নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কুশলাকুশল-বোধ ও প্রজ্ঞা
জয়দেব কর
মানুষের কথা বলতে গেলে, মানবভূমিতে অবস্থান অপরিহার্য,এমন সুনিশ্চিত বোধ উৎপন্ন হতে হবে । আর এও মনে রাখতে হবে যে, কাউকে উপরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, আর কাউকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয় নিচের দিকে। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়,মানবীয়তাকে অতিক্রম করে মানুষ কোথায় পৌঁছায়? সে কি অমানবিক কোনো এক স্তর? নাকি তা মানবিকতার আপন মাধুর্যের প্রাচুর্য বৃদ্ধিসাধন করে এমন এক পর্যায় গ্রহণ করা,যা করুণাঘন-সুন্দরে পুষ্পিত?
গ্রহণ-বর্জনের রুচিবোধের উৎকর্ষসাধন করে কালযাপন এখন সবচেয়ে বড় সঙ্কটে আছে এই যন্ত্রসভ্যতার প্রাণ-অরণ্যে। এত অর্জন মানবের থাকার পরও সুখ-শান্তি-প্রীতি-ভালোবাসা ক্রমশ বর্বরতার অজগরমুখের গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। কে করছে বর্বরতা? কে ছড়াচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ? যাবতীয় খারাপ কারা করছে? আবার বর্বরতার শিকার কারা? হিংসা-বিদ্বেষের শিকার কারা? যাবতীয় খারাপের শিকার কারা? আবার এও প্রশ্ন করা যেতে পারে, বর্বরতার বিরুদ্ধে, হিংসা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান কাদের? যাবতীয় খারাপের বিরুদ্ধে কার বা কাদের অবস্থান? সমস্ত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বেরিয়ে আসবে একটি উত্তর_ মানুষ।
মানুষ কর্মের সন্তান এবং কর্মপ্রবাহও। একটা কর্ম সম্পাদন করার পর যে ফলটি পাওয়া যায়, তা আরেকটি কর্মের কারণ হয়ে যায় _এভাবেই কর্মপ্রবাহ। কর্মের-কর্মপ্রবাহের দুটি হাত_ কুশল ও অকুশল বা সহজভাবে বলতে গেলে মঙ্গল ও অমঙ্গল বলা যেতে পারে। মঙ্গল ও অমঙ্গলের বিবেচনাবোধ বিবেকেরই নামান্তর। বিবেকবর্জিত মানুষ অপূর্ণ মানুষ, পারমার্থিকভাবে মানুষ নয়, মানুষের স্তরের নিচের কিছু। বিবেক হচ্ছে বীজ, প্রজ্ঞা হচ্ছে সেই বীজের বিকাশ। সব বীজ থেকে পুর্ণ ফসল নাও আসতে পারে, অঙ্কুরেও তা ঝরে যেতে পারে। বিবেক আছে কিন্তু তার ব্যবহার যদি কোনো মানুষ শুধুই আত্মসুখে ব্যবহার করে এবং তা অপরের জন্য অকল্যাণ বহে আনে_ তবে তখন সে মানুষটিও অপূর্ণ মানুষ,পারমার্থিকভাবে মানুষ নয়। বিবেকের বীজের পূর্ণবিকাশেই মানবিকতার অভাব লোপ পায়, মানুষ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মানবসত্তার পরিচয়ে _এর জন্য দক্ষ চাষী হওয়া চাই। বীজ, সঠিক ক্ষেত্র আর পরিচর্যা এই তিনের সমষ্টিই ফসল এনে দেয়। এখানে, বীজ দিয়ে যদি বিবেক বুঝিয়ে থাকি তবে সঠিক ক্ষেত্রটা কী? ক্ষেত্রটা হচ্ছে আত্মপরের অভিন্ন মঙ্গলভূমি। আর পরিচর্যা হচ্ছে বিরূপতায় বিপর্যস্ত না করে বিবেকবোধের বিকাশ টিকিয়ে রাখা। দৃঢ়তা আর উদ্যম হচ্ছে পরিচর্যার প্রাণশক্তি।
প্রজ্ঞা অর্জিত হয় কীভাবে? প্রজ্ঞা কি প্রার্থনা না অনুশীলনে আসে? প্রার্থনায় থাকে দাতা ও গ্রহীতা। প্রার্থনায় দাতার ইচ্ছে মুখ্য, গ্রহীতার নয়। প্রজ্ঞা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মাপকাঠি। তা অন্যের দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। প্রজ্ঞা অন্যের মুখ দিয়ে ঝাল খাওয়ার মতো বিষয়। প্রজ্ঞা হচ্ছে বিবেকের বীজ বিকশিত করা, নিরন্তর অনুশীলন (বীজ, ক্ষেত্র, পরিচর্যার মিলন ঘটিয়ে)। আবার প্রজ্ঞা-অর্জনের পন্থা বর্ণনা মানে প্রজ্ঞাদান নয়। এটা তখনই দানে উপনিত হবে যখন ব্যক্তি বর্ণিত-পন্থা অবলম্বনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে সফল যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছার সক্ষমতা অর্জন করবে। প্রার্থনা নয় আত্ম-অনুসন্ধান ও বিবেকের পরিচর্যায়ই মিলে তার সন্ধান, যাতে আসে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি_ চিন্তায়-কথায়-কর্মে।
