নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(ক)
আমার রচনায়, আমি এমন কিছু বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা করি, যা শুধু রিডিং পড়তে পারার যোগ্যতা নিয়ে কেউ তার মর্মমূলে প্রবেশ করতে পারে না। দরকার হয় বিশেষ অনুভূতি ও প্রজ্ঞার, তা না হলে আমার দৃষ্টিভঙ্গি না বুঝার জন্য বদ-বমন করবার ছোট্ট একটি ভয় থেকে যায়। তাই উক্ত বিষয়ে আমি, শুরুতে আমার প্রাজ্ঞ পাঠকদের বিনীতভাবে সতর্ক করি। অনুভূতির সহজ প্রকাশের জন্য শব্দ বা ভাষা, যা অনুভবের চূড়ান্ত বিকাশকে অনুধাবণ করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে অপার বোধই হতে পারে অনুভবের সমকক্ষ। এ পর্যায়ে মুখোমুখি বসে কিছু আলাপচারিতার জন্য আমি আমার সমমানের নয় তো উত্তম কাউকে- “সুস্বাগতম” জানাবার অপেক্ষায় থাকি।
আমি সবচেয়ে বেশি ইতস্তত বোধ করি তখন- কুসংঙ্কার আচ্ছন্ন, সংকির্ণমনা যারা, তারা যখন কোন বিষয়ের টিকিটি ধরতে না পেরে স্নায়ুচাপে ভোগতে থাকে, এবং জাত গেল, জাত গেল! চিলে কান নিল, কান নিল বলে দিগ বিদিক-জ্ঞানশূণ্য ছুটতে গিয়ে চোখে শষ্যে-ফুল দর্শন করে। তাই আমি চাই যে-অমন মানুষ থেকে যেন আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকি, তথাগত আমার সহায় হন। আমরা সকলেই অবগত আছি, বিশেষ কোন গ্রন্থ বা তার অক্ষর মেপে জীবন অতিবাহিত হতে পারে না! তাই আমাদেরকে অক্ষর আর গ্রন্থের উর্ধ্বে স্ব স্ব বোধদয়কে উত্তীর্ণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-জগতে সিদ্বান্ত নেবার ক্ষেত্রে অধিকতর ভুল নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকে। আমরা এ-ও জানি যে-এই ভূ-লোকে নারী বহুমাত্রিক ভুল ও বর্বরতার শিকার। যাকে আজো নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে নানান-ধর্ম-সমাজ-রাজনীতি ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। যারা জানে না, বা স্বীকার করে না যে নারীও তাদের সমকক্ষ মানুষ। যারা নারীকে (মাতৃজাতিকে) কামনাভোগের সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না তারাই অধিকতর নারী সম্পর্কে কঠোর বর্বরতায় পারদর্শী হয়। আমরা যারা জ্ঞান ও জ্ঞানীর প্রসংশান্মোখ, যারা জ্ঞান ও জ্ঞানীর সরণাপন্ন হই অহর্নিশ তারা কেন মনে করবো না “জ্ঞান” জাত-কুল-গোত্র ও লিঙ্গের প্রভেদহীন? তারা কেন মনে করবো না, জ্ঞানই যদি শ্রেষ্ঠ জীবনবাহন হয় তবে তা দিয়ে পাড়ি দেবার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই পদার্পন করতে পারে স্বেচ্ছায়। আমাদের মনে চির-জাগ্রত থাকুক- কারো যাবার পথ যদি মসৃণ না হয়, কণ্টকাকীর্ণ হয় তবে তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে বরং সুন্দরভাবে পথ পাড়ি দিতে সহযোগীতা করাই মনুষ্য-ধর্ম। অন্যথায় হলে মানুষ বলবো কারে?
(খ) বাংলাদেশ শ্রামণী সংঘ প্রতিষ্ঠায়, অবদানে যারা সক্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বলি-
তথাগত বুদ্ধ বিশেষ কোন সম্প্রদায় বা লিঙ্গ-ভিত্তিক ধর্ম প্রচার করেন নি। তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র মানবসমাজে এমন এক চেতনা-ভাবের উন্মেষ যা সকলের হিতের জন্য সমভাবে কার্যকর হয়ে প্রবাহিত হতে থাকবে। বিচার বিবেচনাশূন্য অন্ধবিশ্বাস বা গুরুশ্রেণীয় কেউ বলেছে বলে, বা বংশপরম্পরায়, রীতিনীতিতে প্রচলিত বলে গ্র হণ করতে হবে এমন কিছুকে নিঃষ্ফল, ক্ষতিকর বলেই ঘোষণা করেছেন। যেমন আমরা “কালাম সুত্রে” দেখি, তথাগত বলেছেন:
‘মা অনুস্সবণ, মা পরম্পরায়, মা ইতিকিরিয়ার, মা পিটক সম্পাদানেন, মা তক্কহেতু, মা নয় হেতু, মা আকার পরিবিতক্কেন, মা নয় হেতু, মা আকার পরিবিতক্কেন, মা দিট্ঠি নিম্মান খন্তিয়া, মা ভব্বরুপতায়, মা সমনো, যা গরুতি।’ যার অনুবাদ করেছেন- প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, মানবতাবাদী ভিক্ষু, মুক্তচিন্তার মনিষী ভদন্ত জ্যোতিপাল মহাথেরো- অর্থাৎ-“যদি উন্নতি পথের যথার্থ পথিক হতে চাও, যদি রক্ষিত বিষয় পেতে চাও, জ্ঞানের উন্নতি সাধন করতে চাও, তবে ছাড় শ্রুতির পরম্পরা, ছাড় অন্ধতা, ছাড় বংশানুক্রমিক আগত রীতিনীতির ধারা, ছাড় মিথ্যা ধারণা, অমূলক দৃষ্টি, ছাড় শাস্ত্রোক্তির নির্ভরতা, ছাড় কূট-তর্ক ও বাগ্মীতত্ব, ছাড় মতামতের অনড় বালাই, ছাড় শ্রমণ-ব্রাহ্মনের ফতোয়া, ছাড় গুরু মতের দোহাই। আপন বিবেক বুদ্ধি, চিন্তা, যুক্তি, বিচারের সহিত যা মিলবে না, যা জীবনের জন্য হিতকর বলে বিবেচিত হবে না, তা মেনে নিও না। পরের মুখে ঝাল খেওনা, বাহ্যিক রূপে বিস্মিত হয়ো না, সভ্যতা-ভব্যতায় মানুষের বিচার করো না। শুধু পরমত জেনে, পরের বই পড়ে, শাস্ত্র অধ্যায়ন করে, গুরু মহাশয়ের মুখে মুখে কিংবা দশজন হতে খবর নিয়ে যে জানা তা হলো মাত্র ‘জ্ঞাত পরিজ্ঞান’। জ্ঞানের সীমা অতিক্রমের চেষ্টা ও মিমাংসামূলক যে জানা তা হলো ‘জ্ঞান পরিজ্ঞান’ অপর সজ্ঞানের প্রভাবে প্রচলিত ভ্রান্ত মত সম্পূর্ণরূপে বর্জনপূবর্ক যে জানা তা হলো ‘প্রহাণ পরিজ্ঞান’।
(গ) পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম সমূহে যে সকল বিধি-বিধান পাওয়া যায়, তা বিনা বিচার বিবেচনায় প্রতিপালন করতে হয়। সে-সব বিধি-বিধান নিয়ে কোন প্রশ্ন আর কৌতুহল থাকতে পারে না। তা শুধু চোখ বন্ধ করে মস্তকে ধারণ করতে হয়। চোখ মেলে দেখার, পরখ করার প্রজ্ঞা অথবা সাহস দেখানো দণ্ডনীয়, দুষনীয় কর্ম বলেই সে-সব ধর্ম ও তার বিধি-বিধান সমূহ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, এবং তা মানতে বাধ্য করে। যার দরুণ জ্ঞানীগণ ওই সব ধর্ম নিয়ে বিব্রত বোধ করেন, সামান্যও গৌরব করতে পারেন না।
এদিক থেকে বুদ্ধের ধর্ম ও বিনয়-বিধান সম্পুর্ণ ভিন্ন, গণতান্ত্রিক। যা মানবপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য, এবং বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ন। কারণ বুদ্ধের প্রতিটি বাক্য পরিক্ষাযোগ্য, প্রশ্নযোগ্য এবং তা প্রমানিত হলে গ্রহনযোগ্য, অপ্রমানিত হলে অগ্রহনযোগ্য। তাই তথাগত বুদ্ধই একমাত্র ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব যিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছেন-“হে ভিক্ষুগণ! (দুঃখমুক্তিকামীগণ) আমি যাহা বিহিত বলে ব্যবস্থা দিয়েছি তা যদি অবিহিতের অবিরোধী এবং বিহিতের বিরোধী হয়; তা হলে তা তোমাদের পক্ষে নহে। আমি যা ‘বিহিত’ বলে ব্যবস্থা দেই নি, যদি বিহিতের অনুলোম (অনুযায়ী) এবং অবিহিতের বিরোধী হয় তাহলে তা তোমাদের পক্ষে বিহিত।”[মহাবর্গ ভৈষজ্য স্কন্ধ] বিধি সম্মত ও বিধি বিরুদ্ধ।
উপরোক্ত বক্তব্যের সরল অনুবাদ করেছেন, ভিক্খু জে. প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো, যার নিম্নরূপ- “হে ভিক্ষুগণ! দুঃখমুক্তিকামীগণ আমি যে সকল বিষয়কে তোমাদের জন্য মঙ্গলকর বলেছি তা যদি কখনো দেখ যে অমঙ্গলের স্বপক্ষেই কাজ করছে তাহলে সে মূহুর্ত্তেই তা পরিত্যাজ্য বলে জানবে। আর যা মঙ্গলকর বলি নি অথচ দেখা যাচ্ছে তা মঙ্গলের স্বপক্ষে কাজ করছে তাহলে তা তোমাদের পক্ষে মঙ্গলকর বলেই জানবে।” (মহাবর্গ পরিক্রমা)
