নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জয়দেব করের লেখাজোকা

জয়দেব কর

অন্ধ আমি অন্ধকারে আলো কুড়াই,গন্ধরাজের গন্ধে মাতাল জীবন পোড়াই!

জয়দেব কর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুখপত্র (বৌদ্ধধর্ম: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) : প্রমথ চৌধুরী

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ২:২৫

মুখপত্র


"বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি" _ পুরাকালে ভারতবর্ষে কোটি কোটি লোক এই মন্ত্র উচ্চারণ করে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হত। কিন্তু এই ভারতবর্ষীয় ধর্ম কালক্রমে ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্ধশতাব্দী পূর্ব বুদ্ধ কে, তাঁর ধর্ম কি, বৌদ্ধ সঙ্ঘই বা কি, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের মধ্যে কোটিতে একজনও দিতে পারতেন না; কারণ বৌদ্ধ ধর্মের এই ত্রিরত্নের স্মৃতি পর্যন্তও এদেশে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। "বৌদ্ধ" এই শব্দটি অবশ্য আমাদের ভাষায় ছিলো, এবং বৌদ্ধ অর্থে আমরা বুঝতুম- একটি পাষণ্ড ধর্মমত; কিন্তু উক্ত পাষণ্ডমতটি যে কি, সে সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনোরূপ ধারণা ছিলো না।

সংস্কৃত সাহিত্যে অবশ্য বৌদ্ধধর্মের উল্ল্যেখ আছে; কিন্তু তার কোন বিবরণ নেই। আছে শুধু সংস্কৃত দর্শন শাস্ত্রে এ মতের খণ্ডন। সে খণ্ডন হচ্ছে বৌদ্ধ দর্শনের কিন্তু আমার বিশ্বাস যে, বাংলাদেশে যারা দর্শন শাস্ত্রের চর্চা করতেন, সেই পণ্ডিত মণ্ডলীও বৌদ্ধ দর্শন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতেন। সর্বাস্তিবাদ, বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদ, অথবা ভাষান্তরে সৌতান্ত্রিক মত, বৈভাষিক মত, যোগাচার মত ও মাধ্যমিক মতগুলি যে কি, সে সম্বন্ধে অদ্যাবধি এ দেশের পণ্ডিতসমাজের কোনোও স্পষ্ট ধারণা নেই। শঙ্করাচার্য প্রচ্চন্ন বৌদ্ধ বলে বৈষ্ণবসমাজে প্রসিদ্ধ। কিন্তু যিনি হিন্দুধর্মের পুনর্জন্মদাতা এবং ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদকর্তা বলে জগৎ-বিখ্যাত, তার বিরুদ্ধ এ অপবাদ যে কেন দেয়া হয়েছে, তা জানতে হলে, সঙ্করের জ্ঞানবাদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বিজ্ঞানবাদের সম্পর্ক যে কতঘনিষ্ঠ, তা জানা চায়; যা এদেশের অধিকাংশ দর্শনশাস্ত্রীরা জানেন না। এখন এ বৌদ্ধদর্শন বুদ্ধের দর্শন কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সুতরাং বৌদ্ধদর্শনের বিচার থেকে বুদ্ধদেবের, তার প্রচারিত ধর্মের এবং তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের কোনই পরিচয় পাওয়া যায় না। তাই দুদিন আগে আমরা বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সঙ্ঘ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলুম। আর আজ আমরা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস বলতে প্রধানত বৌদ্ধযুগের ইতিহাসই বুঝি- আর হিন্দুকলাবিদ্যা বলতে বৌদ্ধ কলাবিদ্যাই বুঝি। আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করেছি যে ভারতবর্ষে বৌদ্ধযুগ হচ্ছে এদেশের সভ্যতার সর্বাপেক্ষা গৌরব-মণ্ডিত যুগ। তাই বৌদ্ধ সম্রাট অশোক এবং তার অমরকীর্তির দিকে আমাদের সকলেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তারপর আমরা সম্প্রতি এও আবিষ্কার করেছি যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা সব বৌদ্ধ ছিলেন। বাঙলা বৌধধর্মের একটি অগ্রগণ্য ধর্মক্ষেত্র ছিলো। বাঙলা ভাষায় আদি পদাবলী নাকি বৌদ্ধ দোঁহা ও আদি ধর্মগ্রন্থ "শূন্যপুরান"। এ যুগের পণ্ডিতদের মতে বাঙলা ভাষায় ধর্ম শব্দের অর্থ বৌদ্ধ ধর্ম, এবং ধর্মপূজা মানে বুদ্ধপূজা। বাঙলা ভাষায় যে সকল ধর্মমঙ্গল আছে, সে সবই নাকি বৌদ্ধ গ্রন্থ। এবং ময়নামতি উপাখ্যান বৌদ্ধ উপাখ্যান। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতেও বুদ্ধের স্তব আছে। তারপর আমাদের অধিকাংশ দেবদেবীও নাকি ছদ্মবেশী বৌদ্ধদেবদেবী। "তাঁরা" যে বৌদ্ধ দেবতা তা ত নিঃসন্দেহ। শীতলাও শুনতে পাই তাই। চণ্ডীদাসের ইষ্ট দেবতা বাশুলিও নাকি বৌদ্ধ দেবতা, আর বাঙলার পাষানের পিণ্ডাকার গ্রাম্য মঙ্গলচণ্ডী ছিলো আদিতে বৌদ্ধস্তপ। এই অনুমান সম্ভবত সত্য, কেন না, এ সকল দেবদেবী যে ইন্দ্র, বায়ু, বরুণের স্বগোত্র নয়- অর্থাৎ বৈদিক নয়, তাদের বংশধরও যে নয়, সে বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই।

