নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

A learning Advocate!

মেহরাব হাসান খান

আমি H2O,,,,Solid,Liquid & Gas.How do you deserve me?

মেহরাব হাসান খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

৩২০

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩৪

আমি হেটে যাচ্ছি, পেছনে ফিরে তাকাচ্ছি না।তাকালেই দেখবো খোকন দাদী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যতক্ষণ আমায় দেখা যাবে তিনি তাকিয়ে থাকবেন!আমি একদিন তিনবার ফিরে তাকিয়েছি, দেখেছি তিনি তাকিয়েই ছিলেন। খুব ইচ্ছে করেছে গিয়ে বলি, "দাদী আপনি ঠিকই চিনেছেন, আমিই হাসান।" যাইনি, যাওয়ার সাহস পাইনি।আমি ৩২০ সংখ্যাতে ভীষণভাবে আটকে আছি!মাকড়সা নিজের জালে আটকায় না, আমি মাকড়সা নই!

২০০২ সালের কোন এক ভোর।আম্মা এখনো গার্মেন্টসে যায়নি। সজীব আর আব্বা বিভোর ঘুমে।সজীবের গাল কেটে গেছে, কপালে একটা মাঝারি সাইজের আলু হয়ে আছে, সেদিকে খেয়াল নেই ও ঘুমাচ্ছে।
বাইরে মিছিল হচ্ছে "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ", "জোরসে বল ধানের শীষ"।এই শব্দেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে, মিছিলের শব্দে আমাদের মলির বেড়ার ঘর কাপছে।আমি বেড়ার ফাক দিয়ে বাইরে পিশু করে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম," ওই আম্মা, বিম্পি জিতছেনি?"
আম্মার আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় নেই।আম্মা সজীবকে জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে, আমাকে আর ওকে খোকন দাদীর কাছে রেখে চাকরিতে যায়।
আম্মার পরনে আজ অন্য একটা কামিজ। আমি এটা বিউটি আন্টির পরনেও দেখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,"আম্মা, তোমারে না কইছি, নৌকায় ভোট দিবা।তুমি কি ধানে দিছনি?খোকন মামা ধানের শীষ করে দেইখা ধানেই ভোট দিবা! এইডা কেমন কথা?হাসিনার বাপে যে দ্যাশের লেইগা জীবন দিয়া দিল, হেই খেয়াল আছে? বিউটি আন্টি কামিজ দিল, আর হের কতায় তুমি ভোট দিলা ধানে?ও মা, কথা কস কেন?"

আম্মা উত্তর দেয় না।আমাদের ভূইয়া বাড়ি দিয়ে কাজে যায়।আমরা যতক্ষণ বাড়ির ভিতর না যাই আম্মা দাঁড়িয়ে থাকে।
আমরা আম্মা না থাকলে ঘরে থাকতে পারি না।আব্বার ঘুমে অসুবিধা হয়।শব্দ করলেই জেগে যায়, আর আমাদের মারে।এই যে সজীবের গাল কাটা, কপাল ফোলা, ও কাল মার খেয়েছে। আমি খাইনি, কারণ আমি খোকন দাদীর কাছেই ছিলাম।
আম্মা সকালে আমাদের এখানে রেখে যান, আবার রাতে নিয়ে বাসায় ফিরেন।আমি সকালে দেখি আব্বা ঘুমাচ্ছে, রাতে বাসায় ফিরেও দেখি ঘুমাচ্ছে।মানুষের এত ঘুম কোথা থেকে আসে, আল্লাহ জানেন!
তবে মাঝেমাঝে আব্বা রিকশার গ্যারেজে তাস খেলতে যায়, সেটাও মাসের শুরুতে যখন আম্মা বেতন পান।আব্বা সব টাকা নিয়ে নেয়, না দিতে চাইলে আমাদের বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। আমি চাইলেই মলির বেড়ার ফাক দিয়ে দেখতে পারি কি হচ্ছে, কিন্তু দেখি না।খোকন দাদীকে একবার জিজ্ঞেস করেছি,"দাদী, আম্মা টাকা না দিলে আব্বা দরজা বন্ধ করে কি করে?আম্মাকে তো আব্বা মারে না, মারলেতো আম্মা কানতো।"
দাদী বলেন,"যাই করুক, তুই কিন্তু উকি দিয়ে দেখবি না।ঘরে উকি দিয়ে দেখা পাপ, আল্লাহ গুনা দিবেন।"

