নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পাঠঘর থেকে-১
এস এম সুলতানকে নিয়ে বেশ কৌতূহল কাজ করছে আমার মধ্যে বেশ দীর্ঘদিন ধরে। আহমদ ছফার "যদ্যপি আমার গুরু" পড়ার পর থেকেই এ কৌতূহলের জন্ম। অনলাইনে তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখেছি, সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর যা পেয়েছি তা পাঠ করেছি। আর দেখেছি তারেক মাসুদের "আদম সুরত"। নানা কারণে তাঁকে নিয়ে লেখা কোনও বইয়ের সাথে সংযোগ আমার ঘটেনি। আমার পরিচিত শিল্পী-বলয়ে সুলতান নিয়ে কিছু জানার আগ্রহ যেই প্রকাশ করেছি, দুয়েকজন বাদে প্রায় সকলেই নেশা-ভাঙ আর কিছু মিথই ঘুরেফিরে শুনিয়েছেন।
"আমি চাক্ষিক রূপকার মাত্র" পড়ার পর রামকিঙ্করকে নিয়ে যে কারণে আমার আগ্রহের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল, ঠিক একই কারণে আমি সুলতানকে নিয়েও ঠিক এমন ধাঁচের বইয়ের সন্ধান করছিলাম। গত এক বছরে খসরু পারভেজ সম্পাদিত "মুখোমুখি সুলতান", সৈয়দ নিজারের "ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা" এবং হাসনাত আবদুল হাইয়ের" সুলতান" সংগ্রহ করি। কিন্তু পাঠ করা হয়ে ওঠেনি। এক ধরনের অনিয়মিত রিডিং ব্লক (জানি না রাইটিং ব্লকের মতো করে রিডিং ব্লক আছে কি না!) কাজ করছিল। মন বসাতে পারছিলাম না।
করোনাকালীন সময়ে বুলবন ওসমানের "নন্দনতত্ত্বের গোড়ার পাঠ নাড়তে গিয়ে সুলতান নিয়ে দুটি লেখা পড়লাম। ফের অতৃপ্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পড়ব পড়ব বলে গত সপ্তাহে এসে "মুখোমুখি সুলতান" পড়া শুরু করলাম, বেশ আনন্দ ও তৃপ্তির সাথেই গতকাল পাঠ শেষ করলাম। ১১২ পৃষ্ঠার এই বইটি শেষ করতে সাত-আটদিন লেগে গেল। খসরু পারভেজ, শাহাদুজ্জামান, শরীফ আতিক-উজ-জামান ও বাবলু ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। সুলতান বিষয়ক প্রাথমিক-পাঠে বইটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। শিল্প, সমাজ, নগর, রাষ্ট্র, পৃথিবী, বাঙালি ও মানুষ নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনার দার্শনিক রূপ ছড়িয়ে রয়েছে বইটির পরতে পরতে। তাছাড়াও শিল্পীজীবনের পরিভ্রমণের একটা চিত্র পাওয়া যায়। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়া, সেখানে বরাবরের মতো ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ না করেই পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ফলে এক ঈর্ষণীয় ভবঘুরে জীবনের স্বাদ নিয়েছিলেন। বিশ্বজনীন বোধের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে এই পরিভ্রমণের সমাপ্তি টেনেছেন তিনি। এভাবে শিকড়ের কাছে ফিরে আসা ও তাঁর স্বজাতির কাছে মূল্যায়িত হওয়ার বিন্দুমাত্র আশা-প্রত্যাশা না করে এক সন্ত-শিল্পীর জীবন ধারণ করে মাটি ও মানুষের ঘনিষ্টতর হয়ে এর বয়ান তিনি দিয়ে গেছেন বিস্ময়করভাবে। আর তা যেন একমাত্র সুলতানের পক্ষেই সম্ভব।
তিনি গ্রাম নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন কৃষকসমাজ নিয়ে, আর ভেবেছেন শিশুদের নিয়ে। ভাবনাকে বাস্তবায়নও করেছেন, তার মতো করে। রাষ্ট্র-সমাজ তাকে বুঝেনি। এক জায়গায় তিনি বলেছেন,
“আমি আলাপ করি বেগম এরশাদের সঙ্গে, তাকে অনেক বুঝালাম। তাকে বললাম, আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভোররাতে কাঁদে কেন? চিৎকার করে কাঁদে, এমনকি বিছানা থেকে মাকে উঠতেই দেয় না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কাঁদে কেন? তখন তিনি বলতে পারলেন না। বললেন, আপনি বলেন। আমি বললাম যে, ওদের খিদে লাগে। সারা রাত্রি ঘুমানোর পর ওদের যখন খিদে লাগে, তখন কাঁদে। গরিবের ঘরে এমন কিছু থাকে না, যা দিয়ে সকালে ওদের কান্না থামানো যায়।’