বাঙ্গালী সভ্যতার বুনিয়াদ যে বৌদ্ধ, হিন্দুস্তরের দুহাত নিচেই যে বাঙলার বৌদ্ধস্তর পাওয়া যায়, আজকের দিনে তা প্রমান হয়ে গিয়েছে। বাঙলাদেশের মাটি দুহাত খুঁড়লেই আমরা অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি বৌদ্ধমন্দিরের ভগ্নাবশেষের সাক্ষাৎ পাই। সুতরাং যদি কেউ বলে- মুসলমানযুগে বাঙ্গালী হিন্দু হয়েছে, তাহলে সে কথা সত্যের খুব কাছ ঘেঁসে যাবে। যে বৌদ্ধ ধর্মের নাম পর্যন্ত এদেশে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো, সেই ধর্মই যে আজকাল মাদের সকল গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে, তারই স্মরণ চিহ্ন উদ্ধার করাই যে আমাদের পাণ্ডিত্যের প্রধান কর্ম হয়ে উঠেছে, এটি সত্য সত্যই একটি অত্যাশ্চার্য্য ব্যাপার। এই অত্যাশ্চার্য্য ব্যাপার ঘটলো কি করে? ঘটেছে এই কারনে যে ভারতবর্ষের এই প্রাচীন ধর্মের সঙ্গে বর্তমান ইউরোপ, ভারতবাসীর নতুন করে আবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের জন্মভূমিতে তার মৃত্যু হলেও, আজো তা কোটি কোটি এশিয়াবাসীর ধর্ম। শ্যাম, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, তিব্বত, চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশের লোকে আজো বুদ্ধদেবের পূজা করে, ও নিজেদের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বলেই পরিচয় দেয়। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা হয় সমুদ্রের, নয় হিমালয়ের অপর পারের দেশ সকল থেকেই এ দেশের এই লুপ্ত ধর্মের শাস্ত্র-গ্রন্থ সকল উদ্ধার করেছেন, এবং তাদের বই পড়েই আমরা বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ সঙ্ঘ সম্বন্ধে নতুন জ্ঞান লাভ করেছি। সিংহলেই সর্বপ্রথম বৌদ্ধ শাস্ত্র আবিষ্কৃত হয়, আর পণ্ডিতসমাজে অদ্যাবধি এই সিংহলী বৌদ্ধধর্মই স্বয়ং বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম বলেই গ্রাহ্য। সিংহলের মঠ-মন্দির সযত্নে রক্ষিত বৌদ্ধধর্মের আদিগ্রন্থগুলি সিংহলী ভাষায় নয়, পালি ভাষায় লিখিত। এই পালি ভাষা যে ভারতবর্ষের একটি প্রাকৃত- যে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই; যদিচ সেটি যে ভারতবর্ষের কোন প্রদেশের ভাষা, উত্তরাপথের না দক্ষিণাপথের, বঙ্গের না কলিঙ্গের, মগধের না মালবের-- সে বিষয়ে পণ্ডিতদের দল আজো একমত হতে পারেন নি। সিংহলে যে শুধু বৌদ্ধধর্ম রক্ষিত হয়েছে তাই নয়-- উক্ত ধর্মের জন্মবৃত্তান্ত ও তার সিংহলে প্রচারের ইতিহাসও রক্ষিত হয়েছে। সুতরাং এই সিংহলী শাস্ত্রই হচ্ছে এ যুগের ইউরোপীয় বৌদ্ধশাস্ত্রীদের মতে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং সর্বপেক্ষা প্রামাণ্য দলিল। এবং এই শাস্ত্র থেকে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যে সকল তথ্য উদ্ধার কেরেছেন_ বর্তমান যুগে তাই আমরা বৌদ্ধমত বলে জানি ও মানি।