খোকন দাদী সব কিছুতেই গুনা দেখতেন।মিথ্যা কথা বলা গুনা, মাকে কষ্ট দেয়া গুনা, না বলে কিছু নেয়া গুনা, টিভি দেখা গুনা, বড়দের কথা না শোনাও গুনা, সময়মতো কাজ না করা গুনা, আব্বাকে গালি দেয়া গুনা।আমি আব্বাকে খুন করতে চাইতাম, এই গুনার ভয়েই করিনি!দাদী বলেছেন, গুনা করলে আমি দোজখে যাবো। ওখানে কোন খাবার পাবো না।
আমি সব পারি, ক্ষুধা সইতে পারি না।

একদিন দাদী তেলের পিঠা বানাচ্ছেন।আমি পাশেই বসে আছি, দাদী প্রথম পিঠা তুলেই আমাকে মিষ্টি দেখতে বলবেন।কোন আশ্চর্য কারণে পিঠা ফুলছে না।দাদী আমায় বললেন,"কিরে, তুই নজর দিছসনি?পিডা ফুলে না কেন?" দাদী আরও দুইটা ডিম দিলেন। পিঠাতো ফুলে না!
দাদী পিঠার কাই(চালের গুড়ো,চিনি,ডিম গোলানো আধা তরল পদার্থ) ফেলে দিচ্ছেন।
আমি বললাম,"দাদী, ফেলবেন না।আমারে দিয়া দেন।দেখবেন, আম্মা ঠিকই পিঠা ফুলাইয়া ফালাইবো।"

আশ্চর্য! আম্মার হাতে জাদু আছে।প্রথম পিঠাই ফুলে গেল।আমি খেতে যাবো, আর মনে পরলো,আমি সজীব কথা দিয়েছি প্রথম পিঠা ওকে দিবো।কারণ ও সেদিন আমাকে শন পাপড়ি দিয়েছে।আর যাইহোক আমি দোজখে যেতে চাই না।
ওকে ডেকে এনে দেখি, ঘরে তিন/চারজন লোক বসে আছে। মজা করে তেলের পিঠা খাচ্ছে।আর মাত্র তিনটা পিঠা বাকি।আম্মা আমাদের খেতে দিলেন না।ঐ তিনটা খোকন দাদীকে দিয়ে আসতে বললেন। আমি রাস্তায় খেয়ে ফেলতাম, আগেই বলেছি আমি দোজখে যেতে চাই না!

আমরা স্কুলে যাই না, আমাদের টাকা নেই।সেদিন রুমা আন্টির সাথে প্রশিকা স্কুলে গিয়েছি, আর যাইনি। সবগুলো ছেলেমেয়ে গরীব, আমি ওদের সাথে পড়বো কেন?
আমাকে দাদীই পড়াতেন, আলিফ বা তা ছা.....!আমি সন্ধ্যা না মিলাতেই ঘুমি পড়তাম। ১০ টায় খোকন মামা বাসায় ফিরতেন।আমাকে ডেকে তুলে খেতে বসতেন।এই লোকটি বিএনপির বড় নেতা।সেদিন খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে হুলুস্থুল অবস্থা! সবা ইনাকে ভয় পান, আমিও পাই।যেদিন প্রথমে খেতে বললেন, আমি খেতে চাইনি।এমন ধমক দিলেন, আমি প্যান্ট ভিজিয়ে দিলাম।আর ধমক দেননি, আমি আগেই খেয়ে বসে যেতাম!খেতে খেতে বলতেন, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের গল্প।এই লোকটা আজব!জীবিত অবস্থায় কোনদিন দাবী করলেন না, তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক!অথচ মরে যাবার পরই একদল লোক উঠে পড়ে লাগলো এই প্রমাণ করতে যে তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক!