প্রজ্ঞার পথ _ শান্তির পথ, সুখের পথ, আত্মহিত-পরহিতের পথ, পূর্ণ মানুষের পথ। প্রজ্ঞাপথে দুই অন্তরায় দুই অন্ত _ এক অন্ত অতিভোগ, আরেক অন্ত অতি ত্যাগ_এই দুই অন্তের মাঝামঝি ধরে অপ্রমাদের সাথে কর্মসম্পাদন করে এগিয়ে গেলে মানুষের যাবতীয় বোঝা-বাঁধা ক্ষয়মাণ হতে হতে শূন্য হয়ে যায়। এই মাঝামাঝি পন্থার বর্ণনা মানুষের নিকট ব্যপকভাবে গুরুত্বের সহিত উপস্থাপন করেছেন_বুদ্ধ। মধ্যম পন্থার উপর ভিত্তি করেই তিনি চিরপরিবর্তনশীলতা বোঝার শিক্ষা, অপ্রমাদের সাথে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার শিক্ষা, নিজেকে আলোকিত করার শিক্ষা, মাতৃহৃদয়ে সকল সত্তাকে দেখার শিক্ষা এবং আত্মপর বিভেদ বিলোপের শিক্ষা প্রচার করেছেন।
সত্য অবহিত হয়ে, মুক্তির স্বাদ পেয়ে তা সর্বসত্তার উদ্দেশে প্রকাশ-অপ্রকাশ মূলতঃ ব্যক্তির সক্ষমতা-অক্ষমতার উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। বুদ্ধ সিদ্ধিপ্রাপ্ত, তাই মহান_ ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। আমার কাছে তিনি মহান অন্য কারণে। করুণাতাড়িত প্রজ্ঞায় সত্যসুন্দর প্রকাশ করে, সত্যের পর সত্য _এমন অজস্র সত্যের মননশীল দ্রষ্টা হয়েও, কখনোই নিজের মতবাদকে শ্রেষ্ঠ গণ্য করে পূজা করার কথা বলেন নি, বরং তাঁর শিক্ষাকে নদী পারাপারের ভেলার সাথে তুলনা করার সাহস একজন আদর্শ শিক্ষকের মহত্ত্ব বৈ আর কিছু না । মানুষকে চিন্তার দাস বা মতবাদের দাস বানানোর লোভ তাকে স্পর্শ করে নি। তাঁর সুখের দর্শন প্রজ্ঞা ও প্রেমের দর্শন।
মানুষ সুখপ্রত্যাশী, কিন্তু দুঃখে পতিত। সে সম্রাট হোক আর প্রজা হোক, আপন দুঃখ দূরীকরণে তার স্বীয় উদ্যম উৎপন্ন না হলে হবে না। কর্মপ্রবাহে স্মৃতিমান মানুষ উদ্যমের ফসল হিসেবে যেকোনো এক মুহূর্তে পেয়ে যান আপন-আত্মপরিচয়ের অটল এক বিশাল জগৎ। সমাজ-রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, তাঁদের শুভবোধ বেশি জরুরী, তাতে অভিন্ন মঙ্গলকর্ম সহজেই ব্যপকতা লাভ করে। সম্রাট অশোক-বিম্বিসার সম্পর্কে খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে, বহুজনের কল্যাণ কীভাবে একজন বা গুটিকয়েকের কর্মপ্রবাহের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এভাবে যদি সামাজিক সকল-স্তরে নজর দেয়া যায় দেখা যাবে মানুষের সাথে মানুষের আদানপ্রদানে একের প্রতি অন্যের প্রভাব কম না। সমস্ত মানুষের মধ্যে যদি প্রাণের যথাযথ মর্যাদা উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হয় কল্যাণকর কুশলাকুশল-বোধ, মানুষ যদি চালিত হয় আত্মদীপের আলোয় , তবে ‘অপর’ বলে কিছু থাকবে না, আত্মার বিলোপ সাধিত হবে। সর্বসত্তার মধ্যে নিজেকে আলাদা করার প্রবণতা দূর হবে। ধীরে ধীরে দূর হবে মহাসাম্যের সকল অন্তরায়।
পরিশেষ বলি, মানুষ! দুঃখময় সংসারে তোমরা দুঃখের জ্বালানী ও ইন্ধন, না-বুঝে তোমরা যারা অজ্ঞানতায় আছো_ স্থির হও, সংহত হও, একটু ভাবো একটু দেখো নিজেকে। নিজের প্রতি আস্থা রাখার যোগ্যতা অর্জন কর, জ্বালাও আত্মদীপ। নিজের আলোয় নিজের পথ নিজে স্পষ্ট করো। পথ আছে, তোমাকেই হাঁটতে হবে সে-পথ। আগত-অনাগত সমস্ত জ্ঞানীই তোমার সুহৃদ_শুভাকাঙ্ক্ষী_ সহযাত্রী_পথপরামর্শক বা পথপ্রদর্শক মাত্র।
©somewhere in net ltd.