নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা ভাষা ও চর্যাপদ

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৭

জোবায়ের আলী: বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে হাজার খ্রিষ্টাব্দের পরে, কারো মতে হাজার থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এবং কারো মতে সপ্তম থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আদি বাংলা ভাষার উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।
প্রাচীন বাংলা থেকে মধ্য বাংলা এবং মধ্য বাংলা থেকে আধুনিক বাংলার উৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায়।
প্রাচীন যুগ-৬৫০ খ্রি. ১২০০ খ্রি., সন্ধি যুগ-১২০০ খ্রি.- ১৪০০ খ্রি., মধ্য যুগ-১৪০০ খ্রি. ১৮০০ খ্রি., আধুনিক যুগ- ১৮০০ খ্রি. থেকে অদ্যাবধি
বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের নিদর্শন হলো ‘চর্যাপদ’। মধ্য যুগের নিদর্শন হলো ‘মঙ্গল কাব্য’, ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ ও অনুবাদ সাহিত্য প্রভৃতি।
আজ থেকে ১০৪ বছর আগে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহা মহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগার থেকে হাতে লেখা একটা পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন। এ পুঁথিটির নাম ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’ বা ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। ‘চর্যাচয় বিনিশ্চয়’ আমাদের কাছে ‘চর্যাপদ’ বলেই পরিচিত। ‘চর্যাপদ’-এর কবিতাগুলো বৌদ্ধ বাউল কবিদের রচিত। তারা নানা উপমা ও উদাহরণের দিয়ে নানা ধর্মীয় বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছেন চর্যাগুলোতে। তবে চর্যাপদের কবিতাগুলোতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের নদ-নদীর কথা, পাহাড়, খাল, বিল আর মানুষের কথা, সমাজের সুখ-দুঃখ ও দারিদ্র্যের কথা, বিশেষ করে আমাদের এই উত্তরাঞ্চল তথা বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ‘ভাওয়াইয়া’ ও অন্যান্য গানের মধ্যে চর্যাপদের শব্দের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। এতে প্রমাণ হয়, হয়তো বৌদ্ধ আমলের কোনো কবির আদি বাসস্থান ছিল আমাদের এই উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলাতেই। (পণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের মতে কাহ্নপা ছিলেন এ অঞ্চলের কবি, তার সাধনক্ষেত্র ছিল উত্তরবঙ্গের সোমপুর বিহার)। চর্যাচয় বিনিশ্চয় গ্রন্থে ২৩ জন কবির মোট ৫০টি পদ ছিল। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন এ পাণ্ডুলিপিটি খণ্ডিত ও ছেঁড়া থাকায় পাওয়া গেছে সাড়ে ৪৬টি পদ। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তাদের বলা হতো সিদ্ধাচার্য। তাদের অনেকেই ছিলেন ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের লোক। প্রাচীন যুগের চর্যাপদের ২৩ জন কবির মধ্যে মীনপা, কুক্করীপা, ডেন্ডনপা, সানুপা, চৌরঙ্গীপা, শবরীপা, লুইপা, বিরূপা, ডোম্বীপা, তেলিপা, পরোপা, দারিসপা, সুষ্করীপা, ভূসুকপা, কাহ্নপা, সরহপা, শাস্তিপা, আর্যদেব, কম্বলাস্বর, কঙ্কন কবির নাম আমরা ভালোভাবে জানি। ২৩ জন সিদ্ধাচার্যের সাড়ে তিনটি খণ্ডিত পত্রসহ সর্বমোট ৫০টি চর্যা ধর্মসঙ্গীত উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়েছে।
বহু ভাষাবিদ ও পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে, নাথ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দক্ষিণবঙ্গের লোক মীননাথ বা মৎস্যেন্ত্র নাথ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লেখক, লুইপা নহেন। যেহেতু ফরাসি পণ্ডিত সিলভাঁ লেভির মতে মৎস্যেন্ত্র নাথ ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন, সেহেতু ড. শহীদুল্লাহর হিসাব অনুযায়ী ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার আরম্ভকাল নিঃসন্দেহে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ডক্টর শহীদুল্লাহর বর্ণিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে মীননাথই বাংলার আদি কবি বলে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। চর্যাচর্যের টীকায় মীননাথের একটি আদি কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো :
কাহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মসু রঙ্গ সমধিক পাট॥
কমলবিক শিলি কহিহ ণ জমরা।
কমল মধু পি বিবি ধোকইণ ভোমরা॥
আধুনিক বাংলায় :
কহেন গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট॥
কমল বিকশিলি না কহিও জোংড়াকে (শামুককে)
কমল-মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা।
মধ্য যুগের কবিদের মধ্যে বড়– চণ্ডি দাস, মুকুন্দ রাম, বিজয় গুপ্ত, জ্ঞান দাস, মুকুন্দ দাস, বিদ্যাপতি, আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিদের নাম আমরা পাই। যে চর্যাপদকে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন বলে গর্ব করি তার ভাষা হয়তো আজকাল অনেকেই বুঝতে পারবে না। বাংলা ভাষার সাথে এ ভাষার মিল কতটুকু তা-ও অনেক কষ্ট করে বের করতে হবে। কবি ভূসুকপাদের একটি পদ চর্যাপদ থেকে হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো:
কাহেরে যিনি মেলি আছহ কীস,
বেড়িল পড় অ চৌদীষ।
আপনা মাংস হরিণা বৈরী,
খনহন ছাড় ভূসুক আহেরি।
তিন ন’চ্ছই হরিণা পিবই ন’পানী,
হরিণা হরিণীর নিল অন জানি।
অর্থাৎ প্রাচীনকালের লোকেরা হরিণের মাংস খেতে পছন্দ করতো। শবর বা শিকারীরা জাল পেতে হরিণ ধরতো। চার দিক থেকে ব্যাধ জাল দিয়ে হরিণ ধরে ফেলেছে। হরিণের মাংস সুস্বাদু তাই আপন শরীরের মাংসই হরিণের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে কবি ভূসুক পাদ ইঙ্গিত দিয়েছেন। কবি হরিণকে বলেছেন বন ছেড়ে পালাতে।
চর্যাপদের ভাষাকে বলা হয় আলো আঁধারির ভাষা। কারণ এ সময়কার রচিত চর্যাপদের অনেক পদের অর্থ অত্যন্ত রহস্যময়, বিভিন্ন অর্থ দ্যোতক। তবে কোনো কোনো পদে তৎকালীন মানুষের অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কথা ও সমাজচিত্র প্রতিফলত হতে দেখা যায়। কাহ্নপাদের দু’টি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
মন তরূ পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা॥
আসা বহল পাত ফল বাহা॥
অর্থাৎ মন হলো তরু, পঞ্চ ইন্দ্রিয় তার শাখা
আশা বহুবিধ পত্রের ও ফলের বাহক।
চর্যাগীতিগুলো বাংলা ভাষা ও ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন রূপ। বিতর্কের জালে না জড়িয়ে স্বীকার করতেই হবে এই গীতিকাগুলো প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত। কিন্তু খটকা লাগে এখানে যে, পাঁচশ বছরের সময়ের পরিসরে রচিত এই সাড়ে ৪৬টি চর্যাগীতি বিগত অর্ধশতাব্দীর বাংলা ভাষা-সাহিত্যের গবেষণা ও গৌরবের অবলম্বন হলেও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উদিত হতে পারে যে, একটি জাতির ভাষা এতকাল পর্যন্ত অবিকৃত থেকে একই ভাষা ও ভঙ্গিতে একই গ্রন্থে সংকলিত হলো কিভাবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দেয়ার কোনো চেষ্টা অদ্যাবধি কোনো পণ্ডিত করেননি বিধায় বিষয়টি হেয়ালী চর্যায় হেয়ালীর মতোই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি পাশ্চাত্যের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিজ্ঞানী ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলা ভাষার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত আরো কয়েকটি নেপালি লোকগীতি আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি অন্ধকার যুগের ওপর নতুন আলোকপাত করা সম্ভবপর হবে বলে আশা করা যায়। প্রাচ্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব সংস্কৃতি বিভাগের রিডার মি. আরনন্ড বেক বিগত ১৯৫৫ সালে ভারত সফরকালে নেপালের ভট্টাচার্য সম্প্রদায়ের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংস্পর্শে আসেন; এই ভিক্ষু তাকে লোকগীতি শুনিয়ে মুগ্ধ করেন। মি. আরনন্ড তার গীত-লোকগীতিগুলো টেপ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত লন্ডন সফরে গিয়ে অমূল্য গীতিকাগুলোর সন্ধান লাভ করেন। চা’চাগীতি নামে অভিহিত এই অমূল্য গীতিকাগুলো ড. দাসগুপ্ত মি. বেকের টেপ রেকর্ড থেকে শুনে তৎক্ষণাত এই