নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ সপ্তর্ষিমণ্ডল তার সৌন্দর্য মেলে ধরেছে।আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা জ্বলছে, এক বিন্দু আকাশ খালি নেই।যে বছর আকাশে তারার মেলা বসে, সে বছর দূর্ভিক্ষ হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে নাকি এমনই তারা জ্বলতো, কি ভয়ানক খাদ্যের অভাবই না হল!আমি দেখিনি, শুনেছি।
সারাদিন ঝুম বৃষ্টি আর রাতে মেঘ ভেঙে জ্বলজ্বল করতো কোটি কোটি তারা।
আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকার জন্য রাজু ভাস্কর্যের পাশে যে গেটটা ওখানে বসে আছি।ইদানীং পুলিশ এই উদ্যান নিয়ে বেশ সচেতন, আমাদের ঘর তুলতে দিচ্ছে না।আগের মত রাতে নিশাচরদের ঘোরাঘুরি করতেও দেয় না।তবে আমরা ভ্রাম্যমাণ ঘর তুলে রাতে ঠিকই ঘুমাই।আমার দিনে একটু কষ্ট হয়, এখানে সেখানে বসে থাকি।আজ আরও কষ্ট হচ্ছে, গায়ে পানি এসেছে,পা ফুলে প্রায় কলাগাছ।নতুন যে শিশুটি দুনিয়ায় আসার জন্য ব্যস্ত, সে আজকাল বেশ যন্ত্রণা করে।সে আর কিছুতেই আমার পেটে থাকতে চায় না, মাঝেমধ্যেই পেটে লাত্থিগুতো মারে!আমার ভালো লাগে, আমি তাকে তাকে একটু বেশিই অনুভব করতে পারি তখন।
রাস্তা দিয়ে একটু পরপর হেটে চক্কর দিচ্ছে শেফা আর জান্নাত। দুজনেই খুব সেজেছে, বেশ লাগছে দেখতে!তবে জান্নাত না সাজলেও ওর দিকে দু'বার তাকাতে হয়।কিন্তু কেউ ওকে একবার নিলে আর নিতে চায় না।কেমন মরার মত পরে থাকে, আরে ভাই শরীর বেচে টিকে আছিস একটু নখরা করা শিখ না!না, সে তা করবে না!তবে শেফা মেয়েটা দারুণ। শিক্ষিত লোকজন এমন মেয়েকে সুন্দর করে বলে "আবেদনময়ী"। ওরা আজ কি নাম নিয়েছে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, না থাক।কি দরকার ওদের মিথ্যে মুখোশ মনে করিয়ে দেবার?
আমিও ওদের মতই ছিলাম। সন্ধ্যা হলেই কপালে টিপ,মুখে বাড়তি পাউডার, ঠোটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক, চোখে কাজল দিয়ে সুন্দর করে সেজে, গায়ে কেয়া ফুলের সেন্ট মেখে বেড়িয়ে পরতাম।খদ্দের ধরতে হবে, বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে বিক্রি করতে হবে।সে কি তাড়া!
