নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবীর পথে পথে আমি একা অনভিজ্ঞ এক নাবিক।

মারুফ তারেক

পৃথিবীর পথে পথে আমি একা অনভিজ্ঞ এক নাবিক।

মারুফ তারেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডয়েচল্যান্ডের কড়চা: আমাদের ক্ষমা চাইবার ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাঁচফোড়ন। [চৌদ্দ]

০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:১১


ছবি: জার্মানির জিগেন শহর, ১৯৪২ সালের ২২শে জানুয়ারি এখানে থাকা ইহুদিদের সিনাগগটিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

পূর্বের লেখাগুলো প্রকাশ করবার আগে একবার পড়তে গেলেই মনে হয়, হয়তো নতুন কিছুর সংযোজন প্রয়োজন। কেননা প্রতি মূহুর্তে পৃথিবীতে নতুন ঘটনার জন্ম হয়। মনে পড়ে, বহু বছর আগে Waking Life নামের একটি সুররিয়েলিস্টিক এ্যানিমেশন মুভি দেখেছিলাম, যার একটি লাইন ছিল, This is my window, every second is a different show.
তাই নতুন করে প্রকাশের আগে এই অতিরিক্ত কথাগুলো না বললেই নয়। যদিও সুররিয়েলিজমের দর্শন কপচিয়ে আর কষ্ট দিতে চাই না।

সেদিন লিডেল (LIDL) থেকে কেনাকাটা করে বের হবার পরই বাসস্ট্যান্ডের অপজিটে একটি লেখা চোখে পড়লো। যেখানে লেখা Kampf mit dem islamismus, মানে হলো ইসলামের সাথে যুদ্ধ। মনে মনে বললাম ইসলাম তোমাদের সাথে কী করেছে। মনে হলো ইউরোপে এন্টি-ইসলামিক সেন্টিমেন্ট বাড়ছে। যাইহোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি।

মৃত্যুর আগে আলবার্ট আইনস্টাইন তার জন্মস্থান জার্মানির উলম্ শহরের কথা কল্পনা করছিলেন, বিরবির করে জার্মান ভাষায় কী সব কথা বলছিলেন। কয়েক শতকের সবচেয়ে মেধাবী মানুষটি মৃত্যুর আগে কী বলে গেলেন, তার পাশে থাকা আমেরিকান নার্স বুঝতে পারলো না।
নাজিদের ভয়ে আইনস্টাইন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কিন্তু নিজের ভাষা ছাড়তে পারেননি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে এসে নিষঙ্গ জীবন কাটান, নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারেন না। সময়ের ফেরে আমাদের স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে ফেরে। তিন কিংবা চার জেনারেশন ধরে জার্মানিতে বসবাস করে আসা টার্কিসদেরও কিন্তু শুনতে হয় তোমরা এখানে কেন, তোমাদের দেশে চলে যাও।
১৯৯৩ সালে নর্থ রাইনের জলিংগেনে নিউ নাজি গ্রুপের চারজন মেম্বার একটি টার্কিস পরিবারের বাড়িকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়, যার ফলে তিনজন মেয়ে ও দু'জন মহিলা মৃত্যুবরণ করেন; আহত হন আরও চৌদ্দজন।

১৯৩১ সালে "Hundert Autoren Gegen Einstein" নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন ছাপা হয়৷ যেখানে একশো জন জার্মান সায়েন্টিস্ট লেখেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ভুল৷
আইনস্টাইনের এর উত্তরে বলেছিলেন, আমার তত্ত্ব ভুল ঠিক আছে, কিন্তু সবাই মিলে লেখবার প্রয়োজন ছিল না।
আইনস্টাইনের সমস্যা ছিল কোথায়?
কেবল ইহুদি বলে নিজের জন্মস্থানে আইনস্টাইন নিগৃহীত হয়েছেন।