আমার দিন খারাপ যাচ্ছিল না।সকালে দুপুরে খোকন দাদীর সাথে খাই, রাতে খাই খোকন মামার সাথে।তখন খাবার ভালো থাকে!
সকালে দাদী একগ্লাস ছাগলের দুধ খেতে দেন।শৈশবকালে পুষ্টিকর খাবার খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে, আমি এই পুষ্টিকর খাবার ছাড়া আর কিছুই খাইনি!
সজীব এই দুধ খেত না, ওর কাছে গন্ধ লাগে।লাগারই কথা, ওর কাছে মার ভালো লাগে।আব্বার মাইর, নইলে আম্মা বারবার নিষেধ করলেও কেন বাসায় যাবে?
মাঝেমধ্যে বড় ভাইকে হিংসা হয়, ও মামার বাড়ি থাকে।ওকে আব্বার মাইর খেতে হয় না! নিশ্চয়ই নানী পিঠা বানায়, ওর পিঠা অন্যকেউ খেয়ে ফেলে না,ওকে পাটিতে ঘুমাতে হয় না।অবশ্য ও আম্মাকে পায় না।এটাই আমাদের আনন্দ!

সজীব দাদীর কাছে থাকে না।ও আসলে এক জায়গায় কাজহীন বসে থাকতে পারে না।ওর কিছু বন্ধু আছে, আমার নেই।আমি সেদিন সোহাগ, শিমু, মুন্নীদের সাথে খেলতে গিয়েছি।মুন্নীর মা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে,"এই তুই মিনির ছেলে না!তোর মা তো গার্মেন্টসে কাজ করে।যাহ,ভাগ এখান থেকে।এদের সাথে আর খেলতে আসবি না।"
আর যাইনি, কেন যাবো? আমি খোকন দাদীর সাথেই খেলতাম, লুডু খেলা, ষোলো গুটি খেলা, দাবা খেলা।দাদী সুর করে কোরআন পড়তেন, তাই পাশে বসে শুনতাম। কি যে ভালো লাগতো!
দাদী পাঞ্জাবি, সোয়েটার সেলাই করতেন।আমি পাশেই ঘুমিয়ে পড়তাম।মাঝে মাঝে চোখ খুলেই দেখেছি, দাদী আমাকে বাতাস করছেন।আমি তার দিকে এগিয়ে যেতাম, তার গায়ের গন্ধ পেতাম।আম্মার গায়ের গন্ধ আর উনার গায়ের গন্ধে অত তফাৎ নেই!
তবে দাদী আমার গায়ের বিচ্ছিরি গন্ধ ঠিকই টের পান।পাবারই কথা!আম্মা কেবল শুক্রবার হাফ বেলা ছুটি পান।সেদিন আমাদের গোসল করিয়ে দেন।শরীর পবিত্র পবিত্র লাগে।
দু'তিন দিন গোসল না করলেও খোকন দাদী টের পান।বলেন,"ওই ছেড়া, কলপাড়ে যা।তর শইলে চেড়ার(কেচোর) গন্ধ কয়!" দাদীর নাক একেবারে পিপড়ার নাক, চট করে বলে দেন কয়দিন গোসল দেইনা।

আজ দাদী বাড়ি নেই।আমি একটু কলেজিয়েট স্কুলে গিয়েছি,এই ফাকে খোকন দাদী আমায় ফেলে তার বাপের বাড়ি চলে গেছেন।সজীব ঐ স্কুলে ভর্তি হয়েছে, আমি গরীব স্কুলে পড়বো না।তাই যাইনি, দেখতে গিয়েছিলাম, ও স্কুলে কি করে!
বিকাল হয়ে গেল, দাদীর ফেরার নাম নেই।আমার দুপুরে খাওয়াও হয়নি!
আমি ভয়ে আমাদের বাসায় ফিরলাম, আব্বা বাসায় নেই।এটা আশার কথা, মাইর খাবার সম্ভাবনা নেই।
তবে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোক, কারণ তিনি ইন করে প্যান্ট-শার্ট পরেছেন। আমাদের মলির বেড়ার ঘর তালা দেয়া থাকে না, যে কেউ ঢুকে যেতে পারে, আর দামি কিছু নেইতো।
"তোর নাম কি?"
"হাসান মিয়া"