পালিগ্রন্থ সকল আবিষ্কৃত হবার কিছুকাল পরে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত খানকতক বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থের সন্ধান নেপালে পাওয়া গেলো। সেসব গ্রন্থ আলোচনা করে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ দেখতে পেলেন যে সিংহলী বৌদ্ধধর্ম ও নেপালী বৌদ্ধ ধর্ম এক নয়। এবং বহুকাল পূর্বে বৌদ্ধধর্ম যে দুধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো, তার প্রমান এই দুটি ধারায় দুটি ভিন্ননাম থেকেই পাওয়া যায়। যে বৌদ্ধমত সিংহল, ব্রহ্ম ও শ্যামদেশে প্রচলিত, তা "হীনযান" নামে প্রসিদ্ধ; আর যে বৌদ্ধমত নেপালে, তিব্বতে, চীন, জাপান, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়াতে প্রচলিত, তার নাম হচ্ছে "মহাযান"। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা এই দুটি ভিন্নমতের নাম দিয়েছেন_ Northern School ও Southern School। অনেকদিন ধরে একদলের ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা "হীনযান"কেই মূল বৌদ্ধমত ও মহাযানকে তার অপভ্রংশ বলে প্রমান করতে চেষ্টা করে। ফলে আর একদল পণ্ডিত তার বিরুদ্ধে মত প্রচার করেন। অবশেষে এই পণ্ডিতদের তর্কের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে- উভয় দলই এখন এ বিষয়ে একমত যে, হীনযান ও মহাযান, এ দুয়ের ভিতর বৌদ্ধধর্মের একই মূল তত্ত্ব পাওয়া যায় এবং অন্যান্য বিষয়ে উভয় মতের সাদৃশ্য আছে, এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এখনই আদিমত থেকে এই দুটি ভিন্নশাখা বিনির্গত হয়েছে।