আইনস্টাইন এবং আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সত্যেন বোস পরস্পরের সায়েন্টিফিক কোলাবরেটর ছিলেন, তাদের মধ্যে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ হতো। বোস-আইনস্টাইন স্টাটিকসের জন্ম হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করানোর সময়। সত্যেন বোস পরবর্তীতে আর্টিকেল লেখে যখন প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তখন তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তাই তিনি আইনস্টাইনকে আর্টিকেলটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। সত্যেন বোসকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগদানের জন্যও আইনস্টাইন রিকোমেন্ডশন লেটার পাঠিয়েছিলেন। আইনস্টাইন বোসকে একটি পোস্টকার্ড পাঠয়েছিলেন, যার মাধ্যমে পুরো ইউরোপ ফ্রিতে ভ্রমণ করা যাবে। জার্মানিতে এসে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করেছিলেন সত্যেন বোস।

যাইহোক, কথায় কথা বাড়ে। বাংলাদেশে এখন বাংলা ভাষায় কোন বিজ্ঞান গবেষণা হয় না। এমনকি ভালো কোন সাহিত্যের অনুবাদও ছাপা হয় না। কেননা ভাষা জানা মানুষগুলোই হারিয়ে গেছে। সেদিন সলিমুল্লাহ খান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, অমর্ত্য সেন ভালো ইংরেজি জানলেও বাংলা জানেন না।
সাহিত্যে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চের পরে জার্মানভাষী সাহিত্যিকেরা সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। জার্মান, কোরিয়ান কিংবা চায়নিজ ভাষায় অনুবাদ করার জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট অনুবাদক দল আছে, যাদের কাজ হলো সম্প্রতি প্রকাশিত বই কিংবা জার্নালগুলোকে অনুবাদ করা৷ কেননা মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা না থাকলে সামগ্রিক উন্নতি বা জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়, সমাজের বড় একটি অংশই নতুন জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়।
আমাদের ডক্টর মুহম্মদ ইউনুসও নিজ দেশে রাজনৈতিক কারনে নিগৃহীত ও হেনস্তার স্বীকার হচ্ছেন, তার নামে বানোয়াট সংবাদ ছাপছে সাংবাদিকেরা। শুনেছি বয়োবৃদ্ধ অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধেও বিশ্বভারতীর জমি আত্নসাতের মামলা হয়েছে।

আইনস্টাইন দেশান্তরী হলো, হত্যা করা হলো লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারের পর জার্মানি কিংবা জাপানের রাজনীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে ব্যপক পরিবর্তন এলো। অপরাধের শাস্তি হচ্ছে অনুশোচনা ও ক্ষমা। আর তাই জার্মানির বার্লিনে তৈরি হয়েছে Memorial to the Murdered Jews of Europe.
কোন অপরাধ বার-বার না ঘটার প্রথম শর্ত হচ্ছে অপরাধটিকে অপরাধ হিসেব গণ্য করা, ক্ষমা চাওয়া। শুনে রাখুন, পাকিস্তান বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চালানো গনহত্যাকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। আর তাই পাকিস্তান আরও একটি নতুন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।

জার্মানির বর্তমান জনসংখ্যার ১৯.২ মিলিয়ন অভিবাসনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যারা বা যাদের পরিবার মূলত ১৯৫০ সাল থেকে বর্তমান অব্দি অভিবাসী হয়ে জার্মানি এসেছে, শতাংশ হিসেবে যা জার্মানির জনসংখ্যার ত্রিশ শতাংশ। এর মধ্যে ২.২ মিলিয়ন রিফিউজি। জার্মান সরকার রিফিউজিদের শুধুমাত্র ক্যাম্পে রেখেই কর্তব্য শেষ করেনি, বরং প্রতিনিয়ত তাদেরকে ইন্টিগ্রেশনের ব্যবস্থা করে চলেছে। বুঝতে পারছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি দেশ কতোটা পরিবর্তিত হয়েছে? জার্মানির মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হয়ে আছে সেইসব জুতা কিংবা কাপড়, যেগুলো পড়ে রিফিউজিরা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলো; সেইসব বেদনার ইতিহাস যা জার্মানির ইতিহাসের সাথে এক হয়ে আছে।

মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু যারা প্রত্যাখ্যান করে, তাদের উপর আবারও সেই একই ভুল চেপে বসে। যদিও জার্মান সরকার পূর্বের জেনোসাইডের জন্য ইজরায়েল কে সমর্থন করে। কিন্তু আমার মনে হয় জেনোসাইডের প্রায়শ্চিত্ত অন্য আরেকটি জেনোসাইডের সমর্থন হতে পারে না।

তবু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একটি রাষ্ট্রের এই পরিবর্তন সত্যিই নতুন আলোর দাবি রাখে।

সংযুক্তি: আর যারা দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হতে ভালোবাসে কিংবা বাধ্য হয়? সেইসব হিন্দু বাঙালি যারা ভারতে চলে গেছে। যখন আর্যরা উত্তরের শীতলতা ছেড়ে ইরান হয়ে উষ্ণ বাংলার উর্বর জমিতে এসেছিল। যখন আমি কিংবা আমাদের থেকে ইউরোপের কোন এক শহরে আমাদের ভাষাগুলো আমাদের সন্তানদের মুখ থেকে হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো। সেইসব আর্য কিংবা মঙ্গলেরা, যারা ভেড্ডাদের সাথে মিশে বাঙালি হয়েছিল। এ যেন সেই একই সত্য, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।


১৪ই জুন, ২০২৩
জিগেন, জার্মান

অন্যান্য পর্বসমূহ:

বিশ: কলা যুদ্ধ (Banana War)

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৪৭

ক্রেটোস বলেছেন: কচড়া বলে তো কোন শব্দ নাই , আই হোপ ঐটা কড়চা হবে !

০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৫৮

মারুফ তারেক বলেছেন: ধন্যবাদ ঠিক করে দিয়েছি

২| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:৪৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
জেনোসাইডের প্রায়শ্চিত্ত অন্য একটি জেনোসাইডের সমর্থন হতে পারে না।
সুন্দর বলেছেন।


কোন অপরাধ বার-বার না ঘটার প্রথম শর্ত হচ্ছে অপরাধটিকে অপরাধ হিসেব গণ্য করা, ক্ষমা চাওয়া। শুনে রাখুন, পাকিস্তান বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চালানো গনহত্যাকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। আর তাই পাকিস্তান আরও একটি নতুন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
এটাও চমৎকার বলেছেন। একমত।

শেষের প্যারাটা জটিল হয়ে গেছে, কী বলতে চেয়েছেন বুঝতে পারি নি।

আপনার আরো কিছু পোস্ট পড়েছি। আপনার পোস্টের কনসেপ্ট ও আপনার বক্তব্য খুবই উঁচু মানের। লেখাও খুবই সাবলীল।

শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:২২

মারুফ তারেক বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বেশিরভাগ মানুষ হয়তো তার ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে, বেঁচে থাকবার প্রয়াসে দেশান্তরী হয়। আমাদের দেশের বহু হিন্দুও একই কারণে দেশান্তরিত হয়েছে।

৩| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:৫১

হাসান জামাল গোলাপ বলেছেন: এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক লেখা, ধন্যবাদ।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:১৯

মারুফ তারেক বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

৪| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:১২

বাকপ্রবাস বলেছেন: সলিমুল্লাহ একক যুদ্ধ চালিয় যাচ্ছেন মাতৃভাষা দিয়ে বিশ্ব দেখার ব্যাপারে। উনার বক্তব্যগুরো সম্পদ আমাদের জন্য, কারন দেশের যে অবস্থা সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক কিছুতে রাষ্ট্র থাকছেনা, আধাবুদ্ধিজীবিরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, হয়তো দুদিন পর বলবে রাষ্ট্র ভাষা ইংরেজি, বাংলা ঐচ্ছিক। তখন সলিমুল্লাহর বক্তব্যগুলো কাজে দেবে এবং প্রজন্মকে আস্বস্থ্য করবে মাতৃভাষাই জ্ঞানর্জনের প্রধান মাধ্যম।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:২০

মারুফ তারেক বলেছেন: যথার্থ বলেছেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৫| ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: সত্যেন বোস মেধাবী বাঙ্গালী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.