এ-থেকে বোঝা যায় তার মানবিক শিশুশিক্ষাভাবনার স্বরূপ। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কীভাবে একজন শিশু ছবি আঁকা শিখবে! কীভাবে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে! শিশুদের জন্য তিনি গড়ে তুলেন শিশুস্বর্গ। নির্মাণ করেন বজরা, যাতে করে নৌভ্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রকৃতিকে রঙ-তুলি দিয়ে চিত্রায়িত করতে পারে। তার শিশুভাবনা বা শিশুবিকাশ-ভাবনা সত্যিই মানবিক ও প্রকৃতিঘনিষ্ট। বেশ সুন্দরভাবেই শিশুভাবনার সার উঠে এসেছে। তা যেন ঠিক মহাকালের মগ্ন শিশুর মুখে শিশুস্বর্গের বয়ান।
ইতিহাসের সাথে তাঁর চিন্তার বোঝাপড়ায় তাঁর চিত্রকলার নির্মাণ তা তিনি বেশ সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। বারবার বিষয়বস্তু হিসেবে কৃষকসমাজ ও তাদের দানবীয় শরীরের চিত্রায়ণ তিনি কেন করেছেন তাঁর ব্যখ্যাও পাওয়া গেছে বেশ চমৎকারভাবে। তিনি বলেন,
“সচরাচর আমরা যা দেখে থাকি তার দৃশ্যানুগ সরল উপস্থাপনা ছবি নয়। তেমন কাজ শিল্পীর তুলির দক্ষতা তুলে ধরে মাত্র। কিন্তু তার কোনো হিউম্যান ভ্যালু থাকে না। শুধু প্লাস্টিক ভ্যালু চিত্রকলার উদ্দেশ্য হতে পারে না, তবে শিল্পীর নৈপূণ্য কৌশল তার ছবির হিউম্যান ভ্যালু ফুটিয়ে তুলতে অবদান রাখে অবশ্যই। আবার ছবির স্বাভাবিক অঙ্গ-সৌষ্ঠবের হলে তোমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগত না। এগুলো গ্রামীণ জীবনের Photographic Representation হোত মাত্র। বক্তব্যহীন ছবি নিশ্চয় ছবি নয়। ওদের স্বাস্থ্যবান করে চিত্রিত করার উদ্দেশ্য তিনটি বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিষয় তিনটি হলো _ নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতি। নৃতত্ত্ব বলছে, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা খুবই স্বাস্থ্যবান ছিল, দানবীয় অঙ্গ-সৌষ্ঠবের ছিল। অনার্য জনগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় তাদের রঙ, নাক, চোখ, চুল ইত্যাদি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের যা আমার ছবির মানুষের রয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য হল, একদা তাদের প্রাচুর্য ছিল, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না, কিন্তু রাজনৈতিক চক্রান্তে তাদের সে স্বাস্থ্য হারিয়ে গেল। যুগে যুগে তারা শোষিত হল নিরন্তর এবং এই প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমি চাই ওদের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাক । আমি স্বপ্ন দেখি ওদের সোনালী দিন। আমি তাকাই সামনে ও পেছনে, সময়কে অতিক্রম করে। তাই ওরা দানবীয়। তাছাড়া মানুষকে ভালোবাসলে তার প্রকাশ হওয়া চাই সুন্দর ও বলিষ্ট। আমার কাছে শক্তিই সৌন্দর্য। মাইকেল এঞ্জেলো যেমন মানুষকে Normal size থেকে Abnormal size এ নিয়ে গেছেন। তিনি মনে করেছেন, মানুষ এত বড় হলে ভালো হয়। Concept of Adam-ও কিন্তু এই রকম। তার যে বর্ণনা আছে তা এই রকম”।
বহু বিচিত্র বিষয়ে সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। কাশ্মিরে প্রদর্শনীর কথা যেমন এসে তেমন এসেছে সেখানকার সৌন্দর্য ও কৃষকের কথা। এসেছে ইউরোপে ও আমেরিকায় প্রদর্শনী পরিভ্রমণের গল্প।
বিচিত্র ও বহুমাত্রিক আভায় উদ্ভাসিত শিল্পী সুলতানকে নিয়ে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন, ‘সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না’। “মুখোমুখি সুলতান” পাঠ করে উপলব্ধি হলো গুন্টার গ্রাসের মূল্যায়নটুকু কতটা গভীর ও অন্তর্ভেদী। সুলতান বামুনের দেশে এক অতিকায় স্বাপ্নিক।
