখেছি! উনার উক্তি নিয়ে কেউ আপত্তি করবে তাই রেফারেন্স দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে পেইজের ছবি আছে।
২| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৪
হাবিব বলেছেন: দারুণ এক বই হবে
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৭
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ভাইজান, ঐটা ইসলামিক বই।এটা আমার মিথ্যা গল্প। আমি একটা উক্তি ব্যবহার করেছি মাত্র! দেখুন ২০তম প্যারায় শেষে * চিহ্ন দেয়া আছে।আমি সেটার বর্ণনা দিয়েছি, ঊৎস বলেছি।
যাইহোক ধন্যবাদ।
৩| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:২৪
ইসিয়াক বলেছেন: ভালো লাগিলো।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৫
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনি কি ব্লগ ডে'তে আসছেন?
৪| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৩৮
রাজীব নুর বলেছেন: বালক জানে না তো কতটা পথ গেলে, ফেরার পথ আর থাকে না কোনো কালে...
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৬
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: এতটা বুঝলে কি আর সে বালক থাকে? হয়ে যায় ইচড়ে পাকা।
৫| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৪২
শায়মা বলেছেন: ওহ কিন্তু মানুষ পড়ে ভাববে গল্পটাই ওখান থেকে নেওয়া আর গল্পের নাম বুঝি কলব সংশোধন!
লিখতে হত
* ক্বলব মানে অন্তর
পৃষ্ঠা ১২৬ - ক্বলব সংশোধন ( লেখকের নাম মনে নেই)
এমন কিছু
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৭
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ঠিক করে দিয়েছি। রেফারেন্সিং রিসার্চে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে এত নিয়ম মানা লাগে, ভাবিনি এখানেও অমন নিয়ম আছে। আর ভূল করবো না।
৬| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১৭
কিরমানী লিটন বলেছেন: দারুণ সুখপাঠ্য - চমৎকার ভালোলাগা
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩৮
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ।
একটা কষ্টের গল্প লিখতে চেয়েছি।
৭| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪০
স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: চমৎকার লাগলো।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১১
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ। এমন করে হঠাৎ বিস্মৃতি হয়ে গেলে খারাপ হবে না। কি বলেন? এখনকার সব ঝামেলা শেষ।
©somewhere in net ltd.
১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৮
শায়মা বলেছেন: এত কষ্ট করে ১২৬ পৃষ্ঠা টাইপ করলে ভাইয়া!!!