(ঘ) আমরা এ থেকে বুঝতে পারি- বুদ্ধের ধর্ম অনড়, অবশ বহু কষ্টে বইবার মত কোন পাথর নয়; এটা জীবন-প্রবাহের মত ক্রিয়াশীল, যা স্থান-কাল-পাত্রের অনুকুলে থেকে মঙ্গলের নির্দেশ করে। এটা কোন অবস্থাতেই বিনয়-বিধানের নাম করে জীবন-প্রবাহকে রোধ করে না, শ্রেণী ও লিঙ্গের প্রভেদ করে না।
তাই বুদ্ধের সময়কালে বিশেষ কিছু ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা নারীকে ধর্ম-সম্পদ লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন তার মধ্যে বৌদ্ধরা অন্যতম। বুদ্ধ নারীকে পুরুষের সমান অধীকার দিয়েছিলেন। যা সেই সময়ের জন্য ছিলো অনন্য এক বিপ্লবাত্বক দৃষ্টান্ত। যদিও নারী ভিক্ষুণী সঙ্ঘে অন্তর্ভূক্তির পরে ধর্ম সম্পদে সমঅধীকার বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্য আনন্দের সান্নিধ্য ব্যাথিত (আনন্দ সমমানের উদার ও প্রগতি মনস্ক আরো কেউ কেউ ছিলেন) পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেছেন এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তারও কারণ আছে, নারী সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা হাজার হাজার বছর ধরে মানব সমাজের মর্মমূলে চাষাবাদ হচ্ছিলো, যা থেকে অন্য অনেক দিকে সফল, মূল্যবান পুরুষও নিজেদের মুক্ত করতে না পারা। যার জন্যে ভিক্ষুদের একাংশ নারীদের উদার ও মানবিক দৃষ্টিতে দেখলেও অন্য একটি অংশ তাঁদের সংস্কারাচ্ছন্ন মন বা অন্যকিছুর প্রভাবে ভিক্ষুণীদের অসহযোগিতা করে। হয়ত তাই-ই তথাগত বুদ্ধের নির্বাণ লাভ-পরবর্তী সময় থেকে সম্রাট অশোকের কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রার সময়কাল পর্যন্ত কোথাও আর ভিক্ষুণী সম্পর্কে কোন খবর পাওয়া যায় না। মহাকারুনিক বুদ্ধের নির্বাণ লাভের পরে অনুষ্ঠিত প্রথম সঙ্গীতিতে অনেক ভিক্ষু মহান আনন্দকে ভৎসনা করে এই জন্যে যে আনন্দ ভিক্ষুণী সঙ্ঘ গঠনে তথাগত বুদ্ধের কাছে সুপারিশ করেছিলো।
এ-থেকে যদি আমরা ধরে নেই যে, বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে ভিক্ষুণীগণ বাস্তবপ্রস্তাবে অভিবাবকশুন্য হয়ে পড়েন? এবং বুদ্ধের উপস্থিতিতে যারা নারীদের সঙ্ঘে অন্তর্ভূক্তিকে মেনে নিতে পারে নি, যারা নিরবে ঘাপটি মেরে ছিলো, তারা নানান অজুহাতে নারী তথা ভিক্ষুণীদের উত্থান রোধ করে দিয়েছিলো? আজ যারা নারীদেরকে সঙ্ঘে প্রবেশাধিকারে যে-সব বাঁধাবিপত্তির অস্ত্র প্রয়োগ করছেন তার কতটা তথাগত বুদ্ধদ্বারা প্রস্তুত! উদার, সত্যেন্বেষী মনে গবেষণার দাবী রাখে। বুদ্ধের শিক্ষাই তো এমন যে, বোধের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে গ্রহনীয়কে গ্রহনীয় রূপে আর বর্জনীয়কে বর্জনীয় রূপে আবিষ্কার করা।
এখানে বলে রাখা দরকার, ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে ব্যক্তিবিশেষের বোধে ধরা পরতে বাধ্য আসলে কার বা কাদের মনন বিবিধ বিষয়ের উপর কেমন এবং কেন প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আমরা এভাবে নিখুঁত ভাবনা-বিচার প্রনালীর মধ্য দিয়ে অন্ধকার থেকে আলোতে পৌঁছতে পারি, এমন কি আলো থেকে আলোতে বিচরন করতে পারি অনায়াসে। পৃথিবীর ভালোমন্দ সকল গ্রন্থই স্থান-কাল ও ব্যক্তি বিশেষের মানসিক ধরণ, গুণাবলী নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোন গ্রন্থই শেষ কথা নয়, চূড়ান্ত কোন ভাষ্যও নয়। মহান বুদ্ধের প্রশংসিত বোধের কষ্টি-পাথর দিয়ে যাচাই বাছাইয়ের বিচারপ্রণালীই মানুষের জন্য হতে পারে সুন্দরতম গন্তব্যে পৌঁছবার উৎকৃষ্ট বাহন।
(ঙ) আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে দুঃখমুক্তির জন্য উদ্যোগী আয়ুস্মান গৌতমী তথা পাঁচশত নারী-কন্যার সাহসী প্রচেষ্টায়, তথাগত বুদ্ধ ও প্রাজ্ঞ আনন্দের সান্নিধ্য-দানে পৃথিবীর মানচিত্রে মহান শীলবান ভিক্ষুণীদের আবির্ভাব হয়। নানান প্রতিকুলতায় ও লয়বিলয়ের মধ্য দিয়ে আজো তার নিশানা সমুজ্জ্বল। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে শ্রামণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে; যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রাজ্ঞ শ্রামণী, সু-ধর্মদেশক, ভাবনা পরিচালক, ও গৌতমী সাময়িকীর সম্পাদক রুনা বড়ুয়া। এটা এক অনন্য ইতিহাসের সূচনা, যা শুধু শ্রামণী রুনা বড়ুয়া নয় সমগ্র বৌদ্ধ সমাজের জন্য গৌরবের। নারীরও ইচ্ছার মুক্তি আছে নরের সমান মুক্তি যা সেদিন মহাপ্রজাপতি গৌতমী অনুভব করে বাস্তব প্রদক্ষেপ নিয়েছিলেন, আজ তারই দেখানো পথে হেটে শ্রামণী রুনা বড়ুয়া বাংলার নারীসমাজকে নতুন করে তা জানিয়ে দিলেন নিজের সুদৃঢ় সঙ্কল্পে ও আলোকিত কর্মপ্রবাহের মাধ্যমে। তাঁর এই দৃঢ়চেতা মঙ্গলময় প্রদক্ষেপের আমরা সকলেই সম-অংশীদার। এখানে আমি স্মরণ করে দিতে চাই- রুনা বড়ুয়া (গৌতমী শ্রামণী) কোন তুচ্ছ করে ফেলনার মত ব্যক্তি নন, তিনি ধর্ম ও বিনয়ে, বোধ ও বুদ্ধিতে অসামান্য ধয্য ও সহনশীল। তার আছে বুদ্ধ ও বোধের প্রতি অপার শ্রদ্ধা, যা তার চৈতন্যে স্থির গণমানুষের প্রতি, বিশ্বমানবতার প্রতি করুণা ও মৈত্রীর দান। এমন একজন ব্যক্তি, যে সম্মুখে পা বাড়াবার দৃঢ় সংকল্প, অথচ বৌদ্ধ নারী-সমাজে দূলর্ভ। তাই তাঁর জন্ম ও জীবন প্রবাহ যে সমাজে- সে সমাজ অবশ্যয় আলোকিত, গৌবান্বিত।
(চ) আমাদেরকে এখন সকলের হিতের জন্য চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে, গুরুবাক্য বজ্রমুষ্ঠিতে ধারণ করতে হবে এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, কারণ তা বুদ্ধের শিক্ষার পরিপন্থি। মহান বুদ্ধ বলেছিলেন: আমার ধর্ম বা শিক্ষা হচ্ছে ভেলার ন্যায় যা নদী পাড়ি দেবার জন্য, মাথায় নিয়ে ঘুরে বেরানোর জন্য নয়। তথাগতের উপদেশ শুধু মাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্যেও নয়, যদিও তিনি আলোচনা বা দেশনার শুরুতেই শ্রোতাকে“হে ভিক্ষুগণ বলেই সম্বোধন করতেন। সেই ভিক্ষু সম্বোধীত ভিক্ষু মাত্রেই বুদ্ধের অনুগামী ভিক্ষু নয়! তার মানে কি কাসায় বস্ত্র পরিধান করা বৌদ্ধ ভিক্ষুর বাইরেও ভিক্ষু আছে? অবশ্যই আছে।
তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য, আমরা দেখি,
ভিক্ষু কাকে বলে? তথাগত বুদ্ধ বলেন: ‘সংসারবট্ট দুক্খতো ভয়ট্ঠেন’তি ভিক্খু’ অর্থাৎ যিনি দুঃখময় সংসার ভ্রমণকে মহাভীতি স্বরূপ উপলব্ধি করে তা-হতে মুক্তিকামী তিনিই ভিক্ষু। আসুন, এবিষয়ে আমরা আর একটু বিশদ আলোকপাত করি- বোধিপ্রাপ্তির পরে” তথাগত ক্রমাগত পর্যটন করতে করতে বারানসী সন্নিধানে ঋষিপতন মৃগদাবে উপনীত হলে পঞ্চবর্গীয়গণ দূর হতে বুদ্ধকে তাঁদের দিকে আসতে দেখে তাঁরা পরস্পরকে সতর্ক করে রাখলেন- এই যে দ্রব্যবহুল, সাধনাভ্রষ্ট, বাহুল্যে প্রবৃত্ত শ্রামণ গৌতম আসছেন! তাকে অভিবাদন করা হবে না, এবং তাকে সম্বর্ধনা পূর্ব্বক হস্ত-পদ ধৌত করা হবে না, পাত্র-চীবর গ্রহণ করা হবে না। কেবলমাত্র আসন প্রস্তুত রাখা হবে। যদি ইচ্ছা করেন তাতে উপবেশন করতে পারেন। কিন্তু কার্যতঃ দেখা গেল বুদ্ধ যতই নিকটতর হতে লাগলেন ততই তারা স্ব স্ব সঙ্কল্প চ্যূত হয়ে “একজন অগ্রসর হয়ে পাত্র-চীবর গ্রহণ করলেন, একজন আসন নির্দিষ্ট করে রাখলেন, একজন পাদোদক, পাদপীঠ ও পাদথলিক স্থাপন করে রাখলেন।” বুদ্ধ নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন পূর্বক পাদ প্রক্ষালন করলেন। দেখা গেলো পঞ্চবর্গীয়রা বুদ্ধকে