নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।
টিলার ওপর মাঠ, এমন দৃশ্য হয়। কিন্তু টিলার ওপর চোখ জুড়ানো স্মৃতিসৌধ? আপনি না ভেবে থাকলে কিংবা এমনটি না দেখে থাকলে আপনাকে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে।
ফারুখ আহমেদ:
রক্তে রাঙানো ভ্রাত্রি স্মৃতিকে ভুলবোনা আর
তোমার মাটিতে গড়েছি শহীদ মিনার
তুমি যে আমার হারানো ভাইয়ের শহীদ মিনার।
টিলার ওপর মাঠ, এমন দৃশ্য হয়। কিন্তু টিলার ওপর চোখ জুড়ানো স্মৃতিসৌধ? আপনি না ভেবে থাকলে কিংবা এমনটি না দেখে থাকলে আপনাকে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে। শুধু স্মৃতি সৌধ নয়, এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধী বা কবর। সব মিলিয়ে তিন দিকে মেঘালয় পর্বতমালা ঘিরে থাকা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এক কথায় অসাধারণ। এখানে সৌন্দর্যের আরো সঙ্গী পাবেন-চেলাই খালের ওপর স্লুইজগেট বা পানির ব্যারেজ ও টিলার ওপর জুমগাঁও।
বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ ইতিবৃত্ত
ডাউক সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ নং সেক্টর। পাঁচ নং সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। পাঁচ নং সেক্টরের সাব সেক্টর ছিল সুনাামগঞ্জ জেলার বাঁশতলা। এখানকার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন। পাহাড় বেষ্টিত বাঁশতলা এলাকায় এবং তার আশেপাশে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হন তাদের সমাহিত করা হয় বাঁশতলার এই নির্জনে। সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নির্মাণ হয় বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ। এলাকাবাসির কাছ থেকে জানা যায় প্রায় দশ লাখ টাকা ব্যায় করে বাঁশতলায় এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাাণ করেন ক্যোপ্টেন হেলাল উদ্দিন।
আমাদের বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ দেখা
মেজর জেনারেল আমীন আহমেদ চৌধুরীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গীর ইতিহাস জানতে গেলে তিনি আমাদের সিলেট ক্যান্টনমেন্ট এর স্মৃতিভাস্কর্য নির্মাণের গল্প শোনাতে গিয়ে বাঁশতলা স্মৃতিসৌধের গল্প বলেছিলেন। সে গল্প ভুলতে বসেছিলাম। তরতাজা করল- সিলেটের বন্ধু হযরত বিনয় ভদ্র, রাজীব রাসেল, দেবাশীষ দেবু, একুশ তপাদার, কবির যাহমেদ ও ম্যাক সুমন। তাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার পরিকল্পনা হল, কিন্তু সময় হলনা। একদিন আচমকা বাঁশতলা যাবার প্রস্তাব পেলাম। অ্যাকশন এইডের কমিউনিকেশন অফিসার শরিফুল ইসলামের কাছ থেকে সে প্রস্তাব এলো, তারপর বাসে চেপে বসা। রাত সাড়ে বারটার ইউনিক বাসে আমরা সিলেট যাত্রা করে কনকনে শীতের ভোরে সিলেট পৌঁছে কোনো রকম বিশ্রাম ছাড়াই আম্বরখানা চলে আসি। তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। আম্বরখানায় আগে থেকেই ঠিক করা ছিল সিএনজি চালিত অটোরিকসা। সেই অটোরিকসায় আবার পথে নামি ছাতকের উদ্দেশ্যে। যানজট বিহীন সে রাস্তায় যাত্রাসঙ্গী শরীফ চোখ বুজে ঘুমের ভান করলেও সামিউল্লাহ সম্রাট ইচ্ছেমত বলে চলে বাঁশতলার গল্প। তার গল্প বলার কারন সে এর আগেও বাঁশতলা ঘুরে এসেছে। সম্রাটের সে গল্প শুনে শুনে আমরা এগিয়ে চলি ছাতকের উদ্দেশ্যে।