"মহাযান" মূল বৌদ্ধমতই হোক, কিংবা তার অপভ্রংশই হোক, সেই মত আমাদের কাছে মোটেই উপেক্ষণীয় হতে পারে না। প্রথমত; এ শাস্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। তারপর চীন এবং তিব্বতি ভাষায় লিখিত অধিকাংশ বৌদ্ধ-গ্রন্থই সংস্কৃত-গ্রন্থের অনুবাদ মাত্র। উপরন্তু মহাযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে বর্তমান হিন্দুধর্মের যোগ এত ঘনিষ্ঠ যে, প্রচলিত হিন্দুধর্মেকে উক্ত ধর্মের রূপান্তর বললেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং মহাযান বৌদ্ধধর্মের সম্যক জ্ঞান লাভ করলে, আমরা আমাদের জাতীয় জীবনেরও জাতীয় মনের ইতিহাসের জ্ঞানও লাভ করবো। আর তখন হয়তো আবিষ্কার করবো যে, ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের মৃত্যু হয় নি ও ধর্মমত উপনিষদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে বর্তমান হিন্দুধর্মে পরিণত হয়েছে_ জ্ঞানের ধর্ম কালক্রমে ভক্তির ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই যে, মহাযান- মতের সঙ্গে অদ্যাবধি আমাদের পরিচয় শুধু নাম মাত্র।

আমরা অতীতের যে ইতিহাস উদ্ধার করবার জন্য আজ উঠে পড়ে লেগেছি, সে বুদ্ধধর্মের ইতিহাস নয়, বৌদ্ধযুগের ইতিহাস- এক কথায় জাতীয় জীবনের বাহ্য ইতিহাস। আমরা যে কাজ হাতে নিয়েছি তার নাম archxology এবং antiquarianism। বৌদ্ধধর্ম এদেশে তার কি নিদর্শন, কি স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছে, আমরা নিচ্ছি তারই সন্ধান এবং করছি তারই অনুসন্ধান। আমাদের দৃষ্টি বৌদ্ধযুগের স্তূপ, স্তম্ভ, মন্দির ও মূর্তির উপরেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষের বিশালক্ষেত্রে মৃত বৌদ্ধধর্মের বিক্ষিপ্ত অস্থি সকলই আমরা সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েছি। আর নানাস্থান থেকে সংগ্রহীত অস্থিসকল একত্র জুড়ে যদি আমরা কিছু খাড়া করতে পারি, তাহলে তা হবে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের কঙ্কাল মাত্র। বৌদ্ধ ধর্মের আত্মার সন্ধান না নিয়ে তার মৃতদেহের সন্ধান নেওয়ায়, বলা বাহুল্য আমাদের আত্ম-জ্ঞান একচুলও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে না। আর বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যার পরিচয় নেই, তিনি তার দেহের সাক্ষাৎ লাভ করলেও তার রূপের পরিচয় লাভ করবেন না। বৌদ্ধ-স্তূপ তার কাছে একটা পাষাণ স্তূপ মাত্রই রয়ে যাবে। ইট-কাঠ-পাথরের গড়া মূর্তি সকল মুক। তারা নিজের পরিচয় নিজ মুখে দিতে পারে না, তাদের পরিচয় লাভ করতে হয়, ভাষায় যা লিপিবদ্ধ আছে তারই কাছে। সুতরাং বুদ্ধ, তাঁর ধর্ম ও সঙ্ঘের অজ্ঞানতার উপর বৌদ্ধযুগের বাহ্য ইতিহাস গড়া যাবে না। আমরা বৌদ্ধস্তূপ, স্তম্ভ, মন্দির, মূর্তির মুখে যে সব কথা দিই, সে কথা আমরা বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকেই সংগ্রহ করি। Sanchi এবং Barhut স্তুপের ভিত্তিগাত্রে সংলগ্ন মূর্তিগুলির অর্থ ও সার্থকতা তার পক্ষে জানা অসম্ভব, যাঁর বৌদ্ধ জাতকের সঙ্গে সম্যক পরিচয় নেই। অতএব বৌদ্ধ শাস্ত্রেরও কিঞ্চিৎ পরিচয় লাভ করা আমাদের নব-ঐতিহাসিকদের পক্ষে অত্যাবশ্যক।