নেপালি লোকগীতির সাথে ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ গ্রন্থের ছন্দ ও ভাষার মিল আবিষ্কার করেন। ‘সন্ধি যুগ’ বলে কথিত মাঝখানে দুই শতাব্দীর কোনো সাহিত্যকর্মের নিদর্শন একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। ড. দাসগুপ্তের মতানুযায়ী ‘চা’চা’ গীতি মোট সংখ্যা ২২টি। এই ‘চা’চা’ গীতি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্ধকার যুগের ওপর নতুন আলোকপাত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি আরো মনে করেন যে, নব আবিষ্কৃত গীতিগুলোর সাথে বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে বরং চর্যাপদেরই মিল আছে।
গবেষণার ক্ষেত্রে শেষ কথা ঘোষণা করা কখনোই সম্ভবপর নয়। মি. বেকের সংগৃহীত ‘চা’চা’ গীতি সম্ভবত অদ্যাবধি সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে যখন এটি প্রকাশিত হবে তখনই চর্যাপদের ও শ্রী কৃষ্ণ কীর্তনের ভাষার মধ্যবর্তী হারানো সূত্র জানা সম্ভব হবে। তবে গবেষণার জন্য অদ্যাবধি যদি কোনো গবেষক নেপাল থেকে ‘চা’চা’ গীতির আরো নমুনা সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হন তাহলে সন্ধিযুগ বলে কথিত বাংলা সাহিত্যের এই অন্ধকার যুগটির একটি অবলুপ্ত ধারারই শুধু নিদর্শন মিলবে না, অধিকন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে আত্মগোপনকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক অজ্ঞাত তথ্যও আবিষ্কৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
হাজার বছরের পুরনো আলো-আঁধারির ভাষা বাংলা আজ কত ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আমাদের তরুণেরা দিয়েছেন বুকের তাজা রক্ত ও প্রাণ। এ ভাষার সুরম্য পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই হাজার বছরেরও আগে যে ধূপছায়া পথ দিয়ে আমাদের ভাষার যাত্রা হয়েছিল শুরু, সে ভাষা চর্যাপদের পথ ধরেই আমরা বর্তমান বাংলা ভাষার গৌরবদীপ্ত অবস্থানে উপনীত হয়েছি, উপনীত হয়েছি বর্তমান বাংলা ভাষার অগ্রগতির এ গৌরবোজ্জ্বল অ
বাংলা ভাষা ও চর্যাপদ

জোবায়ের আলীঙ্গনে। - See more at: Click This Link আমাদের প্রাণের ভাষা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে হাজার খ্রিষ্টাব্দের পরে, কারো মতে হাজার থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এবং কারো মতে সপ্তম থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আদি বাংলা ভাষার উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।
প্রাচীন বাংলা থেকে মধ্য বাংলা এবং মধ্য বাংলা থেকে আধুনিক বাংলার উৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায়।
প্রাচীন যুগ-৬৫০ খ্রি. ১২০০ খ্রি., সন্ধি যুগ-১২০০ খ্রি.- ১৪০০ খ্রি., মধ্য যুগ-১৪০০ খ্রি. ১৮০০ খ্রি., আধুনিক যুগ- ১৮০০ খ্রি. থেকে অদ্যাবধি
বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের নিদর্শন হলো ‘চর্যাপদ’। মধ্য যুগের নিদর্শন হলো ‘মঙ্গল কাব্য’, ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ ও অনুবাদ সাহিত্য প্রভৃতি।
আজ থেকে ১০৪ বছর আগে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহা মহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগার থেকে হাতে লেখা একটা পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন। এ পুঁথিটির নাম ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’ বা ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। ‘চর্যাচয় বিনিশ্চয়’ আমাদের কাছে ‘চর্যাপদ’ বলেই পরিচিত। ‘চর্যাপদ’-এর কবিতাগুলো বৌদ্ধ বাউল কবিদের রচিত। তারা নানা উপমা ও উদাহরণের দিয়ে নানা ধর্মীয় বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছেন চর্যাগুলোতে। তবে চর্যাপদের কবিতাগুলোতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের নদ-নদীর কথা, পাহাড়, খাল, বিল আর মানুষের কথা, সমাজের সুখ-দুঃখ ও দারিদ্র্যের কথা, বিশেষ করে আমাদের এই উত্তরাঞ্চল তথা বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ‘ভাওয়াইয়া’ ও অন্যান্য গানের মধ্যে চর্যাপদের শব্দের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। এতে প্রমাণ হয়, হয়তো বৌদ্ধ আমলের কোনো কবির আদি বাসস্থান ছিল আমাদের এই উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলাতেই। (পণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের মতে কাহ্নপা ছিলেন এ অঞ্চলের কবি, তার সাধনক্ষেত্র ছিল উত্তরবঙ্গের সোমপুর বিহার)। চর্যাচয় বিনিশ্চয় গ্রন্থে ২৩ জন কবির মোট ৫০টি পদ ছিল। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন এ পাণ্ডুলিপিটি খণ্ডিত ও ছেঁড়া থাকায় পাওয়া গেছে সাড়ে ৪৬টি পদ। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তাদের বলা হতো সিদ্ধাচার্য। তাদের অনেকেই ছিলেন ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের লোক। প্রাচীন যুগের চর্যাপদের ২৩ জন কবির মধ্যে মীনপা, কুক্করীপা, ডেন্ডনপা, সানুপা, চৌরঙ্গীপা, শবরীপা, লুইপা, বিরূপা, ডোম্বীপা, তেলিপা, পরোপা, দারিসপা, সুষ্করীপা, ভূসুকপা, কাহ্নপা, সরহপা, শাস্তিপা, আর্যদেব, কম্বলাস্বর, কঙ্কন কবির নাম আমরা ভালোভাবে জানি। ২৩ জন সিদ্ধাচার্যের সাড়ে তিনটি খণ্ডিত পত্রসহ সর্বমোট ৫০টি চর্যা ধর্মসঙ্গীত উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়েছে।
বহু ভাষাবিদ ও পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে, নাথ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দক্ষিণবঙ্গের লোক মীননাথ বা মৎস্যেন্ত্র নাথ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লেখক, লুইপা নহেন। যেহেতু ফরাসি পণ্ডিত সিলভাঁ লেভির মতে মৎস্যেন্ত্র নাথ ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন, সেহেতু ড. শহীদুল্লাহর হিসাব অনুযায়ী ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার আরম্ভকাল নিঃসন্দেহে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ডক্টর শহীদুল্লাহর বর্ণিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে মীননাথই বাংলার আদি কবি বলে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। চর্যাচর্যের টীকায় মীননাথের একটি আদি কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো :
কাহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মসু রঙ্গ সমধিক পাট॥
কমলবিক শিলি কহিহ ণ জমরা।
কমল মধু পি বিবি ধোকইণ ভোমরা॥
আধুনিক বাংলায় :
কহেন গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট॥
কমল বিকশিলি না কহিও জোংড়াকে (শামুককে)
কমল-মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা।
মধ্য যুগের কবিদের মধ্যে বড়– চণ্ডি দাস, মুকুন্দ রাম, বিজয় গুপ্ত, জ্ঞান দাস, মুকুন্দ দাস, বিদ্যাপতি, আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিদের নাম আমরা পাই। যে চর্যাপদকে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন বলে গর্ব করি তার ভাষা হয়তো আজকাল অনেকেই বুঝতে পারবে না। বাংলা ভাষার সাথে এ ভাষার মিল কতটুকু তা-ও অনেক কষ্ট করে বের করতে হবে। কবি ভূসুকপাদের একটি পদ চর্যাপদ থেকে হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো:
কাহেরে যিনি মেলি আছহ কীস,
বেড়িল পড় অ চৌদীষ।
আপনা মাংস হরিণা বৈরী,
খনহন ছাড় ভূসুক আহেরি।
তিন ন’চ্ছই হরিণা পিবই ন’পানী,
হরিণা হরিণীর নিল অন জানি।
অর্থাৎ প্রাচীনকালের লোকেরা হরিণের মাংস খেতে পছন্দ করতো। শবর বা শিকারীরা জাল পেতে হরিণ ধরতো। চার দিক থেকে ব্যাধ জাল দিয়ে হরিণ ধরে ফেলেছে। হরিণের মাংস সুস্বাদু তাই আপন শরীরের মাংসই হরিণের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে কবি ভূসুক পাদ ইঙ্গিত দিয়েছেন। কবি হরিণকে বলেছেন বন ছেড়ে পালাতে।
চর্যাপদের ভাষাকে বলা হয় আলো আঁধারির ভাষা। কারণ এ সময়কার রচিত চর্যাপদের অনেক পদের অর্থ অত্যন্ত রহস্যময়, বিভিন্ন অর্থ দ্যোতক। তবে কোনো কোনো পদে তৎকালীন মানুষের অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কথা ও সমাজচিত্র প্রতিফলত হতে দেখা যায়। কাহ্নপাদের দু’টি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
মন তরূ পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা॥
আসা বহল পাত ফল বাহা॥
অর্থাৎ মন হলো তরু, পঞ্চ ইন্দ্রিয় তার শাখা
আশা বহুবিধ পত্রের ও ফলের বাহক।
চর্যাগীতিগুলো বাংলা ভাষা ও ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন রূপ। বিতর্কের জালে না জড়িয়ে স্বীকার করতেই হবে এই গীতিকাগুলো প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত। কিন্তু খটকা লাগে এখানে যে, পাঁচশ বছরের সময়ের পরিসরে রচিত এই সাড়ে ৪৬টি চর্যাগীতি বিগত অর্ধশতাব্দীর বাংলা ভাষা-সাহিত্যের গবেষণা ও গৌরবের অবলম্বন হলেও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উদিত হতে পারে যে, একটি জাতির ভাষা এতকাল পর্যন্ত অবিকৃত থেকে একই ভাষা ও ভঙ্গিতে একই গ্রন্থে সংকলিত হলো কিভাবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দেয়ার কোনো চেষ্টা অদ্যাবধি কোনো পণ্ডিত করেননি বিধায় বিষয়টি হেয়ালী চর্যায় হেয়ালীর মতোই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি পাশ্চাত্যের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিজ্ঞানী ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলা ভাষার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত আরো কয়েকটি নেপালি লোকগীতি আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি অন্ধকার যুগের ওপর নতুন আলোকপাত করা সম্ভবপর হবে বলে আশা করা যায়। প্রাচ্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব সংস্কৃতি বিভাগের রিডার মি. আরনন্ড বেক বিগত ১৯৫৫ সালে ভারত সফরকালে নেপালের ভট্টাচার্য সম্প্রদায়ের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংস্পর্শে আসেন; এই ভিক্ষু তাকে লোকগীতি শুনিয়ে মুগ্ধ করেন। মি. আরনন্ড তার গীত-লোকগীতিগুলো টেপ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত লন্ডন সফরে গিয়ে অমূল্য গীতিকাগুলোর সন্ধান লাভ করেন। চা’চাগীতি নামে অভিহিত এই অমূল্য গীতিকাগুলো ড. দাসগুপ্ত মি. বেকের টেপ রেকর্ড থেকে শুনে তৎক্ষণাত এই নেপালি লোকগীতির সাথে ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ গ্রন্থের ছন্দ ও ভাষার মিল আবিষ্কার করেন। ‘সন্ধি যুগ’ বলে কথিত মাঝখানে দুই শতাব্দীর কোনো সাহিত্যকর্মের নিদর্শন একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। ড. দাসগুপ্তের মতানুযায়ী ‘চা’চা’ গীতি মোট সংখ্যা ২২টি। এই ‘চা’চা’ গীতি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্ধকার যুগের ওপর নতুন আলোকপাত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি আরো মনে করেন যে, নব আবিষ্কৃত গীতিগুলোর সাথে বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে বরং চর্যাপদেরই মিল আছে।
গবেষণার ক্ষেত্রে শেষ কথা ঘোষণা করা কখনোই সম্ভবপর নয়। মি. বেকের সংগৃহীত ‘চা’চা’ গীতি সম্ভবত অদ্যাবধি সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে যখন এটি প্রকাশিত হবে তখনই চর্যাপদের ও শ্রী কৃষ্ণ কীর্তনের ভাষার মধ্যবর্তী হারানো সূত্র জানা সম্ভব হবে। তবে গবেষণার জন্য অদ্যাবধি যদি কোনো গবেষক নেপাল থেকে ‘চা’চা’ গীতির আরো নমুনা সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হন তাহলে সন্ধিযুগ বলে কথিত বাংলা সাহিত্যের এই অন্ধকার যুগটির একটি অবলুপ্ত ধারারই শুধু নিদর্শন মিলবে না, অধিকন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে আত্মগোপনকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক অজ্ঞাত তথ্যও আবিষ্কৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
হাজার বছরের পুরনো আলো-আঁধারির ভাষা বাংলা আজ কত ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আমাদের তরুণেরা দিয়েছেন বুকের তাজা রক্ত ও প্রাণ। এ ভাষার সুরম্য পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই হাজার বছরেরও আগে যে ধূপছায়া পথ দিয়ে আমাদের ভাষার যাত্রা হয়েছিল শুরু, সে ভাষা চর্যাপদের পথ ধরেই আমরা বর্তমান বাংলা ভাষার গৌরবদীপ্ত অবস্থানে উপনীত হয়েছি, উপনীত হয়েছি বর্তমান বাংলা ভাষার অগ্রগতির এ গৌরবোজ্জ্বল অঙ্গনে।
- See more at: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.