দিনের শুরু হচ্ছে সঙ্গে শুরু হচ্ছে মানব কোলাহল। সে সব কোলাহল পেরিয়ে অচেনা নিস্তব্ধ নিঝুম পথে চলতে সময় লাগেনা। এখানে পথের দুপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ সঙ্গে মিষ্টি পাখির ডাক। মনে পড়ে যায়, গেল বছর টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাবার কথা। আমি সামনের সিটে বসায় মুসলিমার সে কী রাগ। আজ আমি সিএনজির পেছনের সিটে বসা আর মুসলিমা এসময় নিশ্চিত ঘুমাচ্ছে এবং আজও তার রাগ হচ্ছে, নাকি রাগে সরারাত ঘুমাতেই পারেনি। ভাবতে ভাবেত এক ঘন্টায় পৌঁছে যাই ছাতক বাজার। এখানে পাবলিক খেয়াঘাট থেকে নৌকায় দশ মিনিটে সুরমা নদী পার হয়ে চলে আসি নোয়ারাই বাজার। সেখান থেকে আবার সিএনজি চালিত অটো রিকসায় প্রায় ৪০ মিনিটে বাংলাবাজার হয়ে বাঁশতলা। অবশ্য বাঁশতলা স্মৃতিসৌধে পৌঁছাবার আগেই মুগ্ধ হতে হয়। সে মুগ্ধতা এনে দেয় এখানকার স্লুইজ গেট। চেলাই খালের ওপর নির্মিত সে স্লুইজ গেট দেখার পর পা আর আগে বাড়তে চাচ্ছিলনা। তবু শরীফ আর সম্রাটের তাড়া খেয়ে আগে বাড়তে হয়। তবে কথা হয় ফেরার পথে স্লুইজ গেটে আমরা অনেক সময় থাকব, আর যাব জুমগাঁও। টিলার ওপর পাহাড়ি গ্রাম। এখানে প্রায় ৩৬ ুদ্রজনগোষ্ঠী পরিবারের বসবাস। শুনে তো আমার পা আবার থমকে যায়। তারপর আবার এগিয়ে চলি স্মৃতিসৌধে। তারপর তো অল্প সময়, চলে আসি বাঁশতলা স্মৃতিসৌধে।
ছাতক পাবলিক খেয়াঘাট থেকে বাঁশতলা যাবার পথটির প্রাকৃতিক শোভা ভারি সুন্দর। বাঁশতলা পৌঁছে মন আনন্দে ভরে উঠল। ভারত সীমান্তঘেরা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এখন আমাদের একেবারে চোখের সামনে। শীতের দিন হলেও আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন নয়, আকাশে সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে নীলাকাশ যাকে বলে ঠিক তাই। আর হাত বাড়ানো দুরত্বে পাহাড়। আকাশ তলে পাহাড় আর স্মৃতিসৌধ ভাবতে ভাবতে মুখ থেকে বের হয়ে আসে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে স্মৃতিসৌধ।’ জাতীয় কবির গানে একটা লাইন জুড়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু সুর জুঁড়ে দিতে পারলামনা। তবু গুনগুনিয়ে চেষ্টা করি। গুনগুন সে চেষ্টায় সম্রাট আর শরীফ চমকে তাকায়। তাদের সে চমক চোখে নিয়ে স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখি। এখানে পর্যটক বলতে আমরা তিনজন। মজার হচ্ছে শীতের ছুটির দিন। অথচ কেউ এখানে বনভোজন করতে আসেনি। স্মৃতিসৌধ তো বটেই পুরো এলাকাটাই অসাধারন সৌন্দর্যেঘেরা। সেই মনোরম মুগ্ধতা ছড়ানো সুন্দরকে ছুঁয়ে চলে আসি সমাধিস্থলে। এখানে দেয়ালের একপাশে লাইন করা স্মৃতিসৌধ আর তাদের ছায়া হয়ে আছে অজস্র বৃরাজি। সমাধি এলাকায় পা রাখতেই দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। এখানে মোট ১৪টি সমাধিতে শুয়ে আছে আমাদের ১৪ ভাই। মিরপুর, কাটাসুর আর বুড়িগঙ্গা হয়ে এমন অজস্র ভাই আমাদের শুয়ে আছে সমগ্র বাংলাদেশে। এখানে শীত-গ্রীস্ম যাবে আসবে, দিন-রাত যাবে আসবে কিন্তু আমাদের সে সব ভাইয়েরা আর ফিরে আসবেনা। ভাবতে ভাবতে অশ্র“সিক্ত নয়নে জুমগাঁওয়ের পথ ধরি।
প্রয়োজনীয় তথ্য
বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ যেতে হলে আপনাকে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে বাঁশতলা যাওয়া যাবে। আবার ছাতক উপজেলা থেকেও বাঁশতলা যাওয়া যাবে। দিনরাত ঢাকা-সিলেট-সুনামঞ্জ বাস চলাচল। সুবিধামত সময়ে হানিফ, ইউনিক কিংবা শ্যামলির বাসে চেপে বসলেই হবে। আমরা সিলেট-ছাতক-দোয়ারা বাজার হয়ে বাঁশতলা গিয়েছিলাম। আমি সবাইকে সে পরামর্শই দেব। সন্ধ্যার বাসে সিলেট যাত্রা করলে রাত বারোটার মধ্যে সিলেট পৌঁছে রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে পরদিন বাঁশতলা। সাত-সকালে আম্বরখানা থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকসায় আপনাকে ছাতক আসতে হবে। ভাড়া মাথা পিছু ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এবার ছাতক বাজার থেকে সুরমানদী অতিক্রম করে আবার সিএনজিতে চেপে সরাসরি বাঁশতলা।
©somewhere in net ltd.