২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫৮
জয়দেব কর বলেছেন: তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:০৭
মুজিব রহমান বলেছেন: হাসনাৎ আব্দুল হাই সুলতহানকে নিয়ে যে উপন্যাসটি লিখেছেন তা খুব ভালই। তাঁর নভেরা’র পরে এটাই হয়তো সেরা- সুলতানের পূর্ণাঙ্গ জীবন। তাঁকে নিয়ে আমরা কয়েকটি উৎসব করেছি তাঁর জন্মবার্ষিকীতে নাম ছিল সুলতান মেলা।
তাঁর পেশীবহুল কৃষক- ভাবনা হিসেবে মন্দ নয়, তবে বাস্তবতা তা বলে না।
২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫৯
জয়দেব কর বলেছেন: ধন্যবাদ। পেশীবহুল কৃষক মূলত ইতিহাসের সাথে ভাবনার সংযোগ।
৩| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৫
পদ্মপুকুর বলেছেন: আপনার লেখাটা আরও একটু বিস্তৃত হওয়ার দাবী করছিলো। হুট করে থেমে গেলো।
আমাদের স্বকীয়তা, সৌন্দর্যবোধ, শক্তিমত্তা অস্বীকার করার ধারাবাহিক পক্রিয়ায় সুলতানও পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মহাত্মা আহমদ ছফার অসংখ্য মহৎ কাজের মত শিল্পী এস এম সুলতানকেও সভ্য সমাজে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে এমন মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, নিঃস্বার্থ সমাজভাবনার মানুষের পরিবর্তে লোভী মানুষদের ক্ষুধার্ত পদচারণা চারিদিকে!
২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:০১
জয়দেব কর বলেছেন: ধন্যবাদ। আমি পরে বিস্তৃত লিখব বলে ভেবেছি। এই লেখাটি মূলত "মুখোমুখি সুলতান" বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া মাত্র।
৪| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৭
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: আহমেদ ছফাকে ধন্যবাদ এই রকম একজন নিভৃতচারী শিল্পীকে খুঁজে বের করার জন্য ও বিভিন্ন সময় তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। আহমেদ ছফা এই দেশে উপযুক্ত সম্মান পেলেন না এইটাই দুঃখজনক।
৫| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৩
আখেনাটেন বলেছেন: চমৎকার একটি সন্ধান দিলেন। এস এম সুলতানকে নিয়ে আমারও জানার আগ্রহ রয়েছে। শাহাদুজ্জামানের 'কথা পরম্পরা' বইয়ে মনে হয় উনার একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। চমৎকার। পরিশীলিত চিন্তার আধার। জীবনবোধ এতটাই গভীর যে ধাঁধা লেগে যায়, মনে হয় এভাবেও মানুষ ভাবতে পারে।
বইটি ক্রয়ের তালিকায় থাকল। ধন্যবাদ সুন্দর একটি বইয়ের সন্ধান দেওয়ার জন্য।
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:১১
জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
৬| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৩
খায়রুল আহসান বলেছেন: একটি সুলিখিত পাঠ প্রতিক্রিয়া।
ধন্যবাদ, বইটি এবং শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য।
পোস্টে ভাল লাগা + +।
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:১০
জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও অসংখ্য ভালোবাসা।
৭| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২৬
রাজীব নুর বলেছেন: আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
৮| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:১৮
ঘনশ্যাম বলেছেন: সুলতান দ্য গ্রেট!
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:২৮
জয়দেব কর বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:১৭
রাজীব নুর বলেছেন: একজন গ্রেট শিল্পী।