নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলা সাহিত্যের একজন কবি যিনি তার জীবদ্দশায় কবি হিসেবে তেমন কোন মর্যাদা পাননি। অনেকটা সেই সব কবিদের মত, যারা নিরবে নিভৃতে মারা গেলেন। জীবনানন্দ দাশ তার সাহিত্যিক জীবনে যার থেকে সবচেয়ে বেশী সাধুবাদ পেয়েছেন সেই বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত বলে ফেলেছিলেন, “মহাপৃথিবীর শেষের দিকে যেসব কবিতা আছে, সেগুলি যেন কতগুলি বাঁধাধরা বাক্যের বিচিত্র অদ্ভুত সংস্থাপন মাত্র। বাক্যগুলি সুন্দর, কিন্তু সবটা মিলিয়ে কিছু পাওয়া যায় না।’’
তবু তার চলে যাওয়া পরবর্তী সময়ই যেন আশীর্বাদ হয়ে এল, কবি হিসেবে পরিচিতি পেতে লাগলেন জীবনান্দ দাশ।
জীবনানন্দের জীবনবোধ যেন আমাদের পরিচিত জীবনেরই মতোই,
এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি -আমি হৃষ্ট কবি
আমি এক; -ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে;
ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ, ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে -ঘাসের আঁচলে
ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি -দেখেছি কিশোরী এস হলুদ করবী
ছিঁড়ে নেয় -বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন শঙ্খের মতো ছবি
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় তার নিজের জীবন ফুটে উঠেছে, মানুষের জীবন ফুটে উঠছে। ব্যক্তিগত জীবনে কবি কষ্ট করেছেন। একটা চাকুরীর জন্য বিভিন্নজনের কাছে গিয়েছেন। দাম্পত্য জীবনে কলোহ ছিল। জীবনান্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য গুপ্ত যিনি অভিনেত্রী হতে চাইতেন। তাকে নিয়েই হয়ত জীবনানন্দ লিখেছিলেন,
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা,
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
শুধুমাত্র দাম্পত্য জীবন নয়, কবি তার প্রতিবেশীদের দ্বারাও নিগ্রহের স্বীকার হয়েছেন। কিন্তু, জীবনানন্দ দাশ তার দুঃখ কষ্ট ভুলে শুধু কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকতে চেয়েছেন। কবি হিসেবে ঠাট্টার স্বীকার হয়েছেন, তবু নিজের মতো করে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। কবির অনেক লেখাই লেখাই তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
কবি ভালোবেসেছেন কবিতায়, কবি ভালোবেসেছেন জীবনে। কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে প্রেম, প্রকাশ পেয়েছে জীবনবোধ। তিনি বাংলাকে ভালোবেছেন। ভালোবেসে লিখেছেন,
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে র'য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে র'য়ে যাব; কতটা মমত্ববোধ, জন্মভুমির প্রতি ভালোবাসা থাকলেই কেবল এ’কথা লেখা যায়? একথা কেবল একজন জীবনানন্দ দাশই লিখতে পারেন।
তাইতো এই বাংলায় আবারও ফিরে আসবার আকুতি নিয়ে লিখেছেন,
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশেকুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন পরাবাস্তব ভাবনা। বাংলা সাহিত্যে এনেছেন নতুনত্ব, হয়েছেন আলাদা। জীবনানন্দ দাশকে তার সমসাময়িক সময়ে কেউ না বুঝতে পারলে জীবনানন্দ দাশই’বা কী করতে পারতেন? জীবনানদ দাশ শুধু তার লেখা চালিয়ে যাতে পারতেন, আর জীবনানন্দ দাশ ঠিক তাই করেছিলেন। তাই আমরা একজন জীবনান্দ দাশকে পেয়েছি। যিনি ভালোবেসে লিখেছেন,
১. চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
(বনলতা সেন)
২. আমি যদি হতাম বনহংস; বনহংসী হতে যদি তুমি; কোন এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে ছিপছিপে শবের ভিতর এক নিরালা নীড়ে,
(আমি যদি হতাম)
কবি ভালোবেসেন, ভালবেসে উপেক্ষিত হয়েছেন। এ যেন এক অনন্য বার্তা, আমাদের জীবনের যেন এই ভালোবাসা, অভিমান ব্যার্থতা ঘটেই চলেছে। আর একথাই জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন তার কবিতায়।
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ’লো না
কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ’ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
আবারও জীবনানন্দ দাশ আশা রেখেছেন কবিতায়, যদি সেই পুরনো প্রেয়সীর সাথে দেখা হয়ে যায়। যদি দেখা হয় তবে কেমন হবে? সে চিনবে কি আমায়? প্রেমিক হৃদয়ের এই ব্যাকুল প্রত্যাশা থেকে জীবনানান্দ লিখেছেন,
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন একজন প্রেমিক হিসেবে লিখেছেন সভ্যতার জাঁতাকল আর জীবনবোধের করুন বিষন্নতা নিয়ে। এক অনন্য হাহাকার, ভীষণ শুন্যতাবোধের সৃষ্টি হয় মানব মনে আর হৃদয়ের গহীনে। যান্ত্রিক জীবনের যান্ত্রিকতায় ক্লান্তি চলে আসে। মানব মন একা বোধ করতে থাকে। আর এই বার্তাই জীবনানন্দ প্রকাশ করেছেন ‘আট বছর আগে এক’ শিরোনামের কবিতায়,
জানি- তবু জানি
নারীর হৃদয়- প্রেম- শিশু- গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরো-এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে ;
কবি আবারও জীবনবোধ লেখেছেন তার বোধ কবিতায়,
আলো –অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে !
স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,-পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা – প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয় !
জীবনের এই অনন্যতায় এক অজানা বিষণ্ণতা গ্রাস করে প্রত্যেকটি চিন্তাশীল মস্তিষ্ককে। তারা যেন অকূল সমুদ্রে একা নাবিক হয়ে পরে। মানুষের এই চিরাচরিত জীবনবোধকেই জীবনানন্দ লিখে ফিরেছেন। লিখেছেন সব থাকার পরও না থাকার এক অমোঘ বেদনা, ব্যক্তি জীবনের ক্ষয়। আর এই বর্তমান সমাজ, ক্লান্তির এক জীবন যা জীবনানন্দ দাশ বারবার লিখে ফিরেছেন।
এই ক্লান্তি দুঃখবোধ আর বেদনা থেকে বের হয়ে জীবনানন্দ তার কবিতায় জীবনের সুর অঙ্কন করেছেন, বেঁচে থাকবার কথা বলেছেন। আবারও এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। পৃথিবীর প্রেমে পরে আবারও একটা নতুন জীবন চেয়েছেন। জন্ম এবং জন্মান্তরের বোধে জীবনানন্দ প্রতীক্ষায় থেকেছেন। লিখেছেন কমালেবু,
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
একজন মানুষ আর কীইবা পারে তার জীবনে? আর কতোটাইবা আশা করতে পার? সবকিছু শেষ হলে পরে তিনি ফিরে আসেন, বারবার তার প্রাণের কাছে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসবার ব্যাকুলতা এই বেঁচে থাকবার আনন্দ মানুষকে বেঁচে থাকতে শেখায়। দেখায় জীবনের শাশ্বত পথ, জীবনের মানে। এই জীবন দর্শন বেঁচে থাকবে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, চির অম্লান।
লেখাটি অগ্নিসেতু সাহিত্য পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত।
২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:০০
মারুফ তারেক বলেছেন: এইতো জীবনানন্দ
এভাবেই তিনি জীবনকে বলে গেছেন, মৃত্যুকে বলে গেছেন।
২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৯
রায়হানুল এফ রাজ বলেছেন: আমার অনেক ভালোবাসার একজন কবি।
২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:০৪
মারুফ তারেক বলেছেন: তিনি আমাদের ভালোবাসাই বেঁচে থাকবেন।
৩| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:২৪
ধ্রুবক আলো বলেছেন: জীবনানন্দ দাসের মত একজন কবি হতে পারতাম!!
২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:০৪
মারুফ তারেক বলেছেন:
২৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:৪৩
মারুফ তারেক বলেছেন: মাঝে মাঝে ভাবি এসব
আহা যদি!!!
৪| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৫৫
ইসফানদিয়র বলেছেন: জীবনানন্দ দাশ শ দিয়ে নাম কেন লিখতেন?
২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:০৩
মারুফ তারেক বলেছেন: শ অনেকেই ব্যবহার করেছেন, হুমায়ূন আজাদও শ এর দলের লোক।
শুধু নিজস্ব বানানরীতি নয়, ব্যাকরণগতও বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আর এ কারণের শ কে স এর উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটা পড়েছিলাম কোথায়, এখন মনে পড়ছে না।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৯
নীলকণ্ঠ পদাতিক বলেছেন: ...সেইখানে ক্লান্তি তবু–
ক্লান্তি–ক্লান্তি;
কেন ক্লান্তি
তা ভেবে বিস্ময়;
সেইখানে মৃত্যু তবু;
এই শুধু–
এই;
চাঁদ আসে একলাটি;
নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে;
দিগন্তের সমুদ্রের থেকে হাওয়া প্রথম আবেগে
এসে তবু অস্ত যায়;
(উত্তরপ্রবেশ)