পূজ্যপাদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের "বৌদ্ধধর্ম" ব্যতীত বাঙলা ভাষায় আর একখানি এমন বই নেই, যার থেকে বুদ্ধের জীবন-চরিত, তাঁর প্রবর্তিত ধর্মচক্র এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরাজি ভাষায় ইউরোপীয় পণ্ডিতদের লিখিত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে সকল গ্রন্থ আছে, সে সকল গ্রন্থের আলোচনা করেই পূজ্যপাদ ঠাকুর মহাশয় এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই "বৌদ্ধধর্মে"র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রস্তুত করতে তিনি আশি বৎসর বয়সে এক বৎসর কাল যে রূপ অগাধ পরিশ্রম করেছেন, তা যথার্থই অপূর্ব। দিনের পর দিন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত তাঁকে আমি এ বিষয়ে একাগ্রচিত্তে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছি। শেষটা যখন তাঁর শরীর নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনও তিনি হয় আরাম চৌকীতে নয় বিছায় শুয়ে শুয়ে সমস্তদিন এই বইয়ের প্রুফ সংশোধন করতেন। এ সংশোধন শুধু ছাপার ভুলের সংশোধন নয়। বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে নতুন নতুন বই পড়ে তাঁর লেখার যেখানে সংশোধন বা পরিবর্তন করা আবশ্যক মনে করতেন, তা করতে তিনি একদিনও বিরত হন নি। তাঁর মৃত্যুর চারদিন আগেও তাঁকে আমি "বৌদ্ধধর্মে"র প্রুফ সংশোধন করতে দেখেছি। এই একাগ্র এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে, আমার বিশ্বাস, এই গ্রন্থখানি যতদূর সম্ভব নির্ভুল হয়েছে। বৌদ্ধধর্ম ও তার ইতিহাস সম্বন্ধে পণ্ডিতে পণ্ডিতে এতদূর মতভেদ আছে, এ বিষয়ে এত সন্দেহের এত তর্কের অবসর আছে যে, এ বিষয়ে এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না, যা চূড়ান্ত বলে পণ্ডিতসমাজে গ্রাহ্য হবে। যে ধর্মের ইতিহাস আট-দশ ভাষার বিপুল সাহিত্য থেকে সংগ্রহ করতে হয়, বলা বাহুল্য সে ইতিহাসের খুঁটিনাটি নিয়ে বিচার তর্ক বহুকাল চলবে, এবং সম্ভবত তা কোন কালে শেষ হবে না। তবে সে ইতিহাসের একটা ধরবার ছোঁবার মত চেহারা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আর এ গ্রন্থে পাঠক সেই চেহারারই সাক্ষাৎ পাবেন।

আমি পূর্বে যা বলেছি তাই থেকে পাঠক অনুমান করতে পারেন যে-
আমি শুধু পণ্ডিতসমাজের নয়, দেশসুদ্ধ লোকের পক্ষে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের জ্ঞান লাভ করা নিতান্ত আবশ্যক মনে করি। আর আমার বিশ্বাস সাধারণ পাঠকসমাজ এই গ্রন্থ থেকে অনায়াসে বিনাক্লেশে সে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
এই গ্রন্থ সাধু ভাষায় লিখিত কিন্তু এই সাধু ভাষা আজকের দিনে যাকে সাধু ভাষা বলে- সে ভাষা নয়। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যেরা যে ভাষার সৃষ্টি করেন। এ সেই ভাষা। এ ভাষা যেমন সরল তেমনি প্রাঞ্জল, যেমন শুদ্ধ তেমনি ভদ্র। এতে সমাস নেই, সন্ধি নেই, সংস্কৃত শব্দের অতি প্রয়োগ নেই, অপ-প্রয়োগ নেই, কষ্ট-প্রয়োগ নেই, বাগাড়ম্বর নেই, বৃথা অলঙ্কার নেই। ফলে এ ভাষা যেমন সুখপাঠ্য, তেমনি সহজবোধ্য।
আমার শেষ বক্তব্য এই যে, বুদ্ধ-চরিতের তুল্য চমৎকার ও সুন্দর গল্প পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। জনৈক জার্মান পণ্ডিত Oldenburg বিদ্রূপ করে বলেছেন যে, বুদ্ধচরিত ইতিহাস নয়, কাব্য। এ কথা সত্য। কিন্তু এই কাব্যের মূল্য যে তথাকথিত ইতিহাসের চাইতে সতগুণে বেশী, তা বুঝবার ক্ষমতা জার্মান পাণ্ডিত্যের দেহে নেই।
এই কাব্য মানুষের চির আনন্দের সামগ্রী। অতীতে যে বুদ্ধচরিত কোটী কৌটী মানবকে মুগ্ধ করেছে, ভবিষ্যতেও তা কোটী কোটী মানবকে মুগ্ধ করবে। এই কাব্যের মহত্ব হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য পাণ্ডিত্যের কোনো প্রয়োজন নেই, যার হৃদয় আছে ও মন আছে, এ সৌন্দর্য তার হৃদয় মনকে স্পর্শ করবেই করবে। যে দেশে ভগবান বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আজ সে দেশের লোকে তার জীবন-চরিত অবলম্বন করে' বুদ্ধচরিত নামক মহাকাব্য রচনা করেছে- সে দেশও ধন্য, সে জাতিও ধন্য। আমি আশা করি, বাঙলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এ গ্রন্থ থেকে বুদ্ধ-চরিতে পরিচয় লাভ করে, নিজেদের ধন্য মনে করবেন।

[সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের (১৯২৩) ভূমিকারূপে প্রমথ চৌধুরীর "মুখপত্র" রচিত হয়।]

............................................................................................................................................................
কৃতজ্ঞতা : বাংলাদেশ ভিক্ষুণী সংঘ

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:০৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আমরা অতীতের যে ইতিহাস উদ্ধার করবার জন্য আজ উঠে পড়ে লেগেছি, সে বুদ্ধধর্মের ইতিহাস নয়, বৌদ্ধযুগের ইতিহাস- এক কথায় জাতীয় জীবনের বাহ্য ইতিহাস। আমরা যে কাজ হাতে নিয়েছি তার নাম archxology এবং antiquarianism। বৌদ্ধধর্ম এদেশে তার কি নিদর্শন, কি স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছে, আমরা নিচ্ছি তারই সন্ধান এবং করছি তারই অনুসন্ধান। আমাদের দৃষ্টি বৌদ্ধযুগের স্তূপ, স্তম্ভ, মন্দির ও মূর্তির উপরেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষের বিশালক্ষেত্রে মৃত বৌদ্ধধর্মের বিক্ষিপ্ত অস্থি সকলই আমরা সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েছি। আর নানাস্থান থেকে সংগ্রহীত অস্থিসকল একত্র জুড়ে যদি আমরা কিছু খাড়া করতে পারি, তাহলে তা হবে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের কঙ্কাল মাত্র। বৌদ্ধ ধর্মের আত্মার সন্ধান না নিয়ে তার মৃতদেহের সন্ধান নেওয়ায়, বলা বাহুল্য আমাদের আত্ম-জ্ঞান একচুলও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে না। আর বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যার পরিচয় নেই, তিনি তার দেহের সাক্ষাৎ লাভ করলেও তার রূপের পরিচয় লাভ করবেন না। বৌদ্ধ-স্তূপ তার কাছে একটা পাষাণ স্তূপ মাত্রই রয়ে যাবে। ইট-কাঠ-পাথরের গড়া মূর্তি সকল মুক। তারা নিজের পরিচয় নিজ মুখে দিতে পারে না, তাদের পরিচয় লাভ করতে হয়, ভাষায় যা লিপিবদ্ধ আছে তারই কাছে। সুতরাং বুদ্ধ, তাঁর ধর্ম ও সঙ্ঘের অজ্ঞানতার উপর বৌদ্ধযুগের বাহ্য ইতিহাস গড়া যাবে না

হুম। প্রকৃত সত্য!

অনেক ভাল লাগল। জ্ঞন যখন নিয়িন্ত্রত হয় অজ্ঞান পোষাক আর ক্ষমতাধারীদের হাতে তখনই জ্ঞানের মৃত্যু হয়- পড়ে থাকে জ্ঞানের নামে অজ্ঞান কংকাল মাত্র!

পোষ্টে++++++++++++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.