অন্ধকারে কাজল,টিপ পরা আর না পরা একই কথা।তবুও পরতাম, আমার ভালো লাগে।
ঢাকার আসল সৌন্দর্য রাতে, উঁচু দালানগুলোয় তারার মত লাইটগুলো জ্বলে, রাস্তায় কোন ভিক্ষুক থাকে না, মোড়ে মোড়ে আবর্জনার স্তুপ অন্ধকারে হারিয়ে যায় আর বিরক্তিকর জ্যাম অদৃশ্য হয়ে যায়, কান পাতলে খোলা আকাশের নীচে যারা বসবাস করে তাদের ঘরেও শোনা যায় খিলখিলিয়ে হাসি বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গল্প! ঢাকার শহরটাই এমন, অনেকের স্বপ্ন টিকিয়ে রাখে বা বাঁচিয়ে রাখে অনেক পরিবার।
এই শহরটাই তো আমাকে নতুন করে বাচার স্বপ্ন দেখালো।আমি আগেও স্বপ্ন দেখতাম, সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানতাম না।এখন জানি, আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।আকাশ আমার স্বপ্ন ঠিকই পূরণ করবে।
এই জমকালো শহরে হঠাৎ একদিন আকাশে সাথে দেখা।এখনো চোখে ভাসে।
আমি সেদিন শিখা চিরন্তনের পাশ দিয়ে ঘুরছিলাম। যদি শিখা চিরন্তন পাহারা দেয়া পুলিশগুলো ডাকে, পুলিশগুলো টাকা কম দিলেও ভালো, শরীরে অত্যাচার করে না।
কয় দিন আগেও আমরা চারজন ছিলাম, আমি, নুসরাত, শেফা আর জান্নাত।নুসরাত হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল।এক খদ্দের ওকে বাড়ি নিয়ে গেল।ওর আর খবর নেই।জান্নাত বলেছে, আমেরিকায় নাকি এক সিরিয়াল কিলার ছিল জ্যাক রিচার, সে নাকি খুজে খুজে নিশিকন্যাদের হত্যা করতো। আমরা ভয় পেলাম, নুসরাত বেঁচে আছেতো?মেয়েটার মোবাইল বন্ধ।পুলিশ আমাদের কথার অত দাম দেয় না, মেয়েটার কি হল আমরা এখনো জানি না।
সেদিনই দেখা হল আকাশের সাথে।
শিখা চিরন্তনের পাশের বসার জায়গাটায় শুয়ে কাতরাচ্ছিল।
ওর কাজও আমার মত রাতেই। তখন উদ্যানে আমাদের ঘর ছিল, সারারাত কাজ করতাম আর দিনে পরে পরে ঘুম।তাকে ঘরে এনে পানি খাওয়ালাম। পানি দিয়ে শরীর মুছে দিলাম।গায়ে অনেক দাগ, মারের দাগ।আকাশ জ্বরে কাপছিল।দুদিন ঘুমালো, আমি জেগে পাসে বসে রইলাম।একটা ঘুমন্ত ফরশা মুখ, এত সুন্দর!
সেদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল, আমার কাছে নতুন না।আমার কাজই এটা, এটা করেই বেঁচে আছিতো।তবে খুব কেদেছিলাম সেদিন। নিশিকন্যাদের শরীর স্পর্শ করা যায়, তাদের পায়ে চুমু খাওয়া যায় না।নিয়ম নেই। আকাশ নিয়ম ভঙ্গ করেছিল!
পরদিন থেকে ও আমার পিছনেই ঘুরতো।জান্নাত, শেফা হাসি ঠাট্টা করতো। আসলে ঘর বাধার শখ আমার বহু আগের, কেউ কি আমাকে ঘরে নিবে?কাচের ঘরতো প্রতিদিনই তৈরি হয়, পুরুষ কাজের সময় কত কথা বলে। শরীর ঠান্ডা হলেই সব ভুলে যায়।আকাশ ভুলেনি, সে কথা রেখেছে।
এক মাতাল আমায় নিয়ে অন্ধকারে যাচ্ছিল। মাতালের সাথে অন্ধকারে যাওয়ায় বেশ লাভ, যা আছে সব রেখে দেয়া যায়।
আকাশ আমাকে ফেরালো, বললো,"লীনা, তুই আর এসব করবি না।"