"হাসান মিয়া আবার নাম হয় নাকি?"
"আজ থেকে তোর নাম মেহরাব হাসান।এখন দেখ, খাবার কিছু আছে নাকি?"
আমার নাম পছন্দ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম যে ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করেছে তার নামে নাম!তাই লোকটাকে পছন্দ হয়ে গেল।
ঘরে খাবার কিছুই নেই।থাকার কথাও না!
"তোদের বাসায় খাবার নেই।তো তোরা দুই ভাই খাস কি সারাদিন?"
উনি মোটামুটি অবাক। হ্যা,উনি নাকি আমার চাচা হন।আমার বাবা সারাদিন সারারাত আড্ডা দেন, তাস পিটান, তার যে এমন একজন অফিসার ভাই থাকতে পারেন আমার জানা ছিল না।

"আমার খোকন দাদী আছেন।আমারে খাবার দেন।আমি তার কাছেই থাকি।আপনি বসেন, আমি এই যাবো এই আসবো।"
"তুই কি মানুষের বাসায় কাজ করিস?"

"না, কাম করমু কেন? আমি কাম করি না।তয় মাঝেমধ্যে দাদীর সেলাই করা সোয়েটার, পাঞ্জাবি একটা বাড়িতে দিবার যাউ, দাদীকে বাজার আইন্না দেই, বিউটি আন্টির শ্বশুরবাড়ি খাবার নিয়া যাই, এগুলাই।"
"ঐটাই!ওই বাড়িতে কাজ করিস।"
আমি অপমান গায়ে মাখলাম না, যে লোক আমাকে সুন্দর নাম দিয়েছে তাকে মাফ করে দিলাম।
দাদী বলেন, ছোট মনের মানুষ মাফ করতে পারেন না।

আমি দাদীর কাছে খাবার নিতে এসেছি। দাদী মাত্র ফিরেছেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,"কি রে হাসান, কই ছিলি?সকালে খেয়েছিস?দুপুরে নিশ্চয়ই কিছু খাসনি!তোর জন্য পোলাও মাংস আনছি।খাড়া দিতাছি।"
আমি টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে বললাম,"আমি বাসায় নিয়ে খাই?" খোকন দাদী কিছু বলার আগেই দৌড় দিয়েছি।

ভদ্রলোক আগ্রহ নিয়ে পোলাও মাংস খাচ্ছেন।আমাকেও খাইয়ে দিলেন। আমি দেখেছি, যারা অন্যদের খাইয়ে দিতে পারে তারা ভালো লোক।যেমন- আম্মা, খোকন দাদী, খোকন মামা আর রুমা আন্টি!
"দেখেছেন, খোকন দাদী আমারে পোলাও মাংস খাইতে দেয়।বিরাট আদর করে!কামের ছেলেরে কেউ গরম পোলাও মাংস দেয় নাকি?"
"তুই এটা ঠিক বলেছিস।"

আমি ভদ্রলোকের সাথে গ্রামে চলে এলাম। যাবার সময় দাদী গুনার তালিকাটা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন। একটা পুরাতন স্কুলে ব্যাগ দিলেন।তাতে দুটো চিতই পিঠা, একটা কদবেল আর একটা সোয়েটার!নীল সোয়েটার, আমার প্রিয় রঙ।
বললেন,"কাকা যা বলবে শুনবি।মন দিয়ে পড়বি, খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করবি না, ঠিকমতো গোসল করবি।যাহ, ভালো থাকিস।"
বলতে ইচ্ছে করছিল "আপনার পাঞ্জাবি, সোয়েটার কে দিয়া আসবো? রান্নার মাঝখানে কাচা মরিচ, ধইন্না পাতা কে আইন্না দিবো?"
বলতে পারিনি। দাদী দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।কেন সেদিন বুঝিনি!

আমি স্কুলে ভর্তি হয়ে এক বিদিগিচ্ছিরি অবস্থা!পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, আর অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেড। এপ্রিলের আগে কেউ বই পায়না, আমি ঠিকই পেয়ে যাই।সরকার আমাকে বই দেয়, খালি বই না, উপরি টাকাও দেয়।ক্লাসেও আমার আলাদা সুনাম।
মাঝেমধ্যে ঢাকা বেড়াতে আসি।
অনেক কিছুই বদলে গেছে।বিউটি আন্টির বিয়ে হয়ে গেছ, খোকন মামা বিয়ে করেছেন। দাদী এখন আর পাঞ্জাবি, সোয়েটার বুনেন না, বাজারে যাবার লোক আছে।তাই আমার আর দরকার পরে না, আর আমার লজ্জাও লাগে।ভাবলেই লজ্জা লাগে, কেবল ভালো খাবার জন্য ওই বাড়ি সারাদিন পরে থকতাম!