স্ব নামে সম্বোধন পূর্বক দোসরভাবে আচরণ করছেন। তখন তথাগত বুদ্ধ বললেন, “হে ভিক্ষুগণ!!! স্ব নামে বন্ধু সম্বোধন করে তথাগতের প্রতি আচরণ করো না। তিনি যে অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ! হে ভিক্ষুগণ!!! অবহিত হও, অমৃত অধিগত হয়েছে, আমি অনুশাসন প্রদান করবো, ধর্মপোদেশ প্রদান করবো। যে ভাবে তা উপদিষ্ট হলে সে ভাবে ধারণ করতে পারলে, আচরণ করতে (প্রতিপন্ন) পারলে, অচিরেই যে জন্যে কুলপুত্রগণ সম্যক ভাবে আগার হতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হয় সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের পরিসমাপ্তি দৃষ্টধর্মে (প্রত্যক্ষ জীবনে) অভিজ্ঞতা দ্বারা সাক্ষাত করে তাতে অবস্থান করতে পারবে।” বুদ্ধ এরূপ বললে পঞ্চবর্গীয়গণ বলেন- সে কি গৌতম! তুমি সেই কঠোর বিহার (জীবন যাপন), সেই কঠোর পন্থাদ্বারা, সেই দুষ্করচর্য্যা দ্বারা আর্যজ্ঞান দর্শন তো দূরের কথা সামান্য অতিন্দ্রিয় ধর্ম (ঋদ্ধি) পর্যন্ত যেখানে লাভ করতে পারলে না; এখন দ্রব্যবহুল, সাধনাভ্রষ্ট এবং বাহুল্যে প্রবৃত্ত হয়ে তুমি কি বলতে চাও যে- তুমি আর্যজ্ঞান দর্শন সহ অতিন্দ্রিয় ধর্ম আয়ত্ব করতে পেরেছ? তখন বুদ্ধ বললেন “হে ভিক্ষুগণ!!! তথাগত দ্রব্য-বহুল, সাধনা-ভ্রষ্ট এবং বাহুল্যে প্রবৃত্ত নহেন, তিনি যে অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ! তোমরা অবহিত হও, অমৃত অধিগত হয়েছে...........তাতে অবস্থান করতে পারবে।”পঞ্চবর্গীয়রা দ্বিতীয় বার ও এরূপ প্রত্যাখ্যান করলে ভগবান বললেন,“হে ভিক্ষুগণ! তোমরা কি জান যে, আমি পূর্বে নিজ সম্বন্ধে এরূপ উক্তি করেছি? “বুদ্ধ কন্ঠে এবাক্য শ্রবণ মাত্রই, না প্রভু, আপনি বলেন নি, এই স্বীকারোক্তিতে পঞ্চবর্গীয়দের মনে তথাগতের প্রতি আস্থারভাব সৃষ্টি হলো। পঞ্চবর্গীয়রা বুদ্ধের উপদেশ শ্রবণে ইচ্ছুক হলেন, তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্যে চিত্তভাব জাগ্রত করলেন”।
[মন্তব্যঃ উপরোক্ত বর্ণনায় কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়-প্রথমতঃ মহাবর্গের আচার্য, সহবিহারী এবং উপাধ্যায় ব্রতে, এবং বিহারে আগন্তক ব্রত সম্পাদনে যে ভাবে পরিচর্যার বিধি নিয়ম প্রজ্ঞাপিত করেছেন তা এখানে পঞ্চ বর্গীয় কর্তৃক তথাগতকে পরিচর্যার ক্ষেত্রেও হুবহু অনুশীলন করতে দেখা যায়। যেমন- আসন প্রস্তুত করে রাখা, পাদোদক, পাদপীঠ, পাদকথলিক ইত্যাদি স্থাপন করা, অগ্রসর হয়ে পাত্র-চীবর গ্রহণ করা ইত্যাদি।
এসব দেখে মনে হয়, বুদ্ধ কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অনুজ্ঞা সমূহের অনেক গুলো তৎকালীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সদাচার হতেই চয়ন কৃত।
দ্বিতীয়ঃ পঞ্চবর্গীয়রা এখানে বুদ্ধ শাসন তথা ধর্ম বিনয়ের বাইরে ভিন্ন সম্প্রদায় ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও ভগবান তাদেরকে হে ভিক্ষুগণ! বলেই সম্বোধন করেলেন।
ভগবানের এই সম্বোধনের প্রেক্ষিতে এমন কি বলা যায় না বুদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বেও আগার (গৃহ) হতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণকারী মাত্রেই তৎকালে ভিক্ষু নামে অভিহিত হতেন? বস্তুতঃ ‘ভিক্ষু’ কাকে বলে? এ প্রশ্নের উত্তরে ভগবান বলেছেন-
‘সংসারবট্ট দুক্খতো ভয়ট্ঠেন’তি ভিক্খু’ অর্থাৎ যিনি দুঃখময় সংসার ভ্রমণকে মহাভীতি স্বরূপ উপলব্ধি করে তা-হতে মুক্তিকামী তিনিই ভিক্ষু। এ অর্থে-‘ভিক্ষু’ শব্দটি কেবল মাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে ইহার পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত।
তৃতীয়তঃ এই পর্বে ভগবান তথাগতকে আমরা স্বীয় ধ্যানলব্ধ বিমুক্তি জ্ঞান অন্যের বোধগম্য করে তোলার জন্যে যেরূপ আশা নিরাশার মেঘ কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টারত দেখি তা যে কোন প্রচারকের জন্যেই একটি আদর্শ শিক্ষা ও অনুপ্রেরণাস্থল। সর্বপ্রথম বণিকদ্বয়ের কাছে প্রকাশ করেও আশানুরূপ ফল না পাওয়া, আজীবক উপককে এমনভাবে আত্মপ্রকাশ সত্ত্বেও তাকে আকৃষ্ট করতে অক্ষম হওয়া এবং সর্বোপরি পঞ্চবর্গীয়ের নিকট সরাসরি সমালোচনা ও বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও উৎসাহ ত্যাগ না করা এ সকল ঘটনা আমাদের নিকট শিক্ষনীয় আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। ষড়াবর্গীয় ভিক্ষুদের সন্দেহ নিরসনার্থে বুদ্ধের আর্যসত্য জ্ঞানের প্রথম দেশনা ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন সূত্রের শুরুতেই বলতে হলো-
“দ্বে মে ভিক্খবে, অন্ত পব্বজিতেন ন সেবিতব্বো যো চাযাং কামেসু কামসুখালি-কানুযোগো হীনো গম্মো পুথুজ্জনিকো অনরিযো অনন্থ সংহিতো। এতে ভিক্খবে, উভো অন্তে অনুপগম্ম মজ্বিমা পটিপদা তথাগতেন অভিসম্বুদ্ধা, চক্খুকরণী, উপসমায়, অভিঞ্ঞায় সম্বোধায় নিব্বানায় সংবত্ততি।”
অর্থাৎ- হে ভিক্ষুগণ! প্রব্রজিতের এই দুই অন্ত সেবন করা উচিত নহে। তা এই- কামসেবন, যা হীন, গ্রাম্য সাধারণ লোককর্তৃক সেব্য অনার্য ও অনর্থকর। এবং এই যে, আত্ম নিগ্রহ (কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন), যা দুঃখ জনক, অনার্য ও অনর্থকর। এই উভয় অন্তে না গিয়ে তথাগত মধ্যম প্রতিপদায় (মধ্যম নীতি অনুশীলনে বা মধ্যম পন্থায়) অভিসম্বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন, যা চক্ষু প্রদান কারিনী (জ্ঞান চক্ষু), জ্ঞান প্রদান কারিনী, উপশম (দুঃখভাব মুক্তি), অভিজ্ঞা (দুঃখ মুক্তির উপায় কৌশল), সম্বোধি ও নির্বাণ লাভের হেতু হয়ে থাকে।
চতুর্থতঃ উপরোক্ত বক্তব্যে বুদ্ধ তথাগত পঞ্চবর্গীয় সন্ন্যাসীদেরকে তাঁর শাসনে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বেই ‘ভিক্খবে’ বলে সম্বোধন করেছেন। আর সেই থেকে তাঁর সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর কাল ধর্ম প্রচার জীবনে কি গৃহী কি প্রব্রজিত যাদের সম্মুখে আর্য্যসত্য ধর্মভাষণ শুরু করেছেন প্রায় সর্বত্রই সম্বোধন কালে ভিক্খবে!ভিক্খবে!বলে সম্বোধন বাক্য উচ্চারণ করেছেন। ইহা দেখে অনেকে বিভ্রান্ত মূলক মন্তব্য করে থাকেন। তাঁরা বলেন, “বুদ্ধের ধর্ম আসলে ভিক্ষু জীবনের জন্যেই” গৃহীজীবনের জন্যে তা প্রযোজ্য নহে। কারণ বুদ্ধ তো প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিক্ষুদেরকে সম্বোধন করেই ধর্মদেশনা করেছেন।” তাদের এই ভ্রান্ত উক্তি, এই ভ্রান্ত ধারণা তারা ‘ভিক্ষু’ বলতে কেবল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদেরই বুঝে থাকেন। বস্তুতঃ জীবনের অনিবার্য দুঃখ জ্বালা,অশান্তি, উপদ্রবকে জ্ঞাতঃ উপলব্ধি করে যারা সংসারবর্ত দুঃখ হতে মুক্তির জন্যে ছট্ফট্ করেন তারা গৃহী হউক বা প্রব্রজিত হউক প্রকৃত ‘ভিক্খু’ হিসেবে সম্বোধনের যোগ্য। কাষায় বসন ধারণ করে, গৃহী সুলভ কাম-সুখান্বেষী হয়ে কি ভিক্খু হওয়া সম্ভব? তাই বুদ্ধ নিজেই ভিক্ষুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন- ‘সংসারবট্ট দুক্খতো ভয়ট্ঠেন’তি ভিক্খু।” অর্থাৎ, দুঃখময় সংসার ভ্রমণকে মহাভীতি স্বরূপ উপলব্ধি করে তা-হতে মুক্তিকামী তিনিই ভিক্ষু। [মহাবর্গ পরিক্রমা] “পরিচ্ছেদ”(স্থানঃ- বারানসী)।