"আকাশ, বাজে বকিস না।আমি কি করবো তাহলে?না খেয়ে মরবো।"
"আমি তোকে বিয়ে করবো।"
কানে ঝনঝনিয়ে কথাটা বাজল।অবিশ্বাস করে আফসোস করে আফসোস করার চেয়ে, বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো। আমরা সে রাতেই বিয়ে করেছি।সারারাত আমি আর আকাশ হাত ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাটলাম।কিছুলোক ডাকলো,"অই মাইয়া যাবিনি?আয় ১০ টেকা বেশি দিমুনে।"
আকাশ ভদ্রভাবে বললো,"কি বলছেন আমার বৌকে?মুখ সামলে কথা বলুন।"
আমার কি ভালো লাগলো, গত রাতের লীনা আর আজ রাতের লীনার মধ্যেও কত ব্যবধান।
আমার ভালো লাগে, আকাশ রাতে একগাদা মানিব্যাগ নিয়ে আসে।আমরা দুজনে মানিব্যাগ খুলে খুলে টাকা আলাদা করি।মাঝেমধ্যে মানিব্যাগে কোন টাকাই পাওয়া যায় না।তবে সব মানিব্যাগেই ছবি থাকে মায়ের, প্রিয়তমা, মেয়ের!কিছু মানিব্যাগে থাকে অতি নোংরা ছবি, বোঝাই যায় কমবয়সী কোন ছেলের মানিব্যাগ।
একবার একটা মানিব্যাগে পাওয়া গেল অনেকগুলো চিঠি, লোকটার বৌ ও মেয়ের চিঠি।
বাবা,
তুমি ছোট ইদেও আসোনি, বড় ইদেও এলেনা।আমি কষ্ট পেয়েছি। আমি ইদে সেমাই, ফিরনি খাইনি।মাও খায়নি।জানো দাদী মাকে মারে, সেদিন ফুপি, কাকা সবাই মিলে মাকে মেরেছে; তরকারিতে লবণ কম হয়েছে তাই।আমিও খেতে বসেছিলাম, আমার কাছে তরকারি ভালোই লেগেছে!
তুমি বাড়ি এসো, বাবা।
ইতি,
তোমার আদরের রিপা
প্রীয়তমেশু,
আমরা ভালো আছি।তুমিও ভালো আছো, জানি।আমি যে তোমার জন্য দোয়া করি।
এমন করছো কেন, তুমি ছাড়া দুনিয়ার সবার চাকরি আছে বুঝি?
কোন সমস্যা নেই, তবে সুদখোর মতিন প্রতিদিন টাকার জন্য আসে।তুমি চিন্তা করো না।তবে বাড়ি এলে কি হয়?মেয়ে ইদে নতুন জামা পরেনি, ফিরনি-সেমাই খায়নি।আমাদের জন্য মন পোড়ে না?
সই সখিনা জিজ্ঞেস করতে বলছে, তুমি আবার বিয়ে করছনি?করছোনি বিয়া?হেয় আমার চেয়েও সুন্দরী?
জানো, ইদে পাগলীটা এসেছিল। আম্মা খাবার দিতে দেয়নি।সারাদিন বসে ছিল, তবুও না।আমার কি যে খারাপ লেগেছে।
বাড়ি এসো, তোমায় দেখিনি অনেক দিন হল।একটা ছবি পাঠালাম।
ইতি,
দুঃখীনী বকুল
আমি আর আকাশ ছবিটা দেখতে পারলাম না, ছবিটি মানিব্যাগে নেইতো।
আকাশ মন করলো,আমার হাত ধরে বসে রইল।আমার নিজেরই কষ্টের সীমা নেই, তবু সেদিন বকুলের কষ্টে অনেকক্ষণ কাদলাম।আকাশ বললো,"এই কাজ আর করবো না।লোকটার জন্যে খারাপ লাগছে।এই ৪০০০ টাকা নিয়ে হয়তো বাড়ি যেত।এই কাজ করবো না, অতি খারাপ কাজ।"
আকাশ অনেক দিন কাজে গেল না।আমরা বিপদে পরে গেলাম। পুলিশ খুব ঝামেলা শুরু করেছে, কিছুতেই আমাদের পার্কে ঘুমাতে দিচ্ছে না।টাকা দিলেই ঝামেলা শেষ, এদেশে সব সম্ভবের দেশ।টাকা হলে এদেশে সব করা যায়, আমাদের টাকাই নেই।
আকাশ এমনেও একাজ ছেড়ে দিত,ইদানীং মানিব্যাগে টাকা পাওয়া যায় না। মানিব্যাগে থাকে প্লাস্টিকের কার্ড, এগুলায় নাকি টাকা থাকে!
আকাশ আজ আবার কাজে গিয়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছে, ও আর এ কাজ করতে চায় না।ও কাজে গেলে আমারও চিন্তা হয়। হবার কারণ আছে, ইদানীং দেশের মানুষ বদ্ধ উন্মাদ। পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলছে, সেদিন একটা পিচ্ছি মেয়ের মাকে মেরে ফেলেছে।মেয়েটার এখন কি হবে?
অবশ্য আকাশকে দেখে কোনভাবেই মনে হয় না ও ওসব করে!আকাশ ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট,গলায় টাই,হাতে চামড়ার ব্যাগ নিয়ে কাজে যায়।দেখতে ভালো লাগে, কেমন সাহেবটা অফিসে যাচ্ছে।তবু আমার উৎকণ্ঠা কাটে না, গলা শুকিয়ে আসে!
রাত ১টা বাজে, জান্নাত আর শেফাও এখন আর চক্কর দিচ্ছে না। মনে হয়, খদ্দের পেয়ে গেছে।আকাশের ফেরার নাম নেই।হয়তো কোন বিপদে পরেছে।এদেশে আমাদের বিপদের সীমা নেই।হয় লোকের হাতে মার খেয়ে মারা যাবো, নয়তো মারা যাবো কষ্টে! পুলিশের মার, সেটাতো নিয়তি।
আমরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমাই, এর মানে শুধু এই না যে আমরা খোলা আকাশের নিচেই ঘুমাই!
এর মানে এই যে আমাদের শরীরের নিচে নরম বিছানা নেই, চাইলেই ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেতে পারিনা, চারপাশে দেয়াল না থাকায় মাঝমাঝেই মাতাল এই শরীরকে নিজের সম্পত্তি মনে করে, টিভি অন করে দেশের খবর নিতে পারিনা, মাঝরাতে টাকা না দিলে পুলিশ লাথি দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়, চাঁদের আলোও আমাদের চোখ ঝলসে দেয়, আমরা ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বসে থাকি, দেখি পাশ দিয়ে হাত ধরে হেটে যায় প্রেমিক যুগল যেন বৃষ্টিতে ভেজা কত আনন্দের!ওরা হেসে কুটিকুটি হয়, আমার খারাপ লাগে!
আমাদের আসলে কিছুই নেই, মাথার উপর একটুকরো আকাশও নেই।
রাজু ভাস্কর্যের ছায়ায় একটা গাঢ় ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।এটা আকাশ! আমি জানি, ও যেদিন ঠিকমতো নিজের কাজ পায় না সেদিনই রাজু ভাস্কর্যের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি জোরে ডাকলাম,"এই আকাশ, এই!ঘরে এসো।"
আকাশ এগিয়ে আসছে, কেমন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে! হয়তো আজকে কাজ ভাল করে করতে পারেনি, এজন্য শাস্তি পেয়েছে।
আজকে রাতে কোন মানিব্যাগ খুলে দেখা হবে না, পাওয়া যাবেনা কোন টাকা, প্রেয়সীর ছবি বা চিঠি! হয়তো আজকেও আমাদের পার্কে থাকতে দেয়া হবে না, তাতে কি?
আমি আকাশের হাত ধরে রাজু ভাস্কর্যের পাশে বসে থাকবো, আমার মাথার উপরে আকাশ নেই তো কি হয়েছে? চোখে আছে অনেক স্বপ্ন, পেটে যে পৃথিবীতে আসার জন্য ব্যস্ত তাকে নিয়ে কথা বলেই না হয় কাটিয়ে দেব পুরো রাত।
চাঁদের আলোয় গা ভিজিয়ে, হাতে এক টুকরো আকাশ নিয়ে বসে থাকবো।আকাশ আমার এক টুকরো নীল আকাশ!
১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫১
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: ওইতো জীবন যার কাছে যেমন!
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৭
রাজীব নুর বলেছেন: যারা রাস্তায় ঘুমায়। আমি তাদের কথা ভাবি হঠাত ঝুম করে বৃষ্টি নামলে তারা কোথায়য যাবে??
অথচ অনেক তরুন তরুনী হঠাত আসা বৃষ্টি নিয়ে কি আহ্লাদ টাই না করে!!