নাইনে ভর্তি হয়নি।ঢাকা বেড়াতে এসেছি।আমার মাথায় তখন সাহিত্যের ভূত চেপেছে। দাদীর কাছে "বিষাদ সিন্ধু" ছিল।দু'পাতা পড়তেই গল্প জমে গেল।ওখানেই পড়তে শুরু করলাম, আর নিয়ে আসলেও পড়া যাবে না।আমরা একটা রুম নিয়ে থাকি, মা-বাবা,দু ভাই, ঘরে কারেন্টও নেই।পড়বো কিভাবে?
"বিষাদ সিন্ধু" পড়তে পড়তে ওখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

সকালে আমাদের বাসায় ফিরে নাস্তা করেছি।আশ্চর্য!অনেক কিছুই বদলেছে। কিন্তু আব্বা একটুও বদলায়নি।এখনো সারাদিন ঘুমান, রাতে আড্ডা দিতে যান।মাঝেমাঝে মন ভালো থাকে, মাঝেমাঝে আবার বিচ্ছিরি খারাপ! বিশেষ করে টাকা না থাকলে।
আম্মা এখনো চাকরিন করেন।সজীবটা নেই, কোথায় চলে গেছে! ভালোই করেছে, ওকে মনে হয় এখন আর বেধড়ক মার খেতে হয় না।

ক্রিকেট খেলা শেষ করে দুপুরে দাদীর কাছে গিয়েছে। আবার বই পড়া শুরু করেছি।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে, শিপন মামা বাসায় ফিরলেন। উনার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি।তিনি আমাকে দেখলেই কপাল কুচকে, চোখ ছোট করে ফেলতেন।হয়তো খোকন মামা, আর দাদীর জন্য কিছু বলতে পারতেন না!
তিনি আমাকে কলার ধরে উঠোনে বের করলেন। দাদী পাশেই ছিলেন, খেজুর গুড় পানিতে গোলাচ্ছিলেন।আজ দুধ চিত্ত আর ভাপা বানানো হবে।
শিপন মামা বলল,"৩২০ টাকা দে।এখন দে!আমি জানি তুইই নিয়েছিস।"
বয়ঃসন্ধি পার করছে এমন একটা ছেলের কলার ধরে টেনে বের করা অত্যন্ত অপমানজনক!আমি লজ্জা-অপমানের চেয়ে বিস্মিত।
খোকন মামা সব শুনে কিছুই বললেন না।দ্রুত চলে গেলেন, আজকে ক্লাবে তারেক জিয়া আসবে।তিনি খুব ব্যস্ত।
দাদীর দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। যদি কিছু বলেন! উনি কিছুই বললেন না। আমার অত খারাপ লাগেনি, যে আমাকে চোর বলা হচ্ছে।এজন্য খারাপ লেগেছিল, যে আমার আজ খেজুর গুড়ের পিঠা খাওয়া হবে না!

দিন অনেক বদলে গেল!বড় ভাই পড়াশোনা করেনি,তবে বেশ ভালো চাকরি করেন।সজীব ফিরে এসেছে, বিয়ে করেছে, ও রঙের ঠিকাদার, আমার ছোটবোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।আমি সদ্য অনার্স শেষ করেছি। আমরা ফ্ল্যাটে থাকি, আগের মত খারাপ দিন নেই! আমি নিজে ৪টা ছাত্র পড়াই, ঢাকার শহরে টিউশনি খারাপ পেশা নয়।
বদলায়নি কেবল আব্বা, আগের মতই ঘুমিয়ে দিন পার করছেন!তবে এখন দমে গিয়েছেন।রাতের আড্ডায় যেতে পারেন না, টাকা নেই!এত বড় বড় সন্তানের সামনে কি আর অমন আগের মত চলা যায়, টাকার জন্য আম্মার সাথে........!

এরমাঝে দাদী আমাকে আর দেখেননি।যেদিন আমি দাদীর কাছ দিয়ে হেটে যাচ্ছি, আমাকে থামালেন।
"তুই কি হাসান নাকি রে?"
"না তো, আমি মেহরাব। আমি হাসান নই!"
উনি দমে গেলেন।
মিন মিন করে বললেন,"কিছু মনে করবেন না।আমি ভেবেছি আপনি হাসান।দেখতে আপনার মতই হবার কথা।আপনার কথাও অর মত।কিছু মনে করেননিতো!বুড়ি হয়েছি, চোখে ভালো দেখি না।"
আমি চলে যাচ্ছি, তিনবার ফিরে তাকালাম, তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।এখন আমি যতটা পাড়ি ঐপথ এড়িয়ে চলি!

সব বদলে যায়, যাচ্ছে, আরও বদলে যাবে।আমি কি কোনভাবে ৩২০ টাকার ঘটনাটা বদলে দিতে পারবো? না, আমার ক্ষমতা নেই। আমার প্রতিনিয়ত মনে পরে যায়।
রিকশাওয়ালা ৫ টাকা ভাড়ার জন্য মেজাজ দেখাচ্ছে, দোকানের পিচ্চিটাকে টাকা চুরির জন্য মারা হচ্ছে, রাস্তায় বেদেনী,হিজড়ার দল, ভিক্ষুক টাকা চাচ্ছে, বাসের হেলপার টাকা বেশি নিচ্ছে, পুলিশ অটোওয়ালা,রিকশাওয়ালার থেকে ১০ টাকা কেড়ে নিচ্ছে, ঘরে কোন আসবাব কিনি, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই;আমার ৩২০ টাকা মনে পরে যায়।৩২০ টাকা!

গরীব হওয়া সত্যিই পাপ,আমৃত্যু শাস্তি।
কিছু হারালে সেটা কেবল গরীব লোকেরাই চুরি করবে, এটাই নিয়ম। উনি নিয়ম করে দিয়েছেন, গরীব লোকদের অভাব দিয়েছেন, বড়লোকদের দিয়েছেন সন্দেহ আর কপাল কুচকে তাকানোর অতিমানবিক ক্ষমতা।
একটা দারুণ খেলা চলছে, তিনি উপরে বসে মজা দেখছেন।
হাসান রাস্তা দিয়ে হেটে যাবে, খোকন দাদী সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন যতক্ষন ওকে দেখা যায়।ঐদিনও তিনি সন্দেহের চোখেই তাকিয়ে ছিলেন যে! ওদের মাঝে একটা দেয়াল, ৩২০ টাকার দেয়াল।কেউ দেয়াল ভাঙতে পারবে না, টপকাতে পারবে না।নিয়ম নেই!

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৮

ইসিয়াক বলেছেন: সবটা পড়ে মন্তব্য করবো । যেটুকু পড়লাম লেখা ভালো লাগছে.........

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৮:১৫

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: অপেক্ষা করছি।

২| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: আর একটু গুছিয়ে লিখুন।

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:০৭

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: চেষ্টা করছি।

৩| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:২০

মা.হাসান বলেছেন: লেখা বরাবরের মতো খুব ভালো হয়েছে।

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:০৭

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:১৮

ইসিয়াক বলেছেন: কাহিনীটা হৃদয় ছোয়া .......অনেকক্ষণ ভাবলাম .....।
হাসানের মতো ছেলেদের জন্মটাই আজন্ম পাপ !
লেখাটা একটু অগোছালো হয়েছে ।একটু কাট ছাট করে মানে কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে । কয়েক প্যারায় ভাগ ভাগ করে বারবার পড়ে নিলে সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে যাবে ।
গল্পটা সত্যি মন ছোয়া ।ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ

০১ লা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১৯

মেহরাব হাসান খান বলেছেন: কিছু লিখে ফেললে কেটে বাদ দিতে পারি না। যেটাই বাদ দিতে যাই, মনে হয় প্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিচ্ছি। খারাপ লাগে, আর অপ্রয়োজনীয় অংশ খুজেও পাইনা।
ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.