(ছ) উপরোক্ত পাঠে আমরা জেনেছি তথাগত এমন কোন বিধান স্থির করেন নি যা মানবিক, মঙ্গলকর তাকে রোধ করার জন্য। বরং যা কিছু সুন্দর ও মঙ্গলজনক তাকে প্রাপ্তির জন্য, তাতে অবগাহনের জন্য যদি তাঁর কোন বিনয়-বিধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে শীতিল অথবা বর্জন করতে বলেছেন। এরকম সুদূর স্পর্শী, উচ্চমার্গীয় দৃষ্টি ও অপার বোধের জন্য মহান বুদ্ধ সবসময়ের আধুনিকতা ও প্রগতির এক বিস্মকর অংশীদার। উত্তরাধিকার সুত্রে বৌদ্ধগণ যতটুকু প্রগতিবাদী হবার কথা, বিশেষ করে বাঙ্গালি বৌদ্ধরা তা হতে পারে নি, তার যে বিশেষ কারণ নেই এমন নয়; কারণ আছে, আমরা একটু পেছনে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাই, বাঙ্গালী বৌদ্ধরা নানান প্রতিকুলতায়, অভাবে, স্বভাবে, ভয়ে, লোভে, নানান কুসংস্কারে, অন্ধতায় হিন্দুদের দেবদেবীর নামে আশ্রীত হয়েছিলো। তারা পারিবারিকভাবে হিন্দুদের নানান প্রথা-পার্বণ বেশ ভালো করেই পালন করতো। শনিপূজা, মনসাপূজা, কার্তিকপূজা, সেবাখোলায় গিয়ে মানত করা বিবিধ। কিন্ত এখন বৌদ্ধরা তেমন কিছু না করলেও, সেই অতীতের সংস্কার থেকে তাদের মানসিকতা সম্পুর্ণ মুক্ত হতে পারে নি। তাদের ধর্মীয় গুরু অনেকেই এই সংস্কার থেকে মুক্ত নন। তাই আমরা যে বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষার দাবী রাখি তা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। আজো তাই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে দেখি- বাংলাদেশে অল্প সংখ্যক বৌদ্ধদের মাঝে ভিক্ষু সঙ্ঘ নানান দলে, উপদলে, বাদে, বিবাদে বিভক্ত!! যেমন কেউ সংঘরাজ দলে, কেউ সংঘনায়ক (মাত্তার) দলে, এ থেকে আবার প্রায় স্বতন্ত্র চাকমা, মারমা আদিবাসী ভিক্ষুরা; কেউ বন ভান্তের দলে, কেউ উছিলা ভান্তের দলে, কেই শীলানন্দ ভান্তের দলে, এমন দল আরো আছে......!!! কেউ কেউ এসব নিয়ে কাদা ছুঁড়াছুড়ি করে। দেখা যায় বৌদ্ধ জনতাও মাঝে মাঝে এসব নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমরা বৌদ্ধদের অতীত গৌরবের দিকে তাকালে দেখি- সেদিনের জনমানুষের কল্যাণে বৌদ্ধরা শিল্প, সাহিত্য, দর্শনের চর্চা শুরু করেছিলো; দূস্থদের জন্য সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষার যে মিশনারী কার্যক্রমকে ধর্মের মূল ভিত্তি করে নিয়েছিলো তা আজ প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন অনেকটাই তার আলোকে খৃষ্ঠানদের মিশনারীগুলো পরিচালিত হতে দেখি। আজকের বৌদ্ধদের অনেকে শুধু মুখে মুখে স্বর্গ! নরক!!নির্বাণ!!! নানাজনের নামে স্তুতি জপ নিয়ে পরে আছে। আর অনেক পূজনীয় গুরুরা আছেন অহর্নিশ মৃতসভা, তিথির ছোয়াইং, সংঘ দান ও সে সবের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে। নানা-তিথির ফাং নিয়েও গোপনে বিভিন্ন দলে উপদলে রাজনীতি চলে, এমনটা শোনা যায়!! নিজেদের দলের কাকে ফাং করা হবে বি-দলের কাকে করা হবে না... বিবিধ। তবে এতকিছুর পরেও ইতিবাচক কিছু যে হয় নি, হচ্ছে না এমন নয়, আমরা অনেক ভিক্ষুদের জানি যাদের অনেকে কালগত হয়েছেন, অনেকে বেঁচেও আছেন যারা মুক্তবুদ্ধি, মুক্তজ্ঞানের চর্চায় মানব বুদ্ধকে যথাযতভাবে প্রাপ্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের তথা গণমানুষের কল্যানসাধনে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত হতে। আজ সচেতন ভিক্ষুদের উচিৎ হবে বৌদ্ধদের হারানো গুণাবলিগুলো নতুনভাবে পুণরুদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া। বৌদ্ধ বিহার শুধু পুজা অর্চনার জন্য নয়, বা সঙ্ঘ আর সংগঠনের মহরা দেবার জন্যও নয়। এক একটা বিহার হতে হবে জ্ঞানপীঠ, এক একটা বাতিঘর! একজন ভিক্ষুকে হতে হবে কয়েকজন জাতীয়মানের শিক্ষকের সমষ্টি, যারা সমাজ ও মানব মনের শিক্ষক/ চিকিৎসকের মহৎ দায়িক্তশীলতার পরিচয় দেবেন। রাজ্যের সমস্ত গ্রন্থ তারার মত ঝিকমিক ছড়াবে বিহার ভিত্তিক পাঠাগারে। আত্ম অহমিকার মিছিলে, শ্লোগানে বৃথা সময় নষ্ট না করে সুবিধা অনুযায়ী সকাল/বিকাল প্রত্যেহ সমবেত হবে কিশোরকিশোরী, তরুণতরুণী, যুবকযুবতী, বৃদ্ধবৃদ্ধারা। তারা পঠনপাঠনের মধ্যদিয়ে আবিষ্কার করবে জ্ঞানের নানান শাখাপ্রশাখার গুপ্ত সৌন্দর্য। অংশগ্রহণ করবে মুক্ত আলোচনায়। একে অন্যের সমস্যা-সমাধানের খবর নেবে। একে অপরের সুখেদুখে অংশগ্রহণ করবে পরম আত্মীয় জেনে, অপার মমতায়। বছরের পর বছর মুখুস্ত প্রসংসা বাক্য ও পূজা-অর্চনায় যে ফল ফলে নি তার চেয়ে বিস্ময়কর ফল ফলতে থাকবে যদি কোন সমাজ উপরোক্ত বিষয়ের চর্চা করতে থাকে। আমরা কে না জানি, বুদ্ধের ধর্ম শুধু মৃত্যুর পরপারে ভালোমন্দ ফলপ্রাপ্তির ধর্ম নয় তার চেয়ে বেশী স্বচ্ছ, সুন্দর, অমলিনভাবে ইহজাগতিক জীবনতরী বাইবার ও দ্বিধাহীন জ্ঞানলোকে জীবন যাপন করবার।
(জ) তবুও, এত চিন্তা, এত জ্ঞান, এত সৌন্দর্য, এত প্রেম, এত মৈত্রী, মানবিকতা প্রায় লুটিয়ে পরতে দেখি অশুভ, অসুন্দর, অন্ধ, বর্বরতার পদতলে। করুণ অসহায় ম্লানচোখে চেয়ে থাকা ছাড়া তখন আর আমাদের কিছুই করার থাকে না। আমরা এই কয়দিন আগে দেখলাম, প্রব্রজাদানে সহযোগীতা করার কারণে-পণ্ডিত প্রবর ভিক্ষু ডঃ বরসম্বোধি ভান্তের উপর বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কতৃক দণ্ড প্রযোগ করতে!!! যদিও বাংলাদেশ শ্রামণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় প্রথম ভাগে প্রব্রজা গ্রহণ যারা করেছেন, বুদ্ধগয়ায়, বুদ্ধের জ্ঞানপ্রাপ্তিরস্থান বোধিতরুমূলে, সেখানে উপস্থিত বহু প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সঙ্ঘ ছিলেন। দ্বিতীয় ভাগে, বাংলাদেশে নারীদের প্রব্রজাদান অনুষ্ঠানে ডঃ বরসম্বোধি ভান্তে সহ সমবেত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বহু গুণী ভিক্ষু। কিন্তু দণ্ড প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি একাই। আপনারা যারা মোটামুটি বহিঃ বিশ্ব সম্পর্কে কিছুটা খবর রাখেন, অবগত আছেন যে শুধু মহাযানী বৌদ্ধ দেশ সমূহেই নয় থেরবাদী বৌদ্ধ দেশেও নানান ঘাতপ্রত্রিঘাতে আয়ুস্মান ভিক্ষুণী, মহাপ্রজাপতি গৌতমীর পরম্পরার সূচনা হয়েছে। অথচ আমাদের এদেশের অনেক বয়স্ক ভিক্ষুও তা জানেন না, আর জানেন না বলেই প্রচার করেন যে নারী চীবর স্পর্শ করলেই পাপ হয়!! এই সে নারী, যে ভিক্ষুদের আহার, বিহারের জন্য সমস্ত রকমের দানধর্ম করে, কায়িক, বাচনিক, মানসিক শ্রমে নিয়োজিত থাকে “নারী” ভিক্ষু তথা ধর্মের সেবায়। সারা রাত জেগে রান্না করা খাবার, খুব ভোরে বিহারে নিয়ে যায় পরম শ্রদ্ধায়। আমি নিজে জানি এমন অনেক পরিবার আজো প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে যারা একবেলার ছোয়াইং এর মানের খাবার সারা মাসেও ভোগ করার সামর্থ রাখে না, তারা পরম শ্রদ্ধায় নিজেরা উত্তম না খেয়ে ভিক্ষুদের দান করে, যে দানে প্রথম ও শেষ পর্যন্ত রত থাকে নারী। যে নারী ধর্ম সভায় উপস্থিত না হলে শুধু বিহারের মাঠ নয় বারান্দার একটি পাশও পূর্ণ হয় না। সভা পূর্ণ না হলে ধর্ম দান আর দানকে উপলক্ষ্য করে নানাজনের বক্তব্য-বাজী, গলা-বাজী পরিতৃপ্ত হয় না, সে নারী যদি ভিক্ষুণী হবার মানসে চীবর পরিধান করেন, তাতে পাপ হবার বিধান আরোপ করে কেউ, তবে তার চেয়ে কৃতঘ্নতা নারীর প্রতি আর কী হতে পারে?
প্রশ্ন জাগে, গৌতম বুদ্ধের বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী সহ তাঁর যে পাঁচশত অনুসারী চীবর পরিধান করে ভিক্ষুণী হয়েছিলেন, তাঁরা নারী ছিলো না এমন কথাও কি বলবেন কেউ?(!!!) মহান ভিক্ষুণী গৌতমৗ ও তার সাথে পাঁচশত ভিক্ষুণী ছাড়াও পরবর্তীতে ভিক্ষুণী হবার ধারা নারীদের অংশগ্রহনে অব্যাহত থাকে। যা আজো বিদ্যমান। এ খরব যারা জানেন না তারা না জেনে জানি বলার সমান, না বুঝে সিদ্বান্ত দেবার সমান অপরাধ করছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। ইতিহাস বলে- নারীমুক্তির জন্য নারীমনের আশা পূরণের জন্য মহান আনন্দ নারীদেরকে সহযোগিতা করেছেন এবং তথাগত বুদ্ধকেও এ-সহযোগিতার প্রধানতম কাণ্ডারি করিয়েছেন। যার দরুণ- বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ পরবর্তী প্রথম সঙ্গীতিতে আনন্দকে ভিক্ষুদের কতৃক ভৎসনা শুনতে হয়। আজ আড়াই হাজার বছর পরে ঠিক একই রকম কারণে পণ্ডিত প্রবর ভিক্ষু ডঃ বরসম্বোধি ভান্তের উপর দণ্ডারোপ করা হলো। এ দণ্ডের জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাসে ডঃ বরসম্বোধি ভান্তে সময়ের অগ্রগামী হিসেবে আধুনিক মানস-প্রবর মহান আনন্দের মত স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। (একটা প্রশ্ন বার বার মাথায় ঘুরপাক খায়- আচ্ছা, তথাগতের জীবদ্দশায় কেন আনন্দকে ভৎসনাকারী প্রাজ্ঞ ভিক্ষুরা ভৎসনা করলো না, প্রশ্ন করলো না? তারা কেন নীরব ছিলো বুদ্ধের উপস্থিতিতে? সুযোগের আশায় নয় তো? আমার মনে হয়, তথাগতের জীবদ্দশায় এ নিয়ে কথা তুললে আমরা বুদ্ধের কাজ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারতাম। নারী তথা ভিক্ষুণী নিয়ে আজকে যেসব জানি তার চেয়েও বেশী কিছু।)
(ঝ) এবার আমরা দেখবো, তথাগত বুদ্ধের প্রবর্তিত বিনয়ে দণ্ডারোপ থেকে কয়েকটি ধরণ-
১। নিরপরাধীকে উৎক্ষিপ্ত করা অপরাধঃ
“তখন তথাগত চম্পায় গর্গরা প্রষ্করনী তীরে (গর্গরা নামে রাজ মহীয়সীর খননকৃত) অবস্থান করছিলেন। অদূবর্তী কাশী জনপদের বাসভ গ্রামের বিহারে কাস্যপ গ্রোত্রীয় এক সুশীল এবং কর্ত্তব্য সচেতন ভিক্ষু অবস্থান করতেন। তিনি সর্বদা আকাঙ্খা করতেন- অনাগত সুশীল ভিক্ষু যেন এখানে আগমন করেন, আগত ভিক্ষু যাতে নিরাপদে অবস্থান করেন এবং কি করলে এই আবাসের বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি ও বৈপুল্য লাভ করে। সে সময়ে কিছু সংখ্যক ভিক্ষু কাশীতে পর্যটন করতে করতে বাসভ গ্রামের সেই বিহারে উপস্থিত হলে আবাসবাসী সেই ভিক্ষু দূর হতে তাঁদের আসতে দেখে আসন প্রস্তুত করলেন, পাধোবন জল, পীঁড়ি, পা মোছার কাপড় ইত্যদি স্থাপন করলেন এবং অভ্যর্থনা জানিয়ে পাত্রচীবর প্রতিগ্রহন করলেন, পানীয় জলের প্রয়োজন কি-না জিজ্ঞাসা করলেন, স্নানের জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করলেন। পরদিন জবাগূ ও খাদ্য সংগ্রহ করে পরিতৃপ্ত সহকারে আপ্যায়ন করলেন।”
‘[মন্তব্যঃ যেখানে লোকেরা বলে থাকেন “আগন্তুক (অতিথি) ভিক্ষু আসলে আমাদের জানাবেন” সেখানেই কেবল খাদ্য ভোজ্য সম্বদ্ধে ঔৎসুক্য প্রকাশ করা বা আপ্যায়ন যায়। যেখানে উপাসক বা দায়কগন তেমন ভাবে প্রার্থনা করে রাখে না সেখানে আগন্তুক ভিক্ষুদের জন্য গৃহীদের নিকট থেকে কোণ দ্রব্য বা খাদ্য যাঞ্চা করা ভিক্ষুদের জন্য অপরাধ। সামন্তপাসাদিকা]’
“বাসভ গ্রামের এই কাস্যপ ভিক্ষুর এমন বিনীত সরল ব্যবহারে আগন্তুকগণ ভাবলেন এ ভিক্ষু অতিশয় ভদ্র, সরল, অমায়িক, অতএব আমরা এখানে বাস করলে ভালো হয়। এ সিদ্বান্তে তাঁরা তথায় অবস্থান করতে থাকলে কাস্যপ গোত্রীয় ভিক্ষুর মনে এভাব জাগলো এই আগন্তুক ভিক্ষুদের পথশ্রমনজনিত যে ক্লেশ ছিল তা এখন উপশমিত হয়েছে, ভিক্ষা করার গ্রাম সম্বন্ধে যে অনভিজ্ঞতা ছিল তাতেও তাঁরা অভিজ্ঞ হয়েছেন। দীর্ঘকাল পরগৃহে (খাদ্য ভোজ্যের জন্যে) ঔৎসুক প্রকাশ করা কষ্টদায়ক এবং যাঞ্চা লোকের প্রীতিকর নহে। অতএব আমি যবাগূ এবং খাদ্য ভোজ্যের জন্যে আর ঔৎসুক প্রকাশ করবো না। তিনি এভাবে বিরত থাকলে আগন্তুক ভিক্ষুগণ মনে করলেন এই আবাসিক ভিক্ষু এখন দুষ্টমতি সম্পন্ন হয়েছেন অতএব আমরা তাকে উৎক্ষিপ্ত করবো। তাই তাঁরা সকলে সমবেত হয়ে কাস্যপ ভিক্ষুকে বললেন,- ‘বন্ধু! পূবে আপনি আমাদের স্নান সম্বন্ধে ঔৎসুক প্রকাশ করতেন, যবাগূ খাদ্য ভোজ্য সম্বন্ধে ঔৎসুক প্রকাশ করতেন, কিন্তু এখন তো করছেন না। এজন্যে আপনি অপরাধী। সেই অপরাধ কি আপনি দেখছেন, স্বীকার করছেন? ‘বন্ধুগণ! আমার এমন কোন অপরাধ আমি দেখছি না (যা স্বীকার করবো)’ তখন অপরাধ দর্শন না করার কারণে আগন্তুক ভিক্ষুগণ কাস্যপগোত্রীয় ভিক্ষুকে উৎক্ষিপ্ত দণ্ডে দন্ডিত করলেন। [এই দণ্ডে দণ্ডিত করলে উৎক্ষিপ্ত দণ্ডে দণ্ডিত ভিক্ষুর সাথে আমিষ সম্ভোগ (এক আসনে বসে আহার করা) এবং ধর্ম সম্ভোগ (উপোসত, আপত্তি দেশনাদি কার্য্য) করা চলে না। সাঃ পাঃ] কাস্যপগোত্রীয় ভিক্ষু তখন চিন্তা করলেন,- জানি না ইহা আমার অপরাধ কি-না। আমি কি দণ্ড প্রাপ্ত হয়েছি, না হই নি? উৎক্ষিপ্ত হয়েছি, না হই নি? তাঁরা আমাকে ধর্মানুসারে না অধর্মানুসারে, ন্যায় মতে না অন্যায় ভাবে দণ্ড দিলেন? আমি কি কারনে উৎক্ষিপ্ত হলাম, না অকারনে হলাম? আমি চম্পায় গমন করবো, এবং ভগবানের নিকট তা জিজ্ঞাসা করবো।’ এরুপ সিদ্বান্ত নিয়ে কাস্যপগোত্রীয় ভিক্ষু শয়নাসন সামলিয়ে ক্রমান্বয়ে পর্যটন করতে করতে চম্পায় যেখানে বুদ্ধ আছেন সেখানে উপনিত হলেন। বুদ্ধকে অভিবাদন করে একান্তে উপবেশন করলে বুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন,- ভিক্ষু! নিরুপদ্রপে আছো তো? সুখে দিন যাপন করছো তো? অল্প কষ্টে বহু পথ অতিক্রম করেছো তো? ভিক্ষু! তুমি কোথা হতে আসছো? হ্যাঁ প্রভু! বলে যথাযত প্রত্যোত্তর দিয়ে আপন অভিপ্রায় বুদ্ধকে নিবেদন করলে বুদ্ধ বললেন,- “হে ভিক্ষু তুমি অপরাধী নও, নিরপরাধ তুমি (দণ্ড) অপ্রাপ্তই আছ, প্রাপ্ত হও নাই। অধর্মানুসারে, অন্যায় মতে, অকারণেই উৎক্ষিপ্ত হয়েছ। ভিক্ষু! তুমি বাসভ গ্রামেই বাস করতে থাকো। যথা আজ্ঞা বলে ভিক্ষু অভিবাদন পূর্বক বিদায় নিলেন। এদিকে আগন্তুক ভিক্ষুদের উদ্বেগ, মনস্তাপ উৎপন্ন হলো- ‘আমাদের দুর্লাভই হলো সুলাভ হলো না, আমরা যে নিরপরাধ পরিশুদ্ধ ভিক্ষুকে অকারণে, অবিষয়ে উৎক্ষিপ্ত করলাম। আমরা চম্পায় যাবো, বুদ্ধের নিকট দোষ স্বীকার করবো।’ তাঁরা চম্পায় আগমণ করে বুদ্ধের কাছে দোষ স্বীকার করলে বুদ্ধ তাদের এ আচরণ নিতান্ত গর্হিত, মূর্খোচিত, অশ্রোমণোচিত, অবিহিত, অকার্য হয়েছে ইত্যাদি নানাভাবে নিন্দা ও ভৎসনা পূর্বক- ভিক্ষুসঙ্ঘকে আহ্বান করে বললেন, “হে ভিক্ষুগণ! পরিশুদ্ধ নিরপরাধী ভিক্ষুকে অবিষয়ে, অকারণে উৎক্ষিপ্ত করতে পারবে না; যে উৎক্ষিপ্ত করবে তার ‘দুক্কট’ অপরাধ হবে।” আগন্তুক ভিক্ষুগণ আসন হতে উঠে উত্তরাসঙ্গ একাংশ করে বুদ্ধের পদে বিলুণ্ঠিত হয়ে বললেন-“প্রভু! আমরা নিরপরাধী, পরিশুদ্ধ ভিক্ষুকে, অবিষয়ে, অকারণে, বালকের ন্যায়, মূঢ়ের ন্যায়, অজ্ঞের ন্যায় উৎক্ষিপ্ত করে অপরাধ করেছি। প্রভু! আমাদের অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ভবিষ্যতে আমরা সাবধান হবার জন্য আমাদের প্রার্থনা অনুমোদন করুন।” “হে ভিক্ষুগণ! তোমরা বালক, মূঢ়, অজ্ঞের ন্যায় নিরপরাধী পরিশুদ্ধ ভিক্ষুকে অবিষয়ে, অকারনে উৎক্ষিপ্ত করে অপরাধ করেছো; অপরাধকে অপরাধ মনে করে-ধর্মানুসারে প্রতিকার করেছ- এজন্যে আমি তা অনুমোদন করলাম। ভিক্ষুগণ! আর্য বিনয়ে ইহা শ্রীবৃদ্ধির কথা। যে দোষকে দোষরুপে দেখে, ধর্মানুসারে তার প্রতিকার করে এবং ভবিষ্যতের জন্যে সাবধানতা অবলম্বন করে।” [মন্তব্যঃ সম্যক সম্বুদ্ধ শাসনে বিনীত হওয়ার এক অনুপম বিধি, দোষকে দোষরুপে দর্শন করে সজ্ঞানে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে সে দোষ না করতে সাবধান হওয়া।]”
২। ধর্মবিরুদ্ধ এবং ধর্ম সম্মত দ-কর্মে উচিত-অনুচিত (কর্মের পার্থক্যঃ
সে সময়ে চম্পার ভিক্ষুগণ এরুপ কর্ম তথা দণ্ড বিধান প্রয়োগ শুরু করলে অল্পেচ্ছু ভিক্ষুগণ এসবের নিন্দা করে বুদ্ধকে জানালেন। বুদ্ধ ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে জিজ্ঞাসা করলেন,- “হে ভিক্ষুগণ! সত্যিই কি চম্পায় ভিক্ষুগণ এরুপ কর্ম (দণ্ড বিধান) করছে, ধর্মবিরুদ্ধ বর্গকর্ম (সংঘের একাংশ হয়ে) করেছ ধর্মবিরুদ্ধ সমগ্র (সঙ্ঘের সকলে) কর্ম করছে...... সঙ্ঘ ও সঙ্ঘকে উৎক্ষিপ্ত করছে? হ্যৃঁ প্রভু! তা সত্য। ভিক্ষুগণ! তা নিতান্ত গর্হিত... এই বলে নিন্দা করে বললেন,- “হে ভিক্ষুগণ! ১) ধর্মবিরুদ্ধ বর্গকর্ম (বুদ্ধেও বাক্যানুসারে না করে সঙ্ঘের একাংশ হয়ে দণ্ড বিধান) তা অকর্ম, ইহা করা অনুচিত। ২) ধর্মবিরুদ্ধ সমগ্র কর্ম (বুদ্ধ অনুজ্ঞার বিপরীতে সঙ্ঘের সকলে মিলে দণ্ড বিধান) ইহা অকর্ম, তা করা অনুচিত। ৩) ধর্মসম্মত বর্গকর্ম (বুদ্ধ অনুজ্ঞা মতে দণ্ড বিধান করে কিন্তু সঙ্ঘের একাংশ হয়ে) ইহা অকর্ম, তা করা অনুচিত। ৪) প্রতিরুপ সম্মত বর্গকর্ম (বুদ্ধ অনুজ্ঞার বিরোধী নহে সদৃশঃ এমন ভাবে দণ্ড বিধান করে কিন্তু সঙ্ঘের একাংশ হয়ে) তা অকর্ম, ইহা করা অনুচিত। ৫) ধর্ম প্রতিরুপ সম্মত সমগ্রকর্ম-ইহা অকর্ম, তা করা অনুচিত। ৬) একক ভাবে অন্য একজনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম, ইহা করা অনুচিত। ৭) একজনে দু’জনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম, ইহা করা অনুচিত। ৮) একজনে বহুজন উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম...। ৯) একজনে সঙ্ঘকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম...। ১০) দুইজনে একজনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম...। ১১)দুইজনে দু’জনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম...। ১২) দুইজনে বহুজনকে উৎক্ষিপ্ত করা... ... ১৩) দুইজনে সঙ্ঘকে উৎক্ষিপ্ত করা......। ১৪) বহুজনে একজনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম... ..। ১৫) বহুজনে দুইজনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম... ...। ১৬) বহুজনে বহুজনকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম... ...। ১৭) বহুজনে সঙ্ঘকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম... ...। ১৮) সঙ্ঘ ও সঙ্ঘকে উৎক্ষিপ্ত করা অকর্ম, হে ভিক্ষুগণ! এ সকল করা অনুচিত। ৩। কর্মের (দণ্ড বিধানের) পার্থক্য ও প্রকার ভেদঃ “হে ভিক্ষুগণ! কর্ম চারিপ্রকার, যথা ১) ধর্মবিরুদ্ধ বর্গকর্ম, ২) ধর্মবিরুদ্ধ সমগ্র কর্ম, ৩) ধর্ম সম্মত বর্গকর্ম, ৪) ধর্মসম্মত সমগ্রকর্ম (বুদ্ধের অনুজ্ঞা মতে সঙ্ঘের সকলে ঐক্যমত্য হয়ে) দণ্ড বিধান করা। হে ভিক্ষুগণ! এ চারিটির মধ্যে ১) ধর্মবিরুদ্ধ ভাবে কৃতকর্ম তা ধর্মবিরুদ্ধ এবং বর্গবসত কুপ্য (নীতি বিরুদ্ধ) এবং অযোগ্য। ভিক্ষুগণ! এরুপ কর্ম করা অনুচিত; আমি এরুপ কর্ম করার অনুজ্ঞা প্রদান করি নি। হে ভিক্ষগণ! একইভাবে ২) ধর্মবিরুদ্ধভাবে কৃত সমগ্রকর্ম এবং ৩) ধর্ম সম্মতভাবে কৃতবর্গ করা উচিত নহে। আমি এরুপ কর্ম করার অনুজ্ঞা প্রদান করি নি। হে ভিক্ষুগণ! এই যে, ৪) ধর্ম সম্মতভাবে কৃত সমগ্রকর্ম তা ধর্ম সম্মত এবং সমগ্রবসত অকুপ্য (নীতিবিরুদ্ধ নহে) এবং যথোচিত। ভিক্ষুগণ! এরুপ কর্ম করা উচিত, আমি এরুপ কর্ম করার অনুজ্ঞা প্রদান করেছি। হে ভিক্ষুগণ! তাই এরুপই তোমাদের শিক্ষা করতে হবে- “আমরা এরুপ কর্ম (দণ্ড বিধান) করব, যা ধর্মানুসারে সমগ্র (বুদ্ধের অনুজ্ঞা মতে সঙ্ঘের সকলে একমত হয়ে)।” মন্তব্যঃ এখানে লক্ষ্যনীয় যে, ধর্মসম্মত অর্থাৎ বুদ্ধের অনুজ্ঞা অনুসারে হলেও যদি বর্গ তথা সঙ্ঘের একাংশ হয়ে কোন কর্ম বা দণ্ড বিধান করা হয়- তা বুদ্ধ প্রত্যাখান করেছেন। সমগ্র ভিক্ষুরা একমত হয়েই ধর্মানুসারে দণ্ড বিধান করুক ইহাই বুদ্ধের ঐকান্তিক ইচ্ছা কিন্ত সমগ্র ভিক্ষু একমত হয়ে ধর্মবিরুদ্ধ দণ্ড বিধান করলে তাও গ্রহণযোগ্য নহে।” (চম্পেয়-স্কন্ধ- [১০-৯] কর্ম ও অকর্ম [স্থানঃ চম্পা]- মহাবর্গ পরিক্রমাঃ- ভিক্খু জে. প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো)
এখন আমার কথা এই- ডঃ ভান্তেকে যে দণ্ড দেয়া হলো তা কতটা বিনয় সম্মত! বিনয় রক্ষার কথা বলে বিনয় লঙ্ঘণ নয় তো? প্রথমত প্রব্রজাদানে সহযোগিতা করা অসুন্দর, অশুভ কোন কর্ম নয়, তা শুভ ও সুন্দর। শুভ ও সুন্দরের জন্যে তথাগত বুদ্ধের আজীবন সাধনা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে সল্পসংখ্যক বৌদ্ধদের মাঝে দলে উপদলে, বাদে বিবাদে বিভক্ত সকল ভিক্ষু সঙ্ঘের কথা বাদ দিলেও- যে ভিক্ষু মহাসভার সিলমোহরে দণ্ডারোপ ঘোষিত হলো, সেই মহাসভার পূজনীয় সকল ভিক্ষু এ দণ্ডারোপে একমত হয়েছেন তো! সবাইকে জানানো হয়েছে তো? নাকি তরিঘরি করে এমনটা করা হয়েছে? এ দণ্ড প্রদানে মহাসভার ভিক্ষুদের মধ্যে প্রাজ্ঞ, উদার ও আধুনিক মনস্ক, বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত কারো কারো অমত আছে কি? এ দণ্ড আরোপ কিছু সংখ্যকের ব্যক্তিগত জেদের ফসল নয় তো? আমরা তো জানি ভিক্ষু মহাসভার সদস্য এমন কিছু ভিক্ষু যারা জানেন সময়ে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে তাদের অনেকেই শ্রামণীদের প্রব্রজাদানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকেই নিরব আছেন নানা-কারণে কিন্তু তারাও শ্রামণীদের মঙ্গলকামী, হয়ত সরব হবেন একদিন। আমরা কি জানি না, অনেকের অপ্রিয় হবেন জেনেও তথাগত বুদ্ধের প্রধান শিষ্য মহান আনন্দ নারী-জাগরণ ও নারীমুক্তির জন্য মহৎ কর্তব্য মাথায় তুলে নিয়েছিলেন? সকলের কাছে প্রিয় হবার দূর্বলতা ত্যাগ করে নিজেকে চেনালেন যে মহামতি বুদ্ধের শিষ্যকে কেমন হতে হয়।
(ঞ) প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ,
ধর্মানন্দ কোসম্বী, নারী তথা ভিক্ষুণীর জন্য প্রদত্ত অষ্ট গুরুধর্মও বাতিল করে দেন! বৌদ্ধ ধর্মের মুল গ্রন্থের উপর তার সুদূর চিন্তাশীল আলোচ্য “ভগবান বুদ্ধ” গ্রন্থে দেখি- “ভিক্ষুণীসংঘের প্রতিষ্ঠার কথা চুল্লবগ্গে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার সার এই- ভগবান বুদ্ধ কপিলবস্তু ও নিগ্রোধারামে থাকিতেন। সেইসময় মহাপ্রজাপতি গৌতমী ভগবানের নিকট আসিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়, নারীদিগকে তোমার সম্প্রদায়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার অনুমতি দাও।” ভগবান এই অনুরোধ তিনবার প্রত্যাখ্যান করিলেন এবং গৌতমী সেখান হইতে বৈশালীতে আসিলেন। এতটা পথ হাঁটায় তাহার পা ফুলিয়া গিয়াছিলো, শরীর ধুলায় মলিন হইয়াছিলো, আর মুখে উদাসীনতা দেখা যাইতেছিলো। আনন্দ তাহাকে দেখিয়া তাহার উদাসভাবের কারণ জিজ্ঞাসা করিল। গৌতমী কহিলেন, ভগবান স্ত্রীলোককে বৌদ্ধসম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিতেছেন না; ইহাতে আমার উদাসভাব হইয়াছে।” তাহাকে সেখানে থাকিতে বলিয়া আনন্দ ভগবানের নিকট গেল এবং নারীকেও সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিতে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিল। কিন্ত্র ভগবান এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিলেন। তখন আনন্দ কহিল, “মহাশয় তথাগত যে ধর্মসম্প্রদায় স্থাপন করিয়াছেন, তাহাতে ভিক্ষুণী হইয়া কোন নারীর পক্ষে ¯স্রোতাপত্তিফল, সকৃদাগামীফল, অনাগামীফল ও অর্হৎফল* প্রাপ্ত হওয়া সম্ভবপর কি না?” ভগবান যখন কহিলেন সম্ভবপর, তখন আনন্দ বলিল “যদি সম্ভবপর, তাহা হইলে যে মাসীমা ভগবানকে মায়ের অভাবে দুধ খাওয়াইয়া লালনপালন করিলেন, তাঁহার অনুরোধে ভগবান নারীদিগকে সন্ন্যাস দিন।” ভগবান কহিলেন, “যদি মহাপ্রজাপতি গেতৈমী আটটি দায়িক্তপূর্ণ নিয়ম (অট্টগরুধম্মা) মানিয়া লন, তাহা হইলে আমি নারীদিগকে সন্ন্যাস লইতে অনুমতি দিব। ১. সংঘে ভিক্ষুণী যত দীর্ঘকালই থাকুক না কেন, সে ছোটোবড়ো সকল ভিক্ষুকে নস্কার করিবে। ২. যে যে গ্রামে ভিক্ষুরা নাই, তথায় ভিক্ষুণীরা থাকিবে না। ৩. প্রত্যেক পক্ষে (১৫ দিন পর) উপবাস কোন কোন দিনে করিতে হইবে, এবং ধর্মোপদেশ শুনিবার জন্য কখন আসিতে হইবে, এই দুইটি কথা ভিক্ষুণীরা ভিক্ষুসংঘকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইবে। ৪. চাতুর্মাসের পর ভিক্ষুণীরা ভিক্ষুসংঘ ও ভিক্ষুণী সংঘের প্রবারণা করিবে। ৫. যেসব ভিক্ষুণীর হাতে “সংঘাদিশেষ আপত্তি” ঘটিয়াছে , তাহারা উভয় সংঘের নিকট হইতে ১৫ দিনের মানত্ত গ্রহন করিবে। ৬. দুই বৎসর সংঘে সাধন করিবার পর ভিক্ষুণীকে উভয় সংঘই উপসম্পদা দিবে। ৭. কোন কারনেই ভিক্ষুণী ভিক্ষুকে গালাগালি করিতে পারিবে না। ৮. ভিক্ষুণী ভিক্ষুকে উপদেশ দিবে না; ভিক্ষুই ভিক্ষুণীকে উপদেশ দিবে। আনন্দ এই আটটি নিয়ম মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে জানাইল এবং তিনি এইগুলি অনুমোদন করিলেন। এই পর্যন্ত কাহিনীটি বলা হইয়াছে, তাহা অঙ্গুত্তরনিকায়ের অট্ঠকনিপাতেও দেখিতে পাওয়া যায়। আর তাহার পর, ভগবান আনন্দকে বলিলেন, ‘হে আনন্দ, যদি আমাদের ধর্মশিক্ষায় নারীকে সন্ন্যাস দেয়া না হইত. তাহা হইলে এই ধর্ম (ব্রম্মচর্য) ১০০০ বৎসর টিকিয়া থাকিত। যেহেতু এখন নারীকেও সন্ন্যাসের অধিকার দেওয়া হইল, সেইজন্য এই সৎধর্ম শুধু পাঁচশত বছরই টিকিবে। এইভাবে বিনয় ও অঙ্গুত্তরনিকায়ের মধ্যে এই ব্যাপারের বর্ণনায় সাম্য আছে বটে, তথাপি এই আটটি কঠোর ধর্ম (গুরুধর্ম) পরে রচিত হইয়াছিল, এইরুপ বলিতে হইবে; কেননা, বিনয়ের নিয়ম বিধান করিবার সময় ভগবান যে-পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহার সহিত বর্তমান নিয়মগুলির স্পষ্ট বিরোধ রহিয়াছে। ভগবান বুদ্ধ বেরঞ্জাগ্রামের নিকট থাকিতেন। ঐ সময় বেরঞ্জার আশেপাশে দুর্ভিক্ষ ছিল বলিয়া ভিক্ষুদের খুব কষ্ট হইতে লাগিল। তখন সারিপুত্ত ভগবানকে অনুরোধ করিল যে, আচার-বিচার সম্বন্ধে ভিক্ষুদের জন্য নিয়ম বাঁধিয়া দেয়া হউক। ভগবান কহিলেন, ‘হে সারিপুত্ত, তুমি একটু থামো। কখন নিয়ম বাঁধিয়া দেয়া দরকার, তাহা তথাগতের জানা আছে। যতদিন পর্যন্ত সংঘে কোনোরকম পাপাচার প্রবেশ না করে, ততদিন পর্যন্ত ঐরুপ পাপ নিবারণ করিবার জন্য তথাগত কোন নিয়ম করে না।” বুদ্ধের এই উক্তি অনুসারেই সংঘের সর্বনিয়ম রচিত হইয়াছিল। প্রথম কোন ভিক্ষু কিছু একটা অপরাধ অথবা ভুল করিত, আর সেই কথা বুদ্ধের কানে আসিলে, তিনি ভিক্ষুসংঘের সভা করিয়া, দুই-একটি নিয়ম প্রবর্তন করিতেন। আর ভিক্ষুরা ঐ নিয়মের ঠিক ঠিক অর্থ করিতে পারে না, এইরূপ বুঝিতে পারিলে, তিনি পরে ঐ নিয়মের সংস্কার করিতেন। কিন্তু (পূর্বোক্ত কাহিনীতে) মহাপ্রজাপতি গৌতমীর ব্যাপারে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নাই। ভিক্ষুণী সংঘে কোন দোষ ঘটে নাই, আর তাহার আগেই ভিক্ষুণীদের উপর এই আটটি নিয়ম চাপানো হইল, ইহা বিলক্ষণ বলিয়া মনে হয়। সুতরাং অনুমান করা যায় যে, বুদ্ধের মৃত্যুর পর, ভিক্ষুসংঘ নিজের হাতে সকল ক্ষমতা রাখিয়া দেয়ার জন্য এইসব নিয়ম করিয়া বিনয় এবং অঙ্গুত্তরনিকায়ে ঢুকাইয়াছিল। বিনয়পিটক হইতে সুত্তপিটক বেশি প্রাচীন। তথাপি ইহাতে কোন কোন নূতন সুত্ত পরে সমাবিষ্ট হইয়াছিল এবং উক্ত আটটি নিয়মও এইরূপই। খৃস্টপূর্ব প্রথম অথবা দ্বিতীয় শতাব্দীতে, যখন মহাযান সম্প্রদায়ের দ্রুত গতিতে প্রসার হইতেছিল,ঐ সময় এইগুলি লিখিত হইয়া থাকিবে। ইহাতে যে সন্ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হইয়াছে, তাহার অর্থ ‘স্থবিরবাদী প্রন্থা।’ এই কাহিনী সুত্তের রচয়িতা যেন এইরূপ ভবিষ্যদবাণী করিতেছেন যে, ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠা হওয়াতে এই ধর্ম পাঁচশো বছর টিকিবে, আর তাহার পর, সর্বত্র মহাযান সম্প্রদায়ের প্রসার হইবে। এই ভবিষ্যদবাণী হইতে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত সুত্তটি ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের পাঁচশো বছর পর লিখিত হইয়াছিল। ভাতরবর্ষেও প্রথম ভিক্ষুণীসংঘ যদি বুদ্ধ দ্বারাই স্থাপিত হইত, তাহা হইলে হয়তো এই আটটি “গুরুধর্ম”কে কিয়ৎপরিমাণে ঐতিহাসিক তথ্য বলিয়া মনে করা যাইতে পারিত। কিন্তু বাস্তবিক অবস্থা সেইরূপ নয়। জৈন এবং অন্যান্য সম্প্রদায় বৌদ্ধসম্পদায় হইতে দুই এক শতাব্দী পূর্বে অস্থিত্ব লাভ করিয়াছিল। এবং ঐ সকল সম্প্রদায়ে ভিক্ষুণীদের বেশ বড়ো বড়ো সংঘ ছিল, এবং উহাদের কোন কোন ভিক্ষুণী বুদ্ধিমতী ও বিদুষী ছিলেন, এই কথার সাক্ষ্য পালি সাহিত্যের অনেক জায়গায় দেখিতে পাওয়া যায়। আসলে এইসব সংঘের অনুকরণেই বুদ্ধেও ভিক্ষুণীসংঘ স্থাপন করা হইয়াছিল। গণমূলক রাজ্যগুলিতে এবং যেসব দেশে একচ্ছত্র রাজতন্ত্র সবেমাত্র দেখা দিয়াছিল, সেইসব দেশেও নারীদের সম্মান বেশ ভালোভাবেই রাখা হইত। সুতরাং ভিক্ষুণীসংঘের রক্ষণার্থ কতকগুলি অদ্ভুত নিয়ম করার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর, সমাজে নারীদের এই অবস্থা পরিবর্তিত হইয়াছিল। এই দেশের উপর যবন ও শকদের আক্রমণ আরম্ভ হইল, এবং উত্তরোত্তর মেয়েদের সামাজিক স্থান একেবারে নীচে নামিয়া গেল। সমাজে তাহাদের পূর্বের মানসম্মান রহিল না। তৎকালে, ভিক্ষুণীদের সম্বন্ধে ঐ ধরণের নিয়ম প্রবর্তিত হইয়া থাকিলে, ইহাতে বিস্মিত হইবার কি আছে?” [ভগবান বুদ্ধঃ-পরিচ্ছেদঃ ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা]
বি:দ্রঃ উপরোক্ত বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ধর্মানন্দ কোসম্বী, কোন আবেগে পর্যবষিত হন নি, তিনি নিজের অবস্থানে আন্তরিক, সৎভাবে বোধ-বুদ্ধি ও ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছেন। তাই তার গবেষণালব্ধ সম্পদ ব্যবহারে যেন কেউ জন্মসুত্রে প্রাপ্ত ও বংশপরম্পরায় আগত রীতিতে বিচার না করেন, বোধের কষ্টিপাথরে যাছাই বাছাই করুক এমনটা প্রত্যাশা করি।
(ট) বজ্জীদের উন্নতির সাতটি নিয়মঃ
ভগবান রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতের উপর বাস করিতেন। তখন রাজা অজাতশত্রু বজ্জীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাইবার পরিকল্পনা করিতে ছিলেন। এই সম্বন্ধে ভগবান বুদ্ধের মত কি, তাহা জানিবার জন্য, তিনি তাহর ‘বস্সকার’ নামক ব্রাহ্মণ অমাত্যকে ভগবানের নিকট পাঠাইলেন। ঐ অমাত্য ভগবানকে অজাত-শত্রুর পরিকল্পনা নিবেদন করিল। তখন আনন্দ ভগবানকে বাতাস করিতেছিলো তাহার দিকে তাকাইয়া ভগবান কহিলেন, “হে আনন্দ, তুমি কি এইরূপ শুন নাই যে, বজ্জীরা বারবার সভা করিতেছে ও একত্র হইতেছে?” আ.-হাঁ মহাশয়, বজ্জীরা বারবার সভা করে ও একত্র হয়, আমি এইরূপ শুনিয়াছি। ভ.-বজ্জীরা কি সকলেই একত্র হয়, সকলেই একসঙ্গে উঠে ও সকলেই মিলিয়া কাজ করে? আ.-হাঁ মহাশয়, আমি এইরকম শুনিয়াছি। ভ.-তাহারা নিজে যে আইন করে নাই সেই আইন নিজেরা করিয়াছে, এইরূপ বলে না কি? অথবা তাহারা যে আইন নিজে করিয়াছে সে আইন ভঙ্গ করে না কি? বজ্জীরা তাদের আইন অনুসারে চলে কি? আ.-হাঁ মহাশয়, বজ্জীরা আইন অনুযায়ী চলে, আমি এইরূপ শুনিয়াছি। ভ.-বজ্জীরা তাহাদের বৃদ্ধ রাজনীতিবিদ্দিগকে সম্মান করে কি, ও তাহাদের পরামর্শ গ্রহন করে কি? আ.-হাঁ মহাশয়, বজ্জীরা বৃদ্ধ রাজনীতিবিদ্দিগকে সম্মান করে ও তাহাদের কথা শুনে। ভ.-তাহারা নিজের দেশে বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার করে না কি? আ.-মহাশয়, বজ্জীদেও রাজ্যে স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার হয় না। ভ.বজ্জীদের শহরগুলিতে এবং শহরের বাহিরে যে-সব দেবমন্দির আছে, সেইগুলি তাহারা যথাযোগ্য যত্ন লয় কি? আ.-তাহারা নিজেদেও মন্দিরগুলির যথাযোগ্য যত্ন লয়, আমি এইরূপ শুনিয়াছি। ভ.-তাহাদের রাজ্যে যে-সব অর্হৎ আসিয়াছে, তাহারা সুখে থাকুক, এবং যাহারা সেখানে আসে নাই তাহারা বজ্জীদের রাজ্যে উৎসাহিত হউক, এই উদ্দেশ্যে যাহাতে অর্হৎদের কোনোরকম কষ্ট না হয়, তাহার জন্য কি বজ্জীরা ব্যবস্থা করে না? আ.-হাঁ মহাশয়, অর্হৎদের যাহাতে কোনো কষ্ট না হয়, তাহার জন্য বজ্জীরা যত্নবান থাকে, আমি এইরূপ শুনিয়াছি। তখন ভগবান বস্সকার- আমত্যকে কহিলেন, “ হে ব্রাহ্মণ, আমি যখন এককালে বৈশালীতে থাকিতাম, তখন বজ্জীদিগকে উন্নতির এই সাতটি নিয়ম পালন করিতে উপদেশ দিয়াছিলাম। যতদিন প্রর্যন্ত তাহারা এই নিয়মগুলি অনুসরণ করিয়া চলিবে, ততদিন পর্যন্ত তাহাদের উন্নতিই হইবে, অবনতি হইবে না”। বস্সকার কহিলেন, “হে গৌতম, এইগুলির মধ্যে যদি একটি নিয়মও বজ্জীরা পালন করে, তাহা হইলেও তাহাদের উন্নতি হইবে, অবনতি হইবে না। তবে যদি তাহারা সাতটি নিয়মই পালন করে, তাহা হইলে যে তাহাদের উন্নতি হইবে, ইহা বলাই নিষ্প্রয়োজন”।[ভগবান বুদ্ধঃ-ধর্মানন্দ কোসম্বী]
(ঠ) সম্মানীত প্রাজ্ঞ-পাঠক,
এই লিখাই আমরা এমন অনেক কিছু প্রাপ্ত হয়েছি-যা সমাজ-ধর্মে অজানায় সংগঠিত হওয়া ভুল-ভ্রান্তি নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আমরা আমাদের সিদ্বান্তে শুধু মাত্র লোক-প্রসংশা, লোক-প্রচারকেই গুরুত্ব দেব না, সাথে সাথে বিচার প্রনালীতে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, ইতিহাসচেতনা, বোধের যথার্থ পরিচয় দেবো, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আলোকিত দৃষ্টান্ত রাখবো যাতে তারা আমাদের অর্বতমানে অল্পকষ্টে বহু পথ পাড়ি দিতে পারে, নিষ্কলঙ্ক, নিরাপদ সুন্দরের পথের পথিক হয়ে। আমরা এই লিখার শুরু থেকে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে দেখেছি-তথাগত বুদ্ধের কোন সিদ্বান্তে নারীর প্রতি এক ফোঁটাও অবমাননা নাই, কোন বৈষম্য নাই। যা আছে- তা হলো নারীর প্রতি অপার মর্মত্ববোধ, সহানুভুতিশীলতা, এবং নারীর সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে পূর্ণ মনযোগ। এ জানা থেকে আমরা সকলে তথাগত বুদ্ধের মননের উত্তরাধিকারী হতে সচেষ্ট হবো- যা বুদ্ধের অনুসারী হিসাবে সবার কাছে যুক্তিক প্রত্যাশা। আমার প্রাজ্ঞ-পাঠক বন্ধুগণ- আপনারা জানুন, মূলত কবিতার প্রতি আমার শতভাগ মনযোগ, তার পরেও সময়ের কত্বব্য কাঁধে নিয়ে এমন অনুসন্ধানী গদ্য আমাকে লিখতে হলো, হয়তো তার ধারাবাহিকতায় একই বিষয়ে আরো বিশদ, ব্যাপ্ত অনুসন্ধানী লিখায় হাত দিবো, নিজের কাছে নিজে এমন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমি। বুদ্ধের সংঘের নারী, বুদ্ধসময়ের ভিক্ষুণী “সোমার” মারের উদ্দেশ্যে একটি অসাধারণ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উক্তি দিয়ে- আমি আমার লিখা শেষ করছি, যাতে সে-সময়ের নারী স্বাধিনতার সুস্পষ্ট অবস্থান প্রতিভাত হয়ে আছেঃ- ‘চিত্ত ভালো রকমে সমাহিত হইলে এবং জ্ঞান লাভ হইলে সম্যকভাবে যে ব্যক্তি ধর্ম জানে তাহার স্ত্রীত্ব নির্বাণ মার্গে কি করিয়া অন্তরায় হয়”?
তথ্যপঞ্জি:
তত্ব তথ্য নিবন্ধাবলী: শ্রী জ্যোতিঃপাল মহাথেরো
ভগবান বুদ্ধ: ধর্মানন্দ কোসম্বী
মহাবর্গ পরিক্রমা: ভিক্খু জে. প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৫
রাজীব নুর বলেছেন: বিশাল পোষ্ট।
ভালো